শুরু…
প্রচন্ড ভয় পেয়েছে তৌফিক । এমন ভয় যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় । হাত-পা ঠান্ডা, অসাঢ় । শীতল একটা স্রোত মাথার পিছন থেকে শুরু হয়ে মেরুদন্ড বেয়ে নিচে নামছে । হরমোনের কার্যকারিতায় সড়সড় করে খাড়া হয়ে গেছে ঘাড়ের চুলগুলো । হৃৎপিন্ড যেন পাগলা ঘোড়া, লাগামহীন ছুটে চলেছে। খুলে গেছে শরীরের প্রতিটি লোমকুপ । আর সেগুলো দিয়ে ঘাম বেরুচ্ছে অবিরাম। ইতোমধ্যে ভিজিয়ে দিয়েছে শরীরের কাপড়-চোপড়, এমনকি তার পিঠের নিচের বিছানার চাদরও । অথচ ও ভয় পেয়েছে বেশিক্ষণ হয় নি ।
ঘুমিয়ে ছিলো ও। ঘুম ভেঙ্গে যায় হঠাৎ করেই । ভাঙ্গার কারণটা অনুমান করতে কষ্ট হয় না মোটেই। ওর ঘরটা থিকথিকে কুয়াশায় ভরা । ঘন ধোয়ার মত সেই কুয়াশা পাক খাচ্ছে, কুন্ডলিত হতে হতে আবার তা ভেঙ্গে ছড়িয়ে যাচ্ছে । হিম ঠাণ্ডায় শরীরের রক্ত পর্যন্ত জমে যাবার জোগাড় । অথচ এখন এরকম হবার কথা নয় । একে তো এখন গ্রীষ্মকাল, তার উপর ঘরের ভিতর কুয়াশার এমন নৃত্যের কথা কে কবে শুনেছে!!
তৌফিক যখন পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে তখন কিছু একটা হঠাৎই স্থির হয়ে গেল । ঘন কুয়াশার ভিতর লাল লাল আকৃতি ফুটতে শুরু করেছে । দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সেগুলো চারিদিকে। বিদ্যুচ্চমকের মত আকৃতির রেখাগুলো পরষ্পরকে জড়িয়ে সংখ্যায় বাড়ছে। তৌফিকের মনে হল ওগুলোর নিজস্ব চিন্তা-চেতনা আছে । কিছু একটা করার চেষ্টা করছে ওগুলো। কিছু কিছু রেখা আকারে মোটা হচ্ছে ,আর বেশির ভাগই সূক্ষ্ম থেকে আরো সূক্ষ্মতর রেখায় বিভক্ত হচ্ছে। হৃৎপিন্ডের স্পন্দনসংখ্যা যদি ভয় নির্নায়ক হত তবে ও এখন তার চরম সীমায় অবস্থান করছে । চিৎকার করার চেষ্টা করে বিফল হল ও। হাত-পা কেউ যেন আঠা দিয়ে বিছানার সাথে সেটে রেখেছে ।
আবার সামনে তাকালো ও । অজস্র রেখার জটিল বিন্যাস এবার কিছুটা বোধগম্য হলো ওর। মানুষের শরীরের শিরা-উপশিরা, ধমনীর সাথে বড় বেশি মিল ওগুলোর। আর চতুর্দিকে অবস্থান করা কুয়াশা যেন ত্বকের কাজ করছে। এখন ওর সামনে একটা অস্পষ্ট মনুষ্যাবয়ব ।
হঠাৎ তৌফিক তার রুম লাগোয়া বাথরুম থেকে পানি পড়ার আওয়াজ শুনতে পেল। শব্দ শুনেই বুঝতে পারল বেসিন সহ বাথরুমের সমস্ত ট্যাপ হতে অঝোরে পানি পড়তে শুরু করেছে । কিন্তু তার স্পষ্ট মনে আছে, সারা দিন ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না তাই ট্যাংকে পানি নেই একটুও। তাহলে এত পানি আসছে কোত্থেকে!! ইতোমধ্যেই পানি বাথরুম ছাপিয়ে রুমের ভিতর ঢুকে পড়েছে। দ্রুত বাড়ছে পানির উচ্চতা। এমন তো হবার কথা নয়। ভয়ে আধমরা হয়ে তৌফিক দেখল হাটুপানি হয়ে গেছে রুমের ভিতর । হঠাৎ করেই প্রচন্ড শীতে কাঁপতে শুরু করল সে । দ্রুতই পানি যখন বিছানা স্পর্শ করল , তখনই তৌফিক বুঝতে পারল তার সময় সমাগত । কিন্তু কেন এমন হচ্ছে ?
আব্বু-আম্মু, ছোট বোনটার কথা মনে পড়ল । পাশের রুমেই নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে তারা । ঘুনাক্ষরেও টের পাচ্ছে না তৌফিক নিজের রুমের ভিতরই মরতে বসেছে । শেষ চেষ্টা করল সে পানি তার শরীর স্পর্শ করতে । কিন্তু একচুলও নড়তে না পেরে হতাশায় কেঁদে ফেলল ।
এতক্ষণে আবার কুয়াশা মোড়া মানুষ্যমুর্তির দিকে চোখ ফেরাল তৌফিক । তীব্র আতংকে ওটার কথা মনেই ছিল না। দেখল আগের জায়গাতেই চুপচাপ ভেসে আছে সেটা । যেন ধৈর্য্য ধরে উপভোগ করছে তার আতংক । তৌফিকের মনে হল এসব কিছুর পিছনে একটা কারন অবশ্যই আছে। কিন্তু হাজার চেষ্টায়ও মনে করতে পারল না । ঠিক তখনই মুর্তিটার মুখমন্ডল পরিষ্কার হতে শুরু করল, যেন ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরেই ।
সহসাই সে বুঝে ফেলল এসবের পিছনে কি কারণ রয়েছে । কিন্তু আর কিছুই করার নেই নিয়তিকে বরন করে নেয়া ছাড়া। পানি নাক ছুয়ে ফেলেছে ইতোমধ্যে । মাথা জ্বালা করছে । পানিতে সম্পূর্ন ডুবে যাবার আগে লক্ষ্য করল ছায়ামুর্তিটা আর নেই, তার জায়গায় পরিচিত এক রক্ত-মাংসের এক মানবশরীর । কিন্তু মুখটা কি বীভৎস !! গুঢ় অন্ধকার গিলে ফেলবার আগে তৌফিক খ্যানখ্যানে একটা হাসির আওয়াজ পেল । বড়ই পৈশাচিক সে আওয়াজ ।
এক
সময়টা বিকেল । এক বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠের এক কোনে বসে আছে কয়েকজন ছেলে । প্রত্যেকের মুখ থমথমে, তাতে শোকের চিহ্ন।
“ কিভাবে কি হল কিছু খবর পেয়েছিস ?”, জিজ্ঞেস করল খালেদ রশীদকে ।
“ তেমন কিছু না ’, বলল রশীদ । “ নিজের বেডরুমে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে ওকে । শরীরে কোন আঘাত নেই ।তবে চোখ দুটো নাকি খোলা ছিলো । ডাক্তার বলেছে তীব্র আতংকে হার্ট এটাক হয়েছে । তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে ওর ফুসফুসে পানি পাওয়া গেছে ।’’
“ কি বলছিস ?, ’’ অবাক হয়ে বলল শুভ । “ লাশ পাওয়া গেল বিছানায় , ফুসফুসে পানি আসবে কোত্থেকে ? ’’
“ সেটাই তো রহস্য । ডাক্তার-পুলিশ কেঊ বের করতে পারছেনা । কি জানি কি ।’’
“ খুব ভাল ছেলে ছিলো তৌফিক,’’ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল রবি । “ চাচা-চাচি ছেলে হারানোর শোক সইবেন কিভাবে কে জানে।’’
আরো কিছু সময় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলল তারা । তারপর সন্ধ্যা হতে উঠে পড়ল সেখান হতে । কিন্তু কেউ লক্ষ্য করল না পাশের ঝাকড়া গাছটার ডালে বসে একটা কুচকুচে কালো রঙয়ের দাঁড়কাক ওদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ওটা কোন সাধারণ কাক নয় । ওটার গভীর কালো চোখে কিসের যেন আভাস । অশুভ কিছু । নিচের ওরা যদি তা টের পেত তাহলে মৃত বন্ধুর জন্য শোক করা বাদ দিয়ে নিজের কথা ভাবত ।
এ ঘটনার তিনদিন পরে টিউশনি করে রাতে হলে ফিরছিল রশীদ । মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে তার । দুপুর থেকেই কেমন কেমন যেন লাগছে । মাঝে মাঝেই শরীরটা এমনিতেই শিরশির করে উঠছে । অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার । আশেপাশে অনেক মানুষ থাকা সত্ত্বেও তার মনে হচ্ছে সে একা । আর মনে হচ্ছে কেউ আড়ালে আবডালে তার উপর চোখ রাখছে । পরে বিক্ষিপ্ত মনের চিন্তা বলে উড়িয়ে দিয়েছে ভাবনাটা । ঘড়িতে সময় দেখল সে । সাড়ে বারটা বাজে । ফিরতে আজকে দেরী হয়ে গেছে অনেক, ভাবল সে । আগেই আসতে পারত কিন্তু আসার পথে পুরানো এক বন্ধুর সাথে দেখা হওয়াতে গল্প করতে করতে দেরী হয়ে গেলো ।
জোর পা চালাল রশীদ । বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেট দিয়ে ঢুকে হলের দিকে চলল । নির্জন রাস্তা অন্ধকার হয়ে আছে । আকাশ মেঘে ঢাকা তাই চাঁদও আলো দিতে পারছেনা । আবারও সেই অদ্ভুত অনুভুতিটা ফিরে এলো রশীদের মনে । শরীরটা অজানা কোন কারনে শিরশির করে উঠলো । ঢোক গিলতে গিয়ে টের পেলো গলা শুকিয়ে মরুভূমি । ভয়ে ভয়ে আশেপাশে তাকাল কেউ আছে কিনা দেখতে। কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই । একদম শুনশান । মাঝে মাঝে রাস্তায় গার্ড মামারা থাকে, রশীদ আশা করছিল তাদের একজনকে দেখতে পাবে । কিন্তু টের পেলো আজ সে একা । হলের আলো চোখে পড়ল তার । ভাবল আর কিছুদুর গেলেই স্বস্তি । সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যত কারণই থাকুক না কেন এত রাত করে হলে ফিরবে না ।
হলের পুকুর ঘাট পর্যন্ত যখন পৌছাল রশীদ তখন হঠাৎই তার ঘাড়ের সমস্ত চুল সড়সড় করে দাড়িয়ে গেল । কিছু একটা শুনতে পেয়েছে সে । আস্তে আস্তে পিছন ফিরল । ঝেড়ে দৌড় দেবার জন্য প্রস্তুত । কিন্তু ফিরে দেখল কেউ নেই । ফেলে আসা রাস্তাটা একাকী অন্ধকারে শুয়ে আছে । আবার যখন সামনে পা বাড়াতে যাবে তখনই চোখে পড়ল তার । কেউ একজন হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছে পুকুরপাড়ের নারকেল গাছটার গোঁড়ায় তার দিকে পিছন ফিরে । এক্সপ্রেস ট্রেনের মত ছুটতে থাকা হৃৎপিণ্ডটা ঠাণ্ডা করে সেদিকে এগোল রশীদ । চাপা কান্নার এই আওয়াজটাই পেয়েছিল একটু আগে ।
কাছে গিয়ে দেখল ঘাড়ে ব্যাগ নিয়ে একটা ক্ষীণকায় ছেলে বসে আছে মাটিতে । মৃদু দুলছে সামনে পিছে আর কাঁদছে । কান্নার শব্দটা মনে কাঁপন ধরালেও সাহস নিয়ে রশীদ বলল , “ কি হয়েছে তোমার ? এতরাত্রে এখানে বসে কাঁদছ কেন ?’’
কিন্তু সে কোন উত্তর দিল না । সুর করে কেঁদেই চলল একটানা । রশীদের মনে দরদ জেগে উঠল । ভাবল, কোন সিনিয়র বোধহয় রাগ করেছে তাই কাঁদছে ছেলেটা । দেখলেই বোঝা যায় জুনিয়র ব্যাচের ছাত্র । এরকম ঘটনা হরহামেশাই ঘটে বিশ্ববিদ্যালয়ে ।
রশীদ এগিয়ে গিয়ে ছেলেটার কাঁধে হাত রাখল । “ কি হয়েছে তোমার ? কাঁদছ কেন ?’’, আবার প্রশ্ন করল সে ।
এবার কান্না থামাল ছেলেটা । আস্তে আস্তে ঘুরে রশীদের দিকে ফিরল । সেই মুহুর্তে চাঁদকে আড়াল করে থাকা মেঘটা সরে গেল । আলো পড়ল ছেলেটার মুখে । সাথে সাথে রশীদের মনে হল হৃৎপিণ্ডটা কেউ চেপে ধরেছে তার । একটা পৈশাচিক বীভৎস মুখের দিকে তাকিয়ে আছে সে ।
কুচকুচে কালো কোঁচকান চামড়া মুখটার, জায়গায় জায়গায় ফেটে লাল মাংস বের হয়ে আছে । ঠেলে বের হওয়া কপালের নিচে লাল রঙয়ের চোখ দুটো ভাটার মত জ্বলছে । নাক নেই, তার জায়গায় বড় দুটো গর্ত । মোটা দুই ঠোটের কষ বেয়ে লালচে রঙয়ের আঠালো রস গড়িয়ে পড়ছে । মুখের ফাকে দেখা যাচ্ছে সূচাল দাতের সারি । তার ফাক দিয়ে কালো রঙয়ের চেরা একটা জিহ্বা বের হয়ে ঠোটের দুপাশ থেকে রস চেটে নিল একবার ।
আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না রশীদ । দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড় দিল । কোনদিকে যাচ্ছে খেয়াল নেই । তাই কিছুক্ষণের মধ্যে তাল হারিয়ে গিয়ে পড়ল গভীর পুকুরে । ডুবে গিয়ে আবার ভাসল সে । দেখল পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে মুর্তিমান আতঙ্কটা । বীভৎস ঠোটের কোনায় হাসি লটকে আছে । হঠাৎ সেটা তাকে লক্ষ্য করে ঝাপ দিল পুকুরে । সরাসরি তার উপর এসে পড়ল । একটা বোটকা গন্ধ পেল রশীদ । তারপর ডুবে গেল পানিতে । বজ্রবাধনে তাকে বেঁধে ফেলেছে পিশাচটা । সেটার জ্বলতে থাকা লাল চোখের দিকে তাকিয়ে হাল ছেড়ে দল রশীদ ।
দুই
রশীদের মৃত্যু বন্ধু খালেদের মনে গভীর রেখাপাত করল । কেমন যেন হয়ে উঠল দিনগুলো । কিছুই ভালো লাগে না । সবসময় মনে হয় কিছু একটা ঘটবে, কিছু একটা ঘটতে চলেছে । বন্ধুকে কবরে নামানোর সময় পাশে ও । হঠাৎ এক অদ্ভুত অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে । মনে হয় কবরের অন্ধকারটা অনেক বেশী গাঢ় হয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে । আতংকে পিছিয়ে আসে সে ওখান থেকে । তারপর থেকে আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছে না । গান সুনে, মুভি দেখে, কম্পিউটারে গেমস খেলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা বিশেষ ফল দিচ্ছে না । ভাল গান গেত ও, গীটারটা এখন একাকী পড়ে থাকে । গাইতে ভাল লাগে না ।
ইদানিং আরও একটা উপসর্গ যোগ হয়েছে । কুকুর দেখলে একদমই সহ্য হচ্ছে না তার । আগে থেকেই যে ওদের দেখতে পারত না তা নয় । কিন্তু এখন দেখলে মনে হয় ওরা তার শত্রু । কাউকে যে খুলে বলবে ব্যাপারটা সে সাহস হচ্ছে না, পাছে সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে এই ভয়ে । এইতো সেদিন একটা বিচ্ছিরি ঘটনা ঘটে গেল । হলের পাশে একটা দোকানের সামনে বসে চিন্তিত মনে জুসের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল । হঠাৎ খেয়াল করল তিনটা কুকুর তার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে । এমনিতে যে আশেপাশে কুকুর থাকেনা তেমন নয় ব্যাপারটা । দোকানের সামনে অনেক কুকুর বসে থাকে, ঘোরাঘুরি করে । কেউ কিছু খেলে সামনে দাঁড়িয়ে লেজ নারে, খেতে চায় । কিন্তু আজকের ব্যাপারটা কেমন যেন ভিন্ন । কুকুরগুলোর কোন চাহিদা নেই যেন । একচুল নড়ছে না । শুধু তাকে দেখছে চুপচাপ । ওদের কালো চোখের দিকে তাকিয়ে ক্ষণিকের জন্য তার মনে হল রশীদের কবরে দেখা অন্ধকারের সাথে ওগুলোর অনেক মিল । হঠাৎ তীব্র আতংক পেয়ে বসল তাকে । তাড়াহুড়োয় চেয়ার ছাড়তে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে উল্টে পড়ল পিছন দিকে । গিয়ে পড়ল এক আমড়া বিক্রেতার উপর । তারপর দুজন মিলে পড়ে গেল মাটিতে । আমড়াগুলো চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার । দোকানদার মামাসহ আশেপাশের সকলে হেসে অস্থির । তারপর অবশ্য সবাই মিলে সাহায্য করল ওদের । কিন্তু কেউ টের না পেলেও ও ঠিকই টের পেল নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছে । কেউই খেয়াল করেনি আমড়াবিক্রেতার হাতের ধারাল ছুরিটা কখন শূন্যে ছিটকে উঠে ওর গলার কেবলই পাশে মাটিতে গেথে গেছে । ও ছুরিটাকে ঠিকই উপর থেকে নিচে নামতে দেখছিল । একদম গলা বরাবর নামতে নামতে শেষে এসে যেন দিক পরিবর্তন করেছে সেটা । মাটি থেকে উঠে গা ঝাড়তে ঝাড়তে দেখল কুকুর তিনটা চলে যাচ্ছে একসাথে । তার কেন যেন মনে হচ্ছিল ইচ্ছা করেই ওগুলো তাকে ফেলে দিয়েছিল ।
খালেদ টের পেল দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে সে । সারাদিনই প্রায় রুমে শুয়ে থাকে । ক্লাসও ঠিকমত করে না । শুভাকাঙ্ক্ষীরা পরামর্শ দিল বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে । তাদের কথা মেনে দুইদিন হল বাড়ি ফিরেছে সে । পরিবারের লোকদের মাঝে থেকে ভালোও লাগতে শুরু করেছে ।
একসপ্তাহ পার হবার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসল সে । বিকেলে গ্রাম্য বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা দেয় মাঠে । বই নিয়ে এসেছিল ভার্সিটি থেকে, তাই পড়ে । এরকমই একদিন মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছিল । দেখল পাশের বাড়ির সম্পর্কে চাচা কিন্তু সমবয়সী ছেলে সুজন তাড়াহুড়ো করে তাদের দিকে আসছে ।
“ভাতিজা, একটু শুইনা যাও, ’’ ওদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বলল সে ।
খালেদ উঠে তারদিকে এগোল । কাছে গিয়ে দেখল তার চোখ দুটো চকচক করছে । কি যেন একটা চেপে রেখেছে সে ।
“কি হইছে ?, ’’ প্রশ্ন করল খালেদ ।
পকেট থেকে কি যেন বের করল সুজন । মুঠো খুলতে খালেদ দেখল কাগজে প্যাচানো কতগুলো ছোট ছোট প্যাকেট দেখা যাচ্ছে । নিমেষে বুঝে ফেলল ওতে কি আছে ।
“চলব নাকি ?, ’’ ভুরু নাচিয়ে প্রশ্ন করল সুজন ।
আশেপাশে একটু তাকিয়ে ও জিজ্ঞাসা করল, “কোথায় ?’’
“ক্যান, আমাগো সেই পুরাইন্যা জায়গায় ! ,’’ যেন ওর প্রশ্নে একটু অবাক সে ।
“ রাইতের বেলা । সজাগ থাইকো । আমি ডাইকা নিবানি,’’ বলে আর দাঁড়ালো না সুজন ।
সন্ধ্যা হতেই খালেদের উত্তেজনা বাড়তে লাগলো । কয়েকদিন আগের কথা চিন্তা করে কিছুটা ভয় লাগলেও গাঁজার কথা মনে পড়তে ভয়টা উবে গেল । সুজন আর ও আগে প্রায় প্রায়ই গাঁজা খেত । সুজনই তাকে শিখিয়েছিল । ওদের গ্রামে পুরানো এক জমিদারবাড়ি আছে । লোকজন বিশেষ একটা যায় না ওদিকে । ঝোপজংগলে ঘেরা ভাঙ্গা জমিদারবাড়ি বসে দুজনে মনের সুখে গাঁজা টানত আর চোখের সামনে রঙ্গিন দুনিয়া দেখত । ভার্সিটিতে ওঠার পর আর তেমন খাওয়া হয় না । আজ অনেক দিন পর আবার খেতে পারবে মনে করে খুশির একটা আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে মনে । কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি এই খুশিই তাকে চরম সর্বনাশের পথে নিয়ে যেতে চলেছে ।
রাত গভীর হতে জানালায় কাংখিত টোকাটা শুনতে পেল । সুজন ডাকছে । নিঃশব্দে রুমের একটা দরজা খুলল খালেদ । এটা দিয়েই বাইরে বের হওয়া যায় । বেরিয়ে দেখল সুজন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে ।
“ চল,’’ বলেই ঘুরে হাঁটা ধরল সুজন ।
খালেদও তার সাথে চলল । কোন কথা না বলে হাঁটছে দুজন । দ্রুতই জমিদারবাড়িটা চোখে পড়ল । কিছুক্ষণ আগে থেকেই একটা বোটকা বোটকা গন্ধ পাচ্ছিল খালেদ । সুজনের কাছ থেকেই আসছে মনে হচ্ছে ।
“ এই শালা, কয়দিন গোসল করিস না ,’’ অস্বস্তিকর নিরবতা ভাঙ্গার জন্য বলল খালেদ ।
কিন্তু সুজন কোন কথা না বলে হাটতে লাগল । খালেদ ভাবল আজ কেমন যেন রহস্যময় আচরন করছে সুজন । পরে ভাবনাটা উড়িয়ে দিল সে । জমিদারবাড়ির সীমানায় এসে হঠাৎই ভয় করতে লাগল খালেদের । কেন যেন মনে হল আঁধারটা কেমন যেন গাঢ়, ভীতিকর । প্রকৃতিও থম মেরে গেছে । এমন সময় ওর ভয়টা বাড়িয়ে দিতেই যেন দূর থেকে ভেসে এল কুকুরের প্রলম্বিত চিৎকার । আঁধারে দাঁড়িয়ে ডাকটা খুব অপার্থিব শোনাল তার কাছে ।
“ কি হইল, খাঁড়ায় রইলা যে ?,’’ সুজন খালেদকে বলল । সে একটু এগিয়ে গিয়েছে সামনের দিকে ।
সুজনের কণ্ঠস্বরে কি যেন একটা ছিল । তা শুনে গাঁয়ে কাটা দিয়ে উঠল তার । তাও সামনে বাড়ল সে । জমিদারবাড়ির মধ্যে পুরানো একটা কুয়া আছে । তলা একদম খটখটে শুকনো । ওটার পাশ দিয়ে এগিয়ে দুজনে তাদের পরিচিত জায়গাটায় বসল । জমিদারবাড়ির ভাঙ্গা কাছারির মধ্যে । সুজন গায়ে জড়ানো চাদরের নিচ থেকে গাঁজাভরা সিগারেট বের করল । বাড়ি থেকেই বানিয়ে নিয়ে আসে সে ।
হাতে নিয়েই খালেদ টের পেল জিনিসটা কেমন ভেজা ভেজা । “ আজ কি হল তোর ?,’’ প্রশ্ন করল সে ।“ভিজায় ফেলছিস মালটা’’
সুজন শুধু কাঁধ ঝাকিয়ে কিছু না বলে আগুন ধরিয়ে দিল । টানতে লাগল খালেদ । গাঁজার গন্ধটাও তেমন সুবিধার না । বাজে মাল ধরিয়ে দিয়েছে বোধহয় । তবে গন্ধটা ভাল না লাগলেও কিছুক্ষনের মধ্যেই মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করল । নেশা হতে শুরু করেছে । এরপর কতক্ষন কাটল খেয়াল নেই খালেদের । দুইটা শেষ করেছে ইতোমধ্যে । নেশায় পুরো বুঁদ । ওই অবস্থায় দেখল সুজন উঠে দাঁড়াচ্ছে ।
“ বইস ভাতিজা । ত্যাল ফ্যালাইয়া আসি ।’’
হাসল খালেদ । শালা, এখন প্রস্রাব করতে যাচ্ছে । সুজন ওর কাছ থেকে চলে যেতেই পুরানো ভয়টা ছেঁকে ধরল ওকে । মনকে বুঝ দিল এখনই ফিরে আসবে সে । ভয় কাটাতে আরেকটা কেবল ধরাতে যাবে, এমন সময় কুকুর ডেকে উঠল । এবার আর দূরে নয় । কাছাকাছি কোথাও থেকে ডাকটা ভেসে এল । তারপর অন্যদিক থেকে আরেকটা । তারপর আরেকটা । ওর মনে হল যেন একপাল কুকুর চলে এসেছে আশেপাশে । নেশা পুরো টুটে গেছে ওর । হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে । উঠে দাঁড়ালো টলমল পায়ে । বেরিয়ে আসল বাইরে । প্রস্রাব করতে কতদূর গেল শালা ।
“সুজন,’’ কেঁদে ফেলল খালেদ, চিৎকার করল, “সুজন । কোথায় গেলি ?’’
ওকে ভেংচি কাটতেই যেন থম মেরে থাকল প্রকৃতি । কোনদিকে যাচ্ছে খেয়াল নেই ওর । দেখল কুয়াটার কাছে চলে এসেছে । আরেকবার ডাকতে যাবে এমন সময় কুকুরটাকে চোখে পড়ল তার । আকারে বিশাল, কুচকুচে কালো রংয়ের কুকুর, একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে । মাথা উপরে তুলে রক্ত হিম করা একটা চিৎকার ছাড়ল সেটা । ঘুরে দৌড় দিল খালেদ । ছুটে গিয়ে কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেল । ভাল করে তাকাতে সুজনের চাদরটা দেখতে পেল । তার দিকে পিছন ফিরে দারান। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে যাবে তখনই ঘুরে মুখোমুখি হল সুজন । কিন্তু একি ? সুজন কোথায় ?? যেন একতাল পচা মাংসের দিকে তাকিয়ে আছে সে । বোটকা গন্ধটা কিসের বুঝতে পারল এতক্ষনে । তবে কি এতক্ষন.......... আর ভাবতে পারল না খালেদ ।
বীভৎস মুখে হাসল সুজনরূপী আতংকটা । “ ডরাইছ ভাতিজা ? ,’’ পরিচিত কিন্তু অন্য আরেকটা কণ্ঠস্বর । খুবই পরিচিত ।
আবার দৌড়ালো খালেদ । কিন্তু নিয়তি যাকে নিয়ে খেলছে কোনদিকেই নিস্তার নেই তার । কুয়ার পাশে ফিরতে দেখল সাক্ষাৎ যমদুতের মত পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে তিনটা ভয়ালরূপী কুকুর । আগেরটার সাথে আরও দুইটা যোগ দিয়েছে । তিনদিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলল কুকুরগুলো । আস্তে আস্তে বৃত্ত ছোট করে আনছে । পায়ে পায়ে পিছাচ্ছে খালেদ, হঠাৎ পায়ে কি যেন বাঁধল । দেখল কুয়ার দেয়ালে পা ঠেকে গেছে । কি ঘটতে চলেছে বুঝতে পারল সে । পিশাচটার হাতের ইশারায় মাঝখানের কুকুরটা ঝাপ দিল সামনের দিকে । টলে উঠে কুয়ার ভিতর পড়তে শুরু করল খালেদ । হাতদুটো বৃথাই বাতাস খামচালো কয়েকবার । ভেবেছিল শুকনা মাটিতে আছড়ে পড়বে । তার বদলে কটু গন্ধযুক্ত তেল চিটচিটে পানিতে আছড়ে পড়ল খালেদ । প্রায় সাথে সাথেই সাক্ষাৎ পাথরের মত তার উপর পড়ল কুকুরটা । পড়েই দু’চোয়ালে তার টুটি চেপে ধরল । সেটার নিঃশ্বাসের বোটকা গন্ধ পেল সে । একটা অন্ধকার চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলছে তাকে । অন্ধকারটা অতি পরিচিত ।
চলবে--------- (আগামী পর্বে সমাপ্ত)
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন