|
তাশমিন নূর
|
|
মেঘমালাঃ পর্ব-২
25 January 2015, Sunday
রমানাথের ছেলে জয়ন্তকে দেখে হাসানুল হক বেশ অবাক হয়েছেন, যদিও তিনি সেটা প্রকাশ করেন নি। আশেপাশের মানুষদের নিজের বিস্মিত ভাব দেখাতে তাঁর ভাল লাগে না। ছেলেটার বেশভূষায় মডার্নিটি আছে, সেটা কথা নয়। একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সে পড়াশোনা করছে। শহরে থাকছে, শহরের মানুষজন দেখছে। কাজেই বেশভূষায় পরিবর্তন আসাটাই স্বাভাবিক। তাঁর অবাক লেগেছে ছেলেটার মুখের ভাষা শুনে। পুরোপুরি প্রমিত রীতিতে কথা বলল সে। এতোটুকু আঞ্চলিকতা নেই। গ্রামের একটা ছেলে এতো তাড়াতাড়ি ভাষার আঞ্চলিকতা কাটিয়ে উঠবে এতোটা তিনি আশা করেন নি। ভাষার আঞ্চলিকতা এমন এক জিনিস, যা অনেক মেধাবী গুণী মানুষও ত্যাগ করতে পারেন না। তাছাড়া রিক্সা ঠিক কর বলতেই সে নিজ থেকে দুটো রিক্সা ঠিক করল। আবার একটা রিক্সায় ব্যাগ নিয়ে নিজেই উঠল, যাতে তারা পিতা-কন্যা আরামে যেতে পারেন। এতে বোঝা যায় ছেলেটার কমনসেন্স এবং ভদ্রতাজ্ঞান দুটোই আছে। রমানাথ তার এই ছেলে সম্পর্কে তাঁকে বেশি কিছু বলেনি। শুধু বলেছিল ছেলেটা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে। রমানাথের দুই ছেলে এক মেয়ে-অনন্ত, জয়ন্ত আর কানন। বড় ছেলে কলকাতায় আছে। সেখানে সে পড়াশোনা করেছে। হাসান সাহেব খবর পেয়েছেন, এখন নাকি গান-বাজনা করে বেড়ায়। তিনটি ছেলেমেয়ের সব খরচ হাসানুল হকই দিয়ে আসছেন। রমানাথের স্ত্রী খুকু রানী বছরখানেক হল প্যারালাইসড হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। তার চিকিৎসার খরচও হাসানুল হক দিচ্ছেন। দেশে-বিদেশে যখন যেখানেই থেকেছেন, তিনি রমানাথের খবর রেখেছেন কোন না কোনভাবে। নিজের বাড়িতে তাকে পাকাপাকিভাবে থাকার অনুমতি দিয়েছেন। গঞ্জে বড় মুদি দোকান উঠানোর জন্য তিনিই রমানাথকে টাকা দিয়েছেন। তাঁর বিশাল বাড়ির আনাচে-কানাচে শাক-সব্জি, ফল-মূল লাগিয়ে রমানাথ তার খাদ্যের অভাব দূর করেছে। আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর ছয় বছর কেটে গেছে। এই ছয় বছরে শুধুমাত্র রমানাথকেই তিনি তার অফিসের ঠিকানা দিয়েছেন। ইচ্ছে করলে দেশে আসার খবর তিনি গোপন করতে পারতেন। কিন্তু করেন নি। হাসানুল হক চোখ বন্ধ করে মনে মনে বললেন,
-এতো কিছুর পরও কি রমা পারবে আমার সাথে বেইমানী করতে? কোথায় থাকত এই রমা, যদি বাবা তাকে আশ্রয় না দিতেন?
১৯৮৮ সালের সেই রাতের কথা হাসানুল হকের স্পষ্ট মনে আছে এখনো। ঝুম বৃষ্টির রাত। বাড়ির কাছারিঘরে (অতিথিশালায়) বসে তিনি দাবা খেলছিলেন তাঁর এক দুঃসম্পর্কের চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে। একটা ভুল চাল দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন হাসানুল হক। এমন সময় একটা অস্পষ্ট পুরুষ কণ্ঠ শুনতে পেলেন তাঁরা। কাছারিঘরের টিনের চালে বৃষ্টির শব্দে কানে তালা লেগে যাবার যোগাড়। তাঁরা দুজনেই কান খাড়া করে শুনলেন। পুরুষ কণ্ঠ আবার শোনা গেল। হাসানুল হক দরজা খুলে দেখেন প্রায় তাঁরই বয়সী এক যুবক দাঁড়িয়ে। সাথে একটি অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়ে, তার কোলে একটি দুধের শিশু। বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। যুবক করুন স্বরে আশ্রয় চাইল,
-আইজকের রাইতখানের লাগি জায়গা দ্যান গো, দাদা। রাইত পোহাইলেই চইলা যামু।
হাসানুল হক দেখলেন, তিনজনের অবস্থাই শোচনীয়। বিশেষ করে বাচ্চাটির। শরীর নীল হয়ে গেছে। তিনি ভেতর বাড়িতে গিয়ে সবকিছু জানালেন। কাছারিঘরে তিনজনের থাকার জায়গা হল। হাসানুল হক কিছু শুকনো কাপড় আর ভারী কাঁথা এনে দিলেন তাদের। পরের দিন বাচ্চাটির প্রচণ্ড জ্বর হয়ে গেল। হাসানুল হকের বাবা সাঈদুল হক ভূঁইয়ার যেমন বিশাল সম্পত্তি, তেমনি বিশাল হৃদয়। তিনি বাচ্চাটির চিকিৎসা করালেন। রমানাথের পরের দিন চলে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু তার সেই পরের দিন আর আসল না। সে মহা আনন্দে ভুঁইয়া সাহেবের ফল-ফুলের বাগান আর গরুর খামারে কাজে লেগে গেল। তার সাথে কথা বলে জানা গেল, তার যাওয়ার কোন জায়গাই নেই। সেই ছোটবেলায় সে বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে এসেছিল। বাবা-মা, ঘর-বাড়ি কোন কিছুর খবরই তার জানা নেই। কাজ করতে করতে একদিন এই জেলায় এসে পড়ল। এখানে এসে বিয়ে-শাদি করে সংসার পাতল। কিন্তু ভিটে-মাটি যেটুকু জুটিয়েছিল সব উন্মত্ত মেঘনার পেটে চলে গেল। নিজের দুঃখের কথা বলে রমানাথ অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগল। ভুঁইয়া সাহেব তাকে পাকাপাকিভাবে তাঁর বাড়িতে জায়গা করে দিলেন। শুধু যে কাজ দিলেন তাই নয়, নিচতলার একটি ছোট্ট ঘরে তাকে থাকার জায়গাও দেয়া হল। রমানাথ সততার সাথে তার সব দায়িত্ব পালন করত। তাই দেখতে দেখতে সে ভূঁইয়া সাহেবের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠল।
ভূঁইয়া সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী দুজনেই গত হয়েছেন, কিন্তু রমানাথ আজও বসবাস করছে সেখানে। গ্রামের সবাই রমাকে ঐ বাড়ির কেয়ার-টেকার হিসেবেই জানে। হাসান সাহেব রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-আর কতো দূর ভূঁইয়া বাড়ি?
তিনি এলাকার রাস্তা-ঘাট কিছুই চিনতে পারছেন না। সবই পাকা হয়ে গেছে। তাও দিন হলেও একটা কথা ছিল। এই আবছা আঁধারে তো চেনার প্রশ্নই আসে না। রিক্সাওয়ালা উত্তর দিল,
-আর অল্প কদ্দূর। ছনখোলার কাছে আইছি।
‘ছনখোলা’ শব্দটি হাসানুল হকের বুকে ধাক্কা দিয়ে গেল। তিনি জোর করে অনেক স্মৃতি মন থেকে সরিয়ে দিতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না। নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনেক পুরোনো স্মৃতি তাঁর চোখের সামনে ঝিকিয়ে উঠল।
হাসান সাহেবের স্ত্রী বিয়ের দীর্ঘ নয় বছর পর মা হয়েছেন। তনয়ার জন্মের কিছুদিন পরের কথা এটা। হাসান সাহেব পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে গ্রামে বাবার বিশাল সম্পত্তি দেখাশোনার কাজে মন দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো রেজাল্ট করেও তিনি শহরে স্যাটেল হতে পারেন নি। কেননা-তারঁ আর কোন ভাই-বোন নেই। ভূঁইয়া সাহেব ছেলেকে দূরে যেতে দেন নি। গঞ্জে ভূঁইয়া সাহেবের অনেক দোকানপাট। সেগুলো দেখাশোনার জন্য হাসান সাহেবকে মাঝে মধ্যে গঞ্জে যেতে হত। সেদিন আকাশের অবস্থা খারাপ ছিল। হাসান সাহেব গঞ্জের দিকে অর্ধেক পথ গিয়ে আবার বাড়ির দিকে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। ছনখোলা জায়গাটার কাছাকাছি আসতেই একটা খসখসে পরিচিত কণ্ঠ তাকে বলল,
-খাড়া রে হাসাইন্যা।
হাসান সাহেব দাঁড়ালেন। তাঁর হাতে টর্চ ছিল। কিন্তু টর্চ জ্বালানোর আগেই বিপরীত দিক থেকে টর্চের আলো এসে তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে দিল। খসখসে কণ্ঠের মালিক তাকে টেনে ছনখোলার একটি ক্ষেতের পাশে নিয়ে এলো। আলো নিভাতেই হাসান সাহেবের চোখ যেন অন্ধ হয়ে গেল। অন্ধকার চোখে সয়ে আসার আগেই লোকটি বলল,
-আমার মুখ বন করন যাইত ন। মাল-হানি ছাড়ন লাইগব।
হাসান সাহেব তখন কণ্ঠস্বর চিনতে পারলেন।
-তুই কে? কুদ্দুস?
-উঁম।
-তোর মুখ ক্যান বন কইরতে হইব?
-সব জানি।
-কী জানস তুই?
-রমা আর তুই মিলি কী কইরছত সব দেইখছি। হেই জায়গায় আছিলাম। আড়াল তন সব দেইখছি। সব কতা হুইনছি। সবেরে কই দিমু।
বলেই কুদ্দুস শয়তানী হাসি হাসতে লাগল। কুদ্দুসের হাসি শুনে হাসান সাহেবের মাথায় রক্ত উঠে গেল। তিনি ‘হারামীর বাচ্চা’ বলে কুদ্দুসকে গালি দিলেন। কুদ্দুস তাঁর বুকে ধাক্কা দিল। ধাক্কা খেয়ে তিনি পড়ে গেলেন। তাঁর মাথায় খুন চেপে গেল। তিনি উঠে এসে সজোরে ধাক্কা দিয়ে কুদ্দুসকে ছনখোলার জমিতে জমে থাকা পানিতে ফেলে দিলেন। ঝপাৎ করে শব্দ হল। কিন্তু কুদ্দুসের কোন সাড়া পাওয়া গেল না। তিনি পড়ে যাওয়া টর্চ কুড়িয়ে নিয়ে আলো জ্বেলে দেখেন, কুদ্দুসের দেহ উপুড় হয়ে আছে। পানি রক্তে লাল হয়ে গেছে। সুঁচালো কিছু একটা কুদ্দুসের পিঠ ভেদ করে বের হয়ে এসেছে। তিনি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলেন। সেই রাতেই মেঘ-বিজলীর মধ্যে তিনি গ্রাম ছাড়লেন। ঢাকায় গিয়ে দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাসায় উঠলেন। ভূঁইয়া সাহেব একমাত্র বাড়িটা ছাড়া আর সমস্ত জমি-জমা এক মাসের মাথায় বেচা-বিক্রি করে ছেলেকে আমেরিকায় পাঠিয়ে দিলেন। ভারী বর্ষণে পানি বেড়ে যাওয়ায় কুদ্দুসের দেহ ডুবে গেল। ঘটনার পাঁচ দিন পর দেহ আবিষ্কৃত হল। পঁচে ফুলে উঠেছিল। অনেক পুলিশি ঝামেলা হয়েছিল। যদিও হাসান সাহেবের গ্রাম ছেড়ে যাবার কারন কেউ জানত না, তবু গ্রামে একটা মৃদু গুঞ্জন উঠেছিল যে কুদ্দুসের খুনের সাথে হাসান সাহেবের যোগ থাকতে পারে। ভূঁইয়া সাহেব প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন বলে সেই গুঞ্জন এক সময় থেমে গেল। কিন্তু ভূঁইয়া সাহেব কেন জমি-জমা সব বিক্রি করে ছেলেকে টাকা পাঠালেন; হাসান সাহেব কেন হঠাত গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেন- এ সমস্ত কথা কেউ কেউ গোপনে আলোচনা করতে লাগল। সরাসরি করার সাহস পেল না, পাছে যদি ভূঁইয়া সাহেবের দয়া থেকে বঞ্চিত হয়? যে কোন সময় যে কারোরই তাঁর দয়া নিতে হতে পারে। তাছাড়া শুধু সন্দেহ থেকে তো আর কিছু প্রমাণ হয় না। আর যাকে নিয়ে এতো সন্দেহ সে-ই তো দেশে নেই। অতএব সেসব সন্দেহও একসময় অক্কা পেল।
হাসানুল হক আমেরিকায় বারো বছর ছিলেন। সড়ক দূর্ঘটনায় স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁর প্রবাস জীবনের অবসান ঘটল। স্ত্রীর লাশ নিয়ে তিনি দেশে ফিরে আসলেন। বাবার দেওয়া টাকা হাসানুল হক যখন যেখানেই থেকেছেন, কাজে লাগিয়েছেন। সফলও হয়েছেন। আজ তাঁর আর্থিক অবস্থা ফুলে-ফেঁপে একাকার হয়েছে। কিন্তু তিনি একা। একমাত্র মেয়ে তনয়া ছাড়া তাঁর আর কোন আপন আত্মীয় নেই। হাসানুল হকের জীবনের একমাত্র আনন্দ তাঁর মেয়ে তনয়া। মেয়েটা নিজের গ্রাম দেখতে চেয়েছে। তাই নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও তিনি গ্রামে এসেছেন। কিন্তু তাঁর খুব অস্থির লাগছে, খুব অস্বস্তি হচ্ছে।
জয়ন্ত বলল,
-কাকু নামুন, আমরা এসে পড়েছি।
হাসানুল হক অতীতে হারিয়ে গিয়েছিলেন। জয়ন্তের হঠাত ডাকে চমকে উঠলেন। তিনি শ্লেষ্মা জড়িত কণ্ঠে বললেন,
-কী?
জয়ন্ত আবার বলল,
-আমরা বাড়ি এসে গেছি।
(চলবে)
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন