অপূর্ব এবার চতুর্থ শ্রেণীতে পরে। মাথার মধ্যে সারাক্ষণ তার পশু পাখি ঘুরে বেড়ায়। বিশেষ করে পাখি তার ভীষণ প্রিয়। বাংলাদেশের অনেক পাখির নাম সে গড় গড় করে বলে দিতে পারে। যেমন দোয়েল, টিয়া, ময়না, শালিক, বাবুই, টুনটুনি, চড়ূই, ঘুঘু, বক, ডাহুক, কোকিল, কাক, প্যাঁচা, ধনেশ, চিল, মাছরাঙা, শ্যামা, বউ কথা কও, শকুন, আবাবিল, বুলবুলি, ফিঙে, হাড়গিলা, হড়িয়াল, কবুতর, মুরগী, হাঁস, হলদে পাখি ইত্যাদি সে একদমে বলে যেতে পারে।
অপূর্বর পাখি পালার খুব শখ। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সে কোন পাখি ধরতে পারে না। তাই পাখি পালাও হয় না। আর গ্রাম দেশে সাধারণত মোরগ, মুরগী, হাঁস, কবুতর এই সব পাখি হাটে বাজারে বেচা কেনা হয়। কিন্তু সে এগুলো পালতে চায় না। সে চায় ঘুঘু, টিয়া বা ময়না জাতীয় পাখি পালতে। ময়না আর টিয়া পাখি নাকি কথা বলতে পারে। ছোট ছোট কথা নাকি তাদের আদর দিয়ে শেখানো যায়।
স্কুল এখন বন্ধ। শীতের ছুটি। অপূর্ব তার নানা বাড়িতে বেড়াতে গেলো। নানা বাড়িতে বেড়ানোর আলাদা একটা মজা আছে। ছোট মামা, অপূর্বকে নিয়ে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। তখন সে অনেক কিছু দেখতে পায়। কিভাবে জেলেরা মাছ ধরে, কিভাবে নৌকা বাইতে হয় ইত্যাদি অনেক কিছু। ছোট মামার সাথে থেকে থেকে অপূর্ব এসব দেখেছে। এখন সে ছোট, তাই মাছ ধরতে কিংবা নৌকা বাইতে পারবে না। কিন্তু বড় হলে ঠিকই পারবে। অপূর্ব মনে মনে ভাবে।
একদিন অপূর্ব তার ছোট মামার কাছে আবদার করে বলে,
-ছোট মামা আমাকে একটা পাখি ধরে দাও না। আমার খুব পাখি পালার শখ। ধরে দাও না।
ছোট মামা অপূর্বকে বলে,
-তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? কীভাবে তুই পাখি ধরবি? পাখির কাছে গেলেইতো সে ফুড়ুৎ দিয়ে উড়াল দিবে।
অপূর্বর মন খারাপ হয়ে গেলো। আসলেইতো, পাখি কীভাবে ধরবে? কিন্তু হঠাৎ করে অপূর্বর চোখ চক চক করে উঠলো। গতকাল সে ছোট খালামনির সাথে পুকুর ধারে পেয়ারা বাগানে গিয়েছিল। সেখানে একটা লিচু গাছে পাখির বাসা দেখেছে। বড় লিচু গাছ। তাই গাছে উঠে দেখা সম্ভব হয়নি, ওটাতে পাখি আছে কিনা। তাছাড়া সে গাছে উঠতেও পারে না।
-ছোট মামা.. ছোট মামা..., পুকুর ধারে বড় একটা লিচু গাছ আছে না? ওখানে আমি একটা পাখির বাসা দেখেছি।
অপূর্ব লাফিয়ে উঠে ছোট মামাকে বললো।
-কী বলিস তুই? চলতো দেখে আসি।
এই কথা বলে ছোট মামা আর অপূর্ব পুকুর ধারে পাখির বাসা দেখতে চলে গেলো। সত্যি সত্যি তারা একটা পাখির বাসা দেখতে পেলো।
-এখনতো সন্ধ্যা হয়ে এলো প্রায়। তাই গাছে উঠার ভয় আছে। চল কাল সকালে আমরা দেখবো কী করা যায়।
এই বলে ছোট মামা অপূর্বকে নিয়ে ঘরে ফিরে এলো।
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ। ছোট মামা অপূর্বকে সাথে নিয়ে তার রুমে ঘুমাতে গেল।
-হ্যাঁরে অপূর্ব, তুই তো দেখি এখন দিব্বি তোর মাকে ছাড়াই থাকতে পারিস।
শুয়ে শুয়ে ছোট মামা অপূর্বকে বলে।
-আমি এখন বড় হয়েছি না? তাই পারি। এখন আর খারাপ লাগে না।
অপূর্ব তার ছোট মামাকে বলে।
-তুই যখন ক্লাস টুতে পড়তিস, তখন একবার পুজোর ছুটিতে খুব বায়না ধরেছিলি আমার সাথে আমাদের বাড়ি আসবি। কিন্তু তুই, তোর মাকে ছাড়া থাকতে পারবি কিনা, এই ভয়ে তোকে আনতে চাইনি। তোর কান্নাকাটিতে আমি বাধ্য হয়েছিলাম তোকে নিয়ে আসতে। কিন্তু যখন রাতে ঘুমাতে যাবি, তখনই শুরু হল তোর কান্না। মার কাছে যাবি। অনেক চেষ্টা করেও তোর কান্না থামাতে পারিনি সেদিন। শেষ পর্যন্ত একটা রিক্সা নিয়ে ঐ রাতেই তোকে তোর মার কাছে দিয়ে আসি।
ছোট মামা অপূর্বকে তার ছোট বেলার গল্প বলতে লাগলো। অপূর্ব শুনে একটু লজ্জা পেলো। তারপর মামা ভাগ্নে গল্প করতে করতে এক সময় দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়লো।
খুব সকালে অপূর্বর ঘুম ভেঙে গেলো। রাতটা তার মোটামুটি উত্তেজনায়ই কেটেছে। কখন সকাল হবে। কখন তারা পাখি ধরবে। ছোট মামা তার ছোট বেলার কথা বলে লজ্জায় ফেলে দিয়েছিল। আর সেই লজ্জায় যে কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছিল মনেই নেই। মামাকে বিছানায় রেখে সে পুকুর ধারে চলে গেলো পাখির বাসাটা আরেক নজর দেখে আসতে। এসে দেখে ওমা দু’টো ঘুঘু দেখি ওখানে বসে আছে। অপূর্ব আরও একটু এগিয়ে ঠিক লিচু গাছটার নীচে ঘুঘুর বাসা বরাবর দাঁড়াল। ওপর দিকে চেয়ে ভালো ভাবে দেখার চেষ্টা করলো। হঠাৎ তার কানে কেমন জানি একটা শব্দ এলো। কান পেতে ভালো ভাবে শুনার চেষ্টা করলো। এবার সে স্পষ্ট কিচিরমিচির আওয়াজ শুনতে পেল। অপূর্বতো খুশিতে আটখানা। ঘুঘুর বাচ্চাও আছে। তাহলে আর চিন্তা কী। বাচ্চা নিয়ে সে খাঁচায় ভরে পালবে। মা ঘুঘু আর বাবা ঘুঘুর তার দরকার নেই। বাঁচাগুলো যখন বড় হবে, তখন তারা তার কথা শুনবে। নিজের মতো করে তাদের কথা শিখাতে পারবে। ভাবতে ভাবতে অপূর্ব দৌড়ে ছোট মামাকে ডাকতে গেলো।
ছোট মামাকে সাথে নিয়ে অপূর্ব আবার পুকুর ধারে লিচু গাছের ওখানটায় এলো। দু’জনে বাচ্চার কিচিরমিচির আওয়াজ শুনতে পেল। কিন্তু অপূর্ব মা ঘুঘু আর বাবা ঘুঘুকে দেখল না। তখন সে ছোট মামাকে জিজ্ঞেস করল,
- আচ্ছা ছোট মামা, আমিতো তখন মা ঘুঘু আর বাবা ঘুঘুকে দেখেছিলাম। ওরা কোথায় গেলো?
ছোট মামা বলল,
-মা ঘুঘু আর বাবা ঘুঘু বাচ্চাদের জন্য খাবার যোগাড় করতে গেছে। এক্ষুনি এসে পড়বে। চল, জলদী বাচ্চাগুলোকে পারার ব্যবস্থা করি। ওদের মা বাবা আসার আগেই পেরে ফেলতে হবে।
অপূর্বকে নীচে রেখে ছোট মামা লিচু গাছে উঠলো। আস্তে আস্তে ঘুঘুর বাসার কাছে গেলো। আর তখনই বাচ্চাগুলো জোড়ে কিচিরমিচির করতে শুরু করল। খুব সম্ভবত ভয় পেয়েছে। বাচ্চাদের কান্না শুনে কোত্থেকে যেন হঠাৎ করে মা ঘুঘু আর বাবা ঘুঘু দু’জনেই উড়ে এলো। কিন্তু ঘুঘুতো আর মানুষের সাথে পারবে না। তাই তারা শুধু ছোট মামার মাথার চারিপাশ দিয়ে উড়তে লাগলো। বাসার মধ্যে দু’টো বাচ্চা ছিল। দু’টোকেই সঙ্গে নিয়ে ছোট মামা কৌশলে নীচে নেমে এলো।
অপূর্ব যেন হাতে আসমান পেল। তার খুশি দেখে কে। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেলো বাচ্চা দুটোকে কোথায় রাখবে।
-তুই বাচ্চা দুটো দেখে রাখ। আমি বাজারে যাচ্ছি একটা খাঁচা কিনে আনতে।
এই বলে ছোট মামা সকালের নাস্তা খেয়ে বাজারে চলে গেল। বাজার থেকে একটা খাঁচা কিনে তারপর বাড়ি ফিরল। বাড়ি ফিরে এসে দেখে অপূর্ব তখনো নাস্তা না খেয়ে ঘুঘুর বাচ্চা দুটোকে নিয়ে পরে আছে। কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। এদিকে মা ঘুঘু আর বাবা ঘুঘু সন্তানদের হারিয়ে পাগলের মতো ছোট মামাদের বাড়ির চারিপাশে ঘুর ঘুর করে উড়ে বেড়াতে লাগলো।
খাঁচার মধ্যে ঘুঘুর বাচ্চা দু’টোকে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা, সেই সকাল থেকে অপূর্ব করে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই খাচ্ছে না তারা। আর বাচ্চা দুটো খাচ্ছে না বলে অপূর্বও খাচ্ছে না। সে তাদের কলা দিলো, রুটি দিলো, চাল দিলো, মুড়ি দিলো, গম দিলো কিন্তু কিছুই খায় না। সকাল গড়িয়ে দুপুর হল। বাচ্চা দুটোও খাচ্ছে না, আর সেই সাথে অপূর্বও খাচ্ছে না।
ভাগ্নের অবস্থা খারাপ দেখে ছোট মামা আর চুপ থাকতে পারলো না। ভাগ্নে সেই সকাল থেকে না খেয়ে আছে। আর এখন বাজে বিকাল পাঁচটা। তার চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। মনে হয় এই কেঁদে ফেলবে। এমন অবস্থা।
-আমি যা বলি মন দিয়ে শোন বোকা ছেলে।
ছোট মামা অপূর্বকে বলল।
প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে অপূর্ব ছোট মামাকে বলে,
-বল, আমি শুনছি।
-তোকে যে গতরাতে তোর ছোট বেলার কথা বলেছিলাম তোর মনে আছে?
অপূর্ব মাথা নেড়ে ছোট মামার কথায় সায় দেয়।
-তুই যেমন ছোট বেলায় তোর মাকে ছাড়া কারো হাতে খাসনি, আবার কোথায় গিয়ে থাকতেও পারিসনি, ঘুঘুর বাচ্চাদেরও একই অবস্থ হয়েছে। এরা এখন ছোট। তাই তারাও তাদের মাকে ছাড়া কিছু খাবে না। আর মাকে ছাড়া থাকতেও পারবে না। সারাক্ষণই কান্নাকাটি করবে। আমিও চাইনি পাখির বাচ্চা দু’টোকে পেরে দিতে। তাই তোকে রাতে তোর ছোট বেলার গল্পটা শুনিয়েছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম তোর এতে কোন শিক্ষা হয়নি, তখন তোকে বাচ্চা দু’টো পেরে দিলাম, যাতে তোর হাতে নাতে একটা শিক্ষা হয়।
ছোট মামা কথাগুলো অপূর্বকে বলে চুপ করে রইলো। অপূর্ব কিছুক্ষণ কোন কথা বলল না। মিনিট দশেক পরে অপূর্ব খুবই ক্ষীণ স্বরে ছোট মামাকে বলল,
-ছোট মামা, চল বাচ্চা দু’টোকে ওদের মার কাছে রেখে আসি।
ছোট মামা অপূর্বকে বলে,
-এতে তোর মন খারাপ হবে না? তোর পাখি পালার এতো শখ!
-না, হবে না। আমি আমার ভুল বুঝতে পেড়েছি ছোট মামা। আমার মামুনির জন্য মন খারাপ লাগছে। বাচ্চা দু’টোকে ওদের মা বাবার কাছে ফেরত দিয়ে আমাকে এক্ষুনি মামুনির কাছে রেখে এসো। আমি আর কক্ষনো কোন পাখির বাচ্চাকে তার মা বাবার কাছ থেকে আলাদা করবো না।
কথাগুলো বলে অপূর্ব মামাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিল।
ছোট মামা আর দেড়ি না করে অপূর্বকে নিয়ে ঘুঘুর বাচ্চা দু’টোকে ওদের বাসায় রেখে এলো। ছোট মামা যখন লিচু গাছ থেকে নেমে এলো, তার সাথে সাথেই মা ঘুঘু এবং বাবা ঘুঘু উড়ে এসে বাচ্চাদের কাছে বসলো। বাচ্চা দু’টো তাদের মা বাবাকে দেখে আনন্দে কিচিরমিচির করতে শুরু করলো।
মা ঘুঘু আর বাবা ঘুঘু আদর করে করে ঠোঁট দিয়ে বাচ্চাদের খাইয়ে দিচ্ছে। অথচ সারাদিন চেষ্টা করেও অপূর্ব তাদের কিছুই খাওয়াতে পারে নাই। অপূর্ব আর ছোট মামা লিচু গাছ থেকে একটু দূরে সরে এসে বাচ্চাদের খাওয়া দেখছে। অপূর্বর কান্না মাখা চেহারায় এখন খুশীর ঝিলিক বইছে। ছোট মামাকে বলছে,
-দেখ ছোট মামা, কি সুন্দর করে খাওয়াচ্ছে। আর বাচ্চাগুলো লক্ষ্মী সোনার মতো খেয়ে যাচ্ছে।
ছোট মামাও দেখছে। তার চোখের কোন বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে আনন্দে। বাচ্চা দু’টোকে মা বাবার কাছ থেকে আলাদা করার অপরাধবোধটা যে তাকেও কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন