|
খেয়া ঘাট
|
|
স্বাধীনতার গল্পঃ কুসুম
26 March 2015, Thursday
পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের সামরিক সদন।সারারাত ঘুম হয়নি মেজর আগা জামিলের।সুন্দরী তাবাসসুম তার দেয়া ফুল তাকেই ছুঁড়ে মারলো। একবার ফিরেও তাকালোনা। এই ফুল হারাম। এ জগণ্য, এ বড় বিভৎস।
কিছুদিন পর। সময় ১৯৭১।আগা জামিলের কাঁধে সাপের ফনার মতো লিকলিক করছে মেজরের ব্যাচ। নিভৃত বাংলার কুসুমবাগ গ্রামে তার সেনা ক্যাম্প। গ্রামের এক রাজাকারকে জিজ্ঞেস করে; "ইয়ে হারামী কুত্তাকে বাচ্ছা,কুসমবাগকা মতলব কেয়া হ্যায়?
সেনা ক্যাম্পের পাশেই ছোট একটি ফুলের বাগান। লাল ফুলে ভরে আছে। মেজর সৈন্যদের নির্দেশ দেয়- একটা করে বাঙ্গাল মারবি আর এই বাগানের ফুল একটা করে বোটের নীচে পেষন করবি। যতটা বাঙ্গাল ততটা ফুল।এই নাও খাতা। হিসাবে যেন কোনো গোলমাল না হয়। একদিন এই ফুল বাগান খালি হবে, সাথে খালি হবে পুরো গ্রাম। শুণেছি-বাংলার হিঁদুরা এই ফুল দিয়ে পুজো করে। বাঙ্গালও থাকবেনা , ফুলের বাগানও থাকবেনা।
চার মাস পর। কলিম শেখের মা ছেলের শোকে কাতর। ছেলে সেই যে গেলো। আর ফিরে আসেনি। পুরো গ্রাম খাঁ খাঁ করেছে। পোলাও নেই, পোলার বেটিকেও নিয়ে গেছে আল বদরেরা। ছোট শিশু কন্যা কুসুম। কিছুই বুঝেনা। শূণ্য চোখে শুধু চেয়ে থাকে।
ফুলের বাগান আজ নিষ্প্রাণ। পাখীর কলতান বন্ধ হয়ে গেছে।প্রজাপতির উড়োউড়ো আর নেই। বাতাস নিথর। মেজরের ঢুলু ঢুল চোখে সারা রাতের নিশা।ভোর হয়ে আসছে। মেজর সাহেবের এবার ঘুমাবার পালা।
কুসুম কিছুক্ষণ কাঁদে। আবার ক্লান্ত হয়। আবার জাগে। থিরথির করে অন্ধকার ঘরে হামাগুড়ি দেয়। পাশি দাদী ঘুমিয়ে আছে। মাঝে মাঝে দাদীকে খামচি দেয়। একসময় সে কাঁদতে কাঁদতে মাটির মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়ে।
সারারাত কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়া কুসুমের এই ভোরে আরেকবার ঘুম ভাঙ্গে। মাতৃস্নেহ আর বাবার আদরের জন্য কেঁপে কেঁপে ওঠছে তার বুক।একবার মা ডাকে, একবার বাবা, আবার কখনো দাদি, দাদি বলে সে চীৎকার করেই যাচ্ছে।
কিন্তু হাজার ডাকে ও ঘুমিয়ে থাকা দাদীমার কোনো সাড়া নেই। কুসুম বুঝতে পারছেনা দাদীমার এ ঘুম আর লক্ষ কোটি ডাকেও ভাঙ্গবেনা। কুসুমের কান্নার শব্দ এবার আরো তীক্ষ্ন হয়।
মেজরের যা একটু তন্দ্রা ভাব এসেছিলো, এবার তাও ছুটে যায়। বাঙ্গাল বাচ্ছাগুলো কখন কাঁদতে হয়, তাও জানেনা। এই কাফেরের দেশে কোনো কিছুতেই কোনো শৃঙ্খলা নেই।
তিনি বের হয়ে ক্যাম্পের বাইরে পায়চারী করেন। দেখেন বাগানে আর একটি ফুল নেই। জওয়ান কে ডাকেন ইধার আও সালা, ও কিতাব নিকালো, গুল আওর বাঙ্গালকা হিসাব।
মেজর ফুল পেষনের আর মুক্তি হননের প্রতিদিনের যোগফল বের করেন। মোট ফুল উপড়ে বোটের নীচে দলিত করা হয়েছে ৮০৯ আর বাঙ্গাল মারা হয়েছে ৮০৮ জন। ১জন কম।
মেজর এবার বেশ্যার মতো চীৎকার করে ওঠেন- সারে কুত্তাকে বাচ্চা কান খুলকে শোন,হিসাব মে গরবর নেহি হোনা চাহিয়ে। জলদি জলদি হিসাব মিলাও।
পুরো গ্রামে একজন মানুষ ও নেই।জনমানবহীন এক গ্রাম। শুধু কিছুক্ষণ পর পর অবুঝ শিশু কুসুমের কান্না ভেসে আসছে।
কান্না একটু বন্ধ করলে কুসুম হয়তোবা ঘরের বাইরে বোটের শব্দ শুনতে পেতো। আর শুণেও লাভ কি? কেন বাবা চলে গেলো সে হিসাব ও জানেনা, কেন মাকে ধরে নিয়ে গেলো সে হিসাব ও না, দাদী যে একা ঘরে লাশ হয়ে শুয়ে আছে তাও সে জানেনা।
কুসুম এও জানেনা -এটাই হতে যাচ্ছে ওর জীবনের শেষ কান্না।কারণ-আর কিছুক্ষণ পর হিসাবের যোগফলটা যে ওকে দিয়েই মিলানো হবে।
লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত দেশের স্বাধীনতায় যে কুসুমরা নিজের রক্ত দিয়ে বিজয়ের অঙ্ক মিলিয়েছিলো-স্বাধীনতার ৪৪ বছরে সেই সত্যিকারের অঙ্কের মিলে আজো গরমিলই রয়ে গেলো।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন