|
মোঃ জুনায়েদ খান
|
|
ছোটগল্প: 'মেয়েটা' - ২
18 February 2015, Wednesday
দুই
মানুষের জীবনে মাঝে মাঝে হুট করেই কিছু মন খারাপের ক্ষণ চলে আসে। ঘটনা ভেদে মনখারাপের তীব্রতাতেও তারতম্য ঘটে। দুই এর সাথে দুই যোগ করলে চার না হয়ে যখন তিন বা পৌনে তিন হয়ে যায় মন খারাপের ঘটনাগুলো ঠিক তখনি ঘটে। ধরে নিন জীবনের ফার্স্ট টাইম আপনি খিচুড়ি রাঁধছেন। কালার, ফ্লেভার টেস্ট সবকিছু ঠিকঠাক। আর দুইমিনিটের মধ্যেই আপনার খিচুড়ি হয়ে যাবে। সবাইকে তাক করে দেবেন আপনি। ফাইনাল টেস্টিং এর জন্য ঢাকনা খুললেন আর অমনি কোত্থেকেএকটা গোবরে পোকা উড়ে এসে আপনার খিচুড়ির পাতিলের মধ্যে আত্নাহুতি দিলো! কেমনটা লাগবে?
শুরুটাতে প্রচন্ড রাগ লাগলেও একটু পর কিন্তু ঠিকই মন খারাপ হবে আপনার। আমারও সেদিন মন খারাপ ছিলো। সাতদিন ধরে করা এক্সপেরিমেন্ট শেষ মুহুর্তে এসে ইন্সট্রুমেন্টাল ইররের জন্য পন্ড হয়ে গিয়েছিলো। প্রচন্ড মন খারাপের অনুভূতি নিয়ে জালাল ভাইয়ের এর চায়ের দোকানে বসে ছিলাম। প্রিয় আদা চা টাও বিস্বাদ লাগছিল।
মেয়েটা কখন এসেছে টের পাইনি।
‘এই যে চাখোর! আপনি চা খাচ্ছেন নাকি বিষ?’
আমি হকচকিয়ে শব্দ উৎসের দিকে তাকালাম। মেয়েটা তখন প্রায় খালি চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে ফেলেছে।
মুখ থেকে বাই ডিফল্ট সবচেয়ে কমন প্রশ্নটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেড়িয়ে এলো- ‘আপনি! আপনি এখানে কি করছেন?’
‘সিনেমা দেখতে এসছি! দেখছেন না টিভিতে কেমন ঢিসুম ঢিসুম রোমান্টিক সিনেমা হচ্ছে’- জালাল ভাইয়ের দোকানের সিলিঙয়ের একটু নিচে সেট করা সাদাকালো টিভির দিকে তাকিয়ে বললো মেয়েটা।
‘ও... তাহলে দেখেন’ - বলে দায়সারা একটা উত্তর দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। চার টেম্পারেচার বিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডেরও নিচে নেমে গেছে।
মেয়েটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও টিভির দিকে তাকাতে বাধ্য হলো। একমিনিট পূর্ণ হতে না হতে টিভি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো সে। তারপর সরাসরি আমার নাক বরারবর তাকিয়ে কিছুটা তিক্ততা মিশিয়ে বলল, - ‘আচ্ছা আপনার সমস্যাটা কি? চায়ের দোকানে কি কেউ সিনেমা দেখতে আসে?’
আমি বললাম, - ‘মসজিদে কিন্তু চোর চুরি করতেই যায়!’
মেয়েটার কন্ঠে তিক্ততার সাথে কিছুটা ঝালও যোগ হলো- ‘হোয়াট ডু ইউ মিন??’
কষ্টের মাঝেও হাসি চলে এল। হাসিটাকে নিয়ন্ত্রণ করে গম্ভীর মুখে বললাম,- ‘নাথিং সিরিয়াস। জাস্ট এন্সার্ড ইউওর কোশ্চেন।’
মেয়েটার কণ্ঠ গিরগিটির মত বদলে গেলো। নিচু স্বরে বললো,- ‘আপনার কি খুব মন খারাপ?’
‘তা জেনে আপনি কি করবেন? পত্রিকায় ছাপবেন?’ – মুখ ফোঁসকে বলে ফেললাম।
‘এইযে দেখুন আমি কিন্তু আপনার সাথে খুব নম্র ভাবে কথা বলছি। আপনি এমন হিল জুতার মত খট খট করছেন কেন?’ অভিমানের সুরে বলল মেয়েটা।
আমিও আমার অবস্থান থেকে সরলাম না। - ‘আপনার উদ্দেশ্যটা কি বলুন তো? হঠাৎ আমার পিছু নিলেন কেন?’
মেয়েটা কোন প্রতিক্রিয়াই দেখাল না। উলটো আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, ‘হাঁটবেন আমার সাথে?’
চোখে মুখে বিস্ময় মেখে তাকালাম মেয়েটার দিকে। কিছু বললাম না। মেয়েটাই বলল, - ‘আপত্তি আছে নাকি ভয় পাচ্ছেন?’
দ্বিধা কাঁটিয়ে বললাম, - ‘চলুন...’
হাঁটার জন্য বেড়িয়ে পড়লেও খুব বেশীদূর হাঁটা হলোনা। বোটানিক্যাল গার্ডেনের সামনে এসে থেমে গেলাম আমরা। মেয়েটার দ্বিতীয় অনুরোধে বসতে হলো ওরই প্রীয় এক জায়গায়। আহামরি কিছুনা। ঝাউ গাছের নিচে একটা কংক্রিটের বেঞ্চ। পূর্ব দিকে মুখ করে বেঞ্চটায় বসলে নদী দেখা যায়। টুকটাক অসংলগ্ন কথা তো চলছিলই...
‘বললেন না তো?’
‘কি বলবো?’
‘কি হয়েছে? গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া?’
‘গার্লফ্রেন্ড থাকলে তো!’
‘তো?’
‘তো কিছু না।’
‘কিছু না তো একঘন্টা ধরে চা খাচ্ছিলেন কেন?’
‘এমনি...’
‘বলার মত না হলে বলতে হবে না। জানেন, মন খারাপ ওয়ালা মানুষ দেখলে আমার না খুব খারাপ লাগে। কিন্তু তাদের জন্য কিচ্ছু করতে পারিনা। আসাদের মা মারা যাবার পর যেদিন ওর সাথে প্রথম দেখা করেছিলাম সেদিন আসাদ ঠিক আপনার মত অস্বাভাবিক আচরণ করছিলো। আপনি যেমন চায়ের গ্লাস হাতে একঘন্টা বসে ছিলেন, আসাদও আইসক্রিম হাতে এভাবে বসে ছিল। আমি যে এসে ওর পাশে বসেছি এটা বুঝতেই ওর পাঁচ মিনিট লেগেছিল।’
‘প্যাথেটিক। আমাকে দেখে কি আপনার তাই মনে হচ্ছে?’
‘হুম। তারচেয়েও বেশী কিছু!’
‘আরে নাহ!’
তারপর মন খারাপের অজানা কারণ অবলীলায় ফাঁস করে দিলাম মেয়েটার কাছে। মেয়েটা প্রথমে খুব মনযোগ দিয়ে শুনলো, তারপর মুচকি হাসলো এবং তারও পর বলল, - ‘মন খারাপ নিয়ে মানুষ এমন বিলাসীতাও করে??”
সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলো। আমরা উঠলাম। একটা রিক্সা নিয়ে চলে গেল মেয়েটা। আমি হাঁটতে থাকলাম। কত বিচিত্র মানুষই না আছে পৃথিবীতে। স্বল্প পরিচিত মানুষের মন খারাপও যেন এদের কাছে অনেক বড় বিষয়।
ভালো মেয়ে! কিন্তু ‘আসাদ’ টা কে?
(চলবে...)
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন