|
মোঃ আহসানুল হক বিশ্বাস
|
|
একটি ছোট গল্পঃ নিশীকন্যা
17 March 2015, Tuesday
চায়ের কাপে চোখ লাগিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শিমুল। চায়ের কাপে দোল খেতে থাকা ধোঁয়াটার সাথে কুয়াশার ভীষন মিল। ওর মনে হচ্ছে স্বচ্ছ কোন পুকুরের পানিতে নিরবে কুয়াশা মিলিয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট ধোঁয়ার ঢেউ খেলা করছে চায়ের কাপে। খুব নিখুঁত করে দেখলেই তা বোঝা যায়।
শিমুল ঠোঁটে চা ভেজালো। না, চা টার আলাদা কোন স্বাদ নেই। শিমুল জীবনে প্রথম কবে চা খেয়েছিল তা মনে করার চেষ্টা করল। সেই চায়ের স্বাদই বা কেমন ছিল? না, কিছুতেই মনে পড়ছে না ওর। খুব অস্পষ্ট ছোট বেলার স্মৃতিগুলো। ঝপসা মনে পড়ে, বাবা কাপ থেকে পিরিচে চা ঢেলে খুব যত্ন করে চা খাওয়াতো ওকে। এর বেশি আর কিছুই মনে পড়ছে না শিমুলের।
ঢাকা শহরের সব চায়ের দোকানের চায়ের স্বাদ মনে হয় একই রকম। তবুও আজকের চায়ের স্বাদটা ভিন্ন হলেই ভাল হত কারণ এটাই হয়ত শিমুলের জীবনের শেষ চা।
আজ বর্ষার বিয়ে। বর্ষার সাথে শিমুলের দীর্ঘ পাঁচ বছরের প্রেম। বর্ষা যেন বর্ষার মতই চঞ্চল ছিল। ওরা দুজন দুজনকে ভীষন ভালবাসতো। এক দিন কথা না হলে কেমন ওলট-পালট হয়ে যেত ওদের পৃথিবী।
একবার অভিমান করে ওদের তিন দিন কথা হয়নি। বর্ষা ফোন দিয়ে শিমুলকে ধানমন্ডি লেকে আসতে বলল। শিমুল আসতেই বর্ষা একটা চড় কষে দিল শিমুলের গালে তারপর শিমুলকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চা মেয়েদের মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। শুধু একটি কথায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলছিল বর্ষা - এতদিন আমার সাথে কথা না বলে কিভাবে ছিলে? কেন কথা বলনি? কেন?
ভীষন পাগলি একটা মেয়ে বর্ষা। খুব স্বপ্ন দেখতো ওরা দু'জন- একটা গোছানো সংসার, কিছু বিকেল নিজের মত করে পাওয়ার। বর্ষা প্রায়ই বলত, আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। আজ সে তার দেয়া কথাগুলো পিছনে ফেলে চলে যাচ্ছে । আর কোনদিন হয়ত বর্ষার সাথে কথা হবে না শিমুলের। এমনটা ভাবতেই শিমুলের সব কিছুই কেমন যেন শূন্য হয়ে যাচ্ছে। পুরো জীবনটাই ওর কাছে অর্থহীন ।
শিমুল যেখানে বসে চা খাচ্ছে সেখান থেকে বর্ষাদের বাড়িটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। লাল-নীল বাতিতে বাড়িটা যেন ছায়াপথ হয়ে উঠেছে। হাজার তারা যেন মেলা বসিয়েছে ওখানে। শিমুলের ভীষন ইচ্ছে করছে বর্ষাকে একটি বার দেখতে। বউ এর সাজে কেমন দেখায় বর্ষাকে। দেখতে ইচ্ছে করছে ভীষন। না, শিমুলের দেখা হবে না কোন দিন।
শিমুল চা শেষ করে টং দোকানে বিল চুকে দিয়ে উঠে পড়লো। শেষবারের মত ঢাকা শহরের নির্জন গলিগুলো হাঁটবে সে। হেঁটে হেঁটে যাবে চন্দ্রিমা উদ্যান। যেখানে বর্ষা কলেজ ফাঁকি দিয়ে ওর সাথে বসে স্বপ্ন বুনতো সেখানে বসে থাকবে কিছুক্ষন তারপর জীবনের মায়া ত্যাগ করবে শিমুল।
শিমুল হাঁটতে হাঁটতে চন্দ্রিমা উদ্যানে চলে আসল। আকাশে রুপার থালার মত ঝকঝকে চাঁদ উঠেছে। কি দীপ্তিই না ছড়াচ্ছে চাঁদটা। তার আলোতে কোন কার্পন্য নেই। শিমুল এক দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ একটি মেয়ে পাশে এসে বলল-
'কি একা নাকি? আমার সাথে বসবেন!'
শিমুল মেয়েটির দিকে তাকিয়ে প্রায় হুংকার দিয়ে বলল- 'যা ভাগ এখান থেকে!'
শিমুলের এমন আচরনে মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসির দাপটে তার শরীরে নদীর ঢেউয়ের মত দোল দিচ্ছে। মেয়েটির হাসির রেশ শিমুলের বুকে ভীষন বিঁধছে। এই হাসির সুর তার ভীষন চেনা। বর্ষা এমন করে হাসত। এত প্রানবন্ত ছিল ওর হাসি যে শত রাগ করে থাকলেও সেই হাসি দেখলে সব রাগ পানি হয়ে যেত শিমুলের।
মেয়েটি হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল-
'থাকেন যাই।'
শিমুল মেয়েটিকে বলল-
'কি নাম তোমার?'
মেয়েটি ঠোঁটের কোনে দুষ্ট মাখা হাসি এঁকে বলল-
'নাম নাই। যে নাম আপনার পছন্দ সেটাই আমার নাম।'
মেয়েটির কথা বলার ভঙ্গিমাও বর্ষার মত। খুব হেয়ালি করে কথা বলতো বর্ষা। শিমুল কিছুটা ঘোরের মধ্যে বলল-
'বস।'
মেয়েটি এবার চোখে এক অন্যরকম রেখা টেনে বলল-
'ঘন্টা দেড়শ টাকা। শুধু বুকে হাত দিতে পারবেন আর অন্য কিছু না।'
এই বলে মেয়েটি খুব ভরা চোখে শিমুলের দিকে তাকালো। শিমুলের কোন ভাবান্তর হল না। সে নিঃস্পৃহ হয়ে বলল-
'বস।'
আকাশ ভেঙ্গে জোৎস্না নামাছে। এমন জোৎস্না দেখলে ভীষন বাঁচতে ইচ্ছে করে শিমুলের। এমন ভরা জোৎস্নায় আজ তার মৃত্যু হবে এমনটা ভাবতেই শিমুলের বুকটা কেমন হুহু করে উঠল। মেয়েটি শিমুলের পাশে বসে আছে তার শরীর থেকে সস্তা প্রসাধনীর সুবাস আসছে। শিমুলের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। চারিদিকে শুনশান নীরবতা।
মেয়েটি নীরবতা ভেঙ্গে বলল-
' কি গায়ে হাত দিবেন না?'
'না।'
'তাহলে মাঙ্গনা টাকা দিবেন?'
'হুম।'
'শুধু শুধু টাকা দিবেন কেন? আমি তাহলে যাই?'
'না বস।'
'বসে লাভ নাই। আপনি ভাবুক মানুষ এক ঘন্টা বসায় রাইখা টাকা না দিয়া হাঁটা শুরু করবেন।'
শিমুল মেয়েটির কথায় ইষৎ হেসে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে দুইশত টাকা তার হাতে দিয়ে বলল-
'এবার বসে থাক।'
মেয়েটা অবাক দৃষ্টিতে শিমুলের দিকে তাকিয়ে বলল-
'আপনার টাকা আমি নিব না। আপনি টাকা রেখে দেন।'
শিমুল ভুরু কুঁচকে বলল-
'কেন?'
'আমি কারো করুনা নেই না।'
'তাহলে কি করা যায়?'
মেয়েটি হালকা হেসে বলল,
'আপনি আমার সাথে গল্প করেন। মন হালকা হবে।'
'কি গল্প করব তোমার সাথে?'
মেয়েটা খুব গাঢ় কন্ঠে বলল,
'যে মেয়েটাকে ভালবাসেন তার গল্প করেন।'
এই কথা শুনে শিমুল খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মেয়েটির দিকে। তারপর খুব শীতল কণ্ঠে বলল,
'তুমি কি করে জানলে, আমি কাউকে ভালবাসি।'
'মেয়েরা অনেক কিছুই বুঝতে পারে। মেয়েদের আলাদা একটা চোখ আছে। সেই চোখ দিয়ে দেখেছি।'
শিমুল হালকা গলায় বলল,
'আজ ওর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।'
মেয়েটি এবার খুব হেয়ালি করে বলল-
' আপনি আজ সেই দুঃখে বিষ খাবেন, তাই না?'
শিমুল চোখ ছোট ছোট করে বলল-
'কে বলল তোমাকে? '
মেয়েটি ইষৎ হেসে বলল-
'কে বলছে সেটা বিষয় না। ঘটনা সত্য কিনা বলেন?'
'হুম সত্য। তবে বিষ খাব না। সুইসাইড করবো।'
মেয়েটি আবার খিলখিল করে হেসে উঠলো। সে হাসি শিমুলের বুকে বিঁধছে। শিমুল কিছুটা মোটা স্বরে বলল-
'এভাবে হাসছো কেন?'
মেয়েটি হাসি থামিয়ে বলল-
'মরদগিরি দেখাবেন না। যে মানুষ এত অল্পতে হার মানে তার মরদ গিরি শোভা পায় না।'
শিমুল একটু রাগী স্বরে বলল,
'আমাকে জ্ঞান দিবে না।'
মেয়েটি ইষৎ হেসে বলল,
'আপনাকে জ্ঞান দিব কেন? আমি এক ঘন্টার জন্য আপনার কাছে জিম্মি। আপনার যা ভাল লাগে তাই করব। '
শিমুল কিছুটা থমথমে গলায় বলল,
'হুম।সেটাই ভাল।'
মেয়েটি এবার পূর্ন দৃষ্টিতে শিমুলের দিকে তাকালো তারপর শীতল গলায় বলল-
'প্রতিদিন আমার শরীরটা আপনাদের মত পুরুষ মানুষ খাবলাখাবলি করে। প্রতিদিন মরেও আমি বেঁচে আছি কেন জানেন?'
'কেন?'
'ঘরে প্যারালাইসেস রোগি আমার মা আর কয়েকটা দিন বাঁচার জন্য আমারর দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার ছোট বোনটা বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে। আমি তাদের জন্য প্রতিদিন মরেও বাঁচি।'
শিমুল কিছুটা নরম সুরে বলল-
'তোমার বাবা নাই।'
মেয়েটির চোখের কোন পানি চিকচিক করে উঠল। মনে হয় দূর আকাশের কোন নাম না জানা তারা ঝিলমিল করছে। মেয়েটি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল-
'ছোট বেলায় বাবা নিরুদ্দেশ হয়েছে। তাই আমার পড়াশুনা হয় নাই। গার্মেন্টসে সারাদিন কাজ করে যে পয়সা পাই তাই দিয়ে মাসের অর্ধেক দিনও চলে না। তাই রাতের অন্ধকারে শরীর বিক্রি করি। আর আপনি শুধু নিজের কষ্ট থেকে বাঁচতে মরে যেতে চাচ্ছেন? আপনার মত স্বার্থপর মানুষের মরে যাওয়াই উচিত।'
এই বলে মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো। শিমুল বলল-
'কোথায় যাচ্ছো?'
মেয়েটি হেসে বলল-
'আপনার মত কাপুরুষের সাথে বসব না। আমার কারবার পুরুষদের সাথে কাপুরুষদের সাথে না।'
এই বলে মেয়েটি খিলখিল করে হাসছে। হাসিটা শিমুলের খুব বুকে বিঁধছে। হাসতে হাসতে মেয়েটি চলে যাচ্ছে। শিমুল মেয়েটির চলে যাওয়া দেখছে। ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে রাতের মেয়েটি।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন