|
তাশমিন নূর
|
|
মেঘমালাঃ ১ম পর্ব
22 January 2015, Thursday
শীতের দিনগুলি এতো ছোট; দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে আসে। হাসান সাহেব এবং তার আঠার বছর বয়েসী একমাত্র কন্যা তনয়া হরিপুর রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। গাছের পাতায় এখনো আলতো করে লেপ্টে আছে বিকেলের সোনারোদ। হাসান সাহেবের হাতে একটা ঢাউস সাইজের ট্রলি ব্যাগ। তনয়ার হাতেও একটা মাঝারি সাইজের ব্যাগ আছে। তার পরনে লাল রঙের সালোয়ার-কামিজ, তার ওপর চাপানো আছে একটা পাতলা শাল। শালটার রঙ বরফ-সাদা। যে ব্যাগটা ধরে সে দাঁড়িয়ে আছে সেটার রঙও লাল। শেষ বিকেলের আলোয় তাকে অতিমানবীর মতো নিখুঁত দেখাচ্ছে। হাসান সাহেব মুঠোফোনে রমানাথকে ধরার চেষ্টা করছেন। কিন্তু রমানাথ ফোন ধরছে না। হাসান সাহেবের চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি স্বগতোক্তি করলেন,
- এরা যে কেন এতো দায়িত্বজ্ঞানহীন, বুঝি না।
বলতে না বলতেই একটা ছেলেকে হনহন করে বাপ-বেটির দিকেই হেঁটে আসতে দেখা গেল। বয়স তনয়ার চেয়ে বেশি হবে। কাছে এসেই ছেলেটা হাসান সাহেবকে জোড়হাতে প্রণাম করল। একই রকম করে তনয়াকেও প্রণাম করল। তারপর হাসি মুখে প্রশ্ন করল,
-আপনাদের শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক আছে তো?
হাসান সাহেব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
-তুমি কে?
ছেলেটা আগের মতোই হাসি মুখে উত্তর দিল,
-আমার নাম জয়ন্ত। যদি ভুল না করে থাকি তাহলে আপনিই হাসান কাকু। বাবা পাঠিয়েছেন আপনাদের নিয়ে যেতে।
-হ্যাঁ, আমিই হাসান। তুমি রমানাথের ছেলে?
-হ্যাঁ। বাবা হঠাত অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাই আসতে পারেন নি।
হাসান সাহেব বললেন,
-তোমরা কেমন আছো?
তারপর উত্তর না শুনেই বললেন,
-রিক্সা ঠিক কর।
জয়ন্ত সাথে সাথেই দুটো রিক্সা ঠিক করে ফেলল। একটা রিক্সায় ব্যাগসমেত সে নিজে উঠল, আরেকটায় পিতা-কন্যা।
হাসান সাহেব ইচ্ছে করলে একটা অটোরিক্সা ঠিক করার কথা বলতে পারতেন। তাহলে তাড়াতাড়ি গ্রামে পৌঁছানো যেত। কিন্তু তা না করে সাহেব রিক্সা ঠিক করলেন কেন সেটা জয়ন্তর মাথায় ঢুকছে না। তাছাড়া শহর থেকে সরাসরি নিজেদের গাড়ি নিয়েও আসতে পারতেন। তা না করে এই বিশাল ব্যাগ-বোঁচকা নিয়ে এতো কষ্ট করে ট্রেনে কেন আসলেন সেটা তার কাছে রহস্যময় লাগছে। সে ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতে লাগল। হঠাত মুঠোফোন বেজে ওঠায় চিন্তায় ছেদ পড়ল। সাহেবের ফোন। সে ভুল করে বাবার ফোন নিয়ে চলে এসেছে। উনাদের রিক্সাটা পেছন পড়ে গেছে, তারটা সামনে। এই রিক্সাওয়ালার গায়ে ভালোই জোর আছে মনে হচ্ছে। মসৃন পিচঢালা রাস্তায় সে মনের আনন্দে রিক্সা চালাচ্ছে। আনন্দে যে আছে সেটা মাঝে মাঝে শিস দিয়ে জানান দিচ্ছে। রাস্তা সংস্কার করা হয়েছে অল্প কিছুদিন আগে। নতুন রাস্তায় যান-বাহন চালানোর এবং যান-বাহনে চড়ার মজাই আলাদা। জয়ন্ত ফোন রিসিভ করল। হাসান সাহেব বললেন-
-রমানাথ, আমি হাসান।
-কাকু, আমি জয়ন্ত। ভুলে বাবার ফোন নিয়ে এসেছি।
-ও আচছা, এই ব্যাপার তাহলে।
হাসান সাহেব একবার ভাবলেন জিজ্ঞেস করবেন, ‘স্টেশনে দাঁড়িয়ে যখন ফোন করছিলাম, ধরছিলে না কেন?’ কিন্তু বেশি কথা বলতে তার ভালো লাগে না, তাই জিজ্ঞেস করলেন না। লাইন কেটে দিলেন। জয়ন্ত আবার পূর্বের রহস্য সমাধানে মন দিল। তখন মাগরিবের আযান শুরু হল।
হাসান সাহেবের পুরো নাম হাসানুল হক। প্রয়োজনীয় কথার বাইরে হাসানুল হক কথা বলেন না। কি অফিসে, কি বাড়িতে। তার বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করে কেবল তনয়ার সাথে। কিন্তু মেয়েটা আরও বেশি স্বল্পভাষী। তাই ইচ্ছে থাকলেও তেমন গল্প করা হয়ে ওঠে না ওর সাথে। তনয়া উচ্চ মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। বাবার কাছে কী উপহার চায় সেটা জানতে চাওয়া হলে সে বলেছিল যে সে গ্রাম দেখতে চায়। আঠার বছরের ছোট্ট জীবনে এই প্রথম তার গ্রামে আসা। আঠারো বছর আগে হাসান সাহেব কেন হঠাৎ গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন সে কথা আজও কেউ জানে না। আঠারো বছরে গ্রাম একেবারে আমূল বদলে না গেলেও অনেক কিছু নিশ্চয়ই অনেক বেশি বদলে গেছে। রেলস্টেশন দেখেই সেটা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছেন তিনি। তারা ভরা আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন হাসানুল হক। সকাল হলে আঠারো বছর আগের সেই পুরনো গ্রামটা হয়তো চিনতেই পারবেন না এটা ভেবে তাঁর কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। হাসান সাহেব নিজের কোটটা খুলে তনয়ার গায়ে চাপিয়ে দিলেন। চাদরটা তনয়ার ঘাড়ের ওপর পড়ে ছিল। সেটা তুলে মাথায় দিয়ে দিলেন। তনয়া একটু হেসে বলল,
-বাবা, তুমি এতো ব্যস্ত হচ্ছ কেন? শীত তো তেমন লাগছে না।
-তবুও মা। তোমার চুলে কুয়াশা পড়া উচিত নয়। যাদের সাইনোসাইটিস আছে তাদের একটু সাবধানে চলতে হয়।
-তোমার শীত লাগছে না?
-না মা, আমার পরনের শার্টটা সিনথেটিক। তাই অত শীত লাগছে না।
-বাবা, তুমি আজ আমাকে খেয়ালই করনি। আমার পোশাকটা মোটা খাদি কাপড়ের। তাছাড়া শীত একেবারেই লাগছে না।
তনয়া কোটটা খুলে বাবার হাতে ফেরত দিল। হাসান সাহেব কোট গায়ে না চাপিয়ে হাতেই রাখলেন। তনয়া ঠিকই বলেছে। শীত কম। তাদের গ্রামটা নদীর কাছাকাছি বলেই হয়তো বাতাসে আর্দ্রতাটা বেশি। তাই যতটা শীত লাগার কথা ছিল ততোটা লাগছে না। তিনি তনয়ার দিকে তাকালেন। তারার হালকা আলোয় কী অদ্ভুত মায়াময় দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। জীবনে প্রথম গ্রামে এসে কেমন লাগছে তার?
তনয়া চারপাশটা দেখতে দেখতে চলেছে। সবকিছু আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে। বহুক্ষণ আগেই সন্ধ্যে মিলিয়ে রাত নেমেছে। রাস্তায় রিক্সার নিচে বাঁধা হারিকেনের আলো পড়েছে। কিন্তু তারার আলোর সাথে হারিকেনের আলো মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়নি। দুটো আলোই আলাদা আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বাঁশঝাড় পড়ছে একটা-দুটা। সেগুলোর নিচে জ্বোনাকীদের উৎসব শুরু হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আকাশ থেকে হাজার হাজার তারা পৃথিবীতে এসে উড়ে বেড়াচ্ছে। এরকম দৃশ্য এর আগে সে সিনেমা-নাটকে দেখেছে। কিন্তু এতো সুন্দর লাগেনি। তনয়া নিচু কিন্তু স্পষ্ট স্বরে বলল,
“তারাগুলোই জ্বোনাক হল,
কিম্বা জ্বোনাক হল তারা।”
হাসান সাহেব তনয়ার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন না। তিনি এখন অন্যকিছু ভাবছেন।
(চলবে)
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন