প্রস্রাবে সেলিমের তলপেট টনটন করছে, প্রায় দুই মাইল পথ পাড়ি দিয়েও খালাশ হবার কোনো পতিত জায়গা, কোনা-কাঞ্চি না পেয়ে বেজির মত আতিপাতি তাকিতুকি করছে। বিয়োনোর দু’চার দিন আগে পেট ঢসকে নিচে ঝুলে গেলে পোয়াতি যেমন অতি কষ্টে পা ঘেষ্টে ঘেষ্টে বেছন্দে হাটে, পথ চলতি লোকের কাছে সেলিমের হাটার ভঙ্গী তার চেয়েও বেঢক বেঢক ঠ্যাকে। সে কিছুক্ষণ শাস বন্ধ করে কষ্ট চুরির চেষ্টা করে হাটি হাটি পা পা করে। রাস্তায় মজনুর সাথে দেখা হতেই মজনু বলে, আরে সেলিম ভাই যে, বিদেশ থে কবে আলেন, শরীল ডা খারাপ মনে হচ্চে,শরীরের এই দশা ক্যা?
আর বলো না, প্রেসার, ডায়বেটিকস, হার্ট ব্লগ, কিডনীর সমস্যা নানান অসুখ একেবারে ব্যাড় দিয়ে ধরেছে। এখন সামান্য ল্যাঙেই কাত।
ঐ তো সামনেই আমার বাড়ি, আসেন ইকটু জিড়েয় যান।
মজনুর বাড়িতে ঢুকেই সেলিম ইশারা করলে মজনু আঙ্গুল দিয়ে উঠানের ওপাড়ে উদ্দিষ্ট জায়গা দেখিয়ে দেয়।
ঘরে এসে সোফায় গতর এলিয়ে গোপাল ভাড়ের গল্পের রাজার বাহ্যে সুখের মত সুখের আমেজে সেলিম চোখ বুজে রইল।
চা খেতে খেতে সেলিম বলে, এ তল্লাটে কত দিন ?
দশ বছর।
জমি কত টুকু?
চার কাঠা।
কত করে কিনে ছিলে?
পাঁচ হাজার টাকা কাঠা।
এখন কত?
ঢেড়! পাঁচ লাখ ট্যাকা কাঠা।
বল কী! এতো!
গত পাঁচ বছরে সোনা-চাঁদি, লেখা-পড়া, খাওয়া-দাওয়া, দেখা-শুনা, চলা-ফেরা নেশার মাল থেন শুরু করে খোল-ভুষি তন্নিক সব জিনিষের দাম প্যাল প্যাল করে বাড়তেছে। সব চে বাড়েছে জমির দাম। বর্ষার পানির সোহাগে যেম্বা পওরে(প্রহর) পওরে আমন ধান বাড়ে জমির দাম তার চেয়েও কয়েক নল বাড়। যারে কয়, ট্যাকায় শতেক বাড়।
এত বৃদ্ধির কারণ কি?
কারণ আবার কী, ভারত বর্ষ এক থাকলি বাঙ্গালী ছাই গুষ্টি লিয়ে চাত্তোরে ছড়া ছিটে পড়বের পারতে। বসোতি ঢেরক্ষিণ পাতলা পাতলাই থাকতে। আর এখুন ভারত ভাগ হয়ে বাংলা দ্যাশের লোক মাছের মত ব্যাড় জালে আটকা পড়ে গিজ গিজ করতেছে। এত মানুষ মিলে ওক্তে ওক্তে যে হারে বিয়েনের বাইচ লাগায়ছে, তাতে জমি কুমতি কুমতি চাঁদিত ঠ্যাকার জো। এহোনি মুতার জাগার আকাল পড়ে গেছে, কয় দিন পর ছ্যাপ ফ্যালানের জাগা মিলাই দায় হবি। জাগা অসম্ভবে বাপ ব্যাটার লেগেন, ভাই ভাইর লেগেন কাল হয়ে দাড়ায়ছে। মাথায় বাড়ি মারতেছে।
তা ঠিক। তোমরা তো নিজের বাড়ি বানাতে পেরেছ, আমিতো পনের বছর বিদেশ খাটার পরেও ভাড়া বাড়ির খোয়ারেই আটকে আছি।
মজনুর বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে বাড়ির পিছে একটা শিমুল গাছের দিকে চোখ যেতেই সেলিম কেমন অসস্থি বোধ করতে লাগল।
কী হয়েছে জানতে চাইলে কিছুক্ষণ চুপ থেকে সেলিম খাদে নামানো কণ্ঠে একটু ভূমিকা করে বলা শুরু করল-
বাড়ির পিছে যে শিমুল গাছ ওর একটা স্মৃতি আছে। সেই কথা মনে চাগান দিতেই শরীর মন কেমন যেন হয়ে গেল। সেই কথা শুরুর আগে এই এলাকার গোড়ার কাহিনী কিছুটা বয়ান করা দরকার-
দাদার কাছে শুনেছি নূরপুরে কবি বন্দে আলীর বাড়ীর মোড়ে দাঁড়ালে বাজিতপুর ঘাটের জাহাজ দেখা যেত। বিহারের পাটনা থেকে প্রতি দিন একটা জাহাজ মালপত্র নিয়ে যাতায়াত করত। কোলকাতা ও অন্যান্য জায়গা থেকেও মাঝে মাঝে জাহাজ আসত। সেই জাহাজ ঘাটায় যাত্রীদের বিশ্রামের জন্য একটা পাকা ঘাট ছিল। তার দুই পাশে দুটি সুন্দর নারী মূর্তি ছিল। সেই খানে নাকি যাত্রা বিরতির সময় রবীন্দ্রনাথ আর বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু আড্ডা দিয়েছিলেন। ১৯২৩ সালে কবি বন্দে আলী যখন কোলকাতায় আর্ট স্কুলে পড়তেন তখন তিনি ছুটিতে পাবনায় আসলে আমার দাদার বয়সী ছেলেদের সাথে নয়নামতির ফাঁকা চরে ঘুরে বেড়াতেন। এই চরে তখন জায়গায় বন ছিল, সবে দুই এক ঘর বসতি শুরু হয়েছে। তেমন ফসল হত না। কিছু জমিতে আউস ধান হত আর শীতের সময় খেসারী চাষ করত গোরুকে খাওয়ানর জন্য। তিনি এই চর, চরের কলমি ফুল নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তার একটা বই আছে ‘ময়নামতির চর’। এই নয়নামতি নিয়েই সেই বই লেখা হয়েছে। প্রকাশক তাঁর অনুমতি নিয়েই নয়নামতির বদলে ময়নামতি করেছিলেন। কেন যে উনি এই পরিবর্তনে রাজি হয়েছিলেন?
ময়নামতি কাব্যগ্রন্থে চৈত্র সংক্রান্তির যে মেলার কথা বলা হয়েছে সেটা হত চকপৈলানপুর(নয়নামতি) প্রাইমারী স্কুলের পূব দিকের আইল ঘেষে সোজা উত্তরে বাসের দোকানদারের বট গাছ পর্যন্ত। এখন যেখানে নয়নামতি যুগিপাড়া ড়োডের তেমাথার পাশে দোতলা মশ্জিদ হয়েছে ঐ পর্যন্ত। যে বটগাছ দুটিকে চৈত্র সংক্রান্তির সময় তেল সিঁদুর দিয়ে বিয়ে দিত; তার একটি ছিল এই মশ্জিদের পাশের বাছের দোকানদারের বট গাছ, যেটি ১৯৮১-৮২সালে ঝড়ে উপড়ে পড়ে। আর একটি ছিল নয়নামতি থেকে আক্কেলের সাঁকো পাড়ি দিয়ে যুগিপাড়ার দিকে আসতে রাস্তার ডান ধারে যে মশ্জিদ হয়েছে তার থেকে একটু দক্ষিণে মাঠের দিকে, ঐ খানে।
স্বাধীনের পরেও জিন্না পার্ক, যেটা এখন পাবনা স্টেডিয়াম, সেখান থেকে চাঁদমারীর মাটির যে ঢিবি ছিল তার পূব দিয়ে তাকালে বালিয়া হালটের ব্রীজ দেখা যেত। এখন আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি এই মাঠ সম্পূর্ণ ফাঁকা ছিল। সেই মাঠে আস্তে আস্তে বসত গাড়তে গাড়তে কলমি ঝাড়ের অবস্থা হয়ে গেছে।
নয়নামতি গাঁয়ে, শালগাড়িয়া থেকে দুলাল নামে একটা ছেলে আসত। একাত্তরের যুদ্ধে তার বাবা শহীদ হন। একমাত্র কর্মক্ষম লোক শহীদ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সেই পরিবারের ছয় পেটের হেসেলে আকাল নিত্য হানা দিতে লাগল। তার পরিবারের সদস্যরা ক্ষিধের জ্বালায় নিজের পেটের কাছেই পরাধীন হয়ে গেল- সদ্য স্বধীন হওয়া দেশে। ক্ষিধের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে দুলাল মাঝে মাঝে নয়নামতিতে পাড়ি জমায়। এখানে তার নানীর বাড়ি। ছোট মেয়েকে নিয়ে নানী একটা কুড়েয় কোন রকমে মাথা গুঁজে থাকে।
দিন-মজুরের বাঁধা কাজ দুলালকে দিয়ে কেও করায় না। তার কাজ হলো ব্যাগার খাটা। নারকেল-সুপারী, আম-জাম পারতে হবে দুলালকে ডাক, ধান-গম-ঘান ভাঙ্গাতে হবে দুলালকে খোঁজ, চকে পাট-পোরেতের পান্তা পাঠাতে হবে দুলাল আছে। নানা রকম ফুট ফরমায়েশ, ছুটা কামে দুলালকেই সবার আগ পছন্দ, কারণ; বিনিময়ে এক পেটা, আধ পেটা খাবার, দুই একটা ফল-মূল, ক্ষেত্রবিশেষে দুই একটা টাকা হাতে গুঁজে দাও, দুলাল তাতেই সই।
তার চলন বলন গৃহস্থ বাড়িতে পোষ মানা লেজ দোলানে পশুর মত বিশ্বস্থ, সে কখুনো চুরি করে না, কারো অকাম করে না। তাই গৃহস্থ বাড়ির মেয়ে মহলে বেগার খাটার ব্যাপারে তার ঢের কদর।
দিন রাত হুক্কা মেরে বেড়ানো ছেলেপেলের কাছে, ফাজলেমি আর ত্যাদড়ামি করার পাত্র হিসেবেও দুলালের বাড়তি দর। এক জন মানুষ চেয়ারে বসলে যতটুকু দেখায়, দুলাল ছিল প্রায় ততটুকু লম্বা। মষে কাল ত্বক, কটা রংএর চুল, বেটে গোছের ছেলেটাকে খচ্চর ছেলেরা ‘খেকশিয়েল’ বলে ডাকে। ওদের দলের পালের গোদা পল্টু। তারা ওর লুঙ্গি খুলে গাছে ঝুলিয়ে রাখে, জোর করে মাথার খানিক অংশ বিনে খরচায় টাক করে দেয়, হাগার-পাগারের নোদ-কেদো তার আস্ত উদোম গা-গতরে লেপে শিব ঠাকুর বানিয়ে রোদে দাঁড় করে রাখে, দুই জন দুই দিক থেকে হাত-পা ধরে চ্যাং দোলা করে দোলাতে দোলাতে পচা মাঠেলের পানিতে ছুঁড়ে দেয়, এ খেকশিয়েল গেলরে, খেকশিয়েল, ধর ধর বলে কুকুর লেলিয়ে দেয়।
মাঠে মাঠে যখন ধান, গোম, ছোলা, মসুর, কলাই কাটা হয়, তখন দুলাল পড়ে থাকা ফসল কুড়ায়, গর্ত খুঁড়ে ইঁদুরের গোলা ঘরে হানা দিয়ে, হাংটে হাংটে ফসল বাহির করে জায়গায় জায়গায় হালা করে রাখে। দিন শেষে উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেরা, তার উঞ্ছবৃত্তির আধার কেড়ে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ঝলসান দানা খুঁটে খুঁটে খেয়ে চোখে-মুখে গা-গতরে কালি-ঝুলি মাখিয়ে হোড়া উত্সব করে।
তারা যে দিন খোশমেজাজে থাকে সে দিন উত্পাতের তোড় একটুখানি লঘু হয়। সেদিন তারা ওকে দিয়ে খ্যাকশিয়ালের প্রচলতি ছড়া-
খ্যাক খ্যাক খ্যাখ খ্যাক
জার লাগেছে খ্যাতা কিনে দে
কাল কেনবো খ্যাতা আজকে প্যাচা যাতা ।।।
তিন বার বলিয়ে ছেড়ে দেয়।
এরকম নানান বাহানায় তারা দুলালের জানটা জলোবলো কোরে নিত্যি নিত্যি নতুন নতুন তামাশা চেখে বেড়ায়। দশজনের সাথে মিলমিশ করে কোনো অমোদ ভাগ বাটরা করার ফাঁক ফুঁকোট তো তার নেইই, বরং; সে হলো বারোয়ারী তামাশার গুলডাং। কোনো জটলা ওকে ঘিরে জট পাকানের আগেই ও সটকে পড়ে; হাচড়পাচড় করে জান বাঁচানের চেষ্টা চালায়। কখনো কখনো বিপদের আগাম গন্ধ পেয়ে ঝোপ-ঝাড়ে সাধিয়ে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে। এত সাবধানের পরেও তারা সুযোগ পেলে তাকে ঠিকই ট্যাংলায়।
আমার বাপ দাদারা এই এলাকায় বাঘ, বাগদাশা, ফেউ, শুয়োর, শজারু ,খরগোশ দেখেছে। ইংরেজরা স্থানীয় জমিদারদের সাথে করে এই নয়নামতির চরে, আফরি, পাটকে বাড়ির ঝোড়, জাতায় ঘোড়ায় চড়ে শুয়র শিকার করত। শিকারের জাহিরি দীর্ঘ মেয়াদী করার জন্য খাড়ার উপর টাটকা টাটকা সেই শিকারের ছবিও আঁকত।
এই মাঠের বুক চিরে পদ্মার একটা খাল ছিল। এটা কুটিপাড়ার ভেতর দিয়ে আটুয়ার রউফ খাঁর সাঁকা হয়ে চকছাতিয়ানীর কাসেম মালতের সাঁকোর নিচ দিয়ে চাঁদমারীর সাকো হয়ে তোমার এই বাড়ির জমির উপর দিয়ে আক্কেলের সাঁকো হয়ে বালিয়া হালটের ব্রীজের তল ছুয়েঁ ঝপঝপের বিল, চিকনাই নদী, বড়াল নদী হয়ে এগাঁও সেগাঁও মেরে নানা খানাখন্দ জলা পাড়ি দিয়ে যমুনায় গিয়ে মিশে সুজানগরের ঢালার চরের দক্ষিণে গিয়ে আবার তার মা পদ্মার সাথে মিশে পূর্ণজন্ম হত। দুই নদীর সেই সঙ্গম স্থান নিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান আছে, “ডাকব না ডাকব না/ অমন করে বাইরে থেকে ডাকব না/.... গঙ্গা ধারা মিশবে নাকি কালো যমুনাতে”। সেই খালের পানিতে আমি ৪ বছর বয়সে সাঁতার শিখেছি, সকাল থেকে সন্ধে ইস্তক যতবার সুযোগ পেয়েছি ততবারই ঝাঁপাঝাঁপি করেছি, কত মাছ মেরেছি, কলা গাছের ভুর চালিয়েছি। বর্ষার পানির তোর সামলাতে না পেরে সেই খাল ভেসে যেত। বান ডাকলে বানের পানি এই তল্লাটের পুরা মাঠ ইজারা নিয়ে বিলের রূপ নিত, আর চোত, বোশেখে সারা মাঠ-ঘাট, খাল বাংগী ফাটা হয়ে আসমান মুখি হয়ে চাতক তৃষায় পড়ে থাকত। ১৯৭৯সালে সার্কিট হাউসের উত্তরে এই খালের উপর পানিউন্নয়ন বোর্ডের অফিস করে খালের গলায় ফাঁস লাগায়, ১৯৮৪ সালে পানিউন্নয়ন বোর্ড পানির উন্নতির নামে পদ্মার কোল ঘেষে বাঁধের ফাঁদ পেতে পদ্মার আর আর সব শাখা নদী ও খালের সাথে সেই খালটাকেও খালের ভাগাড়ে গোর দেয়। আমার শৈশব কৈশরের স্মৃতির গোরও ঐ ভাগাড়ে।
পল্টু দলে-বলে পাখী, সাপ, বেজি, শিয়াল মেরে, রস চুরি, ফল চুরি কোরে মাঠে-ঘাটে হুক্কা মেরে বেড়ায়। লোক জনের আনাগনা কম থাকায় দিন দুপুরে মাঝে মধ্যেই দুই একটা শিয়াল গাওয়ালে বের হয়। এক দিন এক মা শিয়াল তার একটা কালচে বাচ্চা মুখে করে বসত পাল্টানর সময় পল্টু বাহিনীর ধাওয়া খেয়ে বেতের ঝোপে পালিয়ে রক্ষা পায়। কিছুক্ষণ বাদে আর এক রিফুজি শিয়াল চক ছাতিয়ানী গোরস্থান থেকে বের হয়ে মাঠ পাড়ি দিয়ে গ্রামে ঢোকার মুখে পল্টুর চেকপোষ্টের সামনে পড়ে। ধাওয়া শুরু করলে শিয়াল বাঁশঝাড়ে পালায়, কুকুরের আর মানুষের আক্রমনের ঠ্যালায় সে বাঁশঝাড় থেকে বের হয়ে আবার দৌড় লাগায়।
বয়সের তাড়নায় শিয়াল ধাওয়ানর লোভ সামলাতে না পেরে আমিও কলেজে যাওয়া বাদ দিয়ে পথের মধ্যে তাদের সাথে ভিড়ে যাই। একটা কুকুর লেজ কামড়ে কয়েক হাত ছ্যাঁচড়িয়ে গিয়ে জুত করতে না পেরে ছেড়ে দেয়। সবাই চিল্লায়ে ওঠে, এহ্ পাদে দেছেরে, পাদে দেছে, শিয়েল পাদলে কুত্তে গন্দো সহ্য করবের পারে না, পলায়।
এই ভাবে ইট-পাটকেল-ঢিল খেয়ে, আর কুকুরের কুত্তামোর চোটে পলান টুকটুক খেলতে খেলতে বাঁশ ঝাড়, কলার ঝাঁড়, ভাঁট ঝোপ, গোম ক্ষ্যেত, বাড়ির উঠোন, কোনা-কাঞ্চি খচে নয়নামতি পাড়ি দিয়ে, রাধানগর বাগান পাড়ায় গিয়ে শিয়াল হারিয়ে গেল।
কান্না শুনে তাকিয়ে দেখি একটি ছেলে আর দুইটি মেয়ে বাড়ি যাব বাড়ি যাব বলে কান্না জুড়ে দিয়েছে। তাদের সাথে আরো কিছু ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে এসেছে। কয়েক জনের হাটার শক্তি নেই, পা ছড়ে রক্ত পড়ছে। আমাদের মধ্য থেকে কয়েক জনকে দায়িত্ব দেয়া হল তাদের বাড়ি পৌঁছে দেয়ার।
এলাকা বদলের সাথে সাথে লোকও বদল হচ্ছে, কুকুরও বদল হচ্ছে, কিন্ত; পল্টু বাহিনী যমদূতের মত হন্যে হয়ে শিয়ালের পিছে লেগেই আছে। আপন আপন এলাকার কুকুরের গোয়েন্দাগিরি ও কুত্তামির চোটে শিয়ালের পালান বেশিক্ষণ থৈ পেল না। আবার ছুট, শেষ তক শিয়াল হয়রাণ হয়ে নূরপুর পিডিবির দেয়ালের কোল ঘেষে একাই টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল। যমদূতদের অবস্থা তখন চালু হাপড়ের মত।
শিয়ালের পায়ে শুকনো কলার ফাতর বেঁধে টানতে টানতে এলাকার দিকে রওনা দিলাম।
কৌতুহলি নানা বয়সি ছেলে মেয়ে কোলাহল করতে করতে শিয়ালের পিছু পিছু আসছে। তারা নানা মন্তব্য করছে। কেউবা একটু ছুঁয়ে দেখছে। কেউ বা এডভেঞ্চারের স্মারক হিসেবে লোম ছিঁড়ে নিচ্ছে। কেউ আবার বন্দী শিয়ালের উপর ঢিল ছুঁড়ে বন্য আনন্দ পাচ্ছে।
জ্যান্ত শিয়াল পাকড়াও করার কৃতিত্বের জেল্লা সকলের চোখে মুখে খেলা করছে। আমাদের অভিযানের কাহিনীর স্বরলিপি শুনতে শুনতে, পিছু নেয়া ছেলে মেয়েরা আমদের ছুঁয়াচ লেগে খুশিতে টগবগ করতে করতে এগুতে লাগল।
দেশে তখন সবে ইরি ধানের আবাদ শুরু হয়ছে। এই মাঠে তখন সেচের জন্য ডিপ টিউবওয়েল বসেছে। এই মাঠে এসে পৌঁছানের পর শিয়ালের যখন দশমি দশা উপস্থিত, তখন আমাদের নবমী দশা। শিয়াল রেখে সবাই ডিপ টিউবওয়েলের নালা দিয়ে বয়ে যাওয়া ঠাণ্ডা পানিতে গা ভাসিয়ে দিল। চৈত্রের রোদে তেতে উঠা অল্প পানিতে আটকা পড়া মাছের মত সবাই খাবি খেতে লাগল।
আমি পানিতে না নেমে একটা বাবলা গাছের ছায়ায় কোন মত শুয়ে পড়ে অবসন্ন দেহে হাপড় চালাতে লাগলাম।
চৈত্রের খরায় আসমান জমিন যেন নেশায় ঝিম মেরে আছে। একটা মেঠো গন্ধ মাঝে মাঝে নাকে এসে লাগছে। সূর্যের গৃহিণীপনায় মাটির বুকের লুকান পানি বাষ্প হয়ে ধু ধু ঢেউ তুলে- আবার পানি হয়ে মাটির বুকে ফিরে আসার বাসনায় নভোচারী হচ্ছে। আকাশে এক চিলতে মেঘও নেই; দেনা পাওনার হিসেব মেলাতে হয়তো তারা হিমালয়ে গেছে। মেঘমুক্ত আকশের কোলে, কিছুক্ষণ আগে চলে যাওয়া প্লেনের ছেড়ে যাওয়া, সাদা লেজের মত ধোঁয়ার অবশেষ লেগে আছে; আস্তে আস্তে তা ফিকে হয়ে আসছে। মাঠের ওপারের ঝোপে একটা ঘুঘু পাখি বিরহ রাগিনী গাইতে গাইতে কি যেন মনে করে থেমে গেল। দূরে চাষীর লাঙ্গল বাওয়ার সময় গরুকে নির্দেশ দেয়া ডানে ডানে, বায় বায় অস্পষ্ট শব্দ ভেসে আসছে। একটা ফিঙে পাখি গরুর পিঠে সওয়ার হয়ে রাজ্য রাজ্য খেলছে। বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে বিন্দুর মত কয়েকটি শকুন ভাগাড়ের . খোঁজে নিচের দিকে মুখ করে পাক দিচ্ছে। আর নিচের স্তরে অতবড় শূন্য .ফাঁকা জায়গা একটা চিল একাই দখল করে আল্লাদী মেয়ে যেমন থেমে থেমে কান্না করে, সেই রকম- ফ্যা, ফ্যা তিক্ষ্ণ চিত্কারে নিস্তব্ধতাকে .চিরে ফেলছে। আকাশ কিসের যেন আভাস পেয়ে দিগন্তে স্তব্ধ হয়ে কান পেতে আছে। নিসর্গের নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে চোখ যখন মুদে আসছে তখন সবার খেয়াল হতেই দেখা গেল শিয়াল নেই।
হয়রানি না কমতেই পেরেসানি বেড়ে গেল। শিয়েল গেল কই, শিয়েল গেল কই, বলতে বলতে সবা্ই হন্যে হয়ে খোঁজকাতুরে হয়ে উঠল। আমি তখনো ধকল কাটাতে না পেরে শুয়েই আছি।
মাঠের অর্ধেকের বেশী জমির ফসল কাটার পরে ইরি ধানের আবাদের জন্য কিছু জমি পানি দিয়ে পাকানো হচ্ছে, কিছু জমি চষা শেষ, কিছুতে লাঙ্গল চলছে, বাকী জমিতে গম কাটা হচ্ছে। আশপাশের গম ক্ষেতে শিয়াল খোঁজা হচ্ছে, আর মাঝে মধ্যে ঢিল মারছে।
কয়েক আইল .ফাঁকে গম নড়ে উঠতে দেখে একজন চিল্লান শুরু করল, ঐ দ্যাখ গম লড়তেছে, গম লড়তেছে। দশ পনের জন গম ক্ষেতটাক ঘিরে, চষা জমি থেকে ছোট, বড় শুকনো চাঁই বৃষ্টির মত ছুঁড়তে লাগল। উত্তেজনার উষ্কানিতে সংক্রামিত হয়ে আমিও গিয়ে ঢিল ছুঁড়তে লাগলাম।. গোঙানির শব্দ শুনে, কাম ফতে কাম ফতে বলে, হৈ হৈ করে কয়েক জন ক্ষেতের মধ্যে ঢুকে গেল। হায় আল্লা! খেকশিয়েল! বলেই এক জন আতঙ্কে থমকে গেল।
আমি দৌড়ে গম ক্ষেতে ঢুকে দেখি দুলাল। তার চোক-মুখ, নাক-কান দিয়ে রক্তের বান ছুটছে; শহীদের উত্তরাধীকারীর উষ্ণ রক্ত, তেতে ওঠা মাটি শুষে নিতে দিধা দ্বন্দ ভোগার অবসরে কিছুটা বাষ্পায়িত হয়ে আরশ মুখি হচ্ছে।
আমি তাকে খুব স্নেহ করতাম। আমায় দেখে সে তার ঘোর বিপদের সময় আশ্বস্থ হয়ে জড়িয়ে ধরল। সে দমে দমে মা মা করে কাতরাতে লাগল। ওকে কোলে করে হাসপাতালের উদ্দ্যেশ্যে দৌড় লাগালাম। পানি খেতে চাচ্ছে দেখে ওকে ঐ শিমুল গাছের ছায়ায় নামিয়ে কোলে মাথা রেখে শোয়াই। এক জন নালা থেকে গামছা ভিজিয়ে আনতে গেল। দুলাল কি যেন বলতে চাচ্ছে দেখে মাথা নিচু করলাম। সলতের সর্বাঙ্গ নিংড়িয়ে জোগাড় করা শেষ বিন্দু তেলে, হাচড়পাচড় করে জ্বলবার প্রয়াসরত বাতির মত, বুকে একটু বাতাস টানার চেষ্টা করে; অতি কষ্টে সে উচ্চারণ করল, সেলিম ভাই খেলা শেএষ, কিন্-তু.....
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন