|
জুলিয়ান সিদ্দিকী
|
|
রাজনৈতিক গল্প: নেতা
12 February 2015, Thursday
বিরোধীদলীয় নেত্রীর ডাকা অবরোধের সংবাদে চোখ পড়তেই আকস্মিক খুশিতে পত্রিকাটাকে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে রমজান আলি। স্বৈরাচার আর সামরিক জান্তা সরকার বিরোধী আন্দোলনে বাংলার কোরাজন বলে খ্যাত এই নেত্রী তরুণ-যুবা এমন কি বৃদ্ধদের মনেও ভালোবাসার পাকাপোক্ত একটি আসন বাগিয়ে বসতে পেরেছিলেন। আপসহীনতার কারণে রাজনীতিতেও ভালোরকম অনুকরণীয় হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। অথচ সেই খালেদা জিয়া প্রথম যখন রাজাকার আর যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থনে হরতাল ডেকেছিলেন, সেদিন যেন মটমট শব্দে বুকের পাঁজর ভাঙতে আরম্ভ করেছিল তার।
এক সময়ের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা, সম্মুখ সমরে পায়ে গুলির আঘাত নিয়েও অনড় ছিল। সেই রমজান আলি হরতাল আর অবরোধের সংবাদে খুশি হলেও প্রকাশ্যে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থনে প্রিয় নেত্রীকে সরব হতে দেখে লজ্জা পেয়েছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল তখনই ছুটে গিয়ে বলে, বাংলার কোরাজন, আপসহীন নেত্রী, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন আর বাইশ দলীয় ঐক্যজোটের একমাত্র অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ম্যাডাম খালেদা জিয়া এই ভুলটি আপনি করতে যাবেন না। মনে-প্রাণে যে রাজাকার, যার রক্তে বিশ্বাসঘাতকতার বীজ সে কোনোদিন বাংলার ভালো চাইতে পারে না। আপনার আড়ালে থেকে তারা তাদের উদ্দেশ্য পূরণ করে নেবে। মাঝখান থেকে আপনি কলঙ্কিত হবেন।
কিন্তু রমজান আলি কোথাকার কে, দলের জন্যে কী বা এমন অবদান তার যে, ম্যাডাম তাকে চিনবেন বা তার কথায় গুরুত্ব দেবেন? সে নেতা হলেও চুনোপুঁটি আর নিচু ধরনের নেতা। মানুষ হিসেবে নিকৃষ্ট স্বার্থপর, পরশ্রীকাতর আর লোভী একজন মানুষ। তার মাথা এখন খুবই সক্রিয়। হরতাল আর অবরোধের সময়গুলোই তার পুঁজি বৃদ্ধি হয়। শক্তি সংগঠিত হয় আর নতুন করে জেগে ওঠে দেহমন। সে সময়গুলোতে নিজেকে আবিষ্কার করে পলিত-কেশরাজির একষট্টি বছর বয়সেও দুরন্ত অশ্বের তেজোদৃপ্ত তারুণ্যে। শামিমা বেগমের কাতর অনুনয় আর বারবার ক্ষমা চাওয়াটাকে উপভোগ করে জান্তব উল্লাসে। তারপর বীরদর্পে যখন রেজিয়ার ঘরে ঢুকে যায় তখন শামিমা বেগম কিংবা আত্মীয়-স্বজনের কটূক্তির ভাষাগুলোও যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
মনে মনে উপায় খুঁজছিল রমজান আলি। খুব সহজ আর নিখুঁত কোনো উপায়। আইন-আদালত, থানা-পুলিশ যাতে স্পর্শ করতেও না পারে। রাজনৈতিক অঙ্গনে একজন ইউনিয়ন নেতার চেয়ে থানা পর্যায়ের নেতার কদর আর জোর বেশি। সে তুলনায় রমজান আলি যে গোছের নেতা, দলের কেন্দ্রীয় সদস্যরা আরো বেশি ক্ষমতা আর শক্তির অধিকারী। সে সব শক্তি আর ক্ষমতার উৎস সময়ে সময়ে পরিবর্তন হলেও শ্রমিক ইউনিয়নে তেমন একটা বদল আসে না। সরকার যে খুশি আসুক, কি নাই থাকুক শ্রমিক নেতা আর শ্রমিক সংগঠনের ক্ষমতা কমে না। রমজান আলি তাই থানা কমিটির সভাপতির চেয়ে বেশ খানিকটা পিছিয়ে আছে। শক্তি আর অর্থের দিক দিয়ে সমকক্ষ নয় বলে নিজের বাসটাকে লোকাল সার্ভিস থেকে জেলা ট্রান্সপোর্টে উন্নীত করতে পারছে না। কোনোভাবে কথাটা মুখ থেকে বের করতে পারলেও সভাপতি রেহানুদ্দিন মুখের ওপরই বলতে দ্বিধা করে না, ‘তোমার মুড়িট্টিন ডিস্টিকে চালাইয়া প্যাসেঞ্জার পাইবা না।‘ অপমান আর ক্ষোভ দুটোই থিতিয়ে আসে এক সময়। তাই তার পরিকল্পনারা ভেতরে ভেতরেই গুমরে মরে। আকৃতি পাবার মতো দৃঢ়তা অর্জন করতে পারে না।
অবরোধ হোক হরতাল হোক কোনো অবস্থাতেই বন্ধ থাকে না রেহানুদ্দিনের বাস-ট্রাক বা সিএনজি। স্বপক্ষের লোকজনের চাইতে বিরোধী পক্ষের ক্ষতি বৃদ্ধিতেই তাদের উৎসাহ বেশি। থানা সভাপতি বলে রেহানুদ্দিন যেমন পরিচিত, তেমনই পরিচিত তার যানবাহন আত্মীয়-স্বজন। যে কারণে বাড়তি কিছু সুযোগ-সুবিধা তারা পেয়েই যায়।
থানা বা জেলা পর্যায়ের নেতা-নেতৃরা তৃণমূল পর্যায়ে তেমন একটা সক্রিয় হতে পারে না। কিন্তু ইউনিয়ন পর্যায়ে ভালো রকমই তৎপর থাকে রমজান আলি। তবে তা হাঁক-ডাক আর মিছিল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। ডিসট্রিক্ট রোডের দিকে কখনও যেতে হয়নি তাকে। কিন্তু এবার থানা পর্যায়ে রেহানুদ্দিনের বেশি লোকজনের প্রয়োজন হওয়াতে কিছু কম বয়েসি ছেলে-ছোকরাকে নিয়ে তাকে সরব থাকতে হবে সেখানে। এটা একটা বড় সুযোগ বলা যায়। দক্ষতা প্রমাণেরও একটি সুযোগ বলা যায়। তা ছাড়া এ দলটির কেউ রেহানুদ্দিনের কোনো গাড়িই চেনে না।
সদ্য মেতে ওঠা ছেলেদের দায়িত্ব দিয়ে নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে রমজান আলি বাড়িতে থেকে গেল। পেট ব্যথার কথা বলে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকল বিছানায়। খানিকটা পরপর চিত্কার করে উঠছিল মেকি কষ্টে। শামিমা বেগম কিছু একটা নিয়ে বেশ ব্যস্ত বোঝা যায়। তার হাঁক-ডাক শোনা যাচ্ছে একটু পরপর। রেজিয়াকে কিছু একটা নির্দেশ দিচ্ছিল। কিন্তু অসুস্থতার ভান করে বিছানায় পড়ে আছে বলে সেদিকে কোনো রকম আগ্রহ দেখাতে পারছিল না সে।
শুয়ে থেকেই হাত ঘড়িতে সময় দেখে কিছুটা চঞ্চল হয়ে ওঠে সে। ঠিক এ সময়টাতেই রেহানুদ্দিনের বাস ডিসট্রিক্ট রোড ধরে টার্মিনালে যায়। তারপর ধোয়া-মোছা ইঞ্জিনের ত্রুটি দেখা ছোটখাটো মেরামত সেরে সন্ধ্যার দিকে যাত্রী-বোঝাই করে ছেড়ে যায় চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। সে সময় স্থানীয় অনেকেই গ্রামের সামনে দিয়ে বাস যাবার সুযোগটা গ্রহণ করে।
শামিমা বেগম হঠাৎ অস্থির হয়ে ছুটে এসে বলল, হুনছেন? রাস্তার উপরে গাড়িত আগুন দিছে। আপনে যান না একবার। মাইয়াডা তো এই সময় রেহানুদ্দিনের গাড়ি দিয়া আওনের কথা।
শামিমা বেগমের কথা শুনেই যেন রমজান আলির তলপেটের দিকে কিছু একটা আংটা দিয়ে ধরে। এক হাতে তলপেট চেপে ধরে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উঠে বসে সে। ভাবে, একাত্তরের যুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় পেট্রল বোমার ব্যবহার হয়েছিল কিছুদিন। সামান্য গন্ধক আর পেট্রলের মিশ্রণ দিয়ে তৈরি সামান্য খেলনার মতো জিনিসটার ভয়াবহতা সম্পর্কে ভালো করেই জানা আছে তার। গাড়িটা যদি রেহানুদ্দিনের বাস হয়ে থাকে তাহলে তার উদ্দেশ্য বৃথা হবে না। কিন্তু মেয়েটাই বা কেন আজ আসতে গেল? আর শামিমা বেগমের বয়স হবার সঙ্গে সঙ্গে অনেক জরুরি কথাও চেপে রাখবার বদ অভ্যাসটা বাড়ছে দিন দিন।
বিছানা থেকে নেমে গায়ে ফতুয়া চড়াতে চড়াতে ভেতরকার রাগ চেপে রাখতে পারে না রমজান আলি। এমনেই দেশের অবস্থা, রাস্তা-ঘাটের অবস্থা ভালা না, মাইয়াটারে আইতে কইলা কী বুইঝ্যা? আইজগা দেশে হরতাল আর অবরোধ দুইডাই চলতাছে।
-আমি আগে থাইক্যা জানমু কেমনে কবে হরতাল আর অবরোধ হইব?
বলতে বলতে কণ্ঠস্বর কেঁপে ওঠে শামিমা বেগমের।
-শারমিন আইব এই কথাটাও তো জানাইতে পারতা। কখন কই দিয়া কে কোন গাড়িতে আগুন দিবো কেউ কইতে পারে?
স্ত্রীর সঙ্গে খুব বেশি রাগও দেখাতে পারছিল না রমজান। দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে মটর সাইকেল চালু করতে করতে বলে, দরজাডা দিয়া থোও!
মটর সাইকেলে ডিসট্রিক্ট রোডে পৌঁছুবার আগেই দূর থেকে জ্বলন্ত গাড়িটা চোখে পড়ে রমজান আলির। পুরো বাসটাই জ্বলে শেষ হয়ে গেছে। এখন কালচে ধোঁয়া উড়ছে খানিকটা। আশপাশে প্রচুর মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। সতর্ক দৃষ্টিতে দলের ছেলেদের খোঁজে সে। কিন্তু কাউকেই দেখতে পায় না। উপস্থিত লোকজনের মুখে শুনতে পায় যে, বাচ্চা কোলে একটি মেয়ে নামতে পারেনি বাস থেকে। ভেতরেই কয়লা হয়ে গেছে। হঠাৎ করেই ধ্বক করে ওঠে বুকের ভেতরটা। কপালে চাপড় দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সে। আমার শারমিন, আমার নানাভাই রে! এইডা কী হইল? হায় হায়!
রমজান আলি তার মটর সাইকেল সহ রাস্তায় পড়ে যায়। তখনই ভিড়ের একটা অংশ ঝুঁকে পড়ে তার দিকে। কেউ বাতাস করে। কেউ বা চোখে মুখে পানির ঝাঁপটা দেয়। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে এলে প্রায় মুখের ওপর ঝুঁকে আছে দু বয়সের দুটি উদ্বিগ্ন মুখ।
দুজনকেই বুকের সঙ্গে চেপে ধরে রমজান আলি বলে ওঠে, কেমনে আইলি?
মেয়েটি কিছু বলে উঠবার আগেই শিশুকণ্ঠ সরব হয়ে ওঠে, রিশকায়!
রমজান আলি একবার পোড়া বাসটির দিকে তাকিয়ে ফের চোখ বোঁজে।
((সমাপ্ত))
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন