১
দূর থেকে সমুদ্রের শোঁ শোঁ গর্জন শোনা যাচ্ছে । বাতাস কেটে মাঝে মধ্যে এক ধরনের শব্দ তৈরী হচ্ছে যা কানে এলে গায়ে কাটা দেয় । চারপাশে গভীর অন্ধকার । ঝড় থেমে গেছে । তবে টিপটিপ বর্ষন চলছেই । আকাশ ছাইবর্ণ, চারদিক ধূসর । দুপুর যে মাত্র গড়িয়েছে তা ধরবার উপায় নেই । বিকট শব্দে দুবার বজ্রপাত হল । বিজলীর সাময়িক আলোয় যা দেখা গেল এক শব্দে প্রকাশ করতে গেলে তাকে বলতে হয় ভয়ঙ্কর । বড় বড় প্রকান্ড গাছগুলি নিজেদের শিকড় উপড়ে উলটে এলোমেলোভাবে পড়ে আছে । পুরো জায়গাটাকে অচেনা লাগছে । বেশীরভাগ গাছই বাতাসের প্রাবল্যে পত্রশূন্য । টেকো গাছগুলিকে দেখাচ্ছেও বড় অদ্ভুত ।
পিপুল মিয়া নিজের কোমরে বাঁধা কস্তা গামছাটা খুলে মাথার চুল ঢাকলো । তারপর খুব সাবধানে ঢাল বেয়ে নীচের দিকে নামতে শুরু করল । জায়গাটা ভিজে কাদা হয়ে আছে । যেকোন সময় দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে । তার ভয় ভয় লাগছে । বজ্রপাত কিংবা দুর্ঘটনার ভয় না । ভুতের ভয় । দরূদ শরীফ কিংবা সহজ কোন সূরা-কালাম মুখে বিড়বিড় করলেও ভয়টা কাটে । সমস্যা হচ্ছে পিপুল মিয়া সূরা জানে না । যদিও সে পাঁচ ওয়াক্তই মসজিদে জামায়াতে নামাজ পড়ে এবং কোন ওয়াক্তের নামাজ আজপর্যন্ত ক্বাজা হয়েছে এমন কথা তার সম্পর্কে চরের কেউ বলতে পারবে না । কিন্তু ভিতরের ঘটনা ভিন্ন । সে যা পড়ে তা হচ্ছে সূরাহীন নামাজ । এক দিক থেকে ধরতে গেলে মিথ্যা নাটক । নামাজ আদায়ের কায়দা কৌশল জানা থাকলে মানুষের চোখে ধূলা দেওয়া কঠিন কোন ব্যাপার না । আর, পাঁচ-ছয়টা জামায়াতে দাঁড়ালে এমনিতেই রুকু-সিজদার বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায় । পিপুল মিয়া জানে সে পাপ করছে । কিন্তু সে নাচার । তার ব্যবসাই হচ্ছে এমন যে তাকে ধর্মকর্মের আগে-পিছে থাকতে হবে । স্মৃতিশক্তি ভাল হলে অবশ্যই কিছু সূরা-কালাম সে শিখে রাখত । মওলানা জালালুদ্দিন সাহেবের মত কথায় কথায় মুখস্ত করা আরবী আয়াত বলতো । মুসলমান মাত্রই আরবী কথা শুনলে হৃদয় দ্রবীভূত হয় । ব্যবসা-বানিজ্যে কাজে লাগত । কিন্তু উপায় নাই । আল্লাহপাক দুষ্টবুদ্ধি মাথাভর্তি করে দিয়েছেন, স্মৃতিশক্তি কিছুই দেন নাই ।
হুট করে কিসের যেন শব্দ হল । অনেকগুলি পাটকাঠি একসাথে ভাঙলে যেমন শব্দ হয়, কিছু্টা ঐরকম । পিপুল মিয়া থমকে দাঁড়ালো । ঝেড়ে দৌড় দেবে কিনা একবার চিন্তা করল । দৌড় দিয়ে যদিও কোন লাভ নেই, সত্যি সত্যি ভুত হলে তো আর সে তার সাথে দৌড়িয়ে পারবে না । বোধশূন্য মানুষের মত পিপুল দাঁড়িয়ে পড়ল । হিম বাতাসে তার শরীর জমে যাচ্ছে । সবগুলো আঙুলের চামড়া কুঁচকে গেছে । ঠান্ডার চেয়েও ভয়টা বেশী পীড়া দিচ্ছে । বুকের ভিতরে অনর্গল ঢিপ ঢিপ শব্দ । পা ঘষে ঘষে কেউ দক্ষিন দিক থেকে আসছে । পিপুল মিয়া মাথা না ঘুরিয়ে অজান্তেই গলা খাঁকাড়ি দিল, ‘কে ? কে যায় ?’
‘মুঞি !’
‘মুঞি কেডা ?’
‘মুঞি লুকমান ।’
আরে সত্যিই তো লোকমানের মত দেখা যায় । সে একটা কালো রঙের ময়লা শালে মাথা ঢেকে হেঁটে আসছে । পিপুল মিয়ার মুখের জান্তব ভাব মুহূর্তে কেটে গেল । কথা বলবার মত পরিচিত লোক পেয়ে তার সাহস ফিরে এসেছে । মুখভর্তি হাসি নিয়ে বলল, ‘কি ঘটনা লুকমান ? গেছিলি কোম্নে ?’
লোকমান কিছু বলল না । মাথা দুলিয়ে সে মুচকি মুচকি হাসছে ।
‘ঘটনা কইতে না চাইলে কওয়ার প্রয়োজন নাই । মোর ঘটনা হোন । মুঞি আছি রাজ্যের মসিবতের মইধ্যে । বাড়ি দিয়া বাইরমু । পাঁচ বেটারীর একটা টর্চবাত্তি আছিল, ঐডা গেছে নষ্ট হইয়া । কাজের সময় ফ্যাঁকড়ার নাই অভাব । আন্ধারের মইধ্যে হাতড়াইতে হাতড়াইতে আইলাম । কিল্লইগ্যা আইছি হেয়া হুনবি না ? বোস্তা হালাইতে আইছি । বোস্তা ভরা হাপ আর কাঁকড়া-ফাকড়া ।’
‘কন কি পিপুল মামা ?’
‘যা হোনতে আছোস হেইয়াই কইতে আছি । এমন টাইম আর আয় নাই । ব্যাবাক ঘর ভাইস্যা গেছে পানিতে । দুই হাত পানির তলে এহন ঘরদুয়ার । খাট উচা করোন লাগছে । মোর জন্মে মুঞি এমন বইন্যা দেহি নাই । এর মইধ্যে তোর মামী লাগাইছে কুনকুনানী । পোয়াতী মাইয়া । আইজকের ব্যথার টানডা বাড়বাড়ন্ত । হ্যার উপরে বাড়ির মইধ্যে দুর্গন্ধে বাঁচা দায় ।’
‘গন্ধ কিয়ের মামা ?’
‘পানি একলা আয় নাই তো । লগে কইর্যা হাপ-কাঁকড়া-মাকড়া-জোঁক-ফোক সব লইয়া আইছে । হেইডি আবার মরা । গন্ধ ছোটছে ব্যাডা বেদিক করা গন্ধ । তোগো বাড়ির কি অবস্থা ? তুই কি বাড়ির দিকে ম্যালা করছিলি ?’
লোকমান মাথা চুলকাচ্ছে । সে বাড়ির দিকে যাচ্ছে না । সে যাচ্ছে সমুদ্রসৈকতের দিকে । গোপন ব্যাপারটি সম্পর্কে সে পিপুলকে বলবে কি বলবে না এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে । তারপর কি ভেবে ক্ষীণস্বরে বলল, ‘খ্যাপ মারতে যাই মামা !’
‘কিয়ের খ্যাপ ?’
‘টর্লারে কইরা রুমাল স্যারেগো ঘুরাইতে লইয়া যামু ।’
‘মাতা খারাপ হইছে ? এই বইন্যার মইধ্যে টর্লার ছাড়বি ? মরন ঘোনাইছে তোর ।’
‘অনেক ট্যাকা দিবো মামা । এই যে দেহেন এডভান্স ।’
লোকমান লুঙ্গির খুঁট থেকে পাঁচশ টাকার একটা চকচকে নোট বের করে দেখালো । তার চোখ চকচক করছে । রোমেল নামের ঢাকা থেকে আসা ছেলেটি লোকমানকে ভাল অর্থকড়ির লোভ দেখিয়েছে । যুবক শহুরে ছেলেছোকড়ারা যেমন হয় । রক্তে এদের উন্মাদনা । বন্ধুবান্ধব নিয়ে ফুর্তি করতে এসেছে । সেটা খারাপ কিছু না । কিন্তু জীবনের মায়া তো তাদেরও থাকবার কথা । পিপুলের মাঝে মাঝে মনে হয় বিদ্যা বুদ্ধিনাশিনী । নইলে এই ভয়াবহ বাতাসে ট্রলার নিয়ে সমুদ্রে যাওয়া পাগলের ভাবনা ছাড়া তো কিছু না । পিপুল লোকমানের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘টর্লারে কইরা যাইবো কই ?’
‘ছবি উঠাইতে যাইবো । সমুদ্রের ছবি ।’
‘টর্লার লইয়া যে যাবি খবির ভাইরে কইছোস ? তর বাপজান জানে ?’
‘হ্যাগোরে অহন কিছু কইয়ো না পিপুল মামা । জানতে পারলে মোর কল্লা হালাইয়া দেবে ।’
‘ম্যালা করবি কহন ?’
‘টর্লারের দিকেই যাইতে আছেলাম ।’
‘তগো বাড়ির অবস্থা জানোস ?’
‘পানি ওঠছে, তয় সাপখোপ নাই ।’
পিপুল বলল, ‘ল ! তরে আউগ্যাইয়া দিয়া আই !’
সমুদ্রের কাছে যতই এগুনো যায়, বাতাসের বেগ তীব্র থেকে তীব্রতর হয় । ঢেউয়ের বেগ অত্যধিক । ফেনার সাথে বারবার মৃত মাছ-কাঁকড়াদের শরীর ভেসে ভেসে আসছে । আবার পরবর্তী ঢেউগুলি এসব ভাসিয়ে নিয়েও যাচ্ছে । পিপুল মাথার গামছাটা শক্ত করে মাফলারের মত বেঁধে নিল । বাতাসে তার লুঙ্গি পতপত করে উড়ছে । কিছু বালু পাক খেয়ে খেয়ে ওপরের দিকে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছে । গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিও শুরু হয়েছে । এইসবের মধ্যে দূর থেকে একদল জোয়ান ছেলেপুলেকে উল্লাস করতে দেখা যাচ্ছে । পিপুল চোখ পিটপিট করে এদের সংখ্যাটা আন্দাজ করার চেষ্টা করল । দশজনের কিছু কম । দুটা মেয়েকেও দেখা যাচ্ছে । এদের চোখে বিশাল বড় বড় কালো চশমা । এই তীব্র শীতের মধ্যেও একজনের গায়ে পাতলা ফিনফিনে একটা ঢোলা জামা । ভাল করে তাকালে নিচের অন্তর্বাসও দেখা যায় । ছি, ছি ! কি লজ্জা !
পিপুল লোকমানকে বলল, ‘তুই যা তাইলে । মুঞি ফির্যা যাই ।’
লোকমান সমুদ্রের গর্জনে পিপুলের কথা শুনতে পেলো না । পিপুল তার কানের কাছে মুখ রেখে বলতেই সে চিৎকার করে বলল, ‘মামা, যাবা নাহি মোগো লগে ? খুবই মজা অইবে । লও দেহি ।’
পিপুল লোকমানকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘যা ব্যাডা । তর মামীরে একলা বাড়িতে অসুইখ্যা থুইয়া আইছি । যা তুই । আল্লার নাম লইয়া যা । সাবধান থাহিস !’
পিপুল উলটো দিকে হাঁটা শুরু করল । তার কি জ্বর উঠছে নাকি ? শরীর কাঁপছে থরথর করে । এত পানি হাতাহাতি করা ঠিক হয়নি । একা একা এত সাপ-কাঁকড়া বস্তায় ভরা, পানি সেঁচা, রান্না-বান্নাসহ বাড়ির এত কাজ করে তার প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছো । ক্ষুধাবোধও হচ্ছে প্রচুর । ক্ষণে ক্ষণে পেটে পাক দিয়ে উঠছে । অল্প কিছু চিঁড়া ছাড়া আজ সারাদিন পেটে কিছু পড়ে নি । অবস্থা যা, তাতে কালকেও ঘরে রান্নাবান্না চড়ে কিনা সন্দেহ আছে । অবসন্নতা এবং আসন্ন দিনগুলির শঙ্কায় তার সমস্ত শরীর ভেঙে আসছে । সমুদ্রে ঘুরে এলে খুব কি খারাপ হতো ? মাঝসমুদ্র, উদভ্রান্ত বাতাস, আকাশ ভরে থাকা কালো মেঘ, শুধু জল-বাতাসের থৈ থৈ শব্দ ! জগতের সব সৌন্দর্য প্রানভরে দেখতেও সাহস লাগে । জীবনের মায়া নিয়ে ঠিক পরিপূর্ণ ভাল থাকা যায় না । পিপলু মিয়ার মনটা উদাস হয়ে যায় । সে পেটের সঙ্গে চেপে থাকা শাদা পলিথিনের পোঁটলাটা সযত্নে বের করে । জর্দা দেয়া পান মুখে পুরে একটা বিড়িও বের করে সেখান থেকে । আগুন নেই । তবু সে বিড়িটা দু আঙুলের ফাঁকে রেখে দিয়েই পোঁটলাটা লুঙ্গির ভাঁজে ঢোকায় । বিড়ির তৃষ্ণাটা সময়ের সাথে সাথে আরও বেড়ে যায় । জর্দাটা পুরোনো । অল্প সময়েই পিপুলের নেশা ধরে গেছে । সে টলতে টলতে হাঁটছে । হাওয়ায় নৌকার পালের মত গা ভাসিয়ে দেয়া গেলে খুবই ভাল হত । সবচে ভাল হতো বড় ডানাওয়ালা পাখির মত উড়তে উড়তে সমুদ্রে চক্কর মারতে পারলে । সেটা সম্ভব না । তবে বাড়িতে ফিরে যেতেও এখন আর তার ইচ্ছে করছে না । তার ইচ্ছা করছে সমুদ্রের তীর ধরে হেঁটে হেঁটে অন্য কোথাও চলে যেতে । এতক্ষন হাঁটাহাঁটিকে যন্ত্রনা মনে হলেও হাঁটতে এখন খুব একটা মন্দ লাগছে না । সে সুরহীন গলায় পাগলের মত খেঁকিয়ে একটা গানও ধরলঃ
কূল নাই- কিনার নাই- নাইকো দইর্যার পারি
তুমি সাবধানে চালাইয়ো মাঝি
আমার ভাঙা তরী রে...
গান গাইতে গাইতে পিপুল কিছু একটার সাথে পায়ে ধাক্কা খেয়ে হঠাৎ উলটে পড়ে গেল । কাদাবালিতে তার পুরো শরীর মেখে একাকার । সোয়েটারটা নতুন । উলের কাজ ভাল- সহজেই গা গরম হয় । এটাতে পানি লাগলে মহা সর্বনাশ । বাম পায়ের উরূতে কিছু একটা ঢুকেও গেছে বোধহয় । প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে । সে দুহাতে সোয়েটার ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে হাঁটু গেড়ে বসে দেখল একটা সুঁচালো ঝিনুক সুতি কাপড়ের লুঙ্গিটা ফুটো করে উরূর ভেতর অনেকখানি সেঁধিয়ে গেছে । গলগল করে সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে । অন্ধকারে রক্তের রং দেখাচ্ছে ঘন কালো । সে বিড়িটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পা চেপে ধরে দু’আঙুলে ঝিনুকটা টেনে বের করে আনল । তারপর খুব বিশ্রী ভাষায় চিৎকার করে একটা গালি দিল । গালি যে বস্তুকে লক্ষ্য করে দেয়া হল সেটি তার নিজের জায়গাতেই অনড় পড়ে রইল ।
পিপুল হামাগুড়ি দিয়ে বস্তুটির কাছে এগিয়ে গেল । হাতড়ে হাতড়ে জিনিসটা কি সেটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগল । এমন সময় প্রকট শব্দে আচমকা আরও একবার বজ্রপাত হল । বজ্রপাতের আলোয় পিপুল যা দেখল তাতে তার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল । তীব্র ভয় এবং বিস্ময় নিয়ে সে আবিষ্কার করলো যার সাথে ধাক্কা খেয়ে সে পড়ে গেছে তার মুখশ্রী অবিকল মানুষের মত হলেও সেই নগ্ন অবয়বটি আর যাই হোক, মানুষের নয় । তার অর্ধেক শরীর বালুতে নিমজ্জিত, বাকী অর্ধেকের যেটুকু দেখা যাচ্ছে তার বেশীরভাগ অংশেই সজারুর কাটার মত ছোট ছোট লাল কাটা, মুখটি বীভৎস, শাদা চুল জায়গা জায়গা থেকে উঠে গেছে আর কানদুটি অস্বাভাবিক রকমের লম্বা । তবে সবচাইতে ভয়াবহ এবং আতংকের বিষয়টি হচ্ছে সেই অদ্ভুত শরীরটির পিঠ থেকে বেড়িয়ে এসেছে এক জোড়া সুপ্রশস্ত এবং বৃহৎ পালকওয়ালা ডানা !
২
মোজাম্মেল হক কুপীর আলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন । জানালার একটা পাট খোলা । ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটায় চাদরের একটা পাশ লম্বা করে ভিজে গেছে । বাতাসে দপদপ করে আগুনের শিখা কাঁপছে । এক আগুনের ভেতরে অনেক রঙ । বাতাস লেগে একটু কাঁপলেই হলুদের আশপাশ থেকে সেইসব গোপন রঙের এক ঝলক দেখা যায় । গোপন রঙের এই খেলা হকসাহেবের ভাল লাগে । মানুষ অসাধারন সব সৌন্দর্য দেখার জন্য দূর দূরান্তে ভ্রমন করে । কিন্তু অধিকাংশ মানুষই হাতের কাছে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সৌন্দর্যের আনন্দ উপভোগ করতে জানে না । তাজমহল দেখতে উত্তরপ্রদেশ ঘুরে আসে, অথচ পূর্ণিমার সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার প্রয়োজন বোধ করে না । মানুষের যে গড় আয়ু এতে এরা পূর্ণিমা দেখার সুযোগ পায় খুব বেশী হলে ছয়শ বার । এর মধ্যে থেকে শৈশবকালীন সময় বাদ দিলে তো সংখ্যা আরও কমে যায় । মোজাম্মেল হক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন । মানুষ খুবই অদ্ভুত প্রানী । খুবই অদ্ভুত ।
‘খালুজান, জাগনা আছেন ?’
‘হুঁ ।’
‘আদা চা কইর্যা লইয়া আমু খালুজান ? এলাচ-আদার চা খাইলে আপনের ঠান্ডা ভাবটা কমতো । খালি আদা হইলো মহা ঔষধ, বেহেশতী খাদ্য । একটার অর্ধেক আদা যদি কচকচ কইরা চাবাইয়া খাইতে পারেন সর্দি-কাশি ‘লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহু’ কইয়া দৌড় দিয়া পলাইবে । গুরুজনেরা বলেঃ
সর্দি-কাশির উপায় নাই
আদা আইলো লাডি লইয়া
পলাই পলাই ।’
‘মফিজ !’
‘জ্বে খালুজান !’
‘যা বলতে এসেছো বলে চলে যাও । তাই-তাই-তাই ছড়াকে গুরুজনের আদাবিষয়ক শ্লোকে রূপান্তর করার কোন প্রয়োজন নাই ।’
‘জ্বে আচ্ছা খালুজান ।’
‘বলো । যে ঘটনা বলতে এসেছো সেই ঘটনা বলো ।’
‘খালুজান, হামেদ মাঝির পুলা মাঝসমুদ্রে ডুইবা মরছে । ঢাকা তনে যে পোলা-মাইয়াডি আইছিল ঐগুলারে নিয়া ফুর্তি করতে টর্লার ছাড়ছিল । সমুদ্র কি ভাইজান আমাগো মত ? সমুদ্রের হিসাব আলেদা । সেই হিসাবে ফুর্তির জাগা নাই । গুরুজনেরা বলেঃ
ফুর্তি আর কয়দিনের ?
নিমতাফুল যয়দিনের ।’
‘তোমার কথা শেষ হয়েছে ?’
‘দুইডা পোলার লাশ ভাইসা আইছে । বাকীগুলানের হদিস নাই ।’
‘কথা শেষ ?’
‘জ্বেনা খালুজান । আর একটা বিশেষ সংবাদ দেওনের আছিলো ।’
‘আর কোন বিশেষ সংবাদ না । কথা বন্ধ । কথা বেশী বললে যে আয়ু কমে যায় এটা জানো ?’
‘খালুজানের এই কথাটার কোন ভিত্তি নাই । যদি এই কথা সত্য হইতো তইলে এতদিনে মোর মিত্যু নিশ্চিত আছিল মুঞি কিন্তু খালুজান সুস্থ্য । মাইনষের রোগ বালাই লাইগ্যাই আছে । মোরে দ্যাহেন ! বিষ্টিতে ভেজলেও জ্বরজারি হয় না । বুঝেন অবস্থা । হেইদিন মুঞি ফুলবানুরে কইলাম, ফুলবানু শোন...’
‘মফিজ আর একটা কথা বললে চড় দিয়ে আমি তোমার চাপার দাঁত ফেলে দেবো ।’
মফিজ কথা বলা বন্ধ করল । হক সাহেবের মাথা ব্যথা আরও বেড়ে গেছে । নাক থেকে অনবড়ত সর্দি পড়ছে । ডেজলর দুটা খেয়েছে, আরও একটা কি খাবে ? ডাক্তারদের এই এক অসুবিধা । নিজে ডাক্তার হয়ে অন্য এক ডাক্তারের কাছে জিজ্ঞেস করতে লজ্জা লাগে । মোজাম্মেল সাহেব রুমাল দিয়ে নাক মুছতে মুছতে বললেন, ‘মফিজ ! বলো । কি জরুরী কথা বলতে চাও । বলে বিদায় হও । মূর্তির মত সামনে দাঁড়িয়ে থাকবা না ।’
‘খালুজান পিপুল মিয়াকে চিনেন না ? ঐ যে সুঁইগুপী বাজারে আতর-সুরমা-টুপী ব্যাচে যেই পিপুল মিয়া । বিরাট টাউটার । মেসওয়াক বিক্রয় করে ডবল দামে । ফুলবানুর মাতা যে গত হইছিল ঐসুম হুড়াহুড়ার মইদ্যে ট্যাকার হিসাব আছিলনা মাথায় । পিপুইল্যার কাছ থিকা কাফনের কাপড় কিন্যা কইলাম...’
‘মফিজ ! পিপুলকে আমি চিনি । জরুরী কথা এক বাক্যে বলতে পারলে বলো । নইলে নাই । তুমি তো দেখি স্বরে-অ স্বরে-আ থেকে শুরু করেছো ।’
‘পিপুল মিয়া ঝড়ঝাপ্টার মইদ্যে জাল ফালাইয়া একটা জ্বিন ধরছে ভাইজান !’
‘কি ধরেছে ?’
‘জ্বিন । বিরাটাকায় দৈত্য !’
‘কাছে আসো !’
মোজাম্মেল হক ডান হাত বাড়িয়ে মফিজের গালে সশব্দে চড় কষালেন । মফিজ ছিটকে এক হাত দূরে গিয়ে পড়ল । চড় মেরে হক সাহেবের নিজের হাতই লাল হয়ে গেছে । তার মেজাজ আরও খিঁচড়ে গেল । মফিজ গাল ডলতে ডলতে ক্ষীনস্বরে বলল, ‘গরীব মানুষের কতা আর তেলাপোকার লাদি সম মূইল্যের । কোন ব্যাশকম নাই ।’
‘আর কোনদিন আমার সাথে এরকম ফাজলামি ধরনের কথা বললে টান দিয়ে জিহ্বা ছিঁড়ে ফেলবো । ফাজিলের ফাজিল !’
‘খালুজান যাইয়া নিজের চউক্ষেত দেইখ্যা আন । যদি মিছা কথা কই তাইলে যেন মোর আগুনে মিত্যু হয় । জ্বইলা পুইড়া কানতে কানতে মরি । জ্বিন সত্যই ধরা পড়ছে । বিরাটাকায় দৈত্য ।’
দরোজায় টোকা পড়ছে । হকসাহেব বললেন, ‘মফিজ, উঠে দরজা খোল । আর দৈত্যের আলাপ বন্ধ । একেবারে বন্ধ ।’
মফিজ গিয়ে দরোজা খুলে দেখে ইমাম সাহেব এসেছেন । ইমাম সাহেবকে ভৌতিক লাগছে । চোখের সুরমা মোটা করে টানা । গায়ের জোব্বা কুচকুচে কালো বিধায় এটা হতে পারে । তার মাথার পাগড়ীও কালো । বৃষ্টির পানিতে তার কাঁধের একটা পাশ পুরোপুরি ভিজে গেছে । হাতে একটা মরচে ধরা কেরোসিনের টিন । মফিজ ইমাম সাহেবকে দেখে সপ্রতিভ ভঙ্গিতে বলল, ‘ইমামসাব, জ্বিনের ঘটনা হুনছেন ? পিপুল মিয়ার জ্বিন ?’
ইমাম সাহেব মফিজের চোখের দিকে একবার তাকালেন, কিছু বললেন না । হেঁটে ভেতরের ঘরে ঢুকে গেলেন । মোজাম্মেল হক ইমাম সাহেবকে দেখে শোয়া থেকে উঠে বসল । ইমাম জালালুদ্দিন লম্বা করে সালাম দিল । তারপর চিন্তিত স্বরে বলল, ‘ভাল আছেন ডাক্তারসাব ?’
‘ভাল নাই । শরীর বেশ খারাপ করেছে । ঠান্ডা লেগে গেছে ।’
‘শরীরের ভাল মন্দ তো থাকবেই । শরীর আরও খারাপ হতে পারতো । মনে করেন, জ্বরে অচেতন হয়ে পড়লেন । এটা আরও খারাপ হতো না ? আল্লাহপাক কিন্তু তা হতে দেন নাই । অল্পের ওপর থেকে পার করে দিয়েছেন । এই কারনে রোগে শোকে থাকলেও শুকরিয়া আদায় করে বলতে হয় ‘শুকুর আলহামদুলিল্লাহ, ভাল আছি’ ।’
মোজাম্মেল হক হালকা স্বরে বললেন, ‘জ্বি আলহামদুলিল্লাহ । সেই হিসেবে ভাল আছি ।’
‘আপনার কাছে এসেছি একটা বিষয় নিয়ে পরামর্শ করার জন্য ।’
‘কি বিষয় ?’
‘পিপুল মিয়ার বাড়িতে একটা জ্বিন আটক হয়েছে জানেন বোধহয় । ঐ বিষয়ে আলোচনা ।’
মোজাম্মেল ডাক্তার মাথা তুলে একবার মফিজের দিকে তাকালো । মফিজ মাটির দিকে তাকিয়ে আছে । তার ডান পাশের গাল আবীরের মত লাল হয়ে আছে । ডাক্তার দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন । ইমাম জালালুদ্দিন সাহেব রসিকতা করার মত লোক না । তার মুখের ভাবেও স্পষ্ট চিন্তার ছাপ । ডাক্তার বললেন, ‘আমি তো জানি পিপুল মিয়ার স্ত্রী গর্ভবতী । আমি দুবার দেখেও এসেছি । এই অবস্থায় পিপুল জাল ফেলে জ্বিন শিকার করতে যাবে এ কথাটা আমার কাছে ঠিক বিশ্বাসযোগ্য না ।’
‘তামাশা করছেন ডাক্তারসাহেব ?’
‘জ্বি । স্যরি । আর করবো না । জ্বিনের গল্প আপনি শুনেছেন কার কাছ থেকে ?’
‘শোনা কথা হইলে এতটা ঘাবড়াইতাম না । আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি ডাক্তার সাহেব । ইয়া মাবূদ ! যা দেখেছি তা বিশ্বাসযোগ্য না । মনে হল চোখের ভুল । ইয়া বড় বড় শাদা ছিটছিট খয়েরী রঙের দুই ডানা । শরীর ভর্তি লাল-লাল কাটা । গা থেকে আসতেছে মৃগনাভীর কড়া সৌরভ । বুড়ো জ্বিন । পায়ের নীচে খুরের মত দেখেছি । পিঠে বিশাল কুঁজ । পাখনাও ছিন্নভিন্ন । উড়বার সময় ঝড়ের তোড়ে এই অবস্থা হয়েছিল বোঝাই যায় ।’
‘জ্বিন তো জানতাম আগুনের তৈরী ।’
‘ভুল জানেন ডাক্তারসাব । এদের তৈয়ার করা হয়েছে লু’ এর শিখা দিয়ে ।’
‘লু’ জিনিসটা কি ?’
‘লু’ হইতেছে গিয়ে আপনার ধুয়াহীন আগুনের শিখা । আগুন যখন দাউদাউ করে জ্বলে তখন উপরের দিকে যে হইলদা সবুজ রঙের আলো দেখা যায় এরা তার তৈরী ।’
‘এরা লু’র তৈরী হলে আপনি কুঁজওয়ালা পিঠের বৃদ্ধ জ্বিন কিভাবে দেখলেন ? এর তো থাকার কথা অদৃশ্য । যুক্তি তো তাই বলে, নাকি ?’
মাওলানা জালালুদ্দিন সাহেব হেসে বললেন, ‘পান আছে নাকি আপনার কাছে ? বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব তো । মুখের মধ্যে পান থাকলে ভাল হতো ।’
মফিজ উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, ‘ইমামসাব, মুঞি এক দৌড়ে মুন্সী বাড়িত্তন লইয়া আই ? যামু আর আমু ।’
‘যাও । নিয়া আসো । তোমাদের বাড়িতে আজ রাত্রে খানাখাদ্যের জোগাড় কি ? খিচুড়ীর বাস আসতেছে । খিচুড়ী পাকাইতেছো নাকি ?’
‘জ্বে ।’
‘পরিমাণে বেশী থাকলে আমাকে দাওয়াত করতে পারো । আজ রাতে আমার বাড়িতে রান্না হয় নাই । রান্নাঘর পানিতে তলায়ে গিয়েছে । যদিও রিজিক নিয়া চিন্তা করি না । রিজিকের মালিক আল্লাহপাক । যদি রাত্রে উপাস থাকা লিখা থাকে তাহলে দাওয়াত দিয়াও আমারে খিচুড়ী খাওয়াতে পারবা না । আল্লাহপাক সূরা বনী ইসরাঈলে বলেছেনঃ ওয়া কুল্লা ইনসানিন আলযামনাহু ত’ ইরাহু ফি উনুক্বিহী । এর মানে হইতেছে আমি তোমাদের ভাগ্য তোমাদের গলায় গহনার মত করে ঝুলাইয়া দিয়েছি ।’
‘ইমামসাব খিচুরী আছে । মুঞি পান লইয়া আইয়াই খিচুরী বাইড়্যা দেতে আছি ।’
‘আলহামদুলিল্লাহ !’
মফিজ ঝড়ের গতিতে বেড়িয়ে গেল । জালালুদ্দিন দুহাতে হাঁটুতে চাপড় দিতে দিতে মোজাম্মেল হককে বললেন, ‘আজকালকার লোকজন ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে । অথচ জ্বিনে বিশ্বাস করে না । আধুনিক যুগ । যদিও আল্লাহর পাক কালামে জ্বিনদের কথা বর্ণনা করা আছে ।’
হকসাহেব কঠিন কন্ঠে বললেন, ‘ইমামসাহেব কিন্তু আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেছেন ।’
‘এড়িয়ে গিয়েছি কথাটা ঠিক না । আপনার নফরের সামনে আপনার যুক্তি ভাঙতে চাই নাই । এই জন্যে তাকে পানের অজুহাতে সরিয়ে দিয়েছি ।’
‘এখন মফিজ নেই । এখন বলুন ।’
‘জ্বীনদের সৃষ্টি আদমেরও দুই হাজার বৎসর আগে । জ্বিনদের আদিপিতার নাম সামূম । তারে বানানোর পর আল্লাহপাক সৃষ্টির আনন্দে বললেন, ‘তুমি আমার কাছে কিছু চাও !’ তখন সামূম চাইল, ‘আমরা সবাইকে দেখতে পাইলেও আমাদের যেন কেউ দেখতে না পারে, আমরা যেন ইচ্ছা হইলেই অদৃশ্য হইতে পারি এবং আমাদের বৃদ্ধরাও যাতে মৃত্যুর পূর্বে একবার যৌবন ফিরে পায় । আল্লাহপাক তাদের প্রার্থনা কবুল করলেন । তবে জ্বিনদের নানান রকমভেদ আছে । একেক জ্বিন একেক রূপ নিয়া থাকে । হাদীস শরীফে আছে, ইন্না আল হাওয়াম্মা মিনাল জিন্নি ফামান রা’ ফি বাইতি ফাল ইয়াখরুজ আলাইহি ছালা ছামাররাতিন ফা ইন আরা ফালতাক্বতুহু ফা ইন্নাহু শাইতান । সুনানু আবু দাঊদ, কিতাবুল আদাব, বাব ১৬২, হাদীস নং ৫২৫৬ । আমি মনগড়া কিছুই বলতেছি না ।’
‘এই হাদীসের অর্থ কি ?’
‘এর অর্থ হইতেছে, বাড়িতে থাকা কিছু কিছু সাপ-বিচ্ছু জ্বিনদের অন্তর্গত । কেউ বাড়িতে এইগুলি দেখলে তিনবার তাড়ায়ে দেবে । তারপরও যদি সেইটা ফিরে আসে তাহলে তাকে মেরে ফেলতে হবে । কেননা সে হচ্ছে শয়তান জ্বিন ।’
‘ও আচ্ছা !’
‘এইসব সাপ যদিও পুরাপুরি জ্বিন না । এদের নাম হইলো গিয়া জান্নুন । বাচ্চা জ্বিন । ডাক্তারসাহেব যে আমার কথা বিশ্বাস করেন নাই বুঝতে পারতেছি । তবে পিপুল মিয়ার বৃদ্ধ জ্বিনকে দেখলেই আপনার বিশ্বাস হবে । একে মানুষের গোত্রে ফালানো অসম্ভব । বিশাল বিশাল ডানা দুইটা দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন ।’
‘ইমামসাহেব, একটা ঈগল আর একটা এরোপ্লেনের পার্থক্য ডানা দিয়ে করতে যাওয়াটা নিরর্থক । তাছাড়া আপনি যদি নিশ্চিত হতেন যে পিপুল মিয়ার বাড়িতে আটকা পড়া জীবটি আসলেই জ্বিন জাতীয় কিছু তাহলে বোধ করি চিন্তিত মুখে আমার কাছে ছুটে আসতেন না । আপনি আমার কাছে এসেছেন কারন এই দ্বীপে আমিই একমাত্র এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তার । আমি যাতে জীবটির নাড়ি-হৃদস্পন্দন পরীক্ষা করে নিশ্চিত করি যে আসলেই এটি মানুষ কিনা, তাই না ?’
ইমাম জালালুদ্দিন সাহেব কিছু বললেন না । বাম হাতে মাথার পাগড়ী খুলে সামনে রাখা কেরোসিনের টিনের ওপরে রাখলেন । তিনি ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে তর্জনী অনবড়ত ঘষছেন । তাকে সত্যিই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ দেখাচ্ছে । মোজাম্মেল হক খাট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনি রাতের খাবার খেয়ে নিন । আমি ততক্ষণে আমার ডাক্তারী যন্ত্রপাতিগুলি গুছিয়ে তৈরী হয়ে আসছি । আমার এমনিতেও পিপুলের বৌকে দেখতে যাওয়ার কথা ছিল । জ্বিন দেখার আগ্রহের চাইতে রোগী দেখার আগ্রহই আমার বেশী ।’
‘আপনি খাবেন না ?’
‘আমার রূচি নষ্ট হয়ে গেছে ইমামসাহেব । আজ রাতে কিছু খেতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না ।’
৩
মফিজ মিয়া মিথ্যা কিছু বলেনি । পরিত্যাক্ত অর্ধনিমজ্জিত পুরোনো গরুর খোঁয়াড়টার এক কোনে যে বৃদ্ধ গুটিসুটি মেরে মাথা নীচু করে বসে আছে সে বিরাটাকায় না হলেও, তার পাখা দুটি বিরাটাকায় দৈত্যের তো বটেই । বৃদ্ধের মাথার চুল খাবলে খাবলে উঠে গেছে । কিছু শীর্ণশাদা চুল মাথার চাতালের এদিক সেদিক থেকে উঁকি মারছে । তার গায়ে লাল-লাল শজারুর কাটা আছে কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না । কারন সে তার বৃহৎ ডানাদুটি দিয়ে নিজের শরীর ঢেকে রেখেছে । তবে টর্চের আলোয় ডান পায়ের নীচের খুর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । মোজাম্মেল হক অনুভব করলেন, বৃদ্ধের শরীর থেকে সত্যি সত্যিই এক ধরনের অপূর্ব সৌরভ আসছে । সৌরভ মৃগনাভির কিনা তা সে জানে না, মৃগনাভির গন্ধ কেমন হয় এ বিষয়ে তার ধারনা নেই । তবে ঘ্রাণটা হিপনোটাইজিং । খোঁয়াড়ের ভেতরে কয়েকটি লাল রঙের সানকীতে করে আতর আর জ্বলন্ত আগড়বাতি রাখা হয়েছে । আগড়বাতির গন্ধের মধ্যেও বৃদ্ধের গায়ের ঘ্রাণ আলাদা করা যাচ্ছে । আচ্ছা, হক সাহেব কি জ্বরের ঘোরে কোন স্বপ্ন দেখছেন ? হতেও তো পারে এটা বড় ধরনের কোন দুঃস্বপ্ন ! হঠাৎ একসময় ঘুম ভেঙে উঠে বসে নিজের স্বপ্নের কথা ভেবে হয়তো আপনমনেই হাসবেন । এমন তো অনেকবারই হয়েছে ।
পিপুল মিয়া একটা কালো ছাতা নিয়ে খোয়াড়ের দিকে দৌড়ে আসছে । ছাতার কাপড়টা অতিমাত্রায় পাতলা । বাতাসের তীব্রতায় ক্রমাগত উলটে যাচ্ছে । সে হাঁপাতে হাঁপাতে খোঁয়াড়ের সামনে এসে বলল, ‘ডাক্তারসাহেব কি বুঝলেন ? এইডা কি সত্যই জ্বিন ?’
‘এখনও বুঝতে পারছি না । পিপুল, তোমাকে পানি ফুটাতে বলেছিলাম । আমার জিনিসপত্র কাঁচি-সুঁই-সিরিঞ্জগুলি গরম পানিতে রাখতে বলেছিলাম । এগুলি করেছো ?’
‘মুঞি রহিমারে কইয়া রাখছি । হ্যার করার কথা । ফুলবানুও হাইতনা ঘরে আছে । আইচ্ছা ডাক্তারসাব, কন তো দেহি এরে খাওয়াখাইদ্য কি দেওয়া যায় ?’
‘কার খাওয়াখাদ্য ?’
‘বুড়া জ্বিনডার কথা কইতে আছি । এরে যা দেই ফির্যাও চায় না । কাঁচা খইলসা মাছ আঁইশ ছাড়াইয়া দেলাম, কলই দেলাম, গাছের টসটসা কোম্বা কাইট্যা দেলাম । কোন রাও নাই । মুঞি কি এরে এহন রান্ধা মাছ আর সালুন খাওয়ামু, কন দেহি কি বিপদ !’
হকসাহেবের ইচ্ছা করল পিপুলের গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিতে । সে অনেককষ্টে সেই ইচ্ছা দমন করল । একটা মানুষের বৌ মরে যাচ্ছে অথচ তার সে বিষয়ে কোন মাথাব্যথা নেই । সে আছে জ্বিনের খাবার নিয়ে । বাড়ির ভেতর থেকে আবার হেলেনার আর্তচিৎকার শোনা গেল । মেয়েটা প্রসববেদনায় বড় বেশী নাজেহাল হয়ে পড়েছে ।
পিপুল মিয়া আবার গভীর আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ইমামসাবের কি জানা আছে এগো খাওনের সিস্টেমডা কি ? এরা কি খাইতে পছন্দ করে ?’
‘শুকনা হাড্ডি দিয়ে দ্যাখো । খায় কিনা ।’, ইমাম সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, ‘কয়লাও দিতে পারো ।’
‘কয়লা ? কয়লা ক্যান খাইবে ?’
‘কয়লা খাবে কারন এদের কয়লা পছন্দ । গোবরও দেয়া যায় । এই বিষয় নিয়েও হাদীসে বর্ণনা আছে । বর্ণনা শুনতে চাও ?’
‘জ্বেনা ! কি আচানক কায়দা ! মোর বাড়িতে অতিথ হইয়া এউক্কা জ্বিন আইছে । মুঞি হ্যারে আদর কইর্যা কয়লা খাওয়াইয়া দিমু ?’
‘হ্যাঁ খাওয়াবে । যার যেমন ক্ষুধা তার জন্য সেই ধরনের খাবার ।’
মোজাম্মেল হক বিরক্ত গলায় বলল, ‘আপনারা এত অদ্ভুত কেন ? একটা অন্তঃসত্ত্বা মেয়ে মরে যাচ্ছে । আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জ্বিনের খাবার নিয়ে ভাবছেন ?’
পিপুল মিয়া এই কথা শুনে বেশ খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়ল । নিজের ফিনফিনে দাড়ি চুলকে বলল, ‘এইটা একটা বিবেচনার বিষয় । ইমামসাব, খাওয়াখাইদ্য না দিলেও তো এর কিছু হইবে না । জ্বিনেগো আবার মিত্যু কি ?’
ইমাম জালালুদ্দিন প্রসন্ন মুখে বললেন, ‘হযরত হাসান বসরীর মত অনুসারে জ্বিনদের মৃত্যু হয় না । এদের কেয়ামত পর্যন্ত অবকাশ দেয়া হয়েছে । কিন্তু কিছু কিছু জ্ঞানী...’
‘আপনারা চুপ করবেন ?’, মোজাম্মেল ডাক্তারের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল । সে কড়া গলায় বললেন, ‘এই মফিজ ! আয় আমার সাথে ! দেখি কি ব্যবস্থা করা যায় !’
মফিজের খোঁয়াড়ের আশেপাশে আরও কিছুক্ষণ থাকবার ইচ্ছা ছিল । মোজাম্মেল হকের ধমকের উপর সে আর কিছু বলবার সাহস পেল না । নিতান্তই অনিচ্ছাস্বত্ত্বে অপ্রসন্ন মুখে লুঙ্গিতে কাছা দিয়ে হকসাহেবের পিছু পিছু হাঁটা শুরু করল । পানির উচ্চতার জন্য জমিন ঠাহর করা যাচ্ছে না । খানা-খন্দে পড়ে গেলে সর্বনাশ । তাছাড়া সাপ-জোঁকের ভয় তো আছেই ।
হকসাহেব চলে যেতেই পিপুল মিয়া নাকেমুখে জমে থাকা বর্ষার পানি হাত দিয়ে টেনে ফেলতে ফেলতে বলল, ‘মওলানা সাব ! মোর বৌডা মনে কয় বাঁচপে না । মউৎ সন্নিকট । মোরে কইলো কালা কুচকুইচ্যা একটা আবছায়া দ্যাখছে । আজ্রাইল দ্যাখছে আর কি !’
ইমাম সাহেব বললেন, ‘ফালতু কথা বলবা না পিপুল ! আজ্রাইল কোন চোখে দেখার বস্তু না । আমার তো মনে হয় এই জ্বিনটাই এরে ভয় দেখায়েছে । এ কি মুখে কোন কথা বলেছে ?’
‘বলেছে । অন্য ভাষা । ভাষা বুঝি না । খালি বিড়বিড়ায় । এহন তো বিড়বিড়ানিও বন্ধ ! এর শইল মনে হয় ভালো না । বোলাইলে কোন ছ্যাধব্যাধ নাই ।’
‘বদ জ্বিন হওয়ার সম্ভাবনা আছে । বদ জ্বিনের দুই কাজ । মানুষের দৃষ্টিশক্তি চুরি করে আর মেয়েছেলেদের গর্ভপাত করায় ।’
‘কয়েন কি মওলানা সাব ?’
‘সমস্যার কিছু নাই । সূরা আল-হাশরের শেষ তিন আয়াত লিখ্যা বিবির মাথার বালিশের নীচে রেখে দিলেই সমস্যার সমাধান । ঝুঁটিওয়ালা একটা শাদা মোরগ দরকার । মোরগটা খাটের সাথে বাইন্ধ্যা রাখতে হবে । বদ জ্বিন, জাদুকর আর জ্যোতিষী- এই তিনের অনিষ্ট থেকে তাইলে হেফাযতে থাকবা ।’
‘মোরগ আছে । কিন্তুক বাইন্ধ্যা রাহোনের তো গতিক নাই । চৌকি রাখছি টানা দিয়া । পানিতে ব্যাবাক ঘর ছয়লাব । মোরগ রাখলে চৌকির উফ্রে রাহা লাগবে ।’
‘রাখো । ঘরে থাকলেই হইলো ।’
‘জ্বে আচ্ছা ।’
পিপুল মিয়ার স্ত্রী টানা চিৎকার করে যাচ্ছিল । মোজাম্মেল ডাক্তার সবটা বুঝে উঠবার পর প্রায় শিউরে উঠলেন । বাচ্চা মায়ের জরায়ুর মধ্যে ট্রান্সভার্স পজিশনে আছে । অপারেশন থিয়েটারে সিজারিয়ান করা ছাড়া গতি নেই । ব্রীচ টিল্ট জাতীয় কিছু কি করা যায় ? ডাক্তার দ্রুত ভাবলেন । বাচ্চার ইনভার্সন করতে গিয়ে আরও ভয়াবহ সমস্যা হল । হেলেনার প্রি-একলামশিয়া শুরু হল । মোজাম্মেল ডাক্তার হাল ছাড়লেন না । বাচ্চাটাকে বাঁচানো সম্ভব, অবশ্যই সম্ভব !
তার নিজের মেয়ে বিন্তির জন্মের সময় বীথির এমন একলামশিয়া শুরু হল । তিনি পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন । থরথর করে কাঁপছিলেন । তখন নতুন-নতুন পাশ করে বেড়িয়েছেন । নার্ভ সহজেই দূর্বল হয়ে পড়তো, মাথা কিছুতেই ঠান্ডা রাখতে পারছিলেন না । ফরিদা পারভীন ম্যাডাম ওটিতে ছিলেন । তিনি মুখ থেকে কাপড়ের মাস্ক সরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই ছেলে ! তুমি তো ডাক্তার হতে পারবে না ? সামান্য একলামশিয়া দেখে শক্ত হয়ে গেছো । স্বাভাবিক হও । Be normal !’ মোজাম্মেল হক নিজেই নিজেকে বোঝালেন, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে । বি নরমাল ! বি নরমাল !’
রাত্রি প্রায় দুটোর সময় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হল । ঝুঁটিওয়ালা শাদা মোরগের জন্যেই হোক অথবা অন্য যে কোন কারনেই হোক পিপুল মিয়ার স্ত্রী হেলেনা সে যাত্রায় বেঁচে গেল । মোজাম্মেল হক অসাধ্য সাধন করলেন । তিনি ঘর্মাক্ত দেহে বাচ্চাটির নাড়ি কাটলেন । কিছুটা শঙ্কা নিয়ে নিথর হয়ে থাকা শিশুটির দেহে শব্দ করে চড় মারলেন । বাচ্চাটি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চেঁচিয়ে উঠল । মোজাম্মেল ডাক্তার বিড়বিড় করে বললেন, It was a miracle ! It was a miracle !
ফুলবানু হাতে ধরে থাকা পাতিল জলে ফেলে দিয়ে ‘ও আল্লাগো- ও আল্লাগো-’ বলে বিকট শব্দে চিৎকার করে উঠল । বাচ্চাটি বোধহয় ভয় পেয়েই হাত-পা তুমুলভাবে ঝাপ্টঝাপ্টি করতে করতে ভ্রূহীন চোখ কুঁচকে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে । নতুন একটা জগতে এসে সে বড় বেশী অস্থির হয়ে পড়েছে । অমরার মত স্বাধীনতা সে এই জগতেও খুঁজছে । রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘আঁতুড়ঘরে নাড়ি কাটা পড়িল, এখন অন্য জগতে স্বাধীন সঞ্চরণের অধিকার লাভ করিতে হইবে !’
বাচ্চাটির মাথাভর্তি ঘন চুল । মেয়েটিকে দেখাচ্ছে দেবশিশুর মত । মোজাম্মেল হক প্রগাঢ় মমতা দিয়ে মেয়েটিকে বললেন, ‘মা রে ! তোর জন্মের পরপর বাধ্য হয়ে তোকে মারতে হল । তুই জন্মক্ষণে আমার জন্য কাঁদলি । আশীর্বাদ করি সারাজীবনে যেন আর কখনও তোকে কাঁদতে না হয় । তোর বাকীটা জীবন যেন দুধে-ভাতে কাটে !’
৪
জ্বিন ধরা পড়বার সংবাদ ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগল না । দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন তীব্র কৌতূহল নিয়ে বৃদ্ধ জ্বীন দেখতে চর কুকড়ি মুকড়ি দ্বীপে ভীড় করতে শুরু করল । তবে গণমাধ্যম থেকে তেমন কোন আগ্রহ এক্ষেত্রে দেখা গেল না । এরা সম্ভবতঃ এধরনের অনেক ভুল-মিথ্যা তথ্য পেয়ে পেয়ে খোঁজ-খবর করার আগ্রহ নষ্ট করে ফেলেছে । বাঘ-বাঘ বলে চেঁচানো রাখালের মত অবস্থা হয়েছে । এখন সত্যিকার জ্বিন আটকা পড়েও জনপ্রিয় হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় মঞ্চ পাচ্ছে না । তবে দ্বীপে এসে হারিয়ে যাওয়া ঢাকার ছেলে-মেয়েগুলোর নাম বেশ কটি পত্রিকার শেষ পাতায় বেশ বড়সড় আকারে ছাপা হল ।
তাই বলে ভীড় যে কমল, তা না । বরং উলটোটাই হল । মানুষের চাপে পিপুল মিয়ার বাড়িতে পা ফেলা পর্যন্ত দায় । হেলেনা বিরক্ত হয়ে পিপুল মিয়াকে বলল, ‘লুকজনের যন্ত্রণায় তো কাজকাম করাও যায় না । এইহানে কি সার্কেস চলতাছে ? সার্কেস চলতাছে এইহানে ? আম্নে কিছু না করলে মুঞিই কিন্তু কিছু কইর্যা বমু । বুড়াডারে আমি কইলাম হালাইয়া দিয়া আমু সমুদ্রে ।’
হেলেনার কথা থেকে পিপুল মিয়ার মাথায় সূক্ষ্ণ পরিকল্পনা খেলা করতে থাকে । কথাটা তো মন্দ বলে নাই হেলেনা ! মানুষ তো সার্কাস দেখার মতই হল্লা করে আসাযাওয়া করছে । বুড়োটাকে দেখার জন্য টিকেটের ব্যবস্থা করতে পারলে খারাপ হয় না । বুড়া জ্বিন দেখে টাকা দিয়ে যাও । ফ্যালো কড়ি, মাখো তেল । এই জগতে অর্থ বিনা পুলাপাইনের অকাজের খেলনা পর্যন্ত খরিদ করা যায় না । আর সাক্ষাৎ জ্বিন দেইখা পয়সা দিবা না ? এইটা কেমন কথা ?
টিকেটের উদ্ভট ব্যবসা সত্যিসত্যিই বেশ জমে গেল । লাইন ধরে মানুষ টিকেটের আশায় চার সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে আছে । এ এক বিস্ময়কর ব্যাপার ! পাঁচ টাকায় শুরু হওয়া টিকেটের দাম বাড়তে বাড়তে শেষ পর্যন্ত বিশ টাকা পর্যন্ত গড়ালো । অবস্থা এমন হল যে পিপুলের ভাঙা কাঠের আলমারী কাগজের রাশি রাশি নোটে ভরে যাওয়ায় চটের বস্তা কিনে এনে তাতে টাকা রাখা শুরু করতে হল । পিপুলের মেয়ে রূপালির ততদিনে দুটো দাঁত গজিয়ে গেছে । ফোকলা দাঁতে হি-হি-হি করতে করতে সে তার নরম নরম হাত পা থপথপিয়ে হামাগুড়ি দেয় । দেখতে বড় ভাল লাগে । কিন্তু তার একটিই সমস্যা । সে গলা-খিচুড়ী খাওয়া নিয়ে বড্ড যন্ত্রণা করে । জ্বিনের পাশে না নিয়ে গেলে তাকে এক দানা খাওয়ানো যায় না । জ্বিন দেখতে দেখতে সে আহ্লাদ করে খায় । আর রাতের বেলা টাকার বস্তাগুলির দিয়ে খেলনা ঘর-গাড়ি বানিয়ে তার মধ্যে ঢুকে খেলা করতে থাকে । পিপুল মিয়া গাঢ় আনন্দে নিঃশ্বাস ফেলে । রাতে বিছানার ওপর শুয়ে দুহাতের ওপর মাথা রেখে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে ভাবে, ‘আহা ! আমার মেয়ে বড় হচ্ছে টাকার বস্তা নিয়ে খেলতে খেলতে ! কি শান্তি ! কি শান্তি !’
দেখতে দেখতে পিপুলের কুড়েঘর বড়সড় চৌচালা বাড়ি হয়ে ওঠে । বাজারে নতুন আসা রঙিন লাল-বেগুনী রঙের বাহারী টিনে সে বাড়ির চাল সাজায় । বিশাল বড় আঙিনায় টবে টবে দামী গাছ পাতা বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করে । পিপুল মিয়া শখের বশে খবিরউদ্দিনের কাছ থেকে কয়েকটি ট্রলারও কিনে ফেলে । সেগুলিতেও বিস্তর আয় । ঘরের বড় দরোজায় টিকেট বিক্রি করতে করতে হেলেনার নাভিশ্বাস ওঠে । দুদন্ড যে জিড়িয়ে নেবে সে উপায় নেই । সংসারের কাজ, হাসির দেখাশোনা, সেলাইয়ের কাজ সব মিলিয়ে সে যেন থই হারিয়ে ফেলে । অবসর নামের সেই পুরোনো অধ্যায়টি পিপুল মিয়ার পরিবার থেকে পুরোপুরি উধাও হয়ে যায় ।
এতো সবের ভেতর বৃদ্ধ জ্বিনই কেবলমাত্র সেই একমাত্র জীব নিজেকে ঘিরে ঘটে যাওয়া এই বিশাল দক্ষযজ্ঞে যার কিছুমাত্র উপস্থিতি নেই । সে যেন অয়সের মতই কোন দরকারী অনুঘটক যে উগ্র গন্ধে ছাওয়া অ্যামোনিয়া তৈরীর আগে-পিছে অলস বসে থাকলেই হল, কোন ক্রিয়াকর্মের তার প্রয়োজন নেই । তার অবস্থারও খুব একটা উন্নতি হয় নি । সেই পরিত্যাক্ত খোঁয়াড়ের নোংরা নির্জন কোণেই সে সারাদিন নির্বিকার পড়ে থাকে । একটা ইস্পাতের লম্বা শেকলের ব্যবস্থা তার জন্যে করা হয়েছে । এ নিয়ে তার কোন অভাব-অভিযোগ আছে বলেও মনে হয় না । সুবল ময়রার দোকানের সাথে তার খাওয়া নিয়ে নতুন নতুন চুক্তি করা হয়েছে । এরা বৃদ্ধের জন্য নতুন ধরনের সবুজ রঙের এক মিঠাই বানিয়ে তার নাম দিয়েছে জ্বিনের মিঠাই । নামের কারনে বাজারে সেই জ্বিনের মিঠাইয়ের বেশ কদর হয়ে যায় । যদিও বৃদ্ধ জ্বিন তার জন্যে বানানো নবআবিষ্কৃত মিঠাই খুব একটা আগ্রহ নিয়ে খায় না । কাঁসার প্লেটভর্তি করে মিঠাই দিলে তার প্রায় সবটাই রয়ে যায় ।
দেখতে দেখতে দ্বীপে শীত পড়ে যায় । অসময়ে টানা বৃষ্টির কারনে এবার শীত পড়েছে জাঁকিয়ে । শীতের সময়েও বৃদ্ধকে তার চিরাচরিত রূপ পরিবর্তন করতে দেখা যায় না । তীব্র শীতের রাতে সে কবের পাওয়া পিপুলের পুরোনো ছেঁড়া-ফাটা একখানা ধূসর রঙের শাল দিয়ে নিজের পাখাদুটো জড়িয়ে রাখে । শীত তাকে কাবু করতে পারছে কি পারছে না, তা ঠিক বোঝা যায় না । সে অবসন্নভাবে কুপীর আগুনের দিকে নিজের প্রত্নতাত্ত্বিক যুগের হালকা নীলাভ চোখদুটি রেখে চুপচাপ বসে থাকে । মাঝে মাঝে সে চোখের কোণে জল যে দেখা যায় না তা নয় । সে বোধহয় তার ডানাদুটির সন্তাপেই । তার বিস্কুটবর্ণের শাদা ছিটওয়ালা সুবিশাল ডানাদুটির বেশীরভাগ পালকই উবে গেছে । চমৎকার পাখনাদুটিকে দেখতে এখন বড় বিশ্রী লাগে । বৃদ্ধ সত্যিকারের মানুষ হলে এই শোকে আত্মহত্যা করার অভিপ্রায় জাগাটা খুবই স্বাভাবিক ছিল । সব খারাপেরই ভাল দিক থাকে । এর মানুষ হয়ে পৃথিবীতে না জন্মানো হয়তো তেমনই একটি ভাল দিক !
বৃদ্ধ জ্বিনের কোন অতিলৌকিক শক্তি আছে বলেও মনে হচ্ছে না । একমাত্র অলৌকিক ক্ষমতা বলতে এর অপরিসীম ধৈর্য্য ! যারা বৃদ্ধকে টিকেট কেটে দেখতে আসে তারা তাকে চিড়িয়াখানার জন্তু ছাড়া অন্য কিছু ভাবে না । মাঝে মাঝে এরা বৃদ্ধের দিকে খাবার ছুঁড়ে মারে, মাঝে মাঝে ইট-পাথর । বৃদ্ধ জ্বিন তাতেও বেশ নিরুদ্বেগ, নিশ্চিন্ত । মাত্র পেটভরে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা বিশাল অ্যানাকোন্ডার মতন সে নিবিষ্টমনে ঝিমাতে থাকে । চারপাশ যেন তার কাছে অদৃশ্য । শুধু যেদিন বিশাল গোঁফওয়ালা মোটাসোটা লোকটি সে আসলে জীবিত কিনা তা পরীক্ষার করার জন্য তার শরীরে জলন্ত সিগারেট চেপে ধরেছিল, সে প্রবলভাবে নড়ে উঠে তার পালকহীন পাখা ঝাপটানো শুরু করল । একটা মহাজাগতিক শক্তিশালী ঘুর্ণি যেন খোয়াড়টিকে কিছুক্ষণের জন্য নাড়িয়ে দিল । রুগ্ন ঘরটা ধুলোয় অন্ধকার হয়ে গেল এক নিমেষে । মনে হল যেন তুষারের মত দুর্বার গতিতে ঘুরতে থাকা শনিগ্রহের ছোট ছোট উপগ্রহগুলি পথ ভুলে আচমকা ঘরটার ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে । সেই সাথে পাখা কাঁপার সময় মৌমাছির মত বিচ্ছিড়ি ভনভনানি জাতীয় শব্দটা সত্যিকার অর্থেই খুব ভয়জাগানো । সেই শব্দটা যদিও আরও প্রচন্ড ছিল । সেই ঘটনার পর থেকে দর্শকরাও কিছুটা সাবধান হয়ে গেল । অন্ততঃ শিবের নিদ্রাভঙ্গে তাদের আর তেমন আগ্রহ রইলো না, শিবদর্শনই তাদের পক্ষে যথেষ্ট !
পৌষসংক্রান্তির শুরুতে কাহিনী অন্যদিকে মোড় নিল । যেদিন কুয়াশাগ্রস্থ বিকেলে দুটো বড় বড় লঞ্চে করে একটা সিনেমাওয়ালার দল দ্বীপে এসে নামল । কিছু ভিনদেশী পাখি উড়ে উড়ে এসে লঞ্চের তেতলার মাস্তুল ঘিরে জড়ো হতে লাগলো । তাদেরকে দেখবার আগ্রহ ব্যস্ত মানুষগুলোর তেমন ছিল না যদিও । তারা সংকীর্ণ সিঁড়ির ওপর দিয়ে সাবধানে জেনারেটরের বড় বড় যন্ত্রগুলি দ্বীপের বালিতে টেনে নামাতে ব্যস্ত হয়ে রইলো । সুঁইগুপী বাজারে তারা দেখতে দেখতে একটা ছোট্ট সিনেমাহল বানিয়ে ফেলল । মাঘের শেষদিকে বিশ টাকা টিকেটে সেখানে ছবি দেখানোর কাজ শুরু হল । এবং চৈত্রের শেষ নাগাদ পিপুলের বাড়িতে ঢোকার সেই জনাকীর্ণ টিকেট কাউন্টার একেবারে খাঁ খাঁ করতে লাগল ।
সুসময়-অসময়ের হিসেব বুড়ো জ্বিনের আগেও যেমন ছিল না, এখনও তাই । তবে পিপুল-হেলেনা বেশ খানিকটা হতাশ হয়ে পড়ল । তাদের যত রাগ সব গিয়ে ঐ বুড়োটার ওপরেই পড়ল । তাছাড়া রূপালী দিনকেদিক বড় হচ্ছে । মেয়েটা সময়ে অসময়ে খোঁয়াড়ের দিকে চলে যায় । জ্বিনটিকে সে জন্ম থেকেই পরিবারের অংশ হিসেবে দেখায় পোষা একটা বিড়াল ভিন্ন আর কিছু মনে করে না । জ্বিনটি তাই দিনে দিনে একটা বাড়তি ঝামেলা হিসেবেই দেখা দিয়েছে । হেলেনা বুড়োকে কিছু একটা রুক্ষ কথা বললে ছোট্ট রূপালি মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে । রূপালির সাথে জ্বিনের সম্পর্কটি সহজে নির্ধারন করার জন্য সঠিক উপমা হয়তো পথের পাঁচালীর দূর্গা আর ইন্দিরা ঠাকরুনের চরিত্র । বুড়ি ইন্দিরাকে সর্বজয়া ভিখিরী বলে গাল দেয়ার পরপর সেই যে বাচ্চা মেয়েটির মন ভোলানো কথাঃ ‘ক’পয়সা দাম পিতিমা-কেমন নাঙা- না?’
বৃদ্ধ জ্বিন যদিও ইন্দিরা ঠাকরুনের মত কথোপকথনে অত পাকা নয় । তবে তার চোখের কিছু একটা ভাষা আছে । পিপুল মিয়া কি করবে ভেবে পায় না । হেলেনা এক রাতে ভাত মাখাতে মাখাতে বলে, ‘এইযে হুনেন !’
পিপুল মিয়া হাত ধুতে ধুতে বলে, ‘কি ব্যাপার ?’
‘জ্বিনটার শিকল খুইল্যা দ্যান । চইল্যা যাউক ।’
‘কই যাইবে বেচারা ? পাখনাও তো নাই যে উড়াল দিয়া নিজের চইল্যা যাইবে ।’
‘মুঞি হেয়া জানি না । এই আপদ দূর হরেন ।’
‘দেহি কি করা যায় । ভাইব্যা দেহি ।’, পিপুল মিয়া চিন্তিত মুখে জবাব দেয় । ভাবনা শুরু করতে যদিও তার ইচ্ছে হয় না । চলুক না যেমন চলছে ! আল্লাহপাক যেমন একে এখানে এনে ফেলেছে, উঠিয়ে নেয়ার হিসাবও তো তারই হাতে ।
কিন্তু ভাবতে হয় । যখন রূপালি এবং বৃদ্ধ জ্বিন একই সময় বসন্ত রোগে পড়ে তখন জ্বিনের ব্যাপারটি আসলেই একটা প্রকট চিন্তার কারন হয়ে দাঁড়ায় । রূপালি সুস্থ্য হয়ে উঠতে দেড় মাসের মত সময় নেয় । বৃদ্ধ জ্বিন সুস্থ্য হয় না । কাঁসার প্লেটের মিঠাই প্লেটেই জমে থাকে । তার দন্তহীন মুখ থেকে ফেনা বের হয় । চোখ থেকে অনবড়ত পানি ঝড়ে । জ্বিনের দুঃখে পিপুল মিয়াও অস্থির হয় । সাধারন মমতাবোধের চেয়েও তার এই অস্থিরতা কিছুটা বেশী । কারন অসীম সহ্যশক্তির অধিকারী এই জ্বিন যেদিন মধ্যরাত্রিতে সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে ক্ষীণ শব্দ করে তড়াপাতে থাকে সেদিন পিপুল মিয়ার চোখে পানি চলে আসে । সে হেলেনাকে ডেকে তোলে । হেলেনা চমকে ঘুমভাঙা স্বরে বলল, ‘কি হইছে আপনের ? কান্দেন ক্যা ?’
‘বৌ ! মনডা খুব ভার লাগতাছে । খুবই ভার লাগতাছে ।’
‘হইছেডা কি ?’
‘জ্বিনডারে মুঞি শত কষ্টেও রাও করতে দেহি নাই । আইজকে অয় শব্দ কইরা কইরা কানতে আছে । মনডা জ্বইল্যা যায় বৌ । কি করা যায় কও দেহি ।’
‘আম্নে তাহাজ্জুতের নমাজ পড়েন । কানতে হইলে আল্লার কাছে কান্দেন । মিছামিছি কাইন্দা কি লাভ ?’
‘সত্য কতা কইছো বৌ । অতি সত্য কথা কইছো ।’
পিপুল মিয়া খদ্দরের নতুন কেনা পাঞ্জাবীটা তাড়াহুড়ো করে গায়ে চড়িয়ে টর্চবাতি হাতে দরোজার হুড়কো খোলে । হেলেনা বিহ্বল হয়ে বলে, ‘কই যান ? তাহাজ্জুতের নমাজ মচ্ছিদে গিয়া পড়বেন নাহি ? ঘরের ভিত্রে পড়েন । মুঞি জায়নামাজ নামাইয়া দেই ।’
‘লাগবে না । জায়নামাজ লাগবে না ।’
পিপুল মিয়া গভীর অন্ধকারে টর্চবাতির আলো ফেলে ফেলে হনহন করে হাঁটতে থাকে । বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকাদের নিরন্তর একসুরো গান । কয়েকটা কুকুর হঠাৎ করে বুক হিম করিয়ে দিয়ে ডেকে ওঠে । পিপুল মিয়ার ভুতের ভয় প্রচুর । সে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বুকে দলা করে থুতু দেয় কিন্তু হাঁটা থামায় না । মসজিদ ঘর পার হয়ে আরও কিছু পথ হেঁটে একটা একচালা ঘরের উঠানে এসে থামে । ইতস্ততঃ করে সে আঙিনায় উঠে দরোজা ধাক্কা দেয় ।
‘কে ? এত রাত্রিতে কে ?’
‘আমি । পিপুল মিয়া !’
‘পিপুল ? এত রাত্রে কি ?’
‘মওলানা সাইব দরজাডা খুলেন । জরুরী । খুবই জরুরী ।’
মাওলানা জালালুদ্দীন দরোজা খুলে দেখেন পিপুল মিয়া কাঁদছে । সে ভীত কন্ঠে বলল, ‘কি ব্যাপার পিপুল মিয়া ? কান্দো ক্যান ?’
‘মওলানা সাইব মোরে দুইডা সূরা লিখ্যা দ্যান । সূরা ফাতিহাও লিখ্যা দ্যান । বাংলায় লিখ্যা দ্যান । আর নমাজের কলেমাগুলা ।’
‘হয়েছেটা কি তোমার ?’
পিপুল মিয়া তার গোপন কথাটা গোপন রাখতে পারে না । সে যে সূরা-কলেমার অভাবে সত্যিকারের নামাজ পড়তে পারে না এই ব্যাপারটা গোপন রাখার সময় এখন না । একটা জান বাঁচানোর জন্য একটু শরমের মধ্যে দিয়ে নাহয় তাকে যেতেই হল । তা হোক ! জ্বিনটা যেন বাঁচে !
ইমাম জালালুদ্দিন সব শুনে বেশ খানিকটা বিস্মিত হন । তিনি সূরা লেখা একটা কাগজ পিপুলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘কান্দন থামাও পিপুল মিয়া । জ্বিনের আবার মরন আছে নাকি ?’
‘মওলানা সাব জ্বিনটার মুখ দিয়া ফ্যানা ভাঙতাছে ।’
‘আচ্ছা । চিন্তা কইরো না । আমি প্লেটে জাফরান দিয়া কিছু তাবীজ লিখতাছি । ঐগুলান নিয়া গিয়া পানিতে ধুইয়া সেই পানি ওরে খাওয়াবা । ব্যথা কমবো ইনশাল্লাহ ।’
‘জ্বে আচ্ছা ।’
‘আরে কান্দোন থামাও মিয়া । চক্ষের পানি দিয়া তো আমার ঘর ভাসাইয়া ফেলবা ।’
পিপুল মিয়া চোখ মোছে । তারপর প্লেট আর সূরা লেখা কাগজটা নিয়ে হন্তদন্ত ভঙ্গীতে বেড়িয়ে পড়ে । মওলানা জালালুদ্দিন একটা চাদর গায়ে উঠোন থেকে সেই যাত্রা দেখতে থাকেন যতক্ষণ না কুয়াশার আড়ালে পিপুল হারিয়ে না যায় । জালালুদ্দিনের উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকতে খারাপ লাগে না । তিনি আকাশের দিকে তাকালেন । জমাট কালো শীতের আকাশে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র উঁকিঝুঁকি মারছে । জালালুদ্দিনের মনটা ভাল হয়ে গেল । নক্ষত্রকে দূর থেকে দেখার আনন্দ একরকম । সে আনন্দের তুলনা হয় না । কাছ থেকে দেখার আনন্দ নিশ্চয়ই অন্যরকম । জালালুদ্দিনের হঠাৎ মনে হল, সেই আনন্দ কি এই আনন্দের চেয়ে কম না বেশী ?
৫
ডাক্তার মোজাম্মেল হক ভোরবেলা কুয়াশা ভেঙে সুঁইগুপী বাজারের রাস্তায় ধীরপায়ে হাঁটছিলেন, হঠাৎ খবরটা পেলেন । তিনি পুঁইশাক আর ইলিশমাছ বাজারের ব্যাগে নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরছিলেন । শোনামাত্রই সে আবার বাজারের দিকে হাঁটা দিলেন । তিনি শুঁটকী খান না । কচুর লতি খান না । তবু আগ্রহ করে কিছু কচুর লতি কিনলেন, শুঁটকী কিনলেন । বেশ খুঁজে খুঁজে বাজারের শেষ মাথা থেকে শাপলা কিনে নিলেন । তেঁতুল কিনলেন । তারপর ফেরার পথে রইসুদ্দীনের হাতে কমলা দেখে তার কমলা কিনবার কথা মনে হল । সে আবার বাজারের দিকে হাঁটা ধরলেন ।
বাড়ি ফিরে দেখে উঠোনে গোবর রাখা হয়েছে গোল করে । দুর্গন্ধে নিঃশ্বাস নেয়া যাচ্ছে না । নিশ্চয়ই মফিজের কাজ । মোজাম্মেল সাহেবের মনটাই খারাপ হয়ে গেল । সে সাবধানে সবকিছু পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে বিন্তি পা ঝুলিয়ে বসে আছে । তাকে বেশ বড় বড় লাগছে । তার মাথায় একটা হলুদ রঙের লম্বা হ্যাট । তার শার্টের রঙও হলুদ । নিজের মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে, ভাবা যায় ? এই তো সেদিন তাকে বিড়াল দেখে ভয় পেতে দেখেছেন ! ট্রিপেনোফোবিয়া ছিল প্রবল । সাত বছর বয়সে ভ্যাকসিনেশনের সময় তার হাতে ইঞ্জেকশন পুশ করেছিল বলে বাবার ওপর সেকী রাগ ! কথা বন্ধ করে দিয়েছিল । সেই মেয়েটা এত বড় হয়ে গেছে !
মোজাম্মেল সাহেব হেসে বললেন, ‘কেমন আছিস রে মা ?’
‘ভাল আছি । বাবা আমার হাতে সময় নেই । আমি কিন্তু দুপুরে খেয়েই চলে যাবো । লঞ্চ দুটোয় । তুমি কি আমাকে শুঁটকী ভর্তা খাওয়াতে পারবে ?’
‘টক দিয়ে কচুর লতিও খাওয়াতে পারি । তোর পছন্দের শাপলা কিনে এনেছি । আর কিছু লাগবে ?’
‘তুমি কি আমার আসার কথা জেনে বাজারে গিয়েছিলে ?’
‘নারে মা ! তুই আসবি জানতাম না । বাজারে এমনিই গিয়েছিলাম রোজকার মত । ওখানে দাঁড়িয়ে শুনলাম । হামিদ আলি নামের যে লোকের ট্রলারে করে এসেছিস ঐ লোক খবর দিল । তুই কি নাশতা করেছিস ?’
‘বাবা, আমি নাশতা করে এসেছি । আমি শুধু চা খাবো । তারপর তোমাদের এখানে যে জ্বিন ধরা পড়েছে তাকে দেখতে যাবো । লোকটা কি সত্যি সত্যি জ্বিন বাবা ?’
‘আমি জানি না রে মা !’
‘তুমিই না আমাকে জ্বিনের কথা লিখে মেইল করলে ? জ্বিনের হার্টবিট পেয়েছিলে এই শুনে মা আমাকে বলল তোর বাবার মাথার ডাক্তার দেখানো দরকার । আমি কিন্তু বাবা বিশ্বাস করে বসে আছি । বাবা, তুমি মার্কেসের A very old man with enormous wings গল্পটা পড়েছো ? ঐখানে এমন একটা ডানাওয়ালা অদ্ভুত ক্রিয়েচার ঝড়ের রাতে সমুদ্রের তীরের এক বাড়ির উঠোনে পাখাভেঙে পড়ে গিয়ে কাদার গর্তে আটকে পড়ে । সেইটিও ছিল বৃদ্ধ । তোমাদের এই বৃদ্ধ ক্রিয়েচারের সাথে মার্কেসের বৃদ্ধের শুধু একটাই পার্থক্য । তোমাদের বৃদ্ধ জ্বিন, আর গল্পের বৃদ্ধ ছিল ফেরেশতা ।’
‘গল্পে তো সবই সম্ভব । গল্পের সাথে তো বাস্তবের তুলনা হয় না ।’
বিন্তি প্রসঙ্গ পালটে হুট করে বলল, ‘আচ্ছা বাবা, আমি যদি তোমাকে জোর করে ঢাকায় নিয়ে যাই তুমি কি আমাদের সাথে কানাডাতে যেতে রাজি হবে ?’
মোজাম্মেল হক জবাব দিলেন না । মৃদু হাসলেন । বিন্তি বলল, ‘জীবনটা গল্পের মত হলে কতই না সুন্দর হতো, তাই না বাবা ?’
‘এক জীবনে সবকিছু পেয়ে গেলে তো মানুষ স্বপ্ন পূরণের উচ্ছ্বাসই ভুলে যাবে । কিছু কিছু চাহিদা অপূর্ণ থাকাই বরং ভাল ।’
‘দার্শনিকদের মত করে কথা বলবে না তো বাবা ! তুমি প্লেটো নও আর এটাও গ্রীস না ।’
‘রাগ করছিস নাকি ?’
‘তোমার মেয়ে হয়ে তোমার রাগ পাবো না, তা কি হয় ?’
‘হাহাহা । না । তা তো হবার কথা না ।’
মোজাম্মেল হক অনেকদিন পর প্রানখুলে হাসলেন । মেয়ের ভ্রূ কুঁচকে থাকা রাগি রাগি চেহারা দেখেও তার হাসি পাচ্ছে । কারন তিনি ধরতে পারছেন তার মেয়ে অনেক চেষ্টা করেও মুখের হাসি-ভাব লুকাতে পারছে না । এইতো, সে হেসে ফেলল !
চা খেয়ে মোজাম্মেল হক মেয়েকে নিয়ে আবার বাজারের দিকে রওনা হলেন । মেয়ে জ্বিন দেখে তাকে কিছু খাওয়াবে না, তা তো হয় না । সুবলের দোকান থেকে সে এক কেজি জ্বিনের মিঠাই কিনে নিয়ে তারপর পিপুল মিয়ার বাড়ির পথে হাঁটা ধরলেন । পিপুল মিয়ার বাড়ির সামনে বিশাল শোরগোল । হকসাহেব একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ব্যাপার ?’
‘আইজগা সক্কাল-সক্কাল পিপুল মিয়া মারা গেছে । সুস্থ্য রোগ-শোক নাই মানুষটা হঠাৎ কইরা মারা গেল !’
মোজাম্মেল সাহেব মেয়েকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে একাই বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন । ঝি-বৌরা হেলেনাকে ঘিরে উচ্চস্বরে কাঁদছে । হেলেনা শোকে মূহ্যমান হয়ে একদৃষ্টে শাদা কাফনে মোড়ানো পিপুল মিয়ার লাশের দিকে তাকিয়ে আছে । তার চোখ শুকিয়ে আছে, যেন অন্য কোন ঘোরের জগতে আছে সে । হকসাহেব কি করবেন, বুঝলেন না । তার হাতে প্যাকেটভর্তি জ্বিনের মিঠাই । মিষ্টি নিয়ে একটি মরা বাড়িতে ঢুকেছেন এটা ভেবেই তার লজ্জ্বা লাগছে । কিছু সান্ত্বনার কথা বলা উচিত । কাকে সেটি ঠিক কিভাবে বলবেন তিনি তা বুঝতে পারলেন না ।
‘ডাক্তারসাহেব !’
ডাক্তার পেছনে ফিরে দেখেন ইমাম জালালুদ্দীন । তার চোখে পানি । তিনি চোখ মুছতে মুছতে ডাক্তারের হাতটা ধরে বললেন, ‘বুঝেছেন ডাক্তারসাহেব, গতরাত্রে পিপুল মিয়া আমার বাড়িতে আসল । মধ্যরাত্রিতে আমার ঘুম ভাঙালো । তার জ্বিনের জন্য তার মনটা নাকি খারাপ । কান্তেছিল ।’
‘আপনি কাঁদছেন নাকি ইমামসাহেব ?’
‘ডাক্তারসাহেব কি সম্রাট বাবুরের কিচ্ছাটা জানেন ?’
‘কোন গল্পের কথা বলছেন ?’
‘ঐ যে পুত্রের কালব্যাধিতে বাবুরের রাজসভার এক জ্ঞানী বললেন সম্রাটের সবচে প্রিয় জিনিস বিনা প্রশ্নে দান করে দিলে পুত্র হুমায়ূনের প্রানরক্ষা হবে । বাবুর প্রার্থনা করলেন যাতে তার জীবনের বিনিময়ে হলেও পুত্রের জীবন রক্ষা হয় । কারন সম্রাটের কাছে নিজের জীবনের চেয়ে প্রিয় আর কিছুই নাই ।’
মোজাম্মেল হক ইমামসাহেবের কথার প্রসঙ্গ ধরতে পারলেন না । তিনি বললেন, ‘সমস্যাটা কি ইমামসাহেব ?’
‘কিছু না । এমনি বললাম । মনটা খারাপ লাগতেছে ভাই । খুব খারাপ লাগতেছে । পিপুল মিয়া উন্মাদ লোক ছিল । তবে উন্মাদ লোকগুলাই কেন জানি ভাল লোক হয় ।’
ইতোমধ্যে দ্বীপে সূর্যের দীপ ছড়ানো শুরু হয়েছে । শীতের সূর্য কুয়াশা গলিয়ে দিচ্ছে । চাতালের ওপর ছড়িয়ে থাকা পুঁই-লাউপাতার অদৃশ্য রোমকূপগুলি গরম রোদের আঁচে শিহরিত হয়ে শরীর জাগানোর চেষ্টা করছে । মোজাম্মেল হকের হঠাৎ খোঁয়াড়ের দিকে চোখ পড়ল । তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন বৃদ্ধ জ্বিনটি তার জায়গায় আগের মত ঝিমুচ্ছে না । বরং খোঁয়াড়ের দরোজায় এসে বসে বসে গায়ে রোদ লাগানোর চেষ্টা করছে । তার ডানাদুটিকে আজ বেশ সমৃদ্ধ মনে হচ্ছে । সেখানে নতুন গজিয়ে ওঠা পালকগুলি রোদের আলো পেয়ে চিকমিক করছে । তাকে বেশ চমৎকার দেখাচ্ছে । মোজাম্মেল হক মিষ্টির প্যাকেটটি বৃদ্ধের সামনে নিয়ে রাখলেন । বৃদ্ধ আগ্রহ করে প্যাকেট খুলে পরপর তিনটি মিষ্টি খেয়ে ফেলল ।
ডাক্তার বাইরে বেড়িয়ে এসে মেয়েকে বললেন, ‘মা চল ! আমরা সমুদ্রের ধার থেকে হেঁটে আসি । ভীড় কমলে আবার তোমাকে নিয়ে আসবো ! এখন তোমার ভেতরে যাওয়াটা ঠিক হবে না ।’
হকসাহেব ভেবেছিলেন বিন্তি প্রশ্ন করবে । বিন্তি কোন প্রশ্ন করল না । নির্দ্বিধায় হাঁটতে শুরু করল । তারা দুজন জুতো খুলে হাতে দোলাতে দোলাতে সমুদ্রের বালুতে পা ঘষে ঘষে হাঁটতে লাগল । বিন্তি বলল, ‘একটা কবিতা শুনবে বাবা ?’
মোজাম্মেল হক কিছু বলবার আগেই বিন্তি আবৃত্তি করতে শুরু করলোঃ
ডানা ভেঙে ঘুরে-ঘুরে পড়ে গেল ঘাসের উপরে;
কে তার ভেঙেছে ডানা জানে না সে; আকাশের ঘরে
কোনো দিন- কোনো দিন আর তার হবে না প্রবেশ ?
জানে না সে; কোনো এক অন্ধকার হিম নিরুদ্দেশ
ঘনায়ে এসেছে তার ? জানে না সে, আহা,
সে যে আর পাখি নয়-রঙ নয়-খেলা নয়- তাহা
জানে না সে; ঈর্ষা নয়- হিংসা নয়- বেদনা নিয়েছে তারে কেড়ে ।
সাধ নয়- স্বপ্ন নয়- একবার দুই ডানা ঝেড়ে
বেদনারে মুছে ফেলে দিতে চায়; রূপালি বৃষ্টির গান, রৌদ্রের আস্বাদ
মুছে যায় শুধু তার, মুছে যায় বেদনারে মুছিবার সাধ ।
স্কাইলার্কের মত দেখতে কয়েকটি অতিথি পাখি কানফাটানো চিৎকার করতে করতে একটা ওলটানো ট্রলারকে ঘিরে ক্রমাগত ওড়া শুরু করেছে । মোজাম্মেল হক মুখ শুকনো করে চিন্তিত চোখে গভীর দৃষ্টিতে তাদের ওড়াওড়ি দেখছেন । বিন্তি বলল, ‘বাবা, কি ভাবছো ?’ তিনি ‘কিছু না’ বলতে বলতে হঠাৎ করে জালালুদ্দিনের গল্পের অর্থ করতে পারলেন । জালালুদ্দিন কি ইচ্ছাকৃতভাবেই সাধারন একটি মৃত্যুকে অসাধারন অতিলৌকিকতার একটা টাচ দিতে চাইছেন ? মোজাম্মেল হকের কখনোই বিশ্বাস হয় নি এই বৃদ্ধ- জ্বীন । ইভোলিউশনে মিউটেশন বলে যে ব্যাপারটি আছে তাকে ঠিকঠাক জানতে মানুষের আরও অনেকটা সময় লাগবে । ততদিন পর্যন্তই কেবল এসব অতিলৌকিক, অতিপ্রাকৃত । মোজাম্মেল হকের পায়ে আচমকা একটা ঢেউ এসে খুব জোরে ধাক্কা দিয়ে যায় । তার ভ্রম হয় । তিনি কি কোন যুক্তি দিয়ে কথাগুলি সাজাচ্ছেন ? তাতো না ! তিনি নিজেও ধারনাই করছেন । এমনও তো হতে পারে হোরাসের অতিলৌকিকতার প্রতি সেই তীব্র আস্থা সত্যিই সব কালের জন্য সার্বজনীন ?
ডাক্তার দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘মারে ! আমি তোকে বলেছিলাম বাস্তবের সাথে গল্প মেলানো ঠিক না । কিন্তু বাস্তব আসলে গল্পের চাইতেও বেশী অদ্ভুত । গল্পের অলৌকিক ব্যাপারগুলি বিশ্বাস করে নেয়া যায়, বাস্তবেরগুলি অনেক চেষ্টা করেও বিশ্বাস করতে পারা যায় না । বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যে কোন এক জায়গায় এরা আটকে থাকে । Truth is really very stranger than a fiction !’
‘বাবা, আমার বাস্তবতা কি জানতে চাও ?’
মোজাম্মেল হক কৌতূহলী দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন । বিন্তি হেসে বলল, ‘আমার বাস্তবতা হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বাবা এবং শ্রেষ্ঠতম মায়ের সন্তান হয়েও সেই দুজনকে আমি একত্রে পাচ্ছি না । তুমি কি আমার বাস্তবতায় অলৌকিক কিছু যোগ করতে পারো বাবা ? তুমি কি শুধু আমার জন্যে মায়ের সাথে একসঙ্গে থাকতে পারো না ?’
মোজাম্মেল হক একটু ভেবে বললেন, ‘পারি !’
বিন্তি কাঁদছে । তার চোখ ভিজে নিখুঁত করে টানা আইলাইনারের কালি লেপ্টে যাচ্ছে । মোজাম্মেল হক মেয়ের কাঁধে হাত রাখলেন । সৈকতের খোলা হাওয়ায় মোজাম্মেল হকের উড়তে ইচ্ছে করছে । তার মনে হচ্ছে একজোড়া ডানা মানুষের থাকলে ক্ষতি ছিল না ! প্রচন্ড আনন্দের সময় উচ্ছ্বাস প্রকাশের জন্য মানুষ ডানা ঝাপ্টে উড়ে উড়ে বেড়াতো । কেমন হতো সত্যি সত্যি এমন কিছু হলে ? তিনি জানেন না বছরখানিক আগে পিপুল মিয়ারও ঠিক একই জায়গাতে দাঁড়িয়ে এই একই ইচ্ছে হয়েছিল । একমাত্র ইচ্ছেই নিরন্তর ডানাবিহীন ভাবে বহু-বহুদূরে উড়ে চলে যেতে পারে- অন্য কোথাও; এমন কোন মায়াবিহারে যেখানে বাস্তবতার কোন স্পর্শ না থাকলেও কিছু ক্ষতি হয় না !
______________________
========================================
উৎসর্গঃ
অতিলৌকিকতা আর লৌকিকতার মাঝামাঝি যে ঘোরের জগৎ থাকে সেই জগৎটাকে নিয়ে তাঁর লেখা পড়ে সবসময় আনন্দ পাই । রাজনীতির ভূতপ্রেত নিয়ে যদিও তিনি বেশী লেখালিখি করেন । আমি যেহেতু রাজনীতি তেমন বুঝি না, সেহেতু সেইসব লেখাকে অনায়াসে এভয়েড করে যাই । কিন্তু বিজ্ঞান-অবিজ্ঞান, লৌকিকতা-অলৌকিকতা নিয়ে তাঁর লেখা এভয়েড করার সাধ্য শুধু আমার কেন, ব্লগের কারও আদৌ আছে বলে আমার মনে হয় না । তাঁর 'মেটাডাটা' পড়ে যত আনন্দ পেয়েছি- 'একটা একঘেঁয়ে ভূতুড়ে অভিজ্ঞতা' পড়েও ঠিক ততটাই আনন্দ পেয়েছি । অতিলৌকিকতা আর লৌকিকতার মাঝামাঝি এই গল্পটা তাঁর জন্যে ।
ইমতিয়াজ মীর্জা
প্রিয়জনেষু !
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন