|
আপেক্ষিক
|
|
গল্পঃ শেষ বিকেলে... ...
04 March 2015, Wednesday
হাসপাতাল থেকে হোস্টেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে কয়েকটা পেশেন্ট এর হিস্টরি দেখছিলাম। খুব ক্লান্ত লাগছিল। একটু পর বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
মন বেশি ভাল নেই আমার। আজকে হাসপাতালে আমার সামনে একটা রোগী মারা গেল। স্যার অনেক চেষ্টা করলেন বুকে অনেকক্ষণ ধরে চাপ দিলেন,কৃত্রিম শ্বাস দিলেন কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। স্যার যখন বুঝতে পারলেন যে আর কাজ হবে না তখন খেয়াল করলাম তিনি হাল ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন বেডের পাশে। ধীরে ধীরে বিপি মেশিনটা খুললেন। স্টেথো হাতে নিলেন এবং সেখান থেকে বের হয়ে সোজা ইউনিট এর বিশাল রুম পার হয়ে রোবটের মত দরজা খুলে চলে গেলেন বাইরে। একবারের জন্যও এদিক ওদিক তাকালেন না। আমার মনে হল স্যার এখন নিজের রুমে যাবেন,দরজা আটকাবেন ও কিছুক্ষণ বসে বসে চোখের জল ফেলে লোকটার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন।
মানুষটার বয়স ৪৫ বছর। নাম রহমত উল্লাহ। গোলগাল চেহারা। কেমন একটা মায়া আছে যেন চেহারার মধ্যে। কতক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মনে হল আমার বাবার সাথে লোকটার চেহারার অনেক মিল রয়েছে।
আমি মৃত রহমত উল্লাহর ফাইল হাতে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। এই মানুষটার মৃত্যু হতে পারত কোন বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট এর এসি রুমের মধ্যে একাকী হঠাৎ করে অথবা রাস্তায় এক্সিডেন্ট করে। কিন্তু তা কিছুই হল না। তার মৃত্যু হল মিটফোর্ড সরকারী হাসপাতালের আলো আধারিতে ঘেরা এই ব্যস্ত ইউনিটের একটা বেডে,কয়েকজন হতভম্ব মেডিকেল স্টুডেন্টের সামনে এবং একজন ডাক্তারের কাছে বসে যিনি স্রষ্টার ইচ্ছাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। মানুষের বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় রহস্য হলো তার মৃত্যু কিভাবে কখন হবে তা জানতে পারা। স্রষ্টা ছাড়া কেউই জানে না এই রহস্য। এইসব চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম টেরই পেলাম না।
বিকেলে একটা ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙলো আমার। ধরতে ধরতেই ফোনটা কেটে গেল। নাম্বারটা আমার পরিচিত। আমি হাত মুখ ধুয়ে নামাজ পড়লাম। এমন সময় আবার ফোন এল।
- হ্যালো ভাইয়া।
- বলো
- ভাইয়া আপনি আমাকে ফোন দেন না কেন?
- ব্যস্ত থাকি তো। বোঝই তো মেডিকেলের স্টুডেন্ট।
- এইটা কোন কথা না। আপনি ইচ্ছা করলেই আমাকে ফোন দিতে পারেন। আপনি কেন দেন না?
- বললামই তো একটু ব্যস্ত থাকি।
- এখন কি ব্যস্ত?
- না একটু ফ্রি। রাতে ডিউটি আছে।
- ভাইয়া।
- বল।
- না থাক কিছু না।
- আচ্ছা।
- আপনি কি জানতে চান না?
- কি জানতে চাইব?
- উফ! আপনি একটা ছাগল!!
- ঠিক বলেছ আমি ছাগল।
- আপনি গাধা একটা!
- হ্যা আমি গাধা।
- ধুরর!!!
- কি হয়েছে?
- কিছুনা।
- আচ্ছা।
- ভাইয়া।
- বলো
- আপনার মনে আছে?
- কি মনে থাকবে?
- আমি ছোট থাকতে ১ম একটা চিঠি দিয়েছিলাম আপনাকে?যখন আপনারা আমাদের পাশের বাসায় ছিলেন?
- হুম মনে আছে।
- পড়েছিলেন?
- খেয়াল নেই।
- কি লিখেছি মনে আছে?
- না মনে নেই।
- ও। কি করেছেন চিঠিটা?
- মনে নেই।
- আপনি এরকম কেন?
- কিরকম?
- কেমন বোকা বোকা।
- কি জানি জানি না।
- আপনি কি আগের মতই আছেন ? নাকি মোটা হয়েছেন আরো?
- হুম মোটা হয়েছি।
- ভাবি মাইর দেয় না।
- থাকলে অবশ্যই দিত।
- আপনাকে আমার মাইর দিতে ইচ্ছা করে। দেই?
- দাও।
- না থাক। বোকা মানুষকে মারা ঠিক না। মা নিষেধ করেছেন। আপনি একজন সহজ সরল বোকা সোকা ভদ্র ভাল মানুষ।
- হুম।
- বিয়ে করবেন কবে?
- দেরী আছে।
- কেন?
- টাকা পয়সা নাই। বউ না খেয়ে মারা যাবে।
- আন্টি কেমন আছেন?
- ভালো। তোমার বাবা মা?
- ভাল। আপনার ছোট বোন কোথায় পড়ে?ঢাকায়?
- হুম।তোমার বড় ভাই কোথায় এখন?
- ভাইয়া বিদেশে। সামনের মাসে আসবেন।
- ও আচ্ছা।
- আপনি এমন ক্যান? জানেন আমি আপনাকে সেই এস এস সি, এইচ এস সি সব কিছুর রেজাল্ট সবাইকে জানানোর আগেই জানিয়েছি। এমনকি ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে আমি আপনাকেই প্রথম জানাই!
- না জানতাম না। এখন জানলাম।
- আপনি আমাকে কখনই বুঝলেন না।
- হয়ত।
- আসলেই আপনি বোঝেন না।
- হুম।
- আপনাকে আমি মোট আটটা চিঠি দিয়েছিলাম। একটাও পড়েছেন?
- মনে নেই।
- কই সেগুলো?
- জানি না।
- থাক জানার দরকার নেই। একটা কথা ছিল।
- বলো।
- আপনাকে আমার এটাই শেষ ফোন। আমি আর আপনাকে ফোন দিব না।
- এই নিয়ে কয়বার বলেছ এমন?
- অনেকবার। কিন্তু এবার আমি সিরিয়াস।
- ও আচ্ছা।
- ভাইয়া।
- কি?
- আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। সামনের মাসের শেষের দিকে বিয়ে। ভাইয়া অবশ্যই আসবেন। আপনাকে এ কথা জানাতেই ফোন দিয়েছি। কার্ড ছাপানো শেষ। আপনাদের বাসায় কয়েকদিনেই তা পৌছে যাবে।
- কংগ্রাটস!!
- বিয়েতে আসবেন।
- অবশ্যই আসব।
- ভাইয়া।
- কি?
- একটা কথা বলতে চাই।
- বল।
- আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন না?
- জানি না,মনে হয় না।
- আপনি একটা মিথ্যুক।
- তুমিও মিথ্যুক।
- কেন?
- এ নিয়ে চার পাঁচ বার তোমার বিয়ের কথা আমায় বলেছ। সবই মিথ্যা। আমি জানি এবারেরটাও মিথ্যা।
- তারমানে আপনি আমাকে ভালোবাসেন?
- ... ...!
- প্লিজ ভাইয়া একবার শুধু শুনতে চাই আপনার মুখ থেকে,প্লিজ।
- বোকা মেয়ে ফোন রাখ। বোকা বোকা কথা বলা বন্ধ করো।
- (কিছুক্ষন চুপ করে থেকে) ভাইয়া এবার আমি সত্যিই বলছি।
- ভাল।
- আমি আপনাকে ভালোবাসি।
- ... ...
- রাখি ভাইয়া। আর কথা হবে না কখনও আমাদের।
- ... ...!
- রাখি।
- রাখো।
- আপনি একটা ভীতুর ডিম!!!
- হুম। আমি জানি।
মেয়েটা ফোন রেখে দিলো।পুরাই পাগল একটা মেয়ে। বরিশালে আমাদের পাশের বাসায় ছিল। ওর ভাই আর আমি একসাথে পড়তাম। এজন্যই ওদের বাসায় যাওয়া আসা হত। মাঝে মাঝে আমাদের বাসায়ও আসত আমার ছোট বোনের সাথে খেলতে। ওর নাম মারিয়া।
আমি ক্লাস নাইনে উঠলাম। বরিশাল জিলা স্কুলের ডে শিফট এ পড়ি। আমার ছোটবোন ক্লাস ফোরে আর মারিয়া ক্লাস এইটে। তখনকার সময়ের ঘটনা।
আমি স্কুল থেকে বাসায় ফিরে এলাম বিকেলে। রুমে এসে ব্যাগ রেখে হাত মুখ ধুয়ে এসে টেবিল গুছাচ্ছিলাম। এমন সময় একটা বইয়ের ভেতর থেকে একটা চিঠি বের হয়।আমি হাতে নিয়ে ওর নাম দেখতে পাই। কিছুদূর পড়েই সাথে সাথেই পকেটে ঢুকিয়ে রাখি। আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছিল। আম্মা জানলে খবর আছে। তাকে খুব ভয় পেতাম। এখনকার মত তখন প্রেম ভালবাসার বিষয়গুলোকে মোটেও ভাল চোখে দেখা হত না। আমি সেদিন বিকেলে ছাদে গিয়ে চিঠিটা পড়লাম। কাঁপা কাঁপা হাতের লেখায় লেখা চিঠিতে আবেগের কোনই কমতি ছিল না। এত সুন্দর করে একটা মেয়ে লিখতে পারে আমার জানা ছিল না। কিন্তু চিঠিটা ফেলে দিব না রেখে দিব ঠিক করতে পারলাম না। বিকেলের শেষে বসে বসে সূর্যের হারিয়ে যাওয়া দেখতে থাকলাম চুপচাপ।
সেদিনের পর থেকে ওকে কখনই আর সামনে পেলাম না। যখনই দেখা হত কেমন যেন এড়িয়ে যেত। তবে আড়চোখে তাকিয়ে থাকত সেটা আমি খেয়াল করতাম।আস্তে আস্তে সময় এগিয়ে গেল।
এরপর একরকম ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এসএসসি পরীক্ষা, এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় সলিমুল্লাহ মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেলাম। ঢাকায় চলে এলাম আমি। ও আমাকে মাঝে মাঝে ফোন দিত। কথা বলত। রেজাল্ট জানাত।
মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর আমি হোস্টেলেই থাকা শুরু করি। প্রতিমাসে আমার বাবা আমাকে দেখতে আসতেন; আমাকে না দেখে তিনি নাকি থাকতে পারতেন না। তাই প্রতিমাসেই আমাকে দেখতে চলে আসতেন তিনি।
সেবার ফরম ফিল আপ করব প্রথম প্রফের। কয়েকদিন ধরে আমাকে বলছিলেন বাড়ি যেতে,আমাকে নাকি দেখতে ইচ্ছে করছে। সেদিন রাতে কথা হল পরদিন রওনা দিয়ে আসবেন ফর্ম ফিল আপের টাকা নিয়ে। পরদিন বিকেলে বাড়ি ফিরে যখন তার লাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম তখন মনেই হয় নি মানুষটা মরে গেছেন। খুব নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে ছিলেন যেন। মনে হচ্ছিল ডাক দিলেই উঠে বসে আমার নাম ধরে বলবেন,"কিরে এত দেরী করলি কেন?" রাতে বুকে খুব বুকে ব্যথা নিয়ে ঘুম থেকে উঠেছিলেন নাকি। আম্মা পানি খাওয়ালেন,দোয়া দুরূদ পড়লেন, মামাকে ফোন দিলেন। বাবাকে বরিশাল মেডিকেলে ভর্তি করানো হল।কিন্তু কিছুই হলো না। সিভিয়ার এম আই হয়েছিল হার্টে,আর বাঁচানো যায়নি।
সেদিন থেকে আমার নতুন জীবন শুরু হল। টিউশনি শুরু করলাম। টাকা পাঠাতাম বাড়ি। জীবনটা একটা রেস এর মত হয়ে গেল। শুধুই দৌড়াচ্ছিলাম। যেদিকে খুশি সেদিকে দৌড়াচ্ছিলাম। আমি যেন একটা পাগলা ঘোড়া হয়ে গিয়েছিলাম। বাকি তিনটা বছর কিভাবে কিভাবে যে পাড় হয়ে গেল বুঝলাম না। সমস্ত পৃথিবী যেন আমার বুকের উপর চেপে বসেছিল। এরই মধ্যে একজনকে ভালও বেসেছিলাম; বাস্তবতা শিখিয়ে দিয়ে হারিয়ে গেল সে অনেক দূরে। বাস্তবতা শিখলো এ অধম। শিখলাম দুঃসময়ের সমুদ্র একাই পাড়ি দিতে হয়।
মাগরিব এর আজান হচ্ছে। আমি হোস্টেলের ছাদে বসে পুরনো দিনগুলোর কথা ভাবছিলাম এতক্ষণ। এরপর নামাজ পড়তে গেলাম আমি।
এই ঘটনার কয়েকদিন পর আসলেই মারিয়ার বিয়ের কার্ড পেয়েছিলাম আমরা। বর বিশাল বড় ব্যবসায়ী। বিয়ের প্রোগ্রাম
ঢাকায় হয়েছিল।
বিয়েতে মা,খালা সবাই ই গিয়েছিল।আমি যাই নি। পরে শুনলাম বেশ মানিয়েছে নাকি বর কনেকে। সবাইই এমনটা বলাবলি করছিল, শুধু আমার বোন নাফিসা আমাকে ফোন করে ভ্যা ভ্যা করে কান্নাকাটি করেছিল অনেকক্ষণ। মেয়েটা বোকাই রয়ে গেল,আর বুদ্ধি হলো না!!
পরিশিষ্টঃ
আকাশে কালো কালো মেঘ। পশ্চিমে একটু খোলা আকাশের সন্ধান পেয়ে তা থেকেই ঠিকরে পড়ছে আলো। বৃষ্টির দিনে বুড়িগঙ্গার পানি পরিষ্কার থাকে। সলিমুল্লাহ মেডিকেলের ক্যাম্পাসের পেছনের গেট থেকে বের হয়ে সোজা বুড়িগঙ্গার পাড়ে যাই। গুনে গুনে আটটা কাগজের নৌকা বানাই ও ছেড়ে দেই।নৌকাগুলো ভেসে যাচ্ছে।
শেষ বিকেলের আলো,নদীর জলে প্রতিফলন তার মাঝে নৌকাগুলোর ভেসে যাওয়ার দৃশ্যটা সত্যিই অদ্ভুত। সেদিকে তাকিয়ে আছি। যতক্ষণ পারলাম তাকিয়ে ছিলাম।
ফিরে আসার আগ মুহুর্তে মনে হল আমি কাঁদছি। সূর্য অস্ত গেল। ধীরে ধীরে মনের মত, ব্যস্ত শহরটাও একসময় ডুবে গেল অন্ধকারে।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন