|
তাশমিন নূর
|
|
মেঘমালাঃ পর্ব-৫
28 February 2015, Saturday
রমানাথ রান্না ঘরে এসে দেখে জয়ন্ত চুলার সামনে চিন্তিত মুখে বসে আছে। তার খুব জানতে ইচ্ছে করছে সে কী নিয়ে চিন্তা করছে। জিজ্ঞেস করলে বলবে কী? নাও বলতে পারে। তাই সে জিজ্ঞেস না করার সিদ্ধান্ত নিল। ছেলে-মেয়েগুলো বড় হয়ে যাওয়ার পর থেকে তাদেরকে সে একটু একটু ভয় পেতে শুরু করেছে। সবচে বেশি ভয় পায় কাননকে। মেয়েটা খুব শাসন করে। সে অনন্তকেও ভয় পায়। অনন্তও শাসন করে। আবার ছেলেটার মেজাজ মর্জিও বিচিত্র রকমের। এই জল, এই আগুন। দেশে আসার কথা বললেই লাফিয়ে উঠে-আমার গানের কী হবে? তা, গান কি শুধু ঐ দেশেই শেখায়? এই দেশে কি গানের মাস্টার নেই? রমানাথ কিছুই বুঝতে পারে না। তার মাঝে মাঝে ধারণা হয়, ছেলেটা হয়তো সেখানে বিয়ে-শাদি করে ফেলেছে। তাই হয়তো আসতে চায় না। সে জয়ন্তকে কী চিন্তা করছে এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তার পেটের মধ্যে গুড়গুড় করছিল। সে জিজ্ঞেস করে ফেলল।
-কী ভাবস, বাপ?
প্রশ্নটা করে সে নিশ্চিত ছিল জয়ন্ত বলবে, ‘কিছু না, বাবু।’ কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে জয়ন্ত বলল,
-মারে নিয়া চিন্তা করি। মা’র কী জানি অইছে। মাঝে-মইদ্যে খুব ডরায়। মা’রে ডাক্তার দেখান লাগে।
-কী অইছে? কী ডাক্তর দেখাইবি?
-উম। এই ডাক্তাররে সাইকিয়াট্রিস্ট কয়।
-কীয়া কিয়াটিস?
-তুঁই বুইঝতা না, বাবু। তরকারি জাল দেওন অই গেছে। সাহেবরা কুন সময় খাইব?
-খাইত ন বলে।
-ক্যা? এত কষ্ট করি রাইনলাম।
-সাহেবগো মেজাজ মর্জির কি আর ঠিক আছে, বাপ?
-তনয়া খাইত ন?
-না বাপ, তনু খাইত ন।
-তুঁই হিগারে তনু কও?
-উম। ইগা কইতে সঅজ লাগে।
জয়ন্ত একটু কী যেন ভাবল। তারপর হেসে বলল,
-তনু সোন্দর আছে, এক্কেরে পরীর মতন, ক্যান না বাবু?
রমানাথ একটু অন্যমনস্ক ছিল। সে বিড়বিড় করে বলল,
-উম। মা’র মতন অইছে। তিলও আছে ঠিক ঠিক।
জয়ন্ত বাবার কথা পুরোপুরি বুঝতে পারল না। সে বিরক্ত হয়ে বলল,
-কী কও? পষ্ট করি কও।
রমানাথ কিছু বলল না। সে পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল। জয়ন্ত বিরক্তমুখে ডেকচিগুলো নিয়ে ঘরে চলে এলো। তার মা আবার চিৎকার শুরু করেছে। এবার কী হল কে জানে। মাকে এই অবস্থায় রেখে সে শহরেও যেতে পারছে না। কিছু দিনের মধ্যেই টেস্ট পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। পড়ালেখাও খুব একটা করা যাচ্ছে না। সাহেবরা কতো দিন থাকবেন এখনো বোঝা যাচ্ছে না। বেশি দিন থাকলে মুশকিল হয়ে যাবে। তার বাবু হুকুম করে দিয়েছে সাহেব যত দিন থাকবেন তত দিন গ্রামেই থাকতে হবে। গ্রামে আসলে জয়ন্তের পড়ালেখা ভালো হয় না। কী যে হবে।
ঘরে গিয়ে জয়ন্ত শোবার আয়োজন করছিল। হঠাত কী মনে করে দোতলায় গেল। গিয়ে দেখে তনয়া দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। সে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-আপনারা নাকি রাতের খাবার খাবেন না?
-না, আমি খাব না। বাবার ডায়াবেটিস আছে। উনি রাতে দুটা রুটি খান।
-সে কথা বললেই হত। আমি এক্ষুনি রুটি বানিয়ে নিয়ে আসছি।
তনয়া খুব সহজভাবে বলল,
-দরকার নেই। বাবা বিস্কুট খেয়ে শুয়ে পড়েছেন। He is tired. Please, don’t disturb him.
জয়ন্ত বলল,
-But you should eat something.
-Why?
জয়ন্ত বাংলায় বলল,
-আপনি যদি রাতে না খেয়ে ঘুমান, তাহলে আপনার শরীর থেকে তিন চড়ুইয়ের রক্ত কমে যাবে।
তনয়া অবাক হয়ে তাকাল। সে বুঝতে পারছে না, মানুষের শরীরে চড়ুই এর রক্ত কোত্থেকে আসবে। এই ছেলেটি খুব অদ্ভুত কথা বলছে। এত অদ্ভুত কথা সে আগে কখনোই শোনে নি। তনয়া বলল,
-আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার শরীরে আমার রক্ত থাকবে। রক্ত কমে গেলে আমার রক্তই কমবে। এখানে চড়ুই পাখির রক্তের কথা কেন আসছে?
-ও আচ্ছা। এটা হল গ্রামের মানুষদের একটা বিশ্বাস। এর অর্থ হল, আপনি যদি এক রাত না খেয়ে থাকেন তাহলে তিনটি চড়ুই পাখির শরীরে যে পরিমান এনার্জি থাকে তা আপনি হারাবেন। You will lose three sparrows’ blood means you will lose three sparrows’ energy.
জয়ন্ত কথাটা মজা করে বলেছে। কিন্তু তনয়া খুব সিরিয়াস হয়ে গেল। সে বলল,
-Do you believe this?
জয়ন্ত হাসতে হাসতে বলল,
-গ্রামের প্রচলিত অনেক কথাই আমরা এখন আর বিশ্বাস করি না। তবু কিছু কিছু কথার ভিত্তি নিশ্চয়ই আছে। যেমন ধরুন, যারা খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণে রাখেন তারাও কিন্তু রাতে একেবারে কিছুই না খেয়ে ঘুমুতে যান না। অন্তত এক বাটি সব্জি বা ডাল, কিংবা এক গ্লাস ফলের রস হলেও রুটিনে রাখেন।
-so you think I should eat something.
জয়ন্ত তনয়ার চোখের দিকে তাকাল। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জয়ন্ত বলল,
-মন থেকে সাড়া না পেলে জোর করে খাওয়ার দরকার নেই।
তনয়া বলল,
-আমি এক গ্লাস জুস খাব।
-গরম পানিতে?
-গরম পানিতে কেন? শীত তো বেশি নেই। আমি ঠান্ডা পানিতেই খাব।
জয়ন্ত দ্রুত সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে গেল। তনয়া যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে চাপকলটা দেখা যায়। সে এখান থেকে জয়ন্তকে দেখতে পাচ্ছে। জয়ন্ত কল চেপে জগে পানি ভরছে। কলতলায় একটা ৪০ ওয়াটের বাতি জ্বলছে। সেই আলোয় জয়ন্তের মুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। তবু তনয়া সেই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।
তনয়ার বন্ধু রিয়া তাকে বার বার বলে দিয়েছে, ছেলেদের সঙ্গে যেন বেশি না মেশা হয়। বাংলাদেশের বেশিরভাগ ছেলেরাই নাকি সুযোগ পেলেই মেয়েদের ক্ষতি করতে চায়। তাই সে ছেলেদের সাথে মোটেই বন্ধুত্ব করে নি। রিয়ার সাবধানবানী সে মেনে চলেছে। অবশ্য তেমন সুযোগও হয়নি মেশার। পড়েছে গার্লস স্কুলে। তারপর গার্লস কলেজে। যেসব হোম টিউটর ছিলেন, তারাও সবাই মেয়ে ছিলেন। আমেরিকায় সে কো-এডুকেশন স্কুলে পড়েছিল তা ঠিক, কিন্তু ছেলেদের সাথে তেমন বন্ধুত্ব হয়নি। জনি নামের একটা ছেলের সাথে তার কিছুটা ভাব ছিল, যে তাকে স্কুলে বিভিন্নভাবে সাহায্য করত। দেশে আসার পর জনির সাথে আর কখনো যোগাযোগই হয়নি। তার জীবনে সবচে কাছ থেকে দেখা পুরুষ হল তার বাবা। কিন্তু জয়ন্ত নামের এই ছেলেটিকেও তার খুব আপন লাগছে। তনয়ার মোটেই মনে হচ্ছে না এই ছেলেটি তার কোন ক্ষতি করবে। সে দুই হাত প্রজাপতির মতো মেলে দিয়ে গানের মতো সুর করে বলল,
-Be my friend, O butterfly
I will be your friend, I never tell a lie.
গ্রামে এসে তার খুব আনন্দ হচ্ছে। সে আরও দুই লাইন গাইল,
-Be my friend, O dear dove
It’s my vow, I will give you love.
শেষের লাইন দুটি তার পছন্দ হল না। সে মনে মনে ছন্দ কাটাকুটি খেলা খেলতে শুরু করেছে। এই দুটা লাইন কেটে দিয়ে সে নতুন করে ভাবছে। ভাবনা শেষ হবার আগেই জয়ন্ত ফিরে এল। তার হাতে এক গ্লাস লেবুর শরবত।
(চলবে)
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন