সবকিছু ঠিকঠাক করে রেখেছিলাম রাতেই। সকালে শুধু চাদর আর কিছু বোচকাবুঁচকি নিয়ে মঠ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। সারাদিনে কতবার হেঁটেছি, নেমেছি গরুর গাড়ি থেকে, সাঁতার না জেনেও নৌকায় চড়েছি তার ইয়ত্তা নেই। সন্ধ্যা নেমে আসায় আপাততঃ এক সরাইখানায় বসত গেড়েছি; ঠকঠক করে শীতে কাঁপছি আর লিখছি। কত দিন পর নামলাম রাস্তায়!
শুরু থেকেই বলা যাক।
বঙ্গে সুলতানাত শুরু হবার পর আমরা- মানে আমি আর লোহিতলাল- দুজনে গৌড়ে চলে আসি। লোহিতলালের শরীর তখন খুব খারাপ, কালোজ্বরে ভুগে ভুগে তার সেই প্রমত্ত জোয়ান শরীর কঙ্কালসার হয়ে পড়েছে। বহু চিকিৎসক এসে চেষ্টা করলেন, ওষুধ দিলেন, কিন্তু কোন উন্নতির লক্ষণ দেখা গেল না। চোখের সামনে আমার বাবা, আমার মা, আমার শিক্ষাগুরু, আমার পরিবার- আমার একমাত্র বন্ধু লোহিতলাল মরে যেতে লাগল। আমার ভেতরটা কেমন যেন দুমড়ে মুচড়ে অবশ হতে যেতে থাকে। একদিন রাতে লোহিত আমাকে শিয়রের পাশে ডাকল। বরাবরের মতই- 'বাপজি' সম্বোধন করে।
তার হলদে চোখের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আমি শুনি, সে ভেজা গলায় বলে যাচ্ছে- ''বাপজি, মন খারাপ করে না। আপনিও জানেন, আমিও জানি, আমি মরে যাচ্ছি। আমার দায়িত্ব ছিল আপনাকে দেখে শুনে রাখার, ঈশ্বর জানেন সেই কাজে আমি কোন ক্রুটি করি নি। কিছু সম্পদ আছে আপনার জন্যে, আমি ঘরের কোণে খুঁটির পাশে গর্ত করে সেগুলো রেখে দিয়েছি। আপনি নিয়ে নেবেন। ওখানে একটা পাঞ্জা আছে, ত্রিপুরার মহারাজের কাছে আপনি যাবেন, দেখাবেন পাঞ্জাটা। উনি আপনাকে চিনে নেবেন। আর বাপজি, কথা দিন, আমার চিতায় আপনি আগুন দেবেন। কথা দিন বাপজি...'' আমার হাত শক্ত করে ধরে লোহিত বলতে থাকে, 'দেবেন তো বাপজি? আমার আর কিছু চাই না...', ক্রমশ তার কথা অস্পষ্ট হয়ে আসে, বিড়বিড় করে মুখটা নড়তে থাকে শুধু।
সকালের আলো ফোটার আগে লোহিত রক্তবমি করতে করতে মারা গেল। আমি কিছু করতে পারলাম না, স্রেফ মাথা চেপে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। পাগল পাগল লাগছিল নিজেকে। নগরের শেষপ্রান্তে একটা বিষ্ণুমন্দির ছিল, তার কাছে বিষ্ণুভক্ত লোহিতকে চিতায় শোয়ানো হল। আগুন দিলাম আমি। সেই আগুনে লোহিতের সাথে সাথে আমার ঘোলাটে অতীত পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
লোকটা সহজে বলতে চাইত না কিছু। চাপাচাপি করে এটুকু বের করেছিলাম- আমি খুব সম্ভব ত্রিপুরার মহারাজের অসংখ্য জারজ বংশধরদের মাঝে একমাত্র জীবিত সন্তান। মা ছিলেন অন্তঃপুরবাসী সাধারণ দাসি, মহারাজের যখন-খুশি-তখন ভোগ্য এবং তারপর ছুঁড়ে ফেলার বস্তু বিশেষ। সেই দাসি তারই 'পবিত্র' বংশধারায় নতুন কলুষতা এনেছে শুনে তিনি স্বভাবতই খুশি হন নি। মা ও সন্তানের প্রাণনাশের আদেশ দিয়েছিলেন। লোহিত তখন অন্তঃপুরের সুরক্ষায় নিয়োজিত যুবক সৈনিক। সে আমাকে নিয়ে কোনভাবে পালিয়ে আসে। মা-কে বাঁচাতে পারে নি। আমি কতবার ভেবেছি- কেন একজন সম্ভাবনাময় সৈনিক তার জীবনের সবকিছু ছেড়ে রাজার অবৈধ সন্তানকে বাঁচাবে? নিরাপদ, প্রতিষ্ঠিত জীবন ছেড়ে এই অনিশ্চিত ভাগ্য বেছে নেবার কি কারণ থাকতে পারে? একই উত্তর এসেছে বারবার- লোহিত আমার মা-কে ভালবাসত। এই সত্য কখনো সে স্বীকার করেনি আমার কাছে। বলেছে- আমি তার মনিব। আমাকে দেখে রাখা তার কর্তব্য। তার একমাত্র দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমাকে কখনো 'বাবা' বলে ডাকতে দেয় নি। আপন প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবেসেও বলে নি- এ আমার ছেলে। নাকি ভুল বললাম? মৃত্যুতে আমরা কি বাপ-ছেলে হয়ে যাইনি? ছেলেই কি বাপের চিতায় আগুন দেয় না?
লোহিতকে মা-র কথা জিজ্ঞেস করতাম। ও মুখ বুজে থাকত। মা ওর কাছে শেষ আকুতি করেছিলেন- ছেলে যেন তার হতভাগী মায়ের পরিচয় না জানে। এ কথা ভাবেন নি- ছেলে যখন বড় হবে, তার পায়ের নিচে কোন মাটি থাকবে না। আঁকড়ে থাকার মত কিছু থাকবে না। নিঃসঙ্গতা তাকে কুড়ে কুড়ে খাবে। হয়তো ভাবার সময় পান নি, আক্ষরিক অর্থেই মাথার ওপর খড়গ ঝুলছিল যে তখন!
খুঁটির কাছে একটা হাঁড়ি পুতে রেখেছিল লোহিত। ভেতরটা দেখে চমকে গেলাম। দুই মুঠো স্বর্ণমুদ্রা, কিছু তাম্রমুদ্রা, আর লাল মখমলের থলেতে একটা পুঁতির মত চকচকে উজ্জ্বল বস্তু। হীরে! পালিয়ে আসার আগে বুড়ো কোষাগারেও ঢুঁ মেরে এসেছিল তাহলে! মুদ্রা গুলো হাতে নিয়ে আমি ভাবছিলাম- ত্রিপুরায় ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। লোহিত ঘোরের মাঝে প্রলাপ বকছিল। মহারাজ কবে মরে গিয়ে নতুন রাজা এসেছে সিংহাসনে। পাঞ্জা দেখালে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে সানন্দে গুম করে ফেলবে। আর যদি কিছু বুঝতে না পেরে ভাবে, পুরনো সৈনিকের কোন বংশধর এসেছে কাজ চাইতে, চাকরিতে ঢুকিয়ে দেয় - তাতেই বা কি? সারা জীবন কারুর গোলামি করি নি, এখন কেন করব? তারচে এই সম্পদ নিয়ে আমি বিশাল জায়গা কিনতে পারি। নিজের জমিদারি। বাপ ছিল মহারাজ, বেটা তাও তো জমিদার হবে! একটা বিয়ে করতে পারি। স্ত্রী, সন্তান, একটা পরিবার- খুব বেশি কি চাওয়া হয়ে যাচ্ছে? একা থাকলে একদিন পাগল যে হয়ে যাব না তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
কিন্তু পথের পথিককে আপন করে নেবে কে? কার দায় পড়েছে? শিকড়হীন মানুষ শিকড় গজিয়ে বসতে গেলেই ঝড়ের আবির্ভাব ঘটে। উপড়ে ফেলতে চায়। টাকা নিয়ে কিছু করতে যাব- লোকে ভাববে, কোত্থেকে এলো এই মহাজন? ইতিহাস ঘাঁটতে আসবে। গুজব, বলাবলি-কানাকানি, তারপর একথা সেকথায় কুকথা রটবে। তারপর প্রাণসংশয়ের ভয়। ঘুরে ফিরে একই প্রসঙ্গ এসে যাচ্ছে। লোহিত নেই, আমার কোন বন্ধনও নেই। পড়ে থাকলে কেউ ধরবে না, মরে গেলে কেউ খুঁজবে না। কিন্তু টাকা-পয়সা আছে প্রকাশ হলে ঠিকই ক্ষতি করতে এগিয়ে আসবে। তার চেয়ে ভাল আমি ছেড়ে যাব এই কুৎসিত লোকপদ।
লোহিত আমাকে অশিক্ষিত করে রাখে নি। আমার বয়েসি যুবকেরা যখন অস্ত্রচালনা শেখে, আমি তখন শিখেছি বালুঘড়ি দিয়ে লগ্ন কিভাবে নির্ণয় করে। বাকিরা যখন স্থূলরসকাব্য পড়েছে, আমি পড়েছি চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, পঞ্চসিদ্ধান্তিকা, ব্রাহ্মস্ফুট; গঙ্গাপাড়ে বসে শ্রীমজুমদারের কাছে আদি সন্ধ্যাভাষা শিখেছি, উদয়নালার অনুচ্চ টিলার ওপরে বসিয়ে আলিরাজা আমাকে গুপ্তগণিত হাতে ধরিয়ে ধরিয়ে দেখিয়েছেন, পান্ডুয়ার বাজারে শ্রীধর প্রয়োগ করে বুঝিয়েছেন নীতিবিদ্যা আর কূটবিদ্যার গোপন সূত্রগুলো কেমন করে কাজ করে। তাদের সবাই বিদ্যার্থী হিসেবে আমার প্রশংসা করেছেন। এগুলো শুরু থেকেই আমাকে খুব টানে। মনে হয় যেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের লুকোনো ধ্রুব বাস্তব সত্যগুলো ভেসে উঠছে চোখের সামনে, নিজেদের প্রকাশ করছে। এদের মাঝে কোন জটিলতা নেই, কোন ছলাকলা নেই। জীবনে আর কোন পিছুটান যখন রইল না, তাহলে আমি এই বিশুদ্ধ বিদ্যাসাধনাই করি! প্রাচীনকালে মহর্ষিগণ মনোবাঞ্ছা পূরণে জনহীন প্রান্তরে, গিরিশিখরে গিয়ে ধ্যান করেছেন, তাদের সাধনায় তুষ্ট হয়ে এসেছেন দেবতাগণ, দেখা দিয়েছেন, ভক্তের ইচ্ছে পূরণ করেছেন। আমার ইচ্ছেও তো পূরণ হতে পারে!
এই ভেবে দু'দিনের মাঝে গুছিয়ে ফেললাম সবকিছু। ঘরটা বিক্রি করে, লোহিতের ব্যবহার্য সবকিছু বিলিয়ে দেবার পর আমার কাছে থাকল দুটো পরার কাপড়, শ্রীধরের একটা পাণ্ডুলিপি, আর হীরে-মুদ্রাগুলো। একা চলাচলে জান-মালের ভয় থাকে বলে একটা তীর্থযাত্রী দলের সাথে ভিড়ে গেলাম। উদ্দেশ্য- মহাস্থানের মঠগুলোর কোনটায় আশ্রয় নেওয়া। প্রাক্তন শিক্ষকরা বলেছিলেন, সেখানে মহাবীর আর ভাস্করাচার্যের মতো মনিষীদের বিদ্যা পড়ান হয়। যাত্রাপথে ডাকাতের হামলায় পড়লাম কয়েকবার, ঈশ্বরের কৃপায় প্রতিবারই তাদের হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম। ওরা আশা করে নি আমাদের কাছে এত অস্ত্রশস্ত্র থাকবে, আমরা এত প্রস্তুত থাকব। তিনজন মারা পড়ল বর্শার ঘায়ে, কিন্তু বিনিময়ে আমরা ডাকাতদের আদ্ধেক শুইয়ে দিলাম। জীবনে প্রথম বর্শা ছুঁড়তে শিখলাম ওদের সাথে থেকে। কে জানত, তীর্থযাত্রীরা এরকম বর্শা ছুঁড়তে পটু হয়!
একটানা ভ্রমণে কুড়ি দিনের মাথায় পৌঁছে গেলাম মহাস্থানে। তীর্থযাত্রীদের প্রধান নীলমণি বারবার অনুরোধ করল তাদের সাথে থেকে যেতে। আমি পরিবারের বন্ধনহীন শুনে বোধহয় খুব মায়া হয়েছিল লোকটার। পুরোটা সময় একেবারে পাশাপাশি রেখেছে আমাকে, কোন ক্ষতি যেন না হয় এই ভেবে। কিন্তু আমি কিভাবে থাকব ওদের সাথে? ভেতর থেকে কোন সায় পাচ্ছিলাম না। যে উদ্দেশ্যে বেরিয়েছি, তা কি অপূর্ণ থেকে যাবে? পিছিয়ে যাব? অনুরোধ করার সময় নীলমণির ক্ষুদে মেয়ে কমলা বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে রইল। এইটুকুন মেয়ে, এর মাঝে কোন জড়তা নেই! সবার সাথে টুকটুক করে কথা বলে, এর-ওর তাঁবুতে গিয়ে ইচ্ছেমত গল্প জুড়ে দেয়, যখন তখন। অদ্ভুত সাবলীল ভঙ্গিমায়। আমার সাথেও ভাব করে নিয়েছিল খুব। ভেবেছিলাম ও হয়তো থাকতে বলবে। কাছে গিয়ে বললাম, 'বোনটি, সময় তো ফুরোলো, এবার আসি?' শুনে নিরুত্তর, সোজা গিয়ে বাপের কোলে উঠে ঠোঁট ফুলিয়ে বসে রইল।
মঠের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে একবার পিছু ফিরে তাকালাম। বাকিরা এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বাপ বেটী দুজনেই তাকিয়ে আছে ব্যথিত চোখে। কি মায়া, আহা কি মায়া! ঈশ্বর এমনভাবেই ভাগ করে দেন এই মায়া, কেউ দুদিনের অচেনা যুবক-কেও আপন করে নিতে পারে, আবার কেউ নিজের ঔরসজাত সন্তানকেও মেরে ফেলার আদেশ দিতে পারে! তার খেলা, তার রসিকতা বোঝা ভার।
মঠে ঢুকতে বাধা পেলাম না কোন। স্বাভাবিক। মঠে আশ্রয় নিতে পারে যে কেউ, মানা করার নিয়ম নেই। কিন্তু আমি এসেছি বিদ্যালাভের জন্যে। মঠপ্রধানকে খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম এক সময়। অতি বৃদ্ধ একজন মানুষ, আশ্চর্য ভারি গলায় কথা বলেন, হাত দুটো সবসময় হাঁটুর ওপরে রাখা; পরনে মোটা কাপড়ের খসখসে আলখেল্লা। চোখ দুটো অদ্ভুত উজ্জ্বল। কথা হল। সব শেষে ঠিক হল তারা আমাকে শিক্ষা দেবেন, কিন্তু মঠের কোন নিয়মকানুন ভাঙতে পারব না। ভাঙলে কোন কথা না বলে বেরিয়ে যেতে হবে। আমার এতে কোন আপত্তি ছিল না। হীরের কথাটা গোপন রেখে বাকি মুদ্রাগুলো জমা রেখে দিলাম তার কাছে। শুরু হল আমার স্তব্ধ, প্রশান্তময় এক জীবন, যেখানে থেমে থাকে সময়। বয়ে চলে শুধু জ্ঞান আর আত্ননুসন্ধানের একক, শুদ্ধ ধারা।
সকালে উঠে জল আনতে যেতাম কাছের ছড়া থেকে। আদিগুরু, অর্থাৎ মঠপ্রধান, তখন ধ্যানে বসতেন। বাকি সাধুদের কেউ তখন বই নকল করছেন, কেউ কালি প্রস্তুত করছেন, কেউ হাঁটতে হাঁটতে বাইরে থেকে শাকসবজি তুলে আনছেন। নিরামিষ ছাড়া অন্য কিছু খাওয়া ছিল নিষিদ্ধ। একটু পর তার ধ্যান ভাঙত। উত্তরের বাতাস এসে নাড়িয়ে দিচ্ছে বুড়ো অশ্বত্থ গাছের ডালপালা, শনশন মৃদু শব্দ হচ্ছে চারপাশে; আর তার নিচে, ঝকঝকে আকাশের নিচে, নরম উর্বর মাটি-ঘাস-দূর্বার মাঝে যোগাসনে বসে এদের সবার চেয়ে বৃদ্ধ এক মানুষ গমগমে কণ্ঠে বলে যাচ্ছেন মহাকালের কথা, মহাবিশ্বের কথা। যেখানে কোন কুটিলতা নেই, হিংসা-বিদ্বেষ নেই, শুধু আছে খোলা মাতাল হাওয়া আর যুক্তি-বিশ্বাস-বুদ্ধির এক অদ্ভুত মেলবন্ধন, আর হৃদয়ের ভেতরে ক্রমশ প্রবল হতে থাকা আত্মপ্রশান্তির অস্তিত্ব। সেখানে, সেই মঠের মাঝখানে বসে থেকে মনে হত আমার ভেতরে হতাশাবাদ ঘুচে যাচ্ছে; অজানাকে জানার ইচ্ছে আরও ধারাল, প্রবল হয়ে উঠছে। আমি এদের মাঝে কোন এক জায়গায় নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি। নিজের অস্তিত্বের সার্থকতাকে খুঁজে পাচ্ছি।
সকাল থেকে রাত নেমে আসার আগপর্যন্ত আমি সাধুদের কাছে পড়তাম। কয়েক বছর পর তারা বললেন, তোমার ভিত্তিজ্ঞান হয়েছে, এবার প্রয়োগে-ভাবনাকল্পে সেই জ্ঞান প্রয়োগ কর। দায়িত্ব নাও। মঠের পুঁথিগার আমার জন্যে তারা উন্মুক্ত করে দিলেন। তারপর, ঈশ্বর! হাতে যেন সাত রাজার ধন পেলাম। পুঁথিগারের কাষ্ঠশরীরের তাকে তাকে অসংখ্য প্রাচীন তুলোট কাগজ গোল করে কুন্দপুরের নরম কাপড়ে জড়িয়ে রাখা হয়েছে। স্বর্ণযুগের গল্প সেখানে লেখা, বিশুদ্ধ মানুষের কথা সেখানে লেখা; শীলভদ্রের নিজ হাতে রচিত পাণ্ডুলিপি দেখলাম এক কোণে। ভাস্করাচার্যের লীলাবতী, মহাবীরের অঙ্কশাস্ত্র, কৌটিল্যের তর্কবিদ্যা- সব সেখানে নকল করে রাখা আছে। বাকি সাধুরা এসব অমূল্য কাগজ-পুঁথি নিয়ে খুব সাবধানে নাড়াচাড়া করতেন, আর নতুন কাগজে নকল করে রাখতেন লেখাগুলো। কিন্তু এদের ভেতরের বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করার চিন্তা তাদের মাথায় আসেনি। তারা স্মৃতি ধরে রেখেছেন, কিন্তু তার যথাযথ ব্যবহারের দায়িত্ব নেননি। সেই পুঁথিগারে কালির অবোধ অসীম কালো ঘ্রাণ আর হলদে নরম কাগজের শব্দহীন বিহ্বলতার মাঝে দাঁড়িয়ে মনে হল- এমন সম্পদের সদ্ব্যবহার না করাও কি পাপ নয়?
পুঁথিগারে শুধু দেশি মনিষীদের লেখাই নয়, আরও ভিনদেশি মানুষের লেখাও ছিল। এদের নিয়ে পড়ালেখা করতে করতে এক আশ্চর্য জিনিস আবিষ্কার করলাম। প্লাতো আর আরিস্ততল নামক দুজন মনিষীর কথা লেখা আছে, তারা বলছেন, ''যেহেতু মানবের দৃষ্টিসীমা নির্দিষ্ট, এই কারণে ভ্রমণ ব্যতিত পৃথিবীর সঠিক দৈর্ঘ্য নির্ণয় করা অসম্ভব। আকাশে অসীম নক্ষত্র দেখতে পাই, এবং তাহারা স্থির। অথচ সূর্য চন্দ্র স্থান পরিবর্তন করে। সুতরাং সূর্য চন্দ্র ব্যতিক্রমী, উহারা গতিশীল। পৃথিবী, অন্যান্য নক্ষত্রের মতই, স্থির।''
তারপর ভাস্করাচার্য লিখেছেন 'লীলাবতী'-তে, ''কন্যা আমার, অনুধাবন কর পৃথ্বীর বিশালত্ব। দেখ, নদী-সাগর- মহাসাগরের অজস্র অবাধ জলরাশি কোথা যায়, ফিরিয়া আসে কি আসে না। উহা সমতলে বহে, গহ্বরে হারায়ে যায়, এবং ঈশ্বরের কৃপায় পুনরায় ফিরিয়া আসে। পশ্চিমে সূর্য থাকিলে পূর্বে চন্দ্র থাকিবে, ইহারা জলরাশি নিয়ন্ত্রণ করে, জল সচল বলিয়া ইহারাও সচল।''
সবশেষে মহাবীর বলছেন, 'মহাসর্প যেমন আপন লেজ ভক্ষণ করিতে করিতে একসময় শূন্যে অদৃশ্য হইয়া যায়, তেমনি পৃথ্বী ও তার সঙ্গীগণ একসময় গোলক হইয়া মিলিয়া যাইবে। যতদিন ইহা সমতল আছে, ততদিন ইহার অস্তিত্ব আছে। আদি কখনও অন্তকে ধরিবে না। অন্ত কখনো আদিতে বিলীন হইবে না। ইহাই পরম সত্য, ইহাই গণিতের সত্য।'
তিন যুগের তিন মনিষী, কিন্তু সবাই পৃথিবী নিয়ে কথা বলছেন, প্রমাণ করছেন তাদের তত্ত্ব দিয়ে। পৃথিবী স্থির, পৃথিবী সমতল, পৃথিবীর দৈর্ঘ্য অসীম নয়। তারমানে পৃথিবীর শেষ আছে। শুরু আছে। এই একটি কথা আমার মাথার ভেতরে অবিরাম ঘুরপাক খেতে শুরু করল। তাহলে শুরুটা কেমন? শেষটা কেমন? কেউ কি দেখেছে আদি- অন্ত? কৌতূহল বাড়তে লাগল ক্রমান্বয়ে। এর আগে সাধারণ মানুষ যতটুকু জানে আমিও ততটুকু জানতাম। আমাদের পূর্বে মাটি, পশ্চিমে মাটি, উত্তরে মাটি। সেখানে কতিপয় আদিম জাতি আর অসভ্যদের বাস। হিংস্র প্রাণীরা থাকে। আর আছে জালের মত ছড়ানো নদী-খাল-বিল। দক্ষিণে শুরু হয়েছে মহাসমুদ্র, যার আদি আছে কিন্তু কোন অন্ত নেই, অন্ত মিশে গেছে অসীমে। সেখানে ঢেউ ওঠে পাহাড়সমান হয়ে, তারা লুকিয়ে রাখে সমুদ্রের গুপ্তধনকে, গ্রাস করে নেয় লোভীদের। কিন্তু পৃথিবীর অন্ত থাকলে নিশ্চয়ই এই মহাসমুদ্রেরও অন্ত আছে? জিজ্ঞেস করতে লাগলাম সাধুদের। তারপর আদিগুরুকে। কিন্তু এই প্রথম বারের মতন তার দার্শনিক উত্তর আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারল না। আমার আসল উত্তর চাই। বাস্তব উত্তর চাই। কিন্তু, উত্তর দিতে পারল না কেউ। এক সময় বুঝতে পারলাম, এর জন্যে মঠে থাকলে চলবে না। যেতে হবে সমুদ্রের কাছে। নিশ্চয়ই সেখানে কেউ আছে, যে আমার মতই এই ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছে? কয়েক দিন বসে ব্যাপারটা ভালমত চিন্তা করার পর ব্যাপারটা মঠপ্রধানের কাছে খুলে বললাম। শুনে তিনি নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ আমার দিকে, যেন এই কথা বলে আমি বিশাল কোন ভুল করে বসেছি। তারপর, চোখে তীব্রতা নিয়ে বেশ কিছু তথ্য দিলেন। বঙ্গের দক্ষিণে একটা সমুদ্র বন্দর আছে 'সাতগাঁ' নামে। সেখানে পশ্চিম থেকে আগত ভিনজাতির মানুষ ব্যবসা করে। অদ্ভুত অসাধারণ সব জিনিস কেনাবেচা হয়। তাদের বিশাল বিশাল জাহাজ বায়ুবেগে চলতে পারে, ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তারা সমুদ্র চষে বেড়ায়। এই কথা শুনে আমার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। তবে সেই সমুদ্র বন্দরেই যাব। তাদের সাথে কথা বলব, দরকার হলে আস্ত একটা জাহাজই কিনে নেব- তারপর রওয়ানা দেব দক্ষিণে। খুঁজে বের করব মহাসমুদ্রের আর এই পৃথিবীর শেষ প্রান্ত!
আমার এমন হঠাৎ বেপরোয়া উৎসাহে নিজেকেই কেমন আশ্চর্য জীবন্ত মনে হচ্ছিল, কিন্তু আদিগুরুর মাঝে কোন বিচলতা দেখা গেল না। তিনি যা বললেন তার সারমর্ম এরকম- 'মহাবিশ্বের সবকিছুকে একটা না একটা উদ্দেশ্য নিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। কেউ সেটা খুঁজে পায়, কেউ পায় না। হয়তো আমার উদ্দেশ্য এটাই- অজানায় পাড়ি জমানো। যদি তাই হয়, তাহলে আমাকে সাহায্য করা তার কর্তব্যের মাঝে পড়ে। আমি যেন সাতগাঁ বন্দরে গিয়ে খোদি আপ্পার সাথে যোগাযোগ করি আর বলি- মহাস্থানের মঠপ্রধান পাঠিয়েছেন। তাহলে সব ব্যবস্থা উনিই করে দেবেন।
শুনে আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'মহর্ষি, আপনি অতো দূরে সাতগাঁ-র মানুষ চেনেন কি করে?'
আদিগুরুকে সেই প্রথম আমি হাসতে দেখি। নিশ্চুপ, বিষণ্ণ হাসি। তিনি বলেছিলেন, 'বাছা, প্রজাপতি সারাজীবন প্রজাপতি থাকে না, আমিও সারাজীবন এই মঠে ছিলাম না। তুমি সাবধান থেক। জাহাজ টাহাজ আসলেই কিনলে, আপ্পা বাদে আর কাউকে হীরের কথা বোলো না। নিজের ওপরে বিশ্বাস রেখ। যাত্রা শুভ হোক।'
এই বলে তিনি আবার ধ্যানে বসে চোখ মুদলেন। আমি বাকশূন্য হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। উনি হীরের কথাও জানতেন!
আর, তারপরের কথা তো বললামই। এখন আছি সাতগাঁ থেকে একটু দূরে, নিশ্চিন্তপুরে। সকালে বের হলে কদিনের মাঝে বন্দরে পৌঁছে যাব। দেখা যাক!
তাং- ১৫ই পউষ
ভ্রমণের ওপরেই আমার জীবনের সিংহভাগ কেটেছে। গৌড়ের রংচঙে আলো জমজমাট মহানগরের গলিতে গলিতে ঘুরেছি, পুণ্ড্রের অনাহারে ভোগা মানুষের বস্তি দেখেছি, থেকেছিও সেখানে। কিন্তু কুৎসিত বীভৎস নোংরামি আর আভিজাত্যের এমন মায়ামাখা ক্লান্তিহীন ভ্রম আর কোথাও চোখে পড়ে নি। সাতগাঁ শহরে ঢুকতেই চোখে পড়ে নানা এলাকার আয়েশি ব্যক্তিদের তাঁবু; জাঁকজমকপূর্ণ অস্থায়ী বাসস্থান, তার চারপাশে দেখা অদেখা রং বেরঙের অসংখ্য ভোগ্যবস্তুর বাজার। দেশি বিদেশি খাবার, চটকদার খেলনা বস্তু, আকর্ষণীয় কাপড়, যৌনাবেদনময়ী নারী- চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে সব কিছুই। বাজার কেন্দ্র করে তাঁবু টানান হয়েছে নাকি তাঁবু কেন্দ্র করে বাজার বসেছে বলা শক্ত। নাবিকদের বৈঠকখানা দেখা যায় মাঝে মাঝে। নুয়ে পড়া ন্যাকড়ার মত শামিয়ানার নিচে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি নিয়ে বসে আছে সব। অনেকের মাড়ি বিষাক্ত রক্ত-পুঁজে ফুলে আছে, কোমরের ছুরি দিয়ে মাড়ির এখানে ওখানে কেটে কেটে সেই পুঁজ বের করছে। হাতপায়ে অসংখ্য ফোসকা, নখগুলো ফাটা, শরীর থেকে ইঁদুর, নোনাজল আর পচা পাটের গন্ধ বেরুচ্ছে। এক হাতে চোলাই 'হাঞ্চু' মদের পেয়ালা, আরেক হাতে শোভা পাচ্ছে বটফলের মতন লাল গাল নিয়ে বিস্রস্ত কাপড়ের খুচরো বালিকা। মোমবাতির আলোতে অসংলগ্ন হাসি, পেয়ালার টুংটাং, গালাগালি, চিৎকার, সেঁকো কেরোসিনের ঘ্রাণ- সব মিলে অন্য এক জগত যেন ছিটকে বেরুচ্ছে ভেতর থেকে। এই পাপের জলসা ছাড়িয়ে কিছুদুর এগোলে রূপোপজীবিনী-দের আস্তানা। এখানে গরিবেরাই কেবল সরাসরি আসে, ধনীরা দেখলাম দূত পাঠিয়ে একেবারে পাঁচ-সাত জনকে নিয়ে যায় তাঁবুতে। মেয়েগুলো ছেঁড়া কাপড় পরেই নানা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ততঃ এই একটি পেশায় দারিদ্রতা ওদের সহায়ক হয়ে উঠেছে! ঠোঁটে রং, শরীরে সুগন্ধি, চাবি দেওয়া পুতুলের মতন। এদের দেখলে কামনা জাগে না, কান্না পায় বরং। আমি মাথা নামিয়ে কাটিয়ে যাচ্ছিলাম ওদের, কিন্তু তবুও একজনের ওপর চোখ পড়ে গেল। মেয়েটার চেহারা অন্যরকম, কিন্তু কেন যেন আমার কমলার কথা মনে হতে লাগল বারবার। জোরকদমে পা চালিয়ে চলে এলাম সেখান থেকে।
এ গেল বাইরের চেহারা। ভেতরের চেহারা অন্যরকম। সমুদ্রের পার ঘেঁষে সারি সারি বস্তি। সৈকতে শুকোতে দেয়া আছে জাল। সেলাই করছে দুতিনজন। একেকটা পল্লীতে একেক রকম মানুষ, কিন্তু মিল এক জায়গায়- এরা সবাই প্রতিটা দিন সমুদ্রের সাথে জীবনবাজি রাখে। কাঠের নিতান্ত ভঙ্গুর নৌকোয় জাল নিয়ে বহুদূর চলে যায়, সংগ্রহ করে আনে বাঁচার উপাদান। ফিরে আসে না প্রায়ই। সমুদ্র এদের মা, খাদ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে। সমুদ্র এদের খুনি, দুঃসাহস দেখালে গ্রাস করে নেয় অতর্কিতে। কিন্তু কোন অভিযোগ নেই কারুর। এ-ই যেন স্বাভাবিক!
বন্দরটা বিশাল। দুটো জাহাজ দেখলাম। দূরে নোঙ্গর ফেলে ভাসছে আরও সাত-আটটা। আর অসংখ্য নৌকা। ডিঙ্গি, সাম্পান, বজরা, পানসি, কোষা, নাম না জানা আরও কতগুলো- এত ধরণের নৌকো আমি সারা জীবনেও চোখে দেখিনি। বন্দরে কিছুক্ষণ একে ওকে জিজ্ঞেস করার পর আপ্পার খোঁজ মিলল। বিলাসবহুল এক পানসি নৌকায় বসে রোদ পোহাচ্ছিল। লোকটা ষাট পেরিয়েছে, ধনী; কাপড়-চোপড়, চেহারার ধাঁচ তাই ইঙ্গিত করে। বিরক্তমুখে কে-বাপু-এই-ভরদুপুরে-এসেচ ভঙ্গিমায় কিছুক্ষণ শুনল আমার কথা। যখন মঠপ্রধানের কথা তুললাম, বললাম আমার উদ্দেশ্যের কথা- তখন তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। 'শ্বেত পাঠিয়েছেন তোমাকে? কেমন আছেন উনি? তুমি, তুমি উনার কেউ হও নাকি?'
আমি সময় নিয়ে খুলে বললাম সব।
'আচ্ছা! লোকটার সমুদ্রপ্রেম যায় নি এখনও!', হোহোহো করে হেসে উঠল আপ্পা, 'যাকগে। ঠিক লোকের কাছেই এসেছ। আমি বলে রেখেছিলাম, তার ছেলে বা নাতি- সমুদ্রের ডাক শুনে যেই আসুক-আসতেই হবে, রক্তের টান- তাদের দেখাশোনা করার মর্যাদাটা যেন আমাকে দেওয়া হয়। তা উনি তো মঠেই ঢুকে গেলেন, আমিও আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। তুমি এসেছ, অনেক খুশি হয়েছি বাবা। বোসো বোসো।'
আমি কৌতূহল সামলাতে পারছিলাম না। 'আপনি ওনাকে কতদিন ধরে চেনেন? কি করতেন উনি?'
-'শ্বেত? শ্বেতের কথা বলতে গেলে সারা জীবন লেগে যাবে বাবা। কত দিক থেকে তার কাছে আমি ঋণী, জানো না। পুরনো নাবিকদের কাছে শুনেছি উনি এখানের মানুষ নন। কিশোর বয়সে এসে নৌকোয় জেলের কাজ নেন। একা থাকতেন, একা খাটতেন। যুবক হতে না হতে তার সাহসের কথা ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। তখনই তিনি এইটুকুন ছিপ নৌকো নিয়ে দশ বারো ক্রোশ দূরে চলে যেতেন মাছ ধরতে। আবার নৌকোভর্তি করে ফিরেও আসতেন প্রতিবার।'
আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না, 'ছিপ নৌকায় করে?!'
-'হুম, বোঝো তাহলে। তারপর ধীরে ধীরে দূর দূরান্ত থেকে বিশাল জাহাজে করে ভিনদেশিরা এলো। বন্দর হোল। কিন্তু একপাশে উপকূল রেখে জাহাজ চালাতে গেলে বিপদ অনেক। জলদস্যুদের প্রকোপ বেড়ে গেছে তখন। এরা ইচ্ছেমতন খুনখারাপি লুটতরাজ চালাত। বাণিজ্যের ক্ষতি হতে লাগল। এমন সময় শ্বেত ওদের একটা জাহাজ চালান শিখে দায়িত্ব নিয়ে ফেললেন। লোকটা অদ্ভুত চালু ছিল, জানো, যে কারো সাথে ভাব জমিয়ে ফেলতে পারত। আমি তখন তার জাহাজে নতুন কাজ নিয়েছি। বারো বছর বয়েস কেবল। কি যে রোমাঞ্চ লাগত খোলা সমুদ্রে! আর লোকটাকে মনে হতো ঈশ্বর প্রেরিত পুরুষ, সমুদ্র স্বয়ং যাকে সমীহ করে', লোকটার চোখে স্মৃতিকাতরতা দেখি আমি, 'যাই হোক, শ্বেত নতুন এক পথ বের করলেন। বিশ ক্রোশ দক্ষিণে একটা দ্বীপ ছিল, তিনি সেটাকে পেরিয়ে দুক্রোশ ঘুরে ভিনদেশিদের দেশে যেতেন। এতে কি হল, জাহাজের টিকিটি-ও কেউ খুঁজে পেত না। কেউ ভাবেই নি এত দূরে গিয়ে খোঁজ করার। এভাবে দশটি বছর শ্বেত তার জাহাজ নিয়ে এদেশ ওদেশ ঘুরে বেরিয়েছেন, কোনোদিন তার মাঝে কোন ভয় সংশয় দেখিনি।'
'কিন্তু উনি সব ছেড়েছুঁড়ে মঠে চলে গেলেন কেন? কি হয়েছিল?'
-'জানি নে বাবা। আমি তখন নাবিকগিরি ছেড়ে ব্যবসার চেষ্টা করছি। অবশ্য গুজব শুনেছি, কিন্তু নিশ্চিত বলতে পারব না। শ্বেত নাকি নিষিদ্ধ এলাকা পার হয়ে দশ-বারো জন নাবিক নিয়ে সমুদ্রের শেষ খুঁজতে গিয়েছিলেন। মানুষ বলে, সমুদ্র এতে খেপে গিয়ে তাকে অভিশাপ দেয়। আকাশসমান উঁচু হয়ে ঢেউ নাকি পড়েছিল তাদের ওপর, রক্তবৃষ্টি হয়েছিল, পাতাল থেকে পাহাড় উঠে এসেছিল জাহাজ ভেঙেচুরে দিয়ে তাদের অভিযান থামাতে। যাত্রা শুরুর ছয়মাস পর শ্বেতকে পাওয়া যায় সৈকতে, ছিন্নভিন্ন কাপড় গায়ে, সারা শরীরে জখম হয়ে আছে। মৃত মানুষের সাথে নাকি কোন পার্থক্য ছিল না। কিন্তু তবুও বেঁচে যান কোনোমতে। আমি দেখতে যাই যখন, তখন তিনি দিনরাত প্রলাপ বকতেন। নরকের পাহারাদার নাকি তাদের সবাইকে মেরে ফেলেছে, তিনি নিজেও মরে গেছেন, আমরা কেউ আসলে বুঝতে পারছি না ইত্যাদি ইত্যাদি। সমুদ্রের গর্জন শুনে ভয় পেতেন। পানি দেখলে কুঁকড়ে যেতেন। তারপর একদিন হঠাৎ শুনি তিনি মহাস্থানে চলে গেছেন। এরপরে আর যোগাযোগ হয়নি।'
আপ্পা এতগুলো কথা বলে ক্লান্ত হয়ে গেছেন যেন। একটু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, 'তুমি হয়তো শ্বেতের রক্ত নও, তবু উনি তোমার মাঝে একটা কিছু দেখেছেন বলেই এখানে পাঠিয়েছেন। কিন্তু বুঝে নাও ব্যাপারটা। আমার জানামতে শ্বেতই একমাত্র মানুষ, যিনি সমুদ্রের অন্ত খুঁজতে চেয়েছিলেন। তার ভাগ্যে হয়নি। পিঠে মৃত্যুর বোঝা নিয়ে তিনি সরে গেছেন। এখন তুমি এসেছ। হয়তো তোমার ভাগ্য আরও বিরূপ হতে পারে, নিজের প্রাণ হারাতে পারো। আর এমন অভিযান চালাতে গেলে অনেক টাকা প্রয়োজন। আমি ভার বহন করলেও, সবটুকু খরচ দেওয়ার সামর্থ্য রাখি না। তোমাকে আগে কয়েক বছর কাজ করতে হবে। জমাতে হবে টাকা। এই একটি অর্থহীন উদ্দেশ্যের পেছনে কাটিয়ে দিতে হবে নিজের জীবন-যৌবন। ভাবো, এতকিছুর জন্য প্রস্তুত আছ?'
আমি তখন ভাবছি আদিগুরুর কথা। লোহিতের কথা। এমনকি হীরেটার কথাও। ভাগ্যে না থাকলে এতগুলো বিষয় সমান্তরালে মিশে গিয়ে আমাকে নিয়ে এসেছে এখানে- এটা কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? আমি এসেছিলাম জানতে, সত্য খুঁজে বের করতে। এখন কাঁধে চাপল এক প্রাক্তন সমুদ্রবীরের অভিযান সামনে এগিয়ে নেবার ভার, সেই সাথে নতুন কিছু আবিষ্কার করার সম্ভাবনা। বিপদের ভয়ে, শঙ্কায় পিছিয়ে যাব? নাকি ঝুঁকিপূর্ণ, নিষিদ্ধ, কিন্তু রোমাঞ্চকর এক অভিযানে নাম লেখাব?
উত্তর খুঁজে পেতে বিন্দুমাত্র সময় লাগল না। 'প্রস্তুত আছি, ভদ্রে', সেলাইয়ের ভাঁজ থেকে হীরেটা বের করে আপ্পার হাতে গুঁজে দিতে দিতে বললাম আমি, 'আর অর্থ নিয়ে মোটেও চিন্তা করবেন না। ঠিক করেই এসেছি সব।'
আপ্পা হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন হীরেটার দিকে, তারপর আমার দিকে। অবশেষে সামলে নিয়ে হাসিমুখে বললেন, 'তুমি যে শ্বেতের কাছ থেকে এসেছ, ব্যাপারটা মনে করিয়ে দিচ্ছ বারবার। কোথাও না কোথাও একটা মিল আছে তোমাদের। এসো, শুরু করা যাক। অনেক কাজ পড়ে আছে সামনে।'
তাং- ২৩শে পউষ
এ কয়দিনে বুঝতে পারলাম, আপ্পার এখানে ভাল যোগাযোগ আছে। সপ্তাখানেকের মাঝে কাজ এগিয়েছে বেশ। বারো জন নাবিককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, আপাততঃ জাহাজ না থাকায় তারা কাছের এক সরাইখানায় বসে ঘোলা মদ গিলছে। খুশিতে কেউ জিজ্ঞেসও করে নি, কোথায় যেতে হবে। আপ্পা বললেন জাহাজ কিনতে হবে বুঝেশুনে, আগে কাপ্তান আর প্রকৌশলী খুঁজে পাওয়া দরকার। তারাই ভাল জাহাজ কোনটা বুঝে নিতে পারবে।
প্রকৌশলী একজন ছিল কাছেই। বন্দর থেকে অদূরে সমুদ্র ঘেঁষে একটা ছোট্ট কারখানার মতন আছে, নৌকা-জাহাজ সব সারান হয়। অশোক নামের মধ্যবয়েস্ক এক লোক কারখানাটা চালায়। আপ্পা বলছিলেন, পুরো শহরে ওর মতন দক্ষ মানুষ আর একজনও নেই। মাঝসমুদ্রে ঢেউয়ের ঝাপটার মাঝে কেউ যদি মাথা ঠিক রাখতে পারে, তাহলে এই অশোক-ই পারবে। লোকটা ভীষণ নাকউঁচু, উচ্চারণ আশ্চর্যরকম শুদ্ধ, আর কথার মাঝে বিদ্রূপের কোন অভাব নেই। সাতগাঁতে আছে বহুযুগ ধরে, অনেকে সন্দেহ করে এরা সবচে প্রাচীন বংশের ধারাগুলোর মাঝে একটি। প্রথমে কথাই বলবে না আমাদের সাথে, কারণ 'উন্মাদের সহিত ব্যবসা চলে না'; অশোক লোকমুখে আগেই শুনেছে আমরা কোথায় যাচ্ছি। তারপর জোরাজুরি করার পর আপ্পার দিকে তাকিয়ে বলল, 'জনাব, বহু বছর আগে আমার পিতা স্বয়ং শ্বেত-মহাশয়ের সাথে তার জাহাজে উঠেছিলেন। পরিবারে তখন বড় বলতে আমার জ্যৈষ্ঠ-জন, সে এমনকি কৈশোর পেরোয়নি। এমন সময় আমরা এতিম হই। ভাবতে পারেন কতটা কষ্টে দিন কাটিয়েছি? বহু পরিশ্রমে নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়েছি, একদিন এসে বলবেন আর অমনি ধেইধেই করে নাচতে নাচতে উঠে যাব জাহাজে, তা কি হয়?'
আপ্পা রাগলেন না, 'অশোক, তোমার বাবাকে ওই অভিযানের কারণে সমুদ্র গ্রাস করে নিয়েছে, মানলাম। তোমার দাদা কিভাবে মরেছিল?'
-'সমুদ্রে, ঝড়ের কবলে পড়ে। কেন? এর সাথে আমার দাদার কি সম্পর্ক?'
'আর তোমার দাদার বাবা? তার বাবা?'
-'কি বলতে চান আপনি? ওরা সবাই সমুদ্রেই মরেছে, কেউ মাটির স্পর্শ পায়নি, তাতে কি? বলছেন, আমাকেও ওভাবে মরতে হবে?'
'আমি স্রেফ বলছি, তোমাদের বংশের একটা গর্ব ছিল এই ব্যাপারটা। সমুদ্র দেখে কখনো ভয় পাওনি তোমরা। তোমার আদিপুরুষেরা কলাগাছের ভেলা নিয়ে সমুদ্রে নেমেছে, মাছ ধরেছে। এই শহরে তোমার দাদাই সবার আগে কাঠের ভেলা বানিয়েছিল, তোমার বাপ নৌকার চারকোণা পাল লাগান আবিষ্কার করে, আর তুমি ভিনদেশিদের বিশাল জাহাজ বানান দেখে কদিনের মাঝেই ওদের চেয়েও শক্তপোক্ত করে জাহাজ বানানো শিখে নিয়েছ। সমুদ্রকে কিভাবে পোষ মানান যায় তারই চেষ্টা করছ। জিনিসটা তোমার রক্তের মধ্যে আছে, অশোক!
-'আপ্পাজি, আপনি বুঝতে পারছে...
'আচ্ছা, তাহলে গত কুড়ি বছর ধরে নিজের কারখানায় যে একটা জলযান বানানোর পরিকল্পনা করছ, টাকার অভাবে পারছ না- সেটা কি মিথ্যে? আমি কি ভুল শুনেছি অশোক?
-'না, কিন্তু...
'তোমার বড়ভাই সংসার সাজিয়ে বসেছে, তুমি কেন এখনও বিয়ে কর নি? কেন পিছুটান রাখতে চাও না? কেন এখনও নৌকো নিয়ে একাকি চলে যাও সমুদ্রে? আমি জানি, এখনও তুমি সমুদ্রকে হার মানানোর কথা ভাব। হয়তো এতদিনের জীবনযুদ্ধে নিতান্ত কল্পনায় রূপ নিয়েছে তোমার স্বপ্ন, কিন্তু একটা সুযোগ এসেছে, অশোক! দ্যাখো, শ্বেতের নাতি এসেছে দাদার শেষ অভিযানকে সফল করতে, আমি এই বুড়ো বয়সে উঠেপড়ে লেগেছি- ঈশ্বরের দিব্যি, আমরা পিছিয়ে যাব না। প্রশ্ন হল, তুমি আসবে কিনা?'
অশোক মাথা নিচু করে বসে রইল কিছুক্ষণ, তারপর উঠে পড়ল নিঃশব্দে, 'মাফ করবেন আপ্পাজি। আপনারা আসুন।'
বেরিয়ে এসে আমি জিজ্ঞেস করলাম, মিথ্যে বলার কি দরকার ছিল, লোকটা তো এম্নিতেও এলো না। আপ্পা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললেন, 'কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যে বললে পাপ হয় না। ও আসবে, দেখো। বিশ্বাস রাখ আমার ওপর। চলো, কাপ্তান খুঁজে দেখি।'
কাপ্তান খুঁজতে গিয়ে সারা দিন কেটে গেল। এই সরাই থেকে ওই সরাইয়ে, নৌকায়, জাহাজে, এমনকি নষ্টা মেয়েদের আস্তানায় গিয়ে আমরা খোঁজ করলাম- কেউ রাজি হয় কি না। সফল হলে মিলবে নতুন কিছু আবিষ্কারের আনন্দ, বাহবা; আর বিফল হলেও যে টাকা দেব- তাতে তার পরবর্তী তিন প্রজন্ম পায়ের ওপর পা তুলে বসে খেতে পারবে। কিন্তু, সমুদ্রের সাথে কাঁধ ঠেকিয়ে এগোতে হবে শুনে 'দুঃসাহসী', 'বেপরোয়া' কাপ্তানদের কাছায় টান লাগল, পৌরুষ নেতিয়ে পড়ল, আর অবাস্তব সব ভয়ভীতি যেন আঁকড়ে ধরল তাদের।
'খুদার কসম, অমন কথা মুখেও তুলবেন না হুজুর, আপনার সাত পুরুষের ওপর অভিশাপ লাগবে! জানেন সমুদ্রে কি আছে? (দুই হাত দুপাশে ছড়িয়ে দিয়ে) এত্ত মোটা মোটা শুঁড়অলা দানব! হাতির মতন বিশাল হাঙর! একটা আস্ত নৌকার মত লম্বা লম্বা দাঁড়াঅলা কাঁকড়া! এরা সব সমুদ্রের গোলাম, নাগালে পেলেই হল। জাহাজ নিয়ে নিষিদ্ধ এলাকায় যেতেই পারবেন না হুজুর, আগেই ঝাড়েবংশে মারা পড়বেন!'
'শালো সমুদ্দুর পাড়ি দিবি, ধম্ম থাকপে তোর? ভাগ শালো, আমি যাচ্চিনে প্রাণের সাতে জাত-পাত-ধম্ম সব হারাতে।'
'কোথাকার কোন সায়েব এসেচে দ্যাখো, সমুদ্রজয় করবেন! (সমস্বরে হোহোহো করে নাবিকদের বিদ্রূপমাখা অট্টহাসি) যাও যাও ভদ্দরনোক, রাস্তা মাপো, নয় বদ্যি দেখাও গিয়ে।'
'সিনঁর, সমুদ্র শালী-কে দেখে বোকা বনবেন না। রঙ্গ দেখিয়ে টেনে নিয়ে যাবে, তারপর আপনার জাহাজ খেলনার মত ভেঙে দিয়ে খলখলিয়ে হাসবে। কত লোক মারা পড়ল কুত্তিটার হাতে আপনি চিন্তা করতে পারবেন না। আপনার কি মনে হয়, আমরা পারলে এগিয়ে যেতাম না? কিংবা মাছ ধরতে খোলা সমুদ্রে ঢুঁ মারতাম না? মৃত্যু আর সমুদ্র দুজনে যুক্তি করে আটকে রেখেছে আমাদের। যতবার আমরা খোলা সমুদ্রে জাহাজ পাঠিয়েছি, ততবার তার বুক থেকে উঠে এসেছে জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণি- আর মাটি মানুষ পশু সবকিছুর মাথা নুইয়ে দিয়ে আবার ফিরে গেছে সেখানেই। সমুদ্রকে কেউ রাগিয়ে পার পায় না। তাই আমরাও ঘাঁটাই না শালীকে। আমি কেন, দুনিয়ার কেউ এগুবে না আপনাদের জাহাজে কাপ্তানগিরি করতে। এটা সাহস বা টাকার প্রশ্ন নয় কভাল্যেরো, জীবনের প্রশ্ন। এই ব্যাপারটা ভুলে যান সিনঁর। ফিরে যান নিজের জায়গায়। শুধু শুধু আরও কিছু মানুষের বউ-বাচ্চাকে এতিম করে কি লাভ বলুন?'
ফিরে আসার পথটা অনেক লম্বা লাগল আমার। দুজনেই নিশ্চুপ, আপ্পা মুখ কালো করে রইলেন। সরাইখানার কাছে এসে শুনলাম বারো জন নাবিকের সাত জন ভেগে গেছে; বাকিরা জীবনের চেয়ে মদ-কে বেশি ভালবাসে বলে এখনও বোতল জড়িয়ে শুয়ে আছে। বিমর্ষমুখে এদের দিকে একটা মুদ্রা ছুঁড়ে দিয়ে আপ্পা নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। আমি দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখলাম মাতাল নাবিকদের মুদ্রা-কাড়াকাড়ি; তারপর এসে পড়লাম ঘরে।
কি করব মাথায় খেলছে না কিছু।
তাং- ২৪শে পউষ
নৌকোয় বসে আমি আর আপ্পা ভাবছিলাম আরও নাবিক কোথায় পাওয়া যায় সেই কথা, এক ছোকরার চিৎকারে ছেদ পড়ল তাতে।
'আপ্পাজি! আপ্পাজি! শ্বেতঠাকুরের নাতি আচেন আপনার সাথে?'
আপ্পাও চিৎকার করে জবাব দিলেন, 'আছে। কি চাস?'
'অশোকদাদা পাঠিয়েচেন হামাকে। যেতে বলেচেন আপনাদের। গরুর গাড়ি লিয়ে এসচি। দাঁড়াব?'
আমরা দুজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। আপ্পা হাসলেন।
'আসছি দাঁড়া।'
অশোকের কারখানায় গিয়ে দেখি, ঈশ্বর! সে এক হুলুস্থুল কাণ্ড! বিশাল বিশাল টিকের গুঁড়ি একপাশে গাদা করে রাখা, অদ্ভুত সব যন্ত্র দিয়ে সেগুলি ছেলা হচ্ছে, খসখস-ঘসঘস করে কাটা হচ্ছে; এক জায়গায় কজন মিলে দানবাকৃতি হাঁপর উঠাচ্ছে-নামাচ্ছে; আস্ত হাতের সমান লম্বা অসংখ্য পেরেক একটা ঝুড়িতে রাখা, আলকাতরা ফুটছে আরেক হাঁড়িতে, আগুনের তাপে সবার মুখ লাল হয়ে আছে; চারপাশে ঘাম-আগুন-ধাতু-ধোঁয়ার এক অদ্ভুত রূঢ় গন্ধ। নাকে এসে ধক করে লাগে। আমরা অবাক হয়ে চারদিকে চেয়ে দেখছি, এর মাঝে অশোক কালিমাখা ঘর্মাক্ত শরীরে এসে অভিবাদন জানাল, 'আপ্পাজি, এসে পড়েছেন খুব ভাল হয়েছে। কাজ শুরু করে দিলাম। চিন্তা করছি আমার জলযান আর ভিনদেশিদের কেরাভেল জাহাজ- দুটো মিলিয়ে একটা অন্যরকম জিনিস বানিয়ে ফেলব।' তারপর আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, 'এতকিছু আনিয়েছি, আমার কিন্তু আরও লাগবে। ব্যবস্থা করেছেন কিছু?'
আপ্পাজি পিঠ চাপড়ে দিলেন ওর, 'আমি জানতাম তুমি পিছিয়ে যাবে না। সাবাস! সব কিছুর খরচ আমরা দেব অশোক, তুমি কাজ চালিয়ে যাও। একটা ছোট সমস্যা হয়েছে অবশ্য, তোমাকে জানিয়ে রাখি...'
-'কি সমস্যা?'
'কোন কাপ্তান পাচ্ছি না। কেউ রাজি হয় না, সমুদ্রের কথায় সবাই ভয়ে গুটিয়ে থাকে। কয়েকজন তো এও বলেছে, আমরা নাকি জলে জাহাজ নামাতে পারব না, তার আগেই ফিরে যেতে হবে।'
-'কাপ্তান দিয়ে কি হবে?' অশোককে অবাক দেখায়, 'এম্নিতে চেনা পথ ধরে জাহাজ চলে, দিক ঠিক রেখে ডুবোপাথর সামলে চলতে হয়, দস্যু এলে পাল তুলে দৌড় দিতে হয়- এসবের জন্যে কাপ্তান লাগে। আপনি যাচ্ছেন গভীর সমুদ্রে, সেখানে চিৎকার করে আদেশ দিয়ে কি কুলাতে পারবেন? উপকূল রেখা দেখবেন না, রাতের বেলা থাকবে কুয়াশা, অন্ধের মতন চলতে হবে- কি করে দিক ঠিক রাখবেন তখন? এসব কাজ মানুষ দিয়ে হবে না। অন্য ব্যবস্থা করে রেখেছি আমি। আমার শুধু একজন লাগবে যে কিনা নাবিকদের শাসন করতে পারবে। আর কোন কাপ্তান-ফাপ্তান দরকার নেই।'
'শাসন- সেটা আমিই করতে পারি। কিন্তু অন্য কি ব্যবস্থা করেছ দেখি?'
অশোক আমাদেরকে ওর কর্মশালার মাঝখানে নিয়ে আসে। হাতে তারপর তুলে ধরে একটা বাটি, বাটির মাঝে ছুঁচের মাথায় কালো রঙের একটা ক্ষুদে মাছ গাঁথা। 'আমি একে বলি 'মৎস্য-যন্ত্র'। এই যে লেজটা দেখছেন, এইটে সবসময় উত্তরমুখী আর মাথাটা সবসময় দক্ষিণমুখী হয়ে থাকে।'
-'সবসময়?', আমার অবাস্তব লাগে ব্যাপারটা।
'হুম, এই যে দেখুন না' এই বলে সে বাটিটাকে ঘুরিয়ে দেয় একপাক। কি আশ্চর্য, মাছটাও সাথে সাথে ঘুরে গিয়ে উত্তর-দক্ষিণমুখী হয়ে রইল!
'তাহলে বুঝুন, সূর্য না উঠুক, সব তারা নিভে গেলে যাক- আমরা তবু পথ হারাব না।' অশোক সন্তুষ্টির হাসি হাসে।
-'আর কি জাদুর খেলনা লুকিয়ে রেখেছ তোমার ঝুলিতে, অশোক? দেখাও আমাদের!' আপ্পাকে দেখে কে বলবে এই লোকটাই সকালে মুখ ভার করে ছিল! তার চোখেমুখে এখন বালসুলভ আনন্দ।
'দেখবেন আপ্পাজি, সবই দেখবেন। ধীরে ধীরে। আমি কাজে লেগে যাই। আপনারা বসুন। কাজ দেখুন।'
তারপর সারাদিন কাটল কর্মশালাতেই। রাতে অশোকদের এখানে থাকব ঠিক করলাম। জায়গাটা ছেড়ে যেতে মন চাইছে না!
তাং- ৩০শে পউষ
এই কয়দিনে জাহাজ সম্পর্কে মোটামুটি ভাল ধারণা হয়ে গেছে। অশোকের কল্যাণে। লোকটা কাজ করতে ভালবাসে, তারচেয়েও বেশি ভালবাসে সেই কাজ নিয়ে জ্ঞানী জ্ঞানী বক্তৃতা দিতে। যেমন কাঠে হাতুড়ি দিয়ে দুমদাম পিটাতে পিটাতে বলছে আজ, 'জলযান আছে দুই ধরণের (ঠকঠক), বুঝলেন শ্বেতের নাতি (লোকটা ঘুণাক্ষরেও নাম ধরে ডাকে না আমায়। 'ভদ্রে' আর 'শ্বেতের নাতি' এই দুটো আর ভাববাচ্য দিয়েই কাজ চালিয়ে নেয়), একটা হল 'দীর্ঘ'- এগুলোর শরীর মানে স্থূলভাগ পানির কাছাকাছি থাকে (ঠকঠক); আরেকটা 'উন্নত', এদের স্থূলভাগ আবার অনেক উঁচুতে থাকে। আমাদের জলযান হবে দুটোর সঙ্কর (ঠকঠকঠক), বুঝলেন?'
সব মিলিয়ে আমাদের 'জলযান' সত্যিই অন্যরকম হচ্ছে। মূল শরীর পুরোটা খাঁটি টিক কাঠের গুঁড়ি বসিয়ে তৈরি হচ্ছে, হঠাৎ দেখলে বিশাল কোন জন্তুর কঙ্কাল বলে ভুল হয়। তারপর সেটাকে জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে পুরু তামার প্রলেপ দিয়ে। অশোকের লোকজন বলছে- এই অংশ পাহাড়ের সাথে বাড়ি খেলে পাহাড়ই নাকি পিছিয়ে যাবে! তার ফাঁকে ফাঁকে বসছে বার্মা থেকে আনা মেহেগনি কাঠের চার পরতের তক্তা। এত শক্ত দেহ জাহাজের, ডুবোপাথর নিয়ে আর কোন ভয় রইল না। মাস্তুল তিনটে, একেকটা তিন মানুষ সমান মোটা। লম্বায় একটা আকাশমণি গাছের সমান। পাল টানান হচ্ছে দুটো, মোটা গরদ আর দোসূতী কাপড়ে তৈরি। কাজ শেষ হতে আর দুতিন দিন লাগবে, জাহাজটা যেন সহজে বের হতে পারে, শুরুতেই আটকে না যায়, সেজন্যে কর্মশালার সামনের খালটা আরও গভীর করা হচ্ছে। ওটা হয়ে গেলেই আমরা সবকিছু নিয়ে নেমে পড়ব সমুদ্রে।
আপ্পা পরিকল্পনা করছিলেন- জাহাজে কজন নেওয়া যাবে, খাবার কিরকম নেওয়া দরকার ইত্যাদি। আমাদের জাহাজটা ছোট, আঁটে বারজন, কিন্তু চালাতে সর্বোচ্চ সাতজন মানুষ লাগে। নাবিকদের মাঝে এখন পাঁচজন আছে, সুতরাং আপ্পা আর অশোককেও হাত লাগাতে হবে। তারপর আমাকে দিয়ে মোট ছয়জন। এই কজন যাচ্ছি যাত্রায়। খাবার নেওয়া হল - চল্লিশ বস্তা শুকনো রুটি, চল্লিশ বস্তা লবণ-মাখান শুকনো মাংস, আর অনেক অনেক অনেক রাম। জাহাজের তল ভরে ফেলা হল রামের পিপে দিয়ে, এমনকি জাহাজের উপরের তলেও রামের বোতল মজুদ করে রাখা হল। আমি অবাক হয়ে আপত্তি জানাতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আপ্পা বাধা দিয়ে বললেন, 'শোনো বাবা, হাজার হাজার ক্রোশ পাড়ি দিতে হবে, এই সময়ে রুটি মাংস না থাকলেও চলে, কিন্তু রাম না থাকলে পিপাসায় সবার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। তুমি মানা কোরো না।'
-'কিন্তু জল নিলেও তো হয়। মদ কেন নিচ্ছি আমরা?'
'জল কতদিন ভাল থাকবে বলো? দুসপ্তা? তিন সপ্তা? তারপর গন্ধ ছুটবে, পচে যাবে, রঙ বদলে আস্তে আস্তে একসময় হলুদ হয়ে যাবে। পেটের জল আর পিপের জলে কোন পার্থক্য খুঁজে পাবে না। খেতে পারবে সেটা? অন্যদিকে রামের কথা চিন্তা করো। যত দিন যাবে, রাম তত মজা লাগবে খেতে। এই এক জিনিস যার বয়স বাড়ার সাথে স্বাদও বাড়ে। এরকম আর দুটি পাবে না।'
আমি মেনে নিলাম। আসলে এতসব নতুন কিছু ঘটছে চোখের সামনে, সবকিছুর হিসেব ঠিকমত মাথার ভেতরে রাখতে পারছি না। আমার ভেতরে ছোট্ট একটা অংশ এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না যে এতদূর আমি আসতে পেরেছি, কদিন পরেই জলে জাহাজ ভাসাব।
মানুষের জীবন খুব অদ্ভুত, কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায়।
তাং- পহেলা মাঘ
জাহাজ আজকে সম্পূর্ণ হয়েছে। সকালের দিকে। কাঠ-তামা-লোহার এই মজবুত, প্রকাণ্ড কাঠামো দেখে বিশ্বাস হচ্ছিল না আমরাই এটা গড়েছি, এই জলযানে করে সমুদ্রযাত্রায় যাচ্ছি। অবাক চোখে চেয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ, তখন এক কারিগর চিৎকার করে আমার কাছে জানতে চাইল, 'হুজুর কি নাম দেবেন বেটির?' তার হাতে রঙের তুলি।
-'বেটি?'
'জাহাজ, হুজুর। জাহাজের নাম দিতে হয়। কি নাম লিখব?'
বাকিরা বিভিন্ন নাম বাতলাতে লাগল, 'সিন্ধু-সম্রাট', 'মাতঙ্গিনী', 'বঙ্গগৌরব', এমনকি 'শ্বেতসলিলা'ও বলল একজন। কিন্তু নামটা সচেতন হয়ে ভাবার আগেই যেন আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো। আমি নিজেকে বলতে শুনলাম, 'না, লেখো, নাম হবে 'লোহিতশিখা'। কারিগর মাথা নেড়ে লেখা শুরু করল।
তারপর জাহাজ পুলি-রশি দিয়ে টেনে পানিতে নামান হল। প্রচণ্ড কড়কড় মড়মড় শব্দে পুরো কর্মশালা কেঁপে উঠছিল, পানিতে জাহাজ নামতেই অসহ্য নীরব হয়ে গেল; যেন ধাতব সন্তানটিকে প্রসব করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন দানবীয় এই সৃষ্টিকে টেনে সমুদ্রে নিয়ে যাওয়া হবে। তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল কারিগরদের মাঝে। আমি তাদের সাথে সাথে এগোচ্ছি, এমন সময় এক ঝাঁকড়াচুলো যুবক আমাকে থামাল। কাপড়চোপড় বর্বরের মতন, চুলগুলি প্রাণপণে খুলি আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করছে, আর চেহারা যেন সাক্ষাৎ যম। এ কোন নাবিক না হয়ে যায়ই না। আমিই কথা বললাম শুরুতে।
'জাহাজে কাজ নিতে এসেছ?'
-'জি না ভদ্রে, আমি এসেছি আসলে...'
আমার বিরক্তি ধরে গেল। নিশ্চয়ই অকাজে এসেছে, মজা লুটতে। খেয়েদেয়ে কাজ না থাকলে যা হয়।
'ভাগো তো হে! বিরক্ত কোরো না।' এই বলে ঘুরে হাঁটা দিলাম জাহাজের দিকে।
লোকটা দৌড়ে এসে আবার থামাল আমাকে, তারপর আরেকবার মানা করে দেব এই ভয়ে গড়গড় করে বলে গেল, 'আমি জানি আপনারা সমুদ্র-অভিযানে যাচ্ছেন। হয়তো নাবিকের কাজ করতে পারব না, তবে কমবেশি বদ্যিগিরি জানি। কেটে-ছড়ে গেলে বা কারো অসুখ হলে কাজে আসব। কিন্তু জানেন, আমার আসল কাজ বিজ্ঞান নিয়ে। এই যে, এইযে কাগজগুলো দেখুন', সে আমার নাকের সামনে একতোড়া কাগজ চেপে ধরে, 'এইগুলোতে আমার আবিষ্কারের সূত্র লেখা আছে। আমি উদ্ভিদ নিয়ে কাজ করেছি, আর আর ভেষজ ওষুধ বানাতে পারি, আর পাখিদের পর্যবেক্ষণ করেছি, মা-মানুষের শরীর নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করেছি। দেখুন, লেখা আছে সব।' লোকটা উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। আমি কাগজগুলোতে চোখ বোলানোর ভান করি কিছুক্ষণ। প্রত্যেকটাই অসংখ্য হাতে আঁকা ছবি, আঁকিবুঁকি, গাণিতিক সংকেতে ভরা। লোকটা তাহলে কাজের, বুদ্ধিশুদ্ধি আছে, চেহারার সাথে স্বভাবের কোন মিল নেই! একে জাহাজে নিয়ে নিলে অন্ততঃ ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই। তবুও গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করি,
'কিন্তু আপনাকে জাহাজে নেব কেন আমি? আমার কি লাভ?'
লোকটা জেবে আঙুল ঢুকিয়ে চকচকে তিনটে স্বর্ণমুদ্রা বের করে, তারপর বিষণ্ণ হাসি হাসে, 'আমি আমার পৈতৃক সম্পত্তি সব বেচে দিয়ে এসেছি ভদ্রে। এইটুকু শেষ সম্বল, তাও আপনার হাতে তুলে দিচ্ছি। দয়া করে আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না।'
আমি হকচকিত হয়ে মুদ্রাগুলো নিলাম, তারপর তাকে সেতু করে জাহাজে উঠে পড়তে বললাম। অনুমতি পেতেই লোকটা খুশিতে ডগমগিয়ে সাথের মালামাল এক মজুরের পিঠে চাপিয়ে সেতুর দিকে রওনা হল। একটু আগের বিষণ্ণতার কোন ছাপই নেই তার মাঝে।
এভাবেই পরিচয় হল হরিৎ-এর সাথে। অশোক ওকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাল, কিন্তু আপ্পা আপত্তি করছিলেন প্রথমে। কিছুক্ষণ তার সাথে কথা বলে হরিৎ থলে থেকে ক্ষুদে এক শিশি বের করল, তারপর মোটামুটি জোর করেই খাইয়ে দিল দুফোঁটা। আপ্পা ক্ষেপেটেপে গিয়ে খুব একচোট বকলেন তাকে, কিন্তু তারপর ঘনঘন ঢেঁকুর তুলতে লাগলেন। সে কি দৃশ্য! হরিৎকে চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে গালাগাল করছেন, আর একই সাথে 'ঘাআও' 'ঘিয়াও' 'ঘুওও' শব্দ করে বিকট বিকট ঢেঁকুর তুলছেন; হরিৎসহ বাকিরা ওদিকে হাসতে হাসতে এর ওপরে আরেকজন লুটিয়ে পড়ছে। কিছুক্ষণ পর ঢেঁকুরের সংখ্যা কমে এলো, আপ্পা শান্ত হলেন, অবাক হয়ে বসে পেট হাতাতে লাগলেন। তার কণ্ঠে এবাক বিস্ময়, 'আচ্ছা পেটের যন্ত্রণা কমে গেল দেখি! কি দিয়েছিলে বাছা, শুনি?'
হরিৎ হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে, 'কাকা, এই বয়সে বায়ু জমে পেটপীড়া হয়। তখন প্লক্ষপাতার রস সামান্য খেলেই উপকার হবে, শাস্ত্রে লেখা আছে। আপনাকে সেইটিই দিয়েছি মাত্র। ভাল লাগছে আপনার?'
আপ্পা কিছু না বলে ওর পিঠ চাপড়ে দিলেন। ছোট্ট এই ঘটনায় প্রথম দিনেই অপরিচিত, তরুণ এই যুবা সবার প্রিয় হয়ে উঠল।
জাহাজ সমুদ্রে নামার পর অবাক হয়ে দেখলাম, সমুদ্রতীরে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, হাত নাড়ছে বেশ ক'জন আমাদের দিকে। উৎসাহী কয়েকজন নৌকা নামিয়ে আমাদের সাথে সাথে যেতে লাগল। তাদের চোখে এক ধরণের করুণা, রাগ- একজন আরেকজনের সাথে কথা বলছে আর আমাদের দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে বারবার, অশালীন আগ্রহে। যেন আমরা চিড়িয়াখানার নতুন কোন প্রাণী, প্রদর্শনের জন্য আজই উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। চিৎকার করে গালাগাল, অভিশাপ দেওয়ার পাশাপাশি কয়েকটা নৌকা থেকে বড় বড় পাথর ছোঁড়া হতে লাগল। অশোক আর বাকি নাবিকেরা বৈঠা দিয়ে পানিতে থপাস থপাস বাড়ি মেরে ভয় দেখাল ওদের, এতে পিছিয়ে গেল; কিন্তু চিৎকার করা থামল না। গলা ফাটিয়ে মানুষগুলো আমাদের অভিশাপ দিতে লাগল, 'শালো তোরা ঘাড় মটকে মরবি, তোদের বৌদের পেট খসে যাবে, রক্তবমি হবে...'
এরকম আচরণের কারণ খুঁজে পেলাম না আমি। অশোক বলল, আমরা যে নিষিদ্ধ যাত্রায় যাচ্ছি- এতে ওদের ধারণা সমুদ্র খেপে যাবে, আমাদের তো মেরে ফেলবেই- ওদের ওপরেও তার প্রকোপ পড়বে। ঝড় আসবে, জলোচ্ছ্বাস আসবে, মাছ পাবে না। তাই লোকগুলো যাত্রার শুরুতেই এরকম আচরণ করে সমুদ্রকে বুঝিয়ে দিল যে, ওরা আমাদের সাথে নেই। শাস্তি দিলে যেন শুধু আমাদের দেওয়া হয়- ওরা সেই ভয়ঙ্কর ক্রোধের ভুক্তভোগী হতে চায় না। আমি অনেকক্ষণ ভাবলাম এটা নিয়ে। কোনোভাবেই ওদেরকে দোষ দিতে পারলাম না। নিজেকে মানুষগুলোর জায়গায় কল্পনা করলাম- কুসংস্কারাচ্ছন্ন কিংবা এতটা অন্ধভাবে সমুদ্রভীতু হলে আমিও হয়তো নিজের পরিবার, গেরস্থালির স্বার্থে এরকমই করতাম।
যাই হোক, আর কোন সমস্যা ছাড়াই সমুদ্রে নেমে গেছি! এটাই বড় কথা। লোকগুলো যেমন বলেছিল- আমাদের জাহাজ পানির স্পর্শ পেতেই ধসে পড়বে, ডুবোপাথরে গুঁতো খেয়ে পাথরের মতন ডুবে যাবে, বা রাগান্বিত একটা ঢেউ এসে সোজা সমুদ্রের তলদেশে কবর দিয়ে দেবে- তেমন কিছুই ঘটে নি। নাবিক পাঁচজন কাজে লেগে গেছে, জাহাজ সোজা দক্ষিণমুখো করে পাল তুলে দিয়েছে, উত্তরের প্রবল বাতাস ধেয়ে এসে বায়ুবেগে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। জাহাজের ওপরে কিছুক্ষণ কাটানোর পর দুটো ঘর- না, যে আকার, কুঠুরি বলাই ভাল- দুটো কুঠুরিতে আমরা চারজন আপাততঃ আশ্রয় নিয়েছি। আপ্পা-অশোক তাদের কুঠুরিতে ভসভস করে ঘুম দিচ্ছে- বেচারাদের ওপরে একয়দিন ধকল গেছে খুব। আমি লিখছি, হরিৎ মুখ বেগুনি করে বসে আছে। একটু পরপর শিশিতে করে কিসের যেন রস খাচ্ছে। বেচারার মনে হয় সিন্ধুরোগ আছে, জাহাজের মাতাল ঢুলুনি সরাসরি পেটের ভেতরে চাড় দিচ্ছে ওর!
একটা ভুল হয়ে গেছে। আরও শীতের কাপড় আনা উচিৎ ছিল। ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি। বাড়তি কিছু কাপড় থাকার কথা নৌতলে। কাল খুঁজেপেতে আনতে হবে কয়েকটা। শাল জড়িয়ে এই হিম বাতাসের সাথে যুদ্ধ করা সম্ভব না।
তাং- ১৬ই মাঘ
নিষিদ্ধ এলাকায় ঢুকলাম আজ। চারিদিকে জল, জল, আর জল। সামনে-পেছনে-বামে-ডানে আর কিচ্ছু নেই। কেউ নেই। ''এত্ত মোটা মোটা শুঁড়অলা দানব! হাতির মতন বিশাল হাঙর! একটা আস্ত নৌকার মত লম্বা লম্বা দাঁড়াঅলা কাঁকড়া''- এদের এখনও দেখা মেলে নি (সৌভাগ্যক্রমে!); এমনকি আমাদের জাহাজের পেছন পেছন কতগুলো গাংচিল আসছিল অনেকক্ষণ ধরে, ওরাও ফিরে গেছে। দূরের দিগন্তরেখা দেখা যায় আবার যায় না, অদৃশ্য হয়, আবার দৃশ্যমান হয় একটু পরেই। রোদে গা জ্বলে যাবার মতন অবস্থা। বাকিদের অভ্যাস আছে, কিন্তু আমি আর হরিৎ মোটামুটি লঙ্কার মতো লাল হয়ে গেছি। রোদের তাপে তাকানোই কঠিন, চোখ সরু করে একে আরেকজনের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। হরিৎ অনেকগুলো চামড়ার খামের মতন জিনিস এনেছে। সকালের দিকে দেখি গো-চর্মের ওপর ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে কিছু লিখে একটা খামে ভরল। তারপর বোতলে ভরে ফেলে দিল পানিতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'কি করছ হরিৎ?'
-'স্মৃতি, ভদ্রে। নতুন যা দেখছি, সব লিখে লিখে রাখছি।'
'তা ফেলে দিচ্ছ কেন?'
-'ফিরে আসব কি না তার কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই বোতলে করে সেগুলো সমুদ্রের বুকে ছেড়ে দিচ্ছি, একটা সময় ভাসতে ভাসতে তীরে ফিরে যাবেই- তখন মানুষ খুলে পড়বে, জানতে পারবে আমাদের অভিযানের কথা। দারুণ হবে না?'
আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ি। কাজটা ভালই। ছোকরার বুদ্ধি আছে। অবশ্য তেমন নতুন কিছু দেখছি না। ঢেউগুলো একটু বেশি উঁচু, জল একটু বেশি কালো, মাঝে মাঝে শুশুক-তিমি এসব দেখা যায়- এইই তো! সিন্ধু-রোষের চিহ্নমাত্র নেই।
সাথে আনা বইগুলো পড়ছি। কিছু হিসেব করতে হচ্ছে। পণ্ডিতরা একপক্ষ বলছেন, সমুদ্রের শেষ নেই, এটা চারিদিক থেকে আমাদের ঘিরে আছে। আরেকপক্ষ বলছেন, মানলাম, তাহলে নক্ষত্রগুলো আছে কোথায়? এরা নিশ্চয়ই আরও বিশাল কোন জলধিতে ভেসে আছে? আর নক্ষত্রসমূহ স্থির নয়, এরা স্থান পরিবর্তন করে। অর্থাৎ স্রোত বা বায়ু- একটা কিছু এদের ঠেলে নিয়ে যায়। আমরা দুটোর জন্যই প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। জাহাজ আছে, স্রোতে টানবে; পাল আছে, বাতাসে চলবে। এরপর খাবারের প্রশ্ন। আপ্পা বলেছেন আমরা ভালমত আটমাস চলতে পারব, তারপর সীমিতভাবে বণ্টন করে আরও এক মাস চলা যাবে। মানে মোট ন'মাস। প্রতিদিন পাড়ি দিচ্ছি কম করে হলেও ত্রিশ ক্রোশ। তার মানে স্রোত আর বাতাস অনুকূলে থাকলে ন' মাসে আট হাজার ক্রোশ পাড়ি দিতে পারব। প্রাচীন বইগুলোতে সমুদ্রের পরিধি দেওয়া আছে যথাক্রমে তিন হাজার, চার হাজার এবং সাড়ে চার হাজার ক্রোশ। সুতরাং সমুদ্রের শেষ আবিষ্কার করে, বাইরের জগতে ঘুরে আবার ফিরে আসা 'গাণিতিকভাবে' সম্ভব।
জিনিসটা একটু হলেও সাহস যোগাল মনে।
জাহাজে আসলে সময় কাটানোটা বড় একটা সমস্যা। আমি বসে বসে অন্যদের দেখি। নাবিকরা কাজের ফাঁকে ফাঁকে বসে আড্ডা দেয়, চতুরঙ্গ খেলে, বাজি ধরে এই অভিযানে তাদের মাঝে কে আগে মরবে, রাতের বেলায় রাম গিলে সবাই মিলে সমুদ্রের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে, তারপর কোরাস প্রেমসঙ্গীত গাইতে গাইতে দড়ি আর চটের তৈরি দোলনায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ঘোরে কেউ যে গড়িয়ে সমুদ্রে পড়ে যায় না তা-ই ভীষণ আশ্চর্যের ব্যাপার। আর সমতলে...হাহাহা, আগে অশোকের কথা বলে নিই। লোকটা জাহাজ নিয়ে এত স্পর্শকাতর- জিনিসটা চিন্তার বাইরে। সারাদিন নাবিকদের খাটাচ্ছে- এটা পরিষ্কার কর, ওটা গুছিয়ে রাখ, জাহাজের মেঝে এত পিছল কেন, ঘষেঘষে চকচকে করে ফ্যাল ইত্যাদি। তাও মানা যেত, এখন সে পড়েছে ভাষা নিয়ে। আমরা সবাই জাহাজের নিচের অংশকে নৌতল বলি, ওপরের অংশকে উপরিতল বা স্রেফ 'উপর' বলি- এসব তার গায়ে বিঁধেবিঁধে পড়ে। শুনলেই খেপে উঠে একেবারে। নৌতল বলা যাবে না, ওটা 'নভতল', 'উপর' নাকি হতভাগাদের শব্দ- বলতে হবে 'সমতল'; মাস্তুল নয়, শব্দটা হবে 'কূপদণ্ড' ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি একদিন ভুলে নৌতল বলে ফেলেছি ওর সামনে, তাতেই মুখ লাল করে ফেলল।
'ভদ্রে, এরকম শব্দ শুনতে ভাল লাগে না। প্রত্যেকটা জিনিসের নিজস্ব নাম আছে, প্রকৃতি আছে। সেই সঠিক নাম ধরে না ডাকলে অপমান হয়। 'লোহিতশিখা'ও অপমানিত হয়, আমি বুঝতে পারি। বেটিকে এভাবে অপমান করবেন না।'
নাবিকদের একজন টিপ্পনী কাটে, 'হুজুর, আমরা তো বুঝিনি লোহিতশিখা বেটি। আপনি বুঝলেন কি করে?'
-'শালো চামখোর টিকটিকি, জীবনে কোন মাগির ওপরে উঠেছিস যে বুঝবি? যা ভাগ!', অশোক খিস্তি করে ওঠে, তারপর জাহাজের আরেকদিকে চলে যায়। কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধতার পর সবাই একসাথে ফেটে পড়ে হাসিতে। এই অশোকের বদৌলতে এখন অজান্তেই 'সমতল' বলে ফেলি!
যা বলছিলাম, সমতলে শুয়ে থাকাটা খুব বিপদজনক লাগে আমার কাছে, বিশেষ করে রাতের বেলা। এক নাবিককে জিজ্ঞেস করলাম। সে আমাকে দেখাল যে ব্যাপারটা আসলে তেমন না। ওদের দোলনা-বিছানাগুলো অন্যরকম। ওখানে শুলে দুপাশের অংশ চারপাশ থেকে চেপে এসে জড়িয়ে ধরে, ফলে দুতিনবার পাক খেলেও দোলনা থেকে পড়ার ভয় থাকে না। আর জিনিসটা ঝুলন্ত থাকায় ঢেউয়ের ঝাঁকুনি খুব একটা লাগে না। নাবিক আরও জানালো - দোলনাগুলোর আরেকটা বৈশিষ্ট্য আছে। সাগরপথে থাকার সময় কোন নাবিক মারা গেলে, তাকে তার দোলনায় শুইয়ে দেওয়া হয়। তারপর দড়িতে বেঁধে নামিয়ে দেওয়া হয় জলে। এগুলো আক্ষরিক অর্থে প্রত্যেক নাবিকের মৃত্যুবস্ত্র।
আর একটা জিনিস লিখতে ভুলেই যাচ্ছিলাম প্রায়। অশোক আর আপ্পা মিলে অভিনব প্রক্রিয়ায় পাল খাটানোর পরিকল্পনা করছেন। পুরো ব্যাপারটা অসম্ভব রকম সহজ। জাহাজের দুপাশে দুটো লম্বা দণ্ড স্থাপন করা হবে। তারপর মূল পালের সাথে মোটা কাপড় দিয়ে জুড়ে দেওয়া হবে। দণ্ডদুটো বাতাসে যেন উপড়ে না আসে এজন্যে মূলদেহের সাথে শক্ত করে একে সংযুক্ত করা দরকার, এটা নিয়েই এখন চিন্তা ভাবনা চলছে। ঠিকমত করতে পারলে খুব সুবিধা হয়। যখন দরকার নেই, তখন দণ্ডদুটো ভাঁজ করা অবস্থায় মূল মাস্তুলের সাথে বাঁধা থাকবে। দরকার হলে স্রেফ দড়ি খুলে দিলেই ময়ূরের মত পেখম মেলে ছড়িয়ে যাবে, বাতাসের বেগে চলবে। ভাবতেই ভাল লাগছে!
পশ্চিমের আকাশে মেঘ জমে গেছে। কালো কুচকুচে আকাশ। দূরে বজ্রপাত হচ্ছে কোথাও। নিচে সাগরও হঠাৎ অশান্ত হয়ে উঠছে। আমি অনুভব করছি, জাহাজ ঢেউয়ের ধাক্কায় মড়মড় করে উঠছে, প্রচণ্ড থরথরিয়ে কাঁপছে। আপ্পা নাবিকদের ওপর চিল্লাচ্ছেন, ধমকাচ্ছেন, হুড়োহুড়ি লেগে গেছে সবার মাঝে। পাল তুলে দেওয়া হয়েছে, চারজন নাবিক নিচে গিয়ে বৈঠা তুলে নিয়েছে। অশোক মৎস্য-যন্ত্র হাতে নিয়ে বোকার মতন দাঁড়িয়ে আছে। বাতাস, প্রচণ্ড বাতাস। হুহু করে পালের ওপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, যেন ছিঁড়ে ফেলবে। একটা ঝড় আসছে বোধহয়। এইই, বৃষ্টি নেমে গেল। কুঠুরির ভেতরে এসে পড়লাম আমি আর হরিৎ। এই ঢুলুনির মাঝে না লেখাটাই ভাল। ধাক্কা-টাক্কা খেয়ে বিশ্রী অবস্থা হবে। ঝড় থেমে গেলে আবার লিখব বরং। শাল জড়িয়ে শুয়ে থাকি আপাততঃ।
তাং- অজানা
শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না।
ঝড়ের সে রাতের কথা কি লিখব মাথায় আসছে না। সবকিছু উল্টেপাল্টে গেছে। আজ কি তারিখ, কতদিন কেটে গেছে বলতে পারব না। আপ্পা জাহাজে নেই। জলে পড়ে গেছেন নাকি তাও জানি না। শুধু জানি- সমুদ্র থেকে ফিরে শ্বেত প্রলাপ বকেন নি। বাতাস আর জল সত্যিই নরকের পাহারাদার হয়ে উঠে এসেছিল সেদিন!
ঝড় শুরু হলে আমি আর হরিৎ কুঠুরিতে ঢুকে গেছিলাম। বৃষ্টি হচ্ছিল। চুইয়ে চুইয়ে কিছু ভেতরেও আসছিল। হঠাৎ বৃষ্টির পানি দেখে হরিৎ কাঁপতে লাগল। আমি ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাই- লাল! বৃষ্টির রং লাল! রক্ত ঝরছে আকাশ থেকে! তাড়াতাড়ি করে বাইরে এসে যা দেখলাম, আমার নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আকাশ সম্পূর্ণ লাল হয়ে গেছে, গুড়গুড়গুড়ুম করে বাজ পড়ছে জাহাজের খুব কাছে, আর ঢেউ, পাহাড়ের চেয়েও উঁচু হয়ে ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। যেন গ্রাস করে নেবে। জলের প্রকাণ্ড সেই পাহাড় ধসে পড়ল আমাদের ওপরে, সাথে সাথে ছিটকে কে কোথায় চলে গেলাম তার কোন খবর রইল না। আমি কোনোমতে ঘাড়-পিঠ-হাতে একটা দড়ি পেঁচিয়ে ঝুলে রইলাম প্রাণপণে। নাবিকেরা চিৎকার করে দোয়া-দরূদ পড়ছিল, প্রার্থনা করছিল। লাল জল এসে চোখ অন্ধ করে দিচ্ছিল, কাউকে ভাল করে দেখতে পাচ্ছিলাম না। আপ্পা বনবন করে চাকা ঘুরিয়ে দিক পরিবর্তন করতে চাইছিলেন, কিন্তু তখনই ফড়ফড় করে মূল পালের মাঝখান থেকে সবটুকু ছিঁড়ে গেল। বাতাসের বেমক্কা ধাক্কা সামলাতে না পেরে জাহাজ পশ্চিমে পুরো কাত হয়ে গেল, অশোক আপ্পাকে কোনোমতে টেনে নিয়ে এলেন মাস্তুলের কাছে। তখনই আছড়ে পড়ল দ্বিতীয় ঢেউ। সম্ভবতঃ আমার মাথা মেঝের সাথে ঠুকে গিয়েছিল, কারণ তারপর আর কিছু মনে নেই।
যখন জ্ঞান ফিরে এলো- দেখি সকাল হচ্ছে। সূর্য উঠছে কেবল। জাহাজ কোনোমতে ভেসে আছে। সমুদ্র ভয়ানক শান্ত, সামান্য ঢেউয়ের আভাসও নেই। পানিতে ভাঙা কাঠের অংশ, রামের বোতল, মাংসের পিপে অর্ধডুবন্ত হয়ে ভাসছে এখানে ওখানে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বাতাস অদৃশ্য, থেমে আছে যেন। তবুও জাহাজের শরীর কড়কড় শব্দে আর্তনাদ করে উঠছে একটু পর পর। মূল পাল ছিন্ন বিচ্ছিন্ন, বাতাসের তীক্ষ্ণ নখর বেশিরভাগ অংশই ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। মাংসপচা গন্ধ ছুটেছে। মাস্তুলের মাথার ওপরে এক নাবিকের দেহ ঝুলে আছে, নিঃস্পন্দ। জীবিত না মৃত কিছু বোঝা যাচ্ছে না। জাহাজের শরীরে একাধিক গর্ত হয়ে আছে। পানি ধুকছে কলকল শব্দে। এমন কি জিনিসে ঠোক্কর খেয়েছে যে চার পরত কাঠ-তার ওপরে তামার আবরণ মিলেও ঠেকাতে পারেনি?
বাকিদের খুঁজছিলাম। দেখা গেল তিনজন নাবিক, হরিৎ আর অশোক নৌতলে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে। কেউ রক্ষা পায়নি আঘাত থেকে। কারো মাথা থেকে রক্তের ক্ষীণ ধারা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে, কারো হাত-পা বেঁকে আছে অসম্ভব ভঙ্গিতে- ফুলে গেছে- বোঝাই যাচ্ছে হাড় ভেঙ্গে গেছে। আমি হরিৎ-এর মুখে পানির ঝাপটা দিলাম। কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করার পর চোখ খুলল। আমাকে চিনতে সময় লাগল ওর। চিনতে পেরেই চোখ বড় বড় করে চারপাশে তাকাতে লাগল, অস্ফুট স্বরে বলছে, 'এখনও বেঁচে আছি...বেঁচে আছি?' বুঝতে পারলাম প্রচণ্ড মানসিক ধাক্কা খেয়েছে ছেলেটা। কয়েক ঢোক রাম খেতে দিলাম ওকে। ততক্ষণে বাকি নাবিকেরাও নড়তে চড়তে শুরু করেছে, অশোক হাতে চোখমুখ ঢেকে বসে আছে, তার সারা শরীর কাঁপছে। হরিৎ এবার আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করল- 'আমরা কোথায় আছি?'
আমি মাথা নাড়লাম। 'জানি না হরিৎ। কিন্তু চিন্তা কোরো না, আমি ঠিক বের করে ফেলব। তুমি ওঠো। ওদের অবস্থা দ্যাখো, সবাই বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ওষুধ লাগিয়ে দাও গিয়ে।'
হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে পড়ল ছেলেটা। এখনও খোঁড়াচ্ছে। তারপর আস্তে আস্তে থলি থেকে ওষুধ নিয়ে এসে বাকিদের লাগিয়ে দিতে লাগল। হাতের দুপাশে কাঠের খণ্ড বেঁধে কয়েকজনের কাপড়ের পট্টি বানিয়ে দিল। আমি অশোকের দিকে তাকিয়ে থাকি। লোকটা এখনও বসে আছে। চুপচাপ।
অনেক, অনেকক্ষণ পর। সবাইকে সেবা দিয়ে হরিৎ অশোকের পিঠের ক্ষতের পরিচর্যা করছে, মলম লাগিয়ে দিচ্ছে। বাকিরা আহত অবস্থায় গোল হয়ে বসে আছে, কারো কথা বলার শক্তি নেই। অশোকের হাতে মৎস্যযন্ত্রটা। নাড়াচাড়া করতে করতে খসখসে গলায় বলতে শুরু করল- 'শ্বেতের নাতি, কি করতে চান?'
আমি কিছু বলার আগেই এক নাবিক কর্কশস্বরে তেড়ে উঠল, 'কি করবে মানে? জাহাজ ঘুরাও হুজুর, আমি আর একপা-ও সামনে এগোচ্ছিনানে। আমরা কেউ যাব না সামনে।'
সমস্বরে বাকিরাও সম্মতি জানাতে লাগল। কেউ এগোতে চায় না।
অশোক হরিৎকে ঠেলে সরিয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর ছুঁড়ে মারল মৎস্যযন্ত্রটা প্রথম নাবিকের সামনে।
'ঘুরে যাবি? ঘুরে কোথায় যাবি হারামজাদা? দ্যাখ!'
সবার নজর তখন লোহার মাছটার ওপর। উত্তর দক্ষিণ না দেখিয়ে সেটা অবিরাম চরকির মতো ঘুরে যাচ্ছে অক্লান্ত। অশোকের কথা শেষ হয়নি তখনো।
'পিছনে ফিরে যাবি, কি পাড়ি দিয়ে এসেছি আমরা জানিস? নরক, সাক্ষাৎ নরক! সব তো পড়ে ছিলি মরার মতন, কি গজব নেমে এসেছিল তা আমি দেখেছি! প্রাণ নিয়ে বেঁচে এসেছি এই ভাগ্য। আবার যাবি? ভাগ্য প্রতিবার টানবে না বিচিছাড়ার দল! বাইরে তাকিয়ে দেখ! একফোঁটা বাতাস নেই। পাল ছিঁড়ে গেছে। জোড়া লাগাতে কদ্দিন লাগবে ভেবেছিস? জাহাজের মড়মড়ানি শুনেছিস? এই অবস্থায়...'
এইটুকু বলে অশোক ধাক্কা খায় যেন একটা। ঘুরে আমাকে জিজ্ঞেস করে, 'আপনি যখন জ্ঞান ফিরে পান, তখনো কি জাহাজ এরকম শব্দ করছিল?'
আমি স্বীকার করি।
'বাইরে ঢেউ নেই কোন। বাতাস নেই। থেমে থাকা জাহাজ এরকম করবে কেন?' বলতে বলতে অশোক চিন্তিতমুখে সমতলে উঠে আসে। আমরা অনুসরণ করি।
তখনই কলকল শব্দটা প্রথমে শুনি আমি। ক্ষীণ, দুর্বল, প্রায় শোনা যায় না এমন। কিন্তু শব্দ যে হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
আস্তে আস্তে বাকিরাও শুনতে পায় শব্দটা। স্রোতের শব্দ। জলধারার শব্দ।
আরও জোরাল হচ্ছে যেন।
কাছিয়ে আসছে ধীরে ধীরে।
জোরাল। আরও জোরাল।
যেন শতসহস্র মানুষ হুঙ্কার দিচ্ছে একসাথে।
দূরে দিগন্তের দিকে তাকাই আমরা। দেখি দিগন্তসীমা দেখা যাচ্ছে না, কুয়াশা, সাদা ঘন কুয়াশা গ্রাস করে রেখেছে দৃষ্টিসীমা। সূর্যও ঢাকা পড়ে গেছে।
জাহাজের পাশে জলের দিকে তাকাই।
বোতল, কাঠের অংশগুলো পানিতে পাক খেতে খেতে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে।
আমাদের ছাড়িয়ে।
আমরাও চলছি ওদের পেছন পেছন।
একে অপরের দিকে তাকাতে তাকাতে কে আগে বুঝে ফেলে ব্যাপারটা বলা মুশকিল। মনে হল সবাই একসাথেই অনুধাবন করলাম, তারপর চিৎকার করে উঠলাম-- 'সামনে জলপ্রপাত!'
কি বোকার মত কাজ করেছি! এইটুকু বোঝা উচিৎ ছিল- সমুদ্রের শেষ যদি শূন্যে হয়, তবে পানি সব যায় কোথায়? নিশ্চয়ই পড়ে যায় নিচে। জলপ্রপাতের মাধ্যমে। মহাসমুদ্রের শেষে কোন ধনসম্পদ নেই, লুকোনো গুপ্তধন নেই। আছে কেবল দুনিয়ার সবচেয়ে বড়, বিশাল, মহান জলপ্রপাত!
ব্যাপারটা বুঝতেই আমাদের মাঝে যেন পাগলামি শুরু হয়ে গেল। যার ওজন যত বেশি, জলপ্রপাতের নিচে সেটাই সবচে জোরে আছড়ে পড়ে। এখন পিছনে ফেরা অসম্ভব। বাঁচতে চাইলে একটাই কাজ- জাহাজ হালকা করতে হবে! ওজন কমাতে হবে! নাবিকেরা পাগলের মতন রুটির বস্তা-মাংসের বস্তা ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল জলে। কুঠুরির ভেতরের সমস্ত আসবাব-বিছানা আমরা ছুঁড়ে ফেললাম। রামের পিপেগুলো নিয়ে বচসা শুরু হয়েছিল; আমি আর অশোক মিলে একটা ফেলে দিলে ওরাও সমানে ফেলে দিতে লাগল। কিছুক্ষণের মাথায় সম্পূর্ণ জাহাজ খালি হয়ে গেল। আর কি ফেলা যায়? খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেল- জাহাজের নোঙ্গর! ওটাও কেটে ফেলে দেওয়া হল। জাহাজ হালকা হয়ে গতি যেন তিনগুণ বেড়ে গেল। এরপর?
অশোক চিৎকার করতে লাগল- এখনও অনেক ভারি। সব ফেলে দাও। সব।
মাস্তুলের গোড়ায় কুঠারের কোপ বসাল একজন। মড়মড় করে ভেঙে পড়ল মাস্তুল। ফেলে দেওয়া হল।
ফেলে দেওয়া হল কুঠারটা।
কাপড়চোপড় সব ফেলে দিল আরেকজন।
জাহাজের গতি বাড়ল আরও।
সমতলের ভারি ভারি কাঠের খণ্ডগুলোও উপড়ে ফেলার কথা চিন্তা করা হতে লাগল।
ততক্ষণে জলপ্রপাত এসে পড়েছে একেবারে কাছে। উষ্ণ জলকণার স্পর্শ পেতে লাগলাম। জলপতনের শব্দ এখন অন্য সব শব্দকে গ্রাস করে নিয়েছে। আর কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছি না। কুয়াশায় কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। এখন বাদ আছে আর একটা কাজই- পতন! জলপ্রপাতের নিচে আছড়ে পড়ব, সাথে সাথে মৃত্যু ঘটবে আমাদের সবার- এটা জেনেও, মনের ভেতরে আঁতিপাঁতি করে খুঁজে কোন অতৃপ্তি পেলাম না। আমি তৃপ্ত। আমি খুশি। সমুদ্রের অন্ত দেখতে পেয়েছি। মানুষ না জানল আমাদের অভিযানের কথা, আমার কথা- কিন্তু আমি প্রকৃত সৌন্দর্য দেখেছি। এই আমার পাওয়া। মৃত্যু এর কাছে নিতান্তই তুচ্ছ।
এরকম চিন্তা মাথায় নিয়ে, মৃত্যুকে বরণ করার প্রস্তুতি নিয়ে তাকিয়ে আছি সামনে। দেখছি জাহাজের সামনের অংশ জলপ্রপাতের শেষ প্রান্তসীমা পেরিয়ে গেল, এখনই এই অংশ নিচু হতে শুরু করবে, পতন ঘটবে- এই অপেক্ষায় শরীর শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছি। তখনই অবিশ্বাস্য এক ঘটনা ঘটল।
গাংচিল যেমন অনন্য স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে মাটি ছেড়ে শূন্যে পাখা মেলে, আমাদের জাহাজটাও তেমনি জলপ্রপাতের প্রান্তসীমা ছুঁয়ে তারপর ভাসতে ভাসতে সামনে এগোতে লাগল! জাহাজের নিচে কিছু নেই, স্রেফ শূন্যে সওয়ারি হয়ে এগোচ্ছি। আমরা অবাক হয়ে প্রথমে জাহাজের দিকে, তারপর একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম! এও কি সম্ভব! তাহলে কি মাটির রাজ্য, পৃথ্বীর রাজ্য যেখানে শেষ, তার নিয়মকানুনেরও সেখানে ইতি?
আমরা কি শূন্যে পৌঁছে গেছি?
বেঁচে থাকার আনন্দ, সেই সাথে অভাবনীয় কিছু দেখার, আবিষ্কার করার আনন্দ আমাদের সবাইকে বিহ্বল করে দিল। একপ্রস্থ হাসাহাসি, নাচানাচির পর আমরা আবিষ্কার করলাম- সবার অবস্থা যাচ্ছেতাই। বিপদের মুখে পড়ে সবার মাঝেই আতঙ্কজনিত একপ্রকার শক্তি দেখা দিয়েছিল, এখন বিপদ কেটে গেছে; শিথিল গা এলিয়ে আসায় বোঝা যাচ্ছে আসলে বিশ্রামের প্রয়োজন প্রত্যেকের। হাসিমুখে ঘরে ফিরলাম। হরিৎ বিছানায় গা লাগাতেই ঘুমিয়ে পড়ল। আমিও বিশ্রাম নেব এবার।
ঘুম থেকে উঠে নতুন কিছু দেখব- আর কোন মানবচক্ষু যা দর্শন করে নি- ভাবতেই শিহরণ বয়ে যাচ্ছে সারা শরীরে!
******************************************************************
প্রকাশকের চিরকুট
পাঠকমাত্রই জানেন, ১২০৩ বঙ্গাব্দে সর্বপ্রথম মহাকাশে মানবচালিত শূন্যযান পাঠানো হয়। উক্ত অভিযানে দুই শূন্যচারী- প্রতাপ সিং এবং ইকবাল আলম এক বিশ্বকাঁপানো আবিষ্কার করেন। তারা দেখেন, পৃথ্বী ও চন্দ্রের মাঝখানে স্থির ঝুলে আছে শতাব্দী পুরনো একটি জাহাজ! পরবর্তীতে সেখানে একাধিকবার শূন্যযান পাঠানো হয়। এভাবে একে একে সাতটি মৃতদেহ, এবং একটি জীর্ণ পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করা হয়। এরপর ক্রমশ আবিষ্কার হয় যে পাণ্ডুলিপিটি আসলে অভিযাত্রীদের একজনের দিনলিপি। দিনলিপিটি সান্ধ্যভাষায় রচিত হওয়ায় সরকার একে বাংলায় অনুবাদ করার পদক্ষেপ নেওয়া নেন। পরবর্তীতে সমুদ্রের তীর থেকে বিভিন্ন সময়ে উদ্ধারকৃত গোচর্মলিপি, যা একসাথে হরিৎলিপি নামে পরিচিত; সেটির সাথে উক্ত পাণ্ডুলিপির যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। এর আগে অনেকেই হরিৎলিপিকে নকল বলে বাতিল করে দিয়েছিলেন, কিন্তু এই আবিষ্কার আগের সব ধারণা বদলে দেয়। বঙ্গ-ইতিহাসে সূচনা করে নতুন এক দিগন্তের।
আশ্চর্য হলেও সত্যি, লেখকের নাম পাণ্ডুলিপির কোথাও একবারের জন্যেও আসে নি। হরিৎলিপি অনুসারে, এই পাণ্ডুলিপি লেখকের নাম 'কৃষ্ণ'। সম্পূর্ণ নাম কোথাও পাওয়া যায় নি। হরিৎ তাকে কেবল এই নামেই সম্বোধন করেছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পাণ্ডুলিপির শেষ লাইনটি লেখার পর কৃষ্ণ তার বাকি সহযাত্রিদের মতই বিশ্রাম নিতে ঘুমিয়ে পড়েন। তাদের অজান্তে জাহাজটি বায়ুমণ্ডল ভেদ করে মহাশূন্যে প্রবেশ করে। শূন্যযাত্রীরা যখন তাদের আবিষ্কার করেন, তখন সবাই প্রশান্তমুখে চোখ বন্ধ করে ছিলেন। সুতরাং খুব সম্ভব ঘুমন্ত অবস্থাতেই এই সাহসি অভিযাত্রীগণ মৃত্যুবরণ করেন।
সরকার ১২০৫ সালে উক্ত সাত অভিযাত্রীদের জাতীয় বীর উপাধি দেন, এবং তাদের নামে সাতটি রাস্তার নামকরণ করা হয়।
এই সংস্করণে নির্বাচিত প্রধান অংশগুলির সংকলন করা হয়েছে। অনুবাদজনিত জটিলতার কারণে সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপির অনুবাদ একসাথে প্রকাশ করা সম্ভব হল না। উৎসাহী পাঠকদের জানিয়ে রাখি, আগামি বছরই সম্পূর্ণ অনুবাদ ছাপান হবে।
ধন্যবাদ।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন