|
আমি সাজিদ
|
|
ছোটগল্প- প্রহেলিকা
04 March 2015, Wednesday
এই শহরে জানালার ওপাশের চওড়া লন আর কাঠগোলাপের বাগান-বিলাস বহুদিন আগেই মুছে গেছে যান্ত্রিকতায়, তাই বহুদূরের জানালাটা বোধহয় কেউ খুলে দেখে না আজকাল। খোলার সময়টাও যে নেই। দিন নেই-রাত নেই মানুষগুলো ছুটে বেড়াচ্ছে শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। শহরটা ইট লোহার জঙ্গল, সারি সারি আকাশচুম্বী দালানগুলো সারা শরীরে ঠোঁট বসিয়ে অগণিত চুমুতে গোটা আকাশটাকে ঢেকে দিয়েছে। তাই দিনের আলো শহরের যেসব অলিগলিতে ঢুকতে পারেনা, সেসব অলিগলিতে প্রায় চোরাবালির দেখা মেলে। চোরাবালিকে কঠিন ভেবে প্রহেলিকায় কেউ যদি হেঁটে যায়, তবে আটকে যায়। খানিকক্ষণ ভেসে একসময় অতলে হারিয়ে যায়।
অতলে না হারিয়ে বাঁচার সংগ্রাম হচ্ছে বরং মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। জীবিকার তাগিদে শ্যাওলার মতো তাই সারাদিন ভেসে বেড়াই বানের জলে। এরপর অনেকগুলো মুখ আছে, খুব গভীর প্রতিটা রাতে ঘরে ফেরার পর যেগুলো ড্যাবড্যাব করে তাকায় আমার দিকে। এরকম চোখাচোখিতেই জীবনের ত্রিশটা বসন্ত কেটে গেছে। মৃত্যুর আগের বসন্তটাও এভাবেই পার করতে হবে আমি জানি।
ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে কখন হাতের সিগারেটটা জ্বলে প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলো, টের পাইনি। পাশ থেকে ঝাঁকুনি খেয়ে সংবিৎ ফিরে পেলাম। তাকিয়ে দেখি, পাশে বসা ভদ্রলোকটি ডাকছেন আমায়।
জি ? কিছু বলবেন ?
কাতর কণ্ঠে ভদ্রলোক বললেন, কিছু মনে করবেন না।আসলে সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারি না।
ও আচ্ছা, সরি। আমি প্রায় শেষ সিগারেটটা পায়ের জুতোর তলায় পিষে ফেলি।
ধন্যবাদ। হেসে ফেলেন ভদ্রলোক।
আমি এই সুযোগে একবার তাকাই পাশে। অন্য দশ পাঁচজন মানুষের মতো সাধারণ চেহারা। ক্লিন শেভেড, গায়ে সাফারি স্যুট। হাতে ফাইল মতন কি একটা। কিছুটা কুঁজো হয়ে বসে আছেন, বসতে কষ্ট হচ্ছে বোধহয়। একটু সরে গিয়ে বলি, এবার আরাম করে বসুন। লোকাল বাসগুলোর সিটে যে দুজন বসতে পারে এটা অনেক আশ্চর্যের একটা ব্যাপার।
হাহা করে হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেন ভদ্রলোক। ভালো বলেছেন।
বিরোধীদলের হরতাল চলছে, এর মাঝেও বেশ গাড়ি বের হয়েছে রাস্তায়। শেষ বিকেলে অফিস ফেরত লোকগুলোর চাপে মৎস্য ভবনের সামনে বিশাল জ্যাম পড়েছে।দশ মিনিট ধরে বাস একহাতও এগুতে পারেনি। এই ধরনের পরিস্থিতিতে লোকাল বাসগুলোর ভিতরে খুব পরিচিত চিত্রনাট্য মঞ্চস্থ হয়। শুরুতেই ধৈর্য্যচুতি ঘটা গুটি কয়েকজন হেলপার আর ড্রাইভারের গোষ্টি উদ্ধার করে। বিরক্তির মাত্রা যত বাড়তে থাকে গালিবাজির সীমা পরিসীমাও তত বেড়ে যায়। যা একসময় সরকারী দল-বিরোধী দল হয়ে সাধারণ মানুষের বঞ্চনা আর কষ্টের রোষানলে পড়ে চলে যায় আন্তর্জাতিক মহল পর্যন্ত। হঠাৎ সমাজ সংস্কারের কথা বলে উঠে পিছনের সিটগুলোর একটাতে বসা কেউ, এক ধাপ এগিয়ে কেউবা হাঁক দিয়ে রাস্তার পাশ থেকে দিনের বাসি পত্রিকা কিনে সচেতনতার প্রথম পদক্ষেপটা নিয়ে ফেলে।
এধরনের ঘটনাগুলোর সাথে অভ্যস্ত হয়ে যারা চুপচাপ ঘটনাস্থলে বসে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ চালান, আমি তাদের মধ্যে একজন। নিখাদ বিনোদনের উৎস আমার ঠিক সামনেই ছিলো। একই নাটক পুনঃ প্রচার হচ্ছিলো আর আর বাঁধাধরা দর্শক হিসেবে দেখে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ পাশে বসা ভদ্রলোক আমার উদ্দেশ্যে মুখ খুললেন,
এভাবে কি থাকা যায় বলেন তো ?
কিভাবে ? জিজ্ঞেস করি আমি।
এই যে, পথঘাটে এত আটকে পড়লে মানুষ কাজ কর্ম করবে কিভাবে ?
হু। সময়ের তো একটা মূল্য আছে ।
দেখেন না, ব্যাংক ৫ টায় বন্ধ হয়ে যাবে। এখন বাজে সাড়ে চারটা। আর আমি নামবো জিগাতলা।
আজ আর যেতে পারবেন বলে মনে হয় না। কাল বরং যান।
না আজকেই। সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা অফিসের একাউন্টে জমা দিতে হবে, নাহয় হিসাবে গণ্ডগোল বাঁধবে ভাই। কালও আবার হরতাল।
ও আচ্ছা। লোকটার হাতে ধরা রংচটা ফাইলমতোন ব্যাগের উপর আমার চোখ ঘুরে আসে একবার।
এরা আর কত দেরী করবে ? দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন ভদ্রলোক।
বুঝতেসিনা ভাই। জ্যাম ছুটলেই হয়। আমারও বেশ কাজ পড়ে আছে।
এরপর বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। একসময় সামনে সিগন্যাল উঠলো। থেমে থাকা গাড়িগুলো ব্যস্ত-ভাবে ইঞ্জিনে শব্দ তুলে সরব উপস্থিতি জানান দিলো। সিটে একটু রিলাক্স হয়ে বসে জানালার ওপাশে তাকালাম। দেখি, ফুটপাথের পাশ থেকে হঠাৎ বাসের সামনে কয়েকজন ছুটে এসেছে। ওদের কয়েকজন রাস্তায় তাক করে কি যেন ছুঁড়ে মারছে।
প্রচণ্ড শব্দ আর ধোঁয়াতে চারদিক ঢেকে গেলো। সাথে সাথেই আমার লোকাল বাসের সহযাত্রীদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের আর্ত চিৎকার শুনা গেলো।
পরপর কয়েকটা ককটেল ফুটেছে বাসের সামনে।
যাত্রীরা বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সামনের গেটের কাছে প্রচণ্ড ভিড়। কে কার আগে নামবে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। অনেকেই চোখে ভয় নিয়ে এদিকওদিক তাকাচ্ছে। সামনের সিটের জনকে জানালা দিয়ে লাফ মেরে নিচে নামতে দেখে আমিও লাফ দিলাম। নিচে দাঁড়িয়ে একটা দৌড় লাগাবো এমন সময় উপর থেকে পাশে বসা ভদ্রলোকটি বলে উঠলেন, ভাই আমিও লাফ দিচ্ছি। আগে আমার ব্যাগটা একটু ধরেন।
উপর থেকে ব্যাগটা লুফে নিলাম। সুযোগটা এভাবে আসবে ভাবিনি।
আমার পকেটের মানিব্যাগে দশ হাজার টাকা আছে। কাল বড় একটা দাও মেরেছিলাম। আজ আবার এভাবে বড় পার্টি পাবো সত্যিই ভাবিনি।
অপেক্ষা করার মতো সময় আমার ছিল না। এধরনের কাজে অপেক্ষা করিনি আমি আগে কখনো। আমার পা যেন আমাকে টেনে নিয়ে চলল সামনের দিকে। দৌড় লাগালাম। পিছনে তাকাইনি। ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত থামিনি। অনেক দূরে, অনেক দূরে এসে একটা গলিতে ঢুকে থামলাম।
একটা তৃপ্তির হাসি ভিতর থেকে আমার মুখে উঠে এলো। ব্যাগটা বেশ ভারীই লাগছে। জিপার চেনটা খুলে আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
কিছুই ছিল না ভিতরে পুরনো অনেকগুলো পত্রিকা ছাড়া। সুনিপুণ হাতে দলা-মোচা করে ভিতরে পাকিয়ে রাখা হয়েছে।
শালা ! ছোটলোক। মুখ খারাপ করে গালি দিয়ে ফেললাম। প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে ব্যাগটা ছুড়ে ফেললাম ডাস্টবিনে।
মেজাজ চড়ে গেছে। সিগারেট না হলে চলবে না এই মুহূর্তে। একটু সামনের টঙটার দিকে হাঁটছি। পিছনের পকেটে হাত চলে গেলো নিজের অজান্তে।
আমার মানিব্যাগটা বেমালুম হাওয়া হয়ে গেছে !
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন