ফোন টা আসল দুপুর দু'টা পাঁচ এ।
আমার পরীক্ষা চলছে। অনার্স সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। প্রতি পরীক্ষার মাঝে তিনদিন করে বন্ধ। বন্ধের দিনগুলোয় ঠিক দুটোয় শুয়ে পরি আমি। দু ঘণ্টা ঘুম। তারপর পড়তে বসা। আমি ফোন সাইলেন্ট না করে ঘুমাতে পারি না। ঠিক দুটায় ফোন সাইলেন্ট হয়। সেদিন কেন যেন ৫ মিনিট দেরী হয়ে গেল। দুটা পাঁচ! ফোন সাইলেন্ট করতে গিয়ে দেখি অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন, আমি কপাল কুঁচকে ফোন ধরলাম, 'হ্যালো?'
অপরিচিত কণ্ঠ বলল, 'আমনের আব্বায় অসুস্থ, এখনই ঢাকায় আহেন'।
ছোট্ট একটা সংবাদ। এই সংবাদ নিয়ে বিচলিত হওয়ার খুব বেশি কিছু থাকার কথা না! কিন্তু আমি বিচলিত হলাম। আমার বাবা, দেখতে রাসেল ক্রো'র মত মানুষ। আমি আমার সেই আঠার-উনিশ বছরের জীবনে কখনও দেখি নি, মানুষটার সামান্য সর্দি লেগেছে, জ্বর এসেছে। সেই মানুষটা কতটা অসুস্থ হলে তার বাসার বুয়া আমাকে ফোন দেয়! আব্বা ঢাকায় একা থাকেন, অতি ক্ষুদ্র এক চাকুরি করেন, তার চেয়েও ক্ষুদ্র এক ঘরে বাসা ভাড়া থাকেন। আমি থাকি জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির হলে। পরদিন আমার সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার সেকেন্ড পরীক্ষা। আমার পকেটে সাকুল্যে তেইশ টাকা। আমি প্যান্ট শার্ট পড়তে গিয়ে আবিস্কার করলাম, আমার হাত-পা কাঁপছে, সারা শরীর বেয়ে স্রোতের মতন ঘাম নামছে। আমি স্থির হতে চুপচাপ বিছানায় বসলাম। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলাম, 'আমার এমন কেন লাগছে'!
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আমার খুব একটা দেরী হল না। আমার বাবা, সারাটা জীবন বিশাল বিশাল স্বপ্ন বুকে নিয়ে বিরামহীন খেঁটে যাওয়া এই মানুষটার নিশ্চয়ই ভয়ংকর কিছু হয়েছে! না হলে তার বাসার বুয়া আমাকে ফোন দিত না। এই মানুষটা তার সারাজীবনে সামান্য ঠাণ্ডা লাগার মত অসুস্থতায়ও কখনও ভোগেন নি। তার কি এমন হয়েছে যে এমন জরুরী সংবাদ! আমার কেন যেন মনে হল, তার ভয়ংকর কিছু হয়েছে! খুব ভয়ংকর কিছু! তিনি মারা যান নি তো! আমার বুকের ভেতরটা কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে। ঐ ছোট্ট একটা সংবাদে কি ছিল আমি জানি না, কিন্তু আমি যেন সমূলে কেঁপে উঠলাম। আব্বার কিছু হলে আমি কি করব? আমার মা, আমার ছোট ভাই, ছোট বোন, দাদী! আমি কি করব! আমাদের তো আর কেউ নেই, কেউ না! ঐ মানুষটার ঐ ছোট্ট চাকরি, অতটুকু অস্তিত্ব, অতটুকু বেঁচে থাকা, আর এতো এতোগুলো মানুষের জীবনের প্রতিমুহূর্তের বেঁচে থাকার নিঃশ্বাস। মাত্র ৫ মিনিট, ৫ টা মিনিট আমি বসে রইলাম। এই ৫ মিনিটে আঠার-উনিশ বছরের সেই ছোট্ট আমি যেন ভেতরে ভেতরে বেড়ে উঠলাম আরও পঁচিশ বছর। আমি ফ্যানের নিচে বসে রইলাম দীর্ঘ সময়। তারপর ধীর পায়ে উঠে বাথরুমে গেলাম। দীর্ঘ সময় নিয়ে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করলাম। রুমে ফিরে বন্ধু মহিবুল কে ফোন দিলাম, ও তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ফোন দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললাম, 'তোর কাছে টাকা আছে?'
ও বলল, আছে'।
আমি বললাম, কত?'
ও বলল, কত লাগবে?'
আমি বললাম, যত আছে, তার সব। আর এখুনি মিরপুর চলে আয়। মিরপুর ১২'।
ও মিরপুর চলে এলো। আমি আর মহিবুল আব্বার সেই মুরগীর খুপরির মতন ছোট্ট ঘরটায় ঢুকলাম। অন্ধকার ঘর। ছোট্ট চৌকিটাতে মশারি টানানো। আমি গিয়ে লাইট জ্বালালাম, মশারীর ভেতর মানুষটা শুয়ে আছেন। আমি মশারি খুললাম, একটা মানুষ শুয়ে আছেন, মানুষটাকে আমি চিনি? মানুষটার মুখটা বীভৎস ভাবে বেঁকে আছে, ডান দিকের হাত আর পা শক্ত হয়ে আছে। আমি স্বাভাবিক গলায় ডাকলাম, আব্বা!'
আব্বা চেষ্টা করলেন ঘাড় ঘোরাতে। পারলেন না। ভয়ংকর কণ্ঠস্বরে বীভৎস উচ্চারণে তিনি আমাকে ডাকলেন, 'আয়্যব্ব্যা, আয়্যব্ব্যা, আয়্যব্ব্যা!'
মানুষটা আমাকে ডাকছেন। 'আব্বা' বলে ডাকছেন, কিন্তু তার বিকৃত হয়ে যাওয়া মুখ থেকে সেই শব্দ বের হচ্ছে আয়্যব্ব্যা' হয়ে! আমার কি হল জানি না, আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষটার মুখটা আমার কোলে তুলে নিলাম। মানুষটা কাঁদলেন! কি অদ্ভুত ভয়ংকর সেই কান্নার শব্দ! যেন জান্তব গোঙানি! তার চোখের জলে আমার কোল ভিজে যাচ্ছে। আমি স্থীর হয়ে তাকিয়ে আছি। নিষ্কম্প, অবিচল, নিস্তব্দ! মানুষটা আরও কি কি সব বললেন! কত কি!! তার সেই জান্তব গোঙানি, সেই কান্না, সেই ভয়ংকর অদ্ভুত শব্দে বলা 'আয়্যব্ব্যা' শব্দগুলো আমি যেন শুনছিলাম না। আমি যেন তখন অন্য কোথাও।
আমি তার সারা মুখে হাত বোলাতে বোলাতে বললাম, 'আব্বা, এমন ভেঙে পড়লে চলে? মানুষের অসুখ বিসুখ হয় না? মানুষ স্ট্রোক করে না? আবার সুস্থও হয়। এতো ভেঙে পড়ার কি আছে!'
আমার বাবা, সেই বাবা। আমার দেখা সবচেয়ে সুপুরুষ সেই মানুষটা ভেঙেচুড়ে দোমড়ানো-মোচড়ানো মানবদেহের একটা দলা হয়ে আমার কোলের ভেতর ডুকরে কাঁদছেন। একটা ছোট্ট বাচ্চার মতন। তার চোখভর্তি পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহতম অসহায়ত্ব, শুন্যতা, আশ্রয়হীনতা। আঠারো-উনিশ বছরের সদ্য ঢাকা শহরে আসা সেই আমি, মানুষটার মুখটা কোলের ভেতর নিয়ে বসে আছি। তার অবশ হয়ে যাওয়া হাত, বিকৃত হয়ে যাওয়া মুখ আমি আমার ছোট্ট দুহাতে ধরে আছি। সেই হাতের স্পর্শে যেন বলতে চাইছি, 'এই যে আমি আছি! এই যে আমি! আর কিসের ভয়? কিসের ভয়? আর কোন ভয় নেই, কোন ভয় নেই!'
কিন্তু আত্মীয় স্বজন, পরিবার-পরিজনহীন সেই ঢাকা শহরে কি করব আমি! আমি এই শহরের পথ চিনি না, মানুষ চিনি না, হাস্পাতাল-ডাক্তার কিছুই চিনি না। আমি কই যাব? মহিবুল বলল, 'চল, ঢাকা মেডিকেল নিয়া যাই'।
মানুষটাকে একটা সিএনজিতে তুলে আমরা ঢাকা মেডিকেল গেলাম। পুরোটা পথ জুড়ে মানুষটা বমি করলেন, আমার চুল, মাথা, মুখ, ঘাড়, শরীর সেই বমির স্রোতে ভেসে গেল। আমি মানুষটাকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখলাম, মানুষটা প্রতিবার বমির দমক শেষ হতেই সেই অদ্ভুত ভয়ংকর স্বরে গুঙিয়ে ওঠেন, 'আয়্যব্ব্যা, আয়্যব্ব্যা'!
হাসপাতালে কত দিন ছিলাম? রোজ সকালে মানুষটাকে হাসপাতালে রেখে আমি চলে যাই ক্যাম্পাসে, চার ঘণ্টা পরীক্ষা দেই। তারপর আবার চলে আসি, মানুষটার বিছানার পাশে বসে পরীক্ষার পড়া পড়ি। মানুষটা ঘুমান। ঘুমের ভেতর হঠাৎ ফুঁপিয়ে কাঁপেন, কেঁদে ওঠেন বাচ্চাদের মতন, 'আমার মা, আমার মা'।
তার তখন দুটো মা। একটি মা ছোট, আমার দুই তিন বছরের ছোট বোন, আর আমার বৃদ্ধ দাদী। দাদী আমাকে ফোন দিয়ে কাঁদেন, আমার ছোট ভাই ফোন দিয়ে কাঁদে, আমার মা ফোন দিয়ে কাঁদেন। আমি ফোন ধরে স্থীর গলায় বলি, 'এতো কান্নাকাটির কি আছে! মানুষের কি রোগ বালাই হয় না? এতো অস্থীর হওয়ার কি আছে? সব ঠিক আছে।'
আসলে কিছুই ঠিক নেই। আব্বার ছোট্ট চাকুরীর অফিস বেতন দেয় না, আমার ধার করা টাকারা ফুঁড়িয়ে আসে, আব্বার ডান পাশটা অবশ হয়ে থাকে, আমার পরীক্ষাগুলো খারাপ হতে থাকে। আমার নির্ঘুম রাতেরা ভোর হতে থাকে, কিন্তু অন্ধকার কাটে না। যেন আরও গাড় হতে থাকে, গাড় থেকে গাড়। আব্বা যতক্ষণ জেগে থাকেন কাঁদেন, মা কাঁদেন, দাদী কাঁদেন, বোন কাঁদে, ভাই কাঁদে। কাঁদি না শুধু আমি। সেই ছোট্ট আমি। আঠার উনিশ বছরের ঢাকায় আসা ছোট্ট আমি। আমি যেন প্রতিদিন বড় হতে থাকি কয়েক বছর করে, প্রতি মুহূর্তে কয়েক মাস। আমার কান্না পায় না, হাসি পায় না, দুঃখ হয় না, আনন্দ হয় না। আমি যেন অন্য কেউ, সেই অন্য কেউকে আমি চিনি না। চিনি না। চিনি না।
জীবন কি অদ্ভুত খেয়ালের, কি অদ্ভুত খেলার। আমার ছোট ভাই ঢাকা আসে, আমি তারও দিন কয় বাদে আব্বাকে তারসাথে বাড়ি পাঠিয়ে দেই। লঞ্চে কেবিন ভাড়া করে আব্বাকে তুলে দেই তাতে। পাঁচ টাকা, দশ টাকা, একশ টাকা, পঞ্চাশ টাকার হিসেব কষে জীবন কাটিয়ে দেয়া আমার বাবা সেই কেবিনে বসে শুন্য চোখে তাকিয়ে থাকেন আমার দিকে, কিংবা অবাক চোখে। আমি তার করুণ অসহায়ত্বে ভরা মুখখানা আমার বুকের সাথে চেপে ধরি, আব্বা হাউমাউ করে কাঁদেন, কাঁদেন আর কাঁদেন। আমি পাথরের মত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি মাটির মানুষটাকে জড়িয়ে। কিন্তু আমি আমার ভেতরে কোথাও যেন মাটি খুঁজে পাই না, আর্দ্রতা খুঁজে পাই না। এক খটখটে শক্ত পাথরের মানুষ যেন আমি। কিংবা এই আমি যেন আমি নই, এ যেন অন্য কেউ। অন্য অচেনা কেউ।
সতের দিন বাদে, ইউনিভার্সিটি হলের একলা রুমের বন্ধ দরোজার গভীর অন্ধকারে আমি কাঁদি। আমি ঘুমাতে পারি না। আমার ভেতরের মাটিরা যেন পাথর ভেঙে জেগে ওঠে। আর্দ্র হয়। হুড়মুড় করে খসে পড়ে শক্ত পাথরের আস্তরণ। সেই একলা ঘরে, সেই নিকষ অন্ধকারে আমি হাউমাউ করে কাঁদি! থরথর করে কাঁপি। সেই কান্নায় ভেসে যায় রাতের অন্ধকার, ভেসে যায় বালিশের বুক, চোখের কোল, ভেসে যায় পাথর দেয়াল।
আমি কাঁদি, হাউমাউ করে কাঁদি, সেই কান্না কেউ শোনে না। কেউ না।
জগতে কিছু কিছু কান্না একার থাকে, শুধুই একার। এই কান্নারা জগতের শুদ্ধতম কান্না, শ্রেষ্ঠতম কান্না।
এই কান্না মন ও মানুষের কান্না।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন