|
আরণ্যক রাখাল
|
|
গল্প- শব্দ
26 March 2015, Thursday
কুত্তার বাচ্চারা আবার চিতকার শুরু করেছে। একটা সম্মিতিত শব্দ দেয়ালের সিমেন্ট, রং আর কংকৃট ভেদ করে এই ঘরে আসছে। চিতকার- মহিলা কণ্ঠ। শব্দ- পুরুষটার রাগী স্বর। শব্দ- আব্বু আব্বু। অসহ্য। গানও বাজছে একটা। “তুম হি হো কিউকি তুম হি হো জিন্দেগি ......”। বন্ধ করল গানটা। আবার একটা বাজছে। “যাহার লাগি হই বিবাগী, সে তো বুঝল নারে মন”। হাসছে বাচ্চাটা। কিন্তু শিশুর নিষ্পাপ হাসিতে বোধহয় এই মুহূর্তে এই দম্পতির কোন আগ্রহ নেই। তারা গলা চড়িয়ে কথা বলেই যাচ্ছে। কোন বিষয়ে তাদের কণ্ঠ সীমাবদ্ধ থাকছে না। লাফিয়ে লাফিয়ে ফড়িঙের মতো তারা এগিয়ে যাচ্ছে।
“কুত্তার বাচ্চা, তুই আমার টাকায় হাত দিছস ক্যা”। থাপ্পরের শব্দ আসে এবার। মহিলাটাও চুপ থাকে না। তার কণ্ঠ থেকে “তোর কামাইয়ের টাকা নিছি নাকি, কষ্ট করা টাকা আমার” ভেসে আসে। ধুপ ধুপ শব্দও আসছে সমানে। “আব্বু বাল, আব্বু বাল দে”- বাচ্চাটা বলে। কিন্তু ওর কথায় বল ওকে দেয়ার কোন আগ্রহ পুরুষটা বোধ করে না।
“কি দরকার ছিল ভাড়া দেয়ার?”- মাথায় হাত দিয়ে চুল এলোমেলো করে বিড়বিড় করে বলে সমাপ্ত। মনে হয় বাজার বসেছে একটা। মাত্র তিনটা লোক কি করে এতো শব্দ করতে পারে? গলায় একেকজনের মাইক লাগানো আছে যেন। সবাই শেখ মুজিব হতে চায়।
বই সামনে নিয়ে বসে আছে সমাপ্ত। পড়ছে এমন বলা যাবে না। ও পড়ে না। অনেকদিন পড়ে না। কিন্তু বই সামনে নিয়ে বসে থাকে। বসে থাকে নির্লিপ্ত নীরব। বইয়ের পৃষ্ঠার কালো কালো অক্ষর ওর দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু সমাপ্তর তাদের দিকে মনোযোগ দেয়ার ইচ্ছে নেই- অনেকদিন নেই। ঘুনে খেয়েছে বইয়ের কয়েকটা পৃষ্ঠা। গন্ধ আসে একটা। গুমোট গন্ধ। সম্মোহনী গন্ধ। কিন্তু এই গন্ধ এখন আর ওকে আকৃষ্ট করে না। অনেকদিন করে না।
“মাঙ্গের বাচ্চা- মাং দেখি ভাড়া দিছে এদের”- শব্দটা ক্রমশ জোরালো হয়। স্রোতের মতো, বানের জলের শব্দের মতো তাদের কণ্ঠ সমাপ্তর ঘরের দেয়াল ভেদ করে ওর কানে ঢোকে। সমাপ্তের মনে হয়, চিতকার করে। চিতকার করে বলে ওদের- “চুপ কর শালিরা- চুপ। ঘাড় ধাক্কার দিয়ে বের করে দেব।” কিন্তু জানে ওর ঘাড় ধাক্কা দেয়ার অধিকার নেই। তাই কণ্ঠ অনুরনিত হয় না।
ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় সমাপ্ত। মায়ের ঘরে গিয়ে ডাকে মাকে।
“মা কি লাগাইছে এরা। সারাদিন চিতকার চ্যাঁচামেচি। একটুও পড়া যায় না”
ওর মা কিছু করার ক্ষমতা রাখে না- সেটা সমাপ্ত জানে। কিন্তু বলার জন্যই বলা। কিংবা রাগ দেখানোর জন্য কাউকে চাই- সেটা মা ছাড়া আর কে আছে!
“তোর আব্বু ভাড়া দিলে আমি কি করবো?” বলে মা গুনগুন করে। সারাদিন কোরআন পড়ে পড়ে বলে এখন কথার মধ্যেও গুনগুণ ভাবটা চলে এসেছে- অসহ্য লাগে সমাপ্তের। ন্যাকা। আগে তো এভাবে কথা বলত না। এখন এভাবে বলার কি দরকার। মানুষকে বোঝানো যে ‘দ্যাক আমি কোরান পড়ি’।
তার মায়ের এই অক্ষমতার কথা শুনে সে রেগে যায়- যদিও সে এটা জানে যতদিন থেকে সে বুঝতে পারছে। হাতের কাছে থাকা বাড়ির চাবিটা মাটিতে আছাড় মারে। ঝনঝন শব্দ করে সেটা পিছলে যায়।
“বাল”। ওর মা ওর চলে যাওয়ার দিকে নিশ্চল নির্বাক আর আশাহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আবার যাতা দিয়ে সুপারি কাটতে লেগে জান তিনি।
ঘরে এসে আবার শব্দটা পায় সমাপ্ত। এবার অত জোরালো নয়। কিন্তু এই দম্পতীর কণ্ঠ জন্মগতই জোরালো। কোন কিছু আস্তে বলতে পারেনা।
স্পষ্ট শুনতে পায় ও- “দে ভাত দে”
“ভাত কি আমি বানামু”
“ক্যান রান্ধিস নাই”
“না”
এভাবে বাদানুবাদ চলতেই থাকে। এক পর্যায়ে আবার মারামারি হাতাহাতির অবস্থা এসে যায় কিন্তু এবার সামলে নেয় দুই জনই। কিন্তু কণ্ঠ তাদের কাউকেই রেহাই দেয় না। অপরাজিত অনাহত যোদ্ধার মতো তরবারি চালিয়ে যায় তারা। মাঝে মাঝে আঘাত করে পরস্পরের বুকে, মাথায়, হাতে, পায়ে কিন্তু কেউ নিহত হওয়ার মতো আহত হয় না। বীরবিক্রমে তারা পরস্পরের মুণ্ডপাত করতে থাকে।
মায়ের উপর রাগটা ঠিকমতো ঝারা হয়নি। শুধু ‘বাল’ বলে চলে আসায় তার রাগ একটুও প্রশমিত হয়নি। আরো কিছু বলা দরকার ছিল। যা যা বলা উচিত ছিল চিতকার করে সেসব সে মনে মনে শুনিয়ে দেয় তার মা আর বাবাকে। বাপের সামনে সে বেড়াল হয়ে থাকে, টু শব্দটি করার সামর্থ্যও তার নেই। মাঝে মাঝে চরথাপ্পরও গালে এসে পরে কিন্তু প্রতিবাদ করে না সে। চুপ করে থাকে। কিন্তু এখন বরং উল্টোটাই হয়। ওর বাবা চুপ করে থাকে মালিকের সামনে ভৃত্যের মতো। আর সমাপ্ত বলে চলে। গর্জন করে ওঠে মাঝে মাঝে স্বর। ওর বাবা কাঁপতে থাকে। কাঁপতে থাকে ওর হাতের শিরাও।
“মাদারির বাচ্চা- কইলাম ঘর ভাড়া দেয়ার দরকার নাই। কিন্তু আমার কতা তো শুনবে না। বোঝ এলা ঠেলা। শুয়োরের বাচ্চা”- ওর হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে। আর হাতের শিরা ধমনী চামড়ার চর্বি ভেদ করে দৃশ্যমান হয়। রাগের চাপে টেবিলটায় চাপর মারে একটা। বইটা ছুড়ে ফেলে। বইটা ফের কুড়িয়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে বইটার মলাট।
“শালার ভাড়া দেয়”
ওদিকে শব্দ আবার বৃদ্ধি পায় গুণোত্তর ধারায়। চুলে হাত দিয়ে টেবিলে মাথা রেখে বসে থাকে সমাপ্ত। না আর ঘরে থাকা যায় না। পাগল হয়ে যাবে তাহলে ও। বেড়িয়ে আসে।
আকাশটা গুমোট হয়ে আছে। সেই গুমোট তাপমাত্রাকেও প্রভাবিত করেছে। ভ্যাঁপসা গরম। ঘামে ভিজে যায় সার্ট। পিঠ ভিজে গেছে সমাপ্তের অথচ মাত্র ঘর থেকে বেড়িয়ে কয়েক কদম গেছে ও। পারফিউমের গন্ধ ছাপিয়ে ঘামের গন্ধ দেহে জায়গা করে নেয় অনায়েসে।
রাস্তাটা স্যাঁতস্যাঁতে। ড্রেনের পানি রাস্তায় চলে এসেছে কয়েক জায়গায়। তার গন্ধও আসছে। ভ্যাঁপসা গরম ঘামের আর ড্রেনের পানির গন্ধ মিলে সমাপ্তের নিউরনকে বিকল করার চেষ্টা করে। কিন্তু অভ্যস্ত নাক কান মস্তিষ্ক ঠিকছে সামলে নেয় নিজেদের। কিন্তু আকাশের গুমোট এবার ওর মনকে করায়ত্ত করে নেয়।
জোরে জোরে পা চালায় সমাপ্ত। কিন্তু খলিল স্যারের বাড়ির সামনে পায়ের গতি কমে যায় ওর। একটু আস্তে চলে। আশা করে আজো স্যারের মেয়ে বারান্দায় থাকবে। স্যারের কাছে অংক করতো ওরা- সমাপ্ত, সজীব, কৌশিক, আমিনুল, শিশির। হাইস্কুলে পড়ার সময়। তখন স্যারের মেয়ের বয়স কতো ছিল? নয়? নাকি দশ? তেমনই হবে। কতো পিচ্চি ছিল। কতো কোলে নিয়েছে সমাপ্ত। চকলেট এনে দিয়েছে মাঝে মাঝে। সেই মেয়ে এখন কতো বড় হয়ে গেছে!
অকারণেই পকেট থেকে মোবাইল বের করে ও। এসএমএস চেক করে। আবার ঢুকিয়ে ফেলে। এটা একটু সময় বেশি নেয়ার উপায়। কারা যেন ইট সাজিয়ে রেখেছে রাস্তার ধারে। বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে ইট। ইটের ভেজা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কড়া গন্ধ। নাকের ভিতর ঢুকলে কেমন করকর করে, মনে হয় ঝাঝাল কিছু ধুকেছে মুখে। এই ইটের স্তূপ পেরিয়ে গেলেই স্যারের বাড়ি। ভাড়া বাড়ি। স্যাররা কতদিন থেকে ভাড়া আছে এই বাড়িতে? বিশ বছর? হবে। ও জন্মের পর থেকেই দেখছে স্যার এই বাড়িতে। সারা জীবন মাস্টারি করেই গেল স্যারের। করুণা হয় সমাপ্তের। কিন্তু ও এই করুণার মানে খুঁজে পায় না। ঝাটিয়ে বিদেয় করে দেয় সব অনুভূতি।
আছে। আজো দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা- স্যারের মেয়ে।
“ভাইয়া ভালো আছেন” জিজ্ঞেস করে মেয়েটা।
মনে হয় খাল থেকে মাথা বের করেছে কোন ইঁদুর। ইঁদুর সামান্য মাথা বের করে খাল থেকে। বের করেছে ইঁদুর খাল থেকে মাথা। ইঁদুরের মাথার মতো কালো? আচ্ছা ইঁদুরের খাল দেখেছে কোনদিন সমাপ্ত? “দেখেছি কোনদিন ইঁদুরের খাল?” তীরের মতো মাথাটা। পিনপিনে। মনে হয় একটা সমবৃত্তিক কোণক। মাথাটা যার একটু মোটা। একটু। সমবৃতিক কণকের মাথা সামান্য মোটা হয়? সমবৃত্তিক কোণকের সমগ্রতলের ক্ষেত্রফল কতো? আয়তন? পাই আর এল? নাকি পাই আর ইনটু আর প্লাস এল? কোনটা আয়তন? পাই আর এল? স্যারের কাছে পড়েছিল না ওরা? মনে নেই? মনে নেই কেন?
সমাপ্ত একটা সমবৃত্তিক কোণক আবিষ্কার করে মেয়েটার ওড়নার নিচে। সুষম। কালো মাথা যার সাদা আবরণের ভেতর থেকে উঁকি মারে। কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছে মেয়েটা। চিনতে পারল? কৈ সেদিন তো পারেনি। আজ পেরেছে। আজ পেরেছে? কি জিজ্ঞেস করল? “আমি কেমন আছি!”
“আমি ভালো আছি। তুমি কেমন?” হাঁসি ফুটে ওঠে সমাপ্তের ঠোঁটে। ছাটা গোঁফের হাঁসি। কতো ছোট ছিল! এতটুকু। “আমার কোমর পর্যন্ত” ভাবে সমাপ্ত। এখন সমবৃত্তিক কোণকের অধিকারী!
“আমি ভালো। কোথায় যাবেন- বৃষ্টি আসবে তো?”
“তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু দরকারটা জরুরী” একই সুরে বলে সমাপ্ত।
মেয়েটা এতো ঢঙ্গি কেন? এতো হেসে হেসে আর শরীর নাচিয়ে কথা বলার কি আছে? বারবার ওড়নাটা ঠিক করছে অথচ ওটা যেখানে ছিল সেখানেই আছে। সমাপ্তের দৃষ্টির জিহ্বা সেটাকে একচুলও নড়াতে পারেনি এদিক ওদিক। যদি পারতো! পারলে কেমন হতো। “আমি ডানে দেখতে চাইলে সরে যাবে সেটা! ভালোই হতো” । উড়ন্ত না না গতিশীল একটা ওড়না দেখতে পায় ও।
কিন্তু পারেনি তো ও সরাতে একচুলও! তাহলে বারবার ঠিক করছে কেন?
“স্যার সুস্থ আছে এখন?” গলায় একটা তিল আছে। ঠোঁটের কাছেও। গলার তিলটা বড় আর গাঢ়। একটু গভীর। “মোটামুটি”।
ইঁদুরটা আরেকটু মাথা বের করেছে এবার। সামান্য বেশি। “স্যারের না একবার হার্ট এট্যাক হোল?”
“হ্যাঁ। চেন্নাই গেলাম তারপর।”
“নটাঙ্কি শালা”র মেয়েটার কথা মনে পরে যাচ্ছে সমাপ্তের। কথার মাঝে প্রায়ই গলায় হাত বুলায়। খুব আদরে।
আরেকটু মোটা হলে ভালো হতো ঠোঁটগুলো।
আবার রাস্তায় সমাপ্ত। সমবৃত্তিক কোণকের আয়তনের সুত্র তার মনে পরে না। মেঘলা? স্যারের মেয়ের নাম! নাকি মনিরা? মনিরা। মনিরা আক্তার তানিয়া। এবার পরীক্ষা দিচ্ছে এসএসসি। ওর বইয়ে নিশ্চয়ই সমবৃত্তিক কোণকের সুত্র আছে। জেনে নিতে হবে। স্যার কতো করে পড়িয়েছেন। অথচ খেয়াল নেই।
পাই আর এল। পাই আর ইনটু আর প্লাস এল। পাই আর স্কয়ার? পাই আর এল। পাই আর ইনটু আর প্লাস এল।
আড্ডাটা বেশ জমেছে। অনেকে এসেছে যাদের দেখা অনেকদিন পায়নি সমাপ্ত। কাওসার, রাব্বানি, শান্তনু। শান্তনু আজ ফিট বাবু হয়ে এসেছে। চুলটুল কেটেছে। সার্ট প্যান্ট স্ত্রিকরা।
‘বস, কোথাও যাবেন নাকি?’
“মামা, দাওয়াত আছে একখানে। রাতে। কিছুক্ষণ পর যাব”।
কথা বলতে ভালো লাগছে না সমাপ্তের। রহমতকে একটা চা দিতে বলে সাথে একটা লিভ।
“রহমত চা, একটা বিড়ি ঠাণ্ডা ক্যান”।
“ঠিকই আছে। খাও”- নোনতা লাগছে সিগারেটটা। চায়ের কারণে কিনা কে জানে। চাটুকু আর খায় না সমাপ্ত। চোখ বন্ধ করে সিগারেটে টান দেয়।
সমাপ্ত ভেবেছিলো আজ কোন কথা বলবে না। কিন্তু মুখরোচক একটা বিষয় পেয়ে যায় ওরা। অচিরেই তাদের সবার জিহ্বা ধারালো করাত হয়ে যায়।
এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি, যিনি আবার একজন ব্যাংকার তার মেয়ে পালিয়ে গেছে একটা মাঝবয়সী লোকের সাথে। লোকটা ব্যাবসাহি। দুইটা বাচ্চা আছে।
সমাপ্তদের পাড়ায় থাকে কিন্তু ও জানত না। কিন্তু এমন খবর তো চাপা থাকার কথা না। অথচ এদের কথা শুনলে মনে হয় সব জানে এরা। এমনকি পালিয়ে যাওয়া মেয়েটার খাটের নিচেও হয়তো চেপে ছিল। জানে না বলে নিজের উপর ধিক্কার দেয় সে। এরা কতো খোঁজ রাখে, আর আমি?
“মামা, আমরা এতদিন থেকে টাংকি মারছি- আমাদের পছন্দ হয় না; আর শেষে কিনা একটা বুড়া!” কাওসার চায়ে একটা চুমুক দিয়ে গিলতে গিলতে বলে। মনে হচ্ছে পায়খানা করতে বসেছে শালা। কোষ্ঠকাঠিন্য। সে সময় কথা বললে যেমন শোনায় তেমন শোনাচ্ছে।
“এক্সপেরিএন্স মামা, এক্সপেরিন্স। সব জায়গায় ওই এক্সপেরিএন্সের দাম! তোর তো আর ওই বুড়ার মতো এক্সপেরিএন্স নাই” বিজ্ঞের ভঙ্গিতে কে যেন বলে। কণ্ঠটা সমাপ্তের চেনার কথা। কিন্তু চিনতে পারেনা। “আমাদের এক্সপেরিএন্স কম আছে নাকি?” হাসির একটা রোল পরে যায়।
“শালা দুইটা বাচ্চার বাপ, এক্সপেরিএন্স বেশি তো থাকবেই” রাব্বানি বলে।
“পর্দা ফাটাইছে, বস। ফাটাইছে”
“ওইটা ভার্জিন তোকে কে বলল”
সমাপ্তের ইচ্ছে হয় এদের সাথে যোগ দেয়। কি যেন বলতে গিয়েও পারেনা। চায়ে চুমুক দেয়ার জন্য কাপটা হাতে নেয়। কিন্তু খেয়াল হয় যে- চাটা ফেলে দিয়েছে সে।
“সমু তো মারাত্মক মাল পাইছে রে” নিজের নাম শুনতে পেয়ে একটু গা ঝারা দেয় সমাপ্ত। বুক জ্বালা করছে। দুপুর থেকে কিছু খায়নি। এখন এই চা বিড়ি পারমিট করছে না বোধহয় পাকস্থলী।
“কতো কোলে নিছি রে। এখন শালার মাল হইছে একটা”
“তুই এখনো কোলে নিতে চাস নাকি”
আবার ঘটা করে হাসির কোরাস বয়ে যায়। “মামা দেশি পেয়ারার মতো একেকটা। ছোটোই আছে”
“তোর শালা নজর খারাপ। সবসময় ওই দিকেই যায়”
জ্বালা করছে সমাপ্তের বুক। একটা এন্টাসিড পেলে ভালো হতো। রহমতের কাছে একগ্লাস পানি চেয়ে নিয়ে খায় ও। ও ডুবে যায় পানিতে। স্বচ্ছ এক গেলাস পানি ওর মুখে। গ্লাসের ভিতরে তাকায় ও। পানিটা নড়াচড়া করছে ওর গলার টানে। শব্দও হচ্ছে “ঢোক ঢোক”। ডুবে যাচ্ছে গ্লাসের পানিতে। পানিতে একটা মশা। মশা একটা। জীবন্ত?
“ওই শালা কি পানি দিসিছ?” গ্লাসটা বেঞ্চে জোরে শব্দ করে রাখে। “খাট” শুনতে পায় ও।
শব্দ। অনেক শব্দ।
“দেখছিস কিভাবে লুঙি তুলে হাঁটছে?”
দেখে ওদের মসজিদের খাদেম লুঙির ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে কুলুপ নিচ্ছেন। শালা রাস্তার পাশে প্রসাব করেছে।
“আসসালামু আলাইকুম হুজুর”
হুজুর সরাত করে হাতটা সরিয়ে ফেলে। “ওয়ালাইকুম সালাম”
খ্যাক খ্যাক করে হাসে ওরা। হাসতে হাসতে সমাপ্তের বুক পেট জ্বালা ভুলে যায়।
***
এতো হাসির কি আছে? ফ্যাক ফ্যাক ফ্যাক। মহিলাটা হাসছে। পুরুষটাও। বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়েছে। ফ্যাক ফ্যাক ফ্যাক। গলা চিপে দেয়ার ইচ্ছে করে। দেড়টা বাজে। একটু ঘুমাবে তারও উপায় নাই। “বাবা কি করবি কর- একটু চুপচাপ কর। এতো হেসে হেসে পাড়া জানান দেয়ার কি দরকার”। মহিলাটার গলা চিপে দেয়ার ইচ্ছে হয়। শালা মূর্খ।
মা বারণ করেছিলো এদের ভাড়া দিতে। “কাজ করা লোক, এতগুলা ভাড়া দিতে পারবে না। বাড়ির পরিবেশ খারাপ করবে খালি”। কিন্তু আব্বু ভাড়া দিয়েছিল। এমনিতেই এখানে ভাড়া কম পাওয়া যায়। কেউ এতো দামে ভাড়া নিতে চায় না।
“এতো টাকা দিয়ে বাড়ি করলাম। দশ পাঁচ হাজার যদি ওয়াশিলই না হয় তাইলে কি” আব্বু বলেছিল। তার কৈফিয়ত দেয়ার দরকার ছিল না। তিনি যাই করবেন সেটাই সংবিধান। তার উপরে কথা বলবে কে আছে এই বাড়িতে? তবুও বলেন তিনি। মাও খুশী হয় অনেকদিন পর কৈফিয়ত শুনে।
গলাটা টিপে দিলে কেমন হয় মহিলাটার। সারাদিন হাসে। কথায় কথায়। এখনো রমণকালেও হাসছে। খ্যাক খ্যাক।
সন্ধ্যার পরপর ওরা ঘরে ঢুকে। তারপর চলছে শব্দ। কখনো গান। কখনো কান্না। কখনো চিতকার। আজো ঝগড়া করেছে ওরা। আর এখন দেখনা কেমন খ্যাক খ্যাক করে হাসছে। শিয়ালের ডাক কোন দিন সমাপ্ত শোনে নি। এমনই হবে।
ডিম লাইটটা জ্বলছে সবুজ আলো ছড়িয়ে। উঠবে নাকি একবার। কান ধরে বের করে দেই চুতমারানির বাচ্চাদের?
লাইটটা জ্বালে সমাপ্ত। দরজাটায় খ্যাচ করে শব্দ করে। মা অনেকদিন বলেছিল তেল দিতে। দিতে দিতেও দেয়া হয় না। এখন যেন একটু বেশি শব্দ হচ্ছে। গলির মোর থেকে কুকুরের শব্দ শোনা যাচ্ছে। অনেকগুলো কুকুর। আর এখানে মহিলাটার হাঁসি।
দম্পতীর ঘরে ধাক্কা দেয় সমাপ্ত। কিছুক্ষণ নীরবতা। একটুও শব্দ নেই এবার, মনে হয় দুজনই জমে গেছে।
“শুয়োরের বাচ্চারা বের হ” ধাক্কা দেয় আবার আবার। কিন্তু কেউ সারা দেয় না। জোরে জোরে ধাক্কা দিতেই থাকে সমাপ্ত। আর ওর মুখ থেকে বেড়িয়ে আসে শ্রুতিমধুর খিস্তি। ধাক্কা দিতে থাকে ও। কিন্তু তাদের দরজা খোলার কোন নামগন্ধ নেই। মরার উপর খাড়া ঘা দিতেই যেন ওরা আবার শব্দ করা শুরু করে। এবার ওরা হাসছে না। ঘোড়ার ডাকের মতো চিহি চিহি শোনা যাচ্ছে। না না হাসছে। অট্টহাসি। খ্যাক খ্যাক খ্যাক। সমাপ্ত আরো জোরে ধাক্কা দেয়। “মাগির বাচ্চারা বের হ”।
ধাক্কা দিতে দিতে অবসন্ন হয়ে পরে ও। সেখানেই বসে পরে। তাকে বিদ্রুপ করছে এই মূর্খ দম্পতী। মূর্খ? মূর্খ না তো কি? লেখাপড়া করেছে? বসে থাকে সমাপ্ত ওদের দরজার সামনে। আবার উঠে দাঁড়ায়।
এবার আর ভুল করে না ও। ধাক্কা দেবে না এবার। সরাসরি পা দিয়ে লাথি দেয় ও। কিছুই হয়না। কিছুই না। আবার দেয়। কিন্তু ওদের হাঁসি যেন উত্তরোত্তর বেরেই চলে। এবার মহিলাটার সাথে পুরুষটাও যোগ দেয়। সহ্য হয় না সমাপ্তের। সে জীবনের সব শক্তি দিয়ে ধাক্কা দেয় এবার। খুলে যায় দরজাটা।
ডিম লাইটা টিমটিম করে জ্বলছে। পূর্ণিমার চাঁদের মতো। কিন্তু এই চাঁদে কোন কলঙ্ক নেই। সবুজ আলো ছড়িয়ে আছে সারা ঘরে। হাসিটা এখনো অব্যাহত আছে মহিলাটার। খ্যাক খ্যাক করে নয়। অনেক মোলায়েম। রাত দেড়টায় এই সেক্সি হাঁসিকে বৃথা যেতে দেয় না সমাপ্ত। সে নিজের পৌরুষকে শাণিত করে। মহিলার খিন খিন হাসির প্রতিবাদ করে সে। শাস্তি দেয়। শাস্তি দেয়ার এরচেয়ে আর কি ভালো উপায় আছে?
দুর্গন্ধ, গাঢ় তরল প্রবাহিত করে ঘুমিয়ে পরে সমাপ্ত। দম্পতীর হাঁসি, রাস্তার কুকুরের ঘেউ ঘেউ তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন