ভুল শুরু হয়েছিল বাসের জানালা দিয়ে চামড়ার ব্যাগ ঢুকিয়ে সিট দখল রাখতে গিয়ে। আরো দু’একবার এমন করেছে সে, কেউ আপত্তি করেনি। বাসে উঠবার মুখে প্যাসেঞ্জাররা লক্ষ্যই করেনি জানালা দিয়ে কেউ ব্যাগ ঢুকিয়ে সিট দখল করছে। বাস তখন খালি। উঠতে গিয়ে লম্বা কিউ’র একবোরে শেষ মাথায় পড়ল সে। তারপর একে একে প্যাসেঞ্জাররা বাসে উঠল। তার সামনে যখন আরো পাঁচজন লোক ওঠার বাকী, তখন বাস ছেড়ে দিল, সে উঠতে পারল না। সিট দখল করার উম্মাদনায় বাসে উঠতে পারবে কি পারবে না তা বিবেচনায় সে নেয়নি। বাসের পিছনে হৈ হৈ করে কোন লাভ হল না, ডিম ভরা কৈ এর মত প্যাসেঞ্জার ভরা ষ্টেট বাস দুলকী চালে চলে গেল। এই বাসটাকে পথে ধরা যাবে না, এটা এক্সপ্রেস বাস, থামবে গিয়ে সেই নারায়ণগঞ্জ বাস টার্মিনালে। নারায়ণগঞ্জ পৌঁছে বাসটাকে টার্মিনালে সে না ও পেতে পারে, যদি সেটা তার আগেই ঢাকার দিকে আবার রওয়ানা দিয়ে দেয়। আর বাসটাকে টার্মিনালে পেলেও ব্যাগ পাওয়ার নিশ্চয়তা কি? ট্যাক্সি ধরে বাসের আগে যাওয়া যায়, মানে পাঁচ সিকার শেয়ারের ট্যাক্সি্। শেয়ারের ট্যাক্সি ধরার জন্যে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে এল মামুন। এটা তার দ্বিতীয় ভুল। শেয়ারের শেভ্রলে ট্যাক্সিতে দু’জন প্যাসেঞ্জার পেছনের সিটে বসে ছিল । সে সামনে বসতে যাচ্ছিল, ড্রাইভার নিষেধ করল, ‘পিছনে বহেন, সামনে মেকানিক বইব’। উশকো খুশকো মুশকো চেহারার একজন লোক বনেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই সম্ভবত: মেকানিক। ট্যাক্সিতে সার্বক্ষণিক মেকানিক প্রয়োজন হয় জানতো না মামুন। কি জানি বাবা, বদু খাঁ আমলের আমেরিকান শেভ্রলে, পথে পথে হয়তো সামাল দিয়ে চলতে হয়। পিছনের একজন লোক গাড়ি থেকে নেমে তাকে মাঝখানে জায়গা করে দিল। আর প্যাসেঞ্জারের জন্যে অপেক্ষা না করে তক্ষুনি ট্যাক্সি ছেড়ে দিল। রাত আটটা বাজে, নারায়ণগঞ্জ পৌঁছুতে পৌনে ন’টার মত বাজবে। শীতের রাত, তেমন শীত না পড়লেও রাস্তা ফাঁকা, যাত্রী দু’জনের গায়ে কালো শাল। এতই ঠান্ডা লাগছে এদের! মামুনের শার্টের উপর শুধু একটা পাতলা সোয়েটার। যাত্রাবাড়ি-পোস্তগোলা রাস্তার মাঝামাঝি পৌঁছে গাড়ি ঘটর ঘটর করতে শুরু করল। ‘কার্বুরেটর সমস্যা করতাছে’ বলল ড্রাইভার, তারপর বাম ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করাল। মেকানিক বাইরে গিয়ে বনেট খুলে খুটখাট করতে লাগল। এমন সময় দু’পাশের দু’জন যাত্রী চেপে ধরল মামুনকে। শালের ভিতর থেকে একজন একটা পিস্তল বের করল, অন্য জনের হাতে কিছু নেই কিন্তু শালের ভিতরে হাত, মানে এখনি পিস্তল, রিভলবার বা নিদেন পক্ষে ছুরি বের করবে। এ সব কিছুরই দরকার ছিল না, দু’জন ষন্ডা মার্কা লোকের জ্বল জ্বলে চোখের চাউনি দেখেই মামুনের হয়ে এসে ছিল। উপরের পকেটে হাত দিতে যাচ্ছিল মামুন, পিস্তলহীন মাস্তান আঙুলের ইশারায় তার প্যান্টের চোরা পকেট দেখিয়ে দিল। হারামজাদারা জানে! হয়তো ট্যাক্সিতে ওঠার আগে পকেটে হাত দিয়ে ফেঁপে ওঠা চোরা পকেট হাতড়াতে দেখেছে তাকে অথবা হয়তো আগে থেকেই তাকে অনুসরণ করছিল তারা। নি:শব্দে পকেট থেকে জমি বায়নার পাঁচ হাজার টাকা পিস্তলধারীর হাতে তুলে দিল সে। টাকাটা নিয়ে গাড়ি থেকে যত্ন করে তাকে নামাল পিস্তলধারী ছিনতাইকারী। প্রথমে নিজে নামল, তারপর মামুনকে হাত ধরে নামাল। পিস্তল ডান পকেটে রাখল, বুক পকেট থেকে দশ টাকার নোট বের করে মামুনের হাতে দিল। বলল, “বাড়ি যাওনের খরচ্”, এরপর লম্বা একাটা সালাম দিয়ে বলল, “সাবধানে যাইয়েন, স্যার. দিন কাল ভাল না।” শয়তান! দিন কাল যে ভাল না তুইইতো তার প্রমান! নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর সারা দেশে ফুরফুরে মেজাজ, শেখ সাহেব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন, এখন এসব হওয়ার কথা না। তা’ও পত্রিকায় পড়ে এখনো শহরে ছিনতাই, রাহাজানি গ্রামে গরু চুরী। সমাজবিরোধীরা সময়ের সুযোগ নিচ্ছে। ট্যাক্সি চলে গেল, আর মামুনের তখনি মনে হল ট্যাক্সিতে ওঠা তার দ্বিতীয় ভুল নয়, তৃতীয় ভুল । প্রথম ভুল কবিতা অসমাপ্ত রেখে বাড়ি থেকে বেরুনো, দ্বিতীয় ভুল বাসে ব্যাগ রাখা। শীতের রাত নয়টার নির্জন যাত্রাবাড়ি-পোস্তগোলা রাস্তায় অকুল পাথারে পড়ল মামুন। একধারে বিস্তীর্ণ মাঠ। ধান তোলা হয়ে গেছে। পশ্চিম পাশে ঝোপ ঝাড়, জোনাকীর আলো। মামুনের ভয় করছে না, শুধু রাগে গা জ্বালা করছে। রাগটা নিজের উপরই বেশী। বাসায় যাওয়া কোন সমস্যা না, ছিনতাইকারীর দশ টাকা ছাড়াও আরো বারো টাকা পিছনের পকেটে আছে। ছিনতাইকারীর সংখ্যা বেড়ে গেছে শহরে। চামড়ার ব্যাগ উদ্ধারের চেষ্টা না করলে কি হত তার? যেত একটা কলম, জমির বায়না নামার একটা কপি, যে’টা চাইলেই আরেকটা নতুন কপি পাওয়া যাবে জমির ক্রেতার কাছ থেকে, জয়দেবপুর বাজার থেকে কেনা ১৯৭১ সালের একটা ডাইরী এবং ১৫ টাকা দামের নতুন লুঙী, এইতো! জায়গা বিক্রীর রফা করতেই জয়দেবপুর সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে গিয়েছিল সে। দলিল মুসাবিদা হয়েছে। এখন পুরো টাকা পাওয়ার পর রুমানা-সামিনাকে নিয়ে একদিন রেজিষ্ট্রি অফিসে আসতে হবে। টাকাটা রুমানার ব্যবসায়ের জন্যে দরকার। রীতিমত পয়সা খরচ করে সে ফলের জুস বানানো এবং বোতলজাত করার প্রক্রিয়া শিখেছে, সংগী জুটেছে বোন, সামিনা। ‘আর এস ফ্রুটসÚ এন্ড বেভারেজ লি:’ নাম দিয়ে গত শীতে ব্যবসা খারাপ করেনি। শুধু পাড়ায় কয়েক বোতল অরেঞ্জ স্কোয়াশ সাপ্লাই দিয়ে লাভ হয়েছে প্রায় তিন হাজার টাকা। বছরভর বিভিন্ন ফলের রস দিয়ে চালাতে পারলে না জানি কত লাভ হত! জুস বানানোর সাথে সাথে মার্কেটিং-এর কায়দা কানুনও শিখেছে রুমানা, এবার তাই ব্যবসা ছড়াতে চায় পাড়ার সীমানার বাইরে। কয়েকটা বড় জেনারেল ষ্টোর্সের সাথে আলোচনা হয়েছে। তারা বলেছে ঢাকার কিছু বড় দোকানের সাথে তারা যোগাযোগ করে দিতে পারবে। ব্যাপক হারে করতে গেলে মেশিনারীজ দরকার হবে, যেমন ফ্রুট ক্রাশার, জুসার, বোটল সিলিং ইত্যাদি। বেশী করে কাঁচা মাল কিনতে হবে, আরো জায়গা লাগবে, লাগবে আরো লোক। বিয়ের পর চার বছর পার করে সন্তান না হওয়ায় হন্যে হয়ে এ কাজে লেগেছে সে। কাজ চাই তার বোন সামিনা’র ও। বিয়ে করে তার স্বামী আসিফ সে’ই যে বিদেশ গেছে আর ফেরার নাম নেই। সামিনা ন্যাশনেল ব্যাংক অব পাকিস্তানে চাকরী করে। বাসা থেকে হেঁটেই যাওয়া যায়। কিন্তু ব্যাংকের চাকুরী ভাল লাগে না সামিনার। একমাত্র মহিলা সহকর্মী বলে পূরুষ কমীঁরা বেশী বেশী খাতির করতে চায়, পাড়া-প্রতিবেশী কেমন ঘোর হয়ে তাকায়। তাই স্বাধীন পেশা তার দরকার। মামুনের শ্বাশুড়ী বিয়ের আগেই গত হয়েছেন, শ্বশুর মারা গেলেন তার বিয়ের দু’ বছর পর। জয়দেবপুরে রাস্তার ধারে জমিটা রুমানা-সামিনার বাবার কাছে পাওয়া, যেমন পাওয়া নারায়ণগঞ্জের বাড়ি। একমাত্র ভাইয়ের সাথে যৌথ মালিকানায় কাপাসিয়ায় আছে আশী বিঘা জমি, বাড়ি, পুকুর। ভাই নিজে ঢাকায় ব্যবসা করে। এক কথায় তারা বড়লোক। মামুন শ্বশুর বাড়িতে ঘর জামাই হয়ে থাকে, জগন্নাথ কলেজে মাষ্টারী করে এবং দু’ই বোনের ফাই ফরমাসের ফাঁকে কবিতা লেখে। মামুনের ভাই-বোন, মা তাকে ধিক্কার দেয়। আটশ’ টাকা বেতন পায়, খাতা দেখে কোন না আরো হাজার টাকা বছরে পায়, ঢাকায় বাসা করে থাকতে পারে না সে? বউয়ের ভেড়া হয়ে থাকে! মামুন কান পাতে না। তার লেখার জন্যে দরকার অফুরন্ত অবসর। ঢাকায় বাসা বদলে চলে আসলে ঘর গেরস্থালীর সব কাজ, বাড়ি ভাড়া, এক্সট্রা টাকার প্রয়োজনে টিউশনী, এতসব মিলে অবসর সে পেত কোথায়? বউ আর শালীর সামান্য টুকটাক কাজ তার লেখার কাজে তেমন বিভ্রাট করে না। এ ছাড়া বউয়ের কাছ থেকে কবিতার বই ছাপানোর জন্যে টাকা প্ওয়ার আশ্বাস ও সে পেয়েছে। কবিতার বই ছাপানোর কথা মনে পড়তেই অসমাপ্ত কবিতার কথা মনে পড়ল মামুনের। যদি সে জেদ ধরতো? যদি বলতো কবিতা শেষ না করে সে জয়দেবপুর যাবে না?
তখন সকাল সাতটা। সদ্য নাস্তা শেষ করেছে সে। এমন সময় মার মার ডেকে কবিতা তেড়ে এল, যে কবিতা ক’দিন ধরে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছিল তার মনে, কিন্তু ফুটে উঠছিল না। সাত সকালে রেডিওর খবর না শুনেই কবিতা লেখা শুরু করে দিয়েছিল সে। সবে সাত লাইন লিখেছে কি লিখেনি, রুমানা এসে তাগাদা দিল। কবিতাটা শেষ করতে পারলে ময়মনসিং মেইল সে নির্ঘাত মিস করত, জয়দেবপুর যেতে পারত না, বায়নার টাকা পেত না, ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়ত না, টাকা খোয়া যেত না, মাঝরাতে বিজন রাস্তায় হাঁটতে হতো না। অথবা কবিতা শেষ করে ট্রেনে উঠলে সারাদিন সে অন্যমনস্ক থাকত না, ফেরার পথে ট্রেনে কবিতা লিখবে বলে জয়দেবপুর বাজারের ষ্টেশনারী দোকান থেকে ১৯৭১ সালের নতুন ডাইরী কিনতো না্ এবং ডাইরী কিনতে গিয়ে সস্তায় লুঙী কিনতে যেত না, ফলত: ৩টার ট্রেন মিস করতো না। ৩টার ট্রেন ফেইল করে সে ৫টার লোকাল ট্রেন ধরল, ফলে নারায়ণগঞ্জের বদলে ঢাকার কমলাপুরে নামল। তারপরতো্ এই হুজ্জত। অথচ দেখ ট্রেনে দুই ঘন্টা জানালার ধারে বসে প্রাকৃতিক শোভা দেখতে দেখতে ও কবিতার লাইন আর মনে আসল না। অথচ সারাদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে কতবার কবিতাটা মনে এসেছে, রেজিষ্ট্রি অফিসে, রেষ্টুরেন্টে, দোকানে, কিন্তু তখন লেখার সরঞ্জাম হাতে ছিল না, অবকাশ ছিল না। কবিতা লিখতে না পেরে হাল ছেড়ে ডাইরীটা আবার ব্যাগে রেখে দিয়েছিল সে।
যাকÚÚ সে ভাবনা!বাস স্টপেজের দিকে হাঁটতে শুরু করল মামুন। কোথায় স্টপেজ? হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ব্যাথা হয়ে গেল। পোস্তগোলা মোড়ে এসে বাঁয়ে ঘুরতে পাওয়া গেল বাস স্টপ, রাস্তার বামে ঈগল বক্স কার্টণ নামে একটা বড় কার্টন ফ্যাক্টরী। আলো জ্বলছে, মানে এখনো কাজ কর্ম চলছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কতক্ষণ থাকা যায়? আর দেরী হলেতো বাসও বন্ধ হয়ে যাবে। ফ্যাক্টরী থেকে কোন লোক বের হচ্ছে না। এরা কি রাতে বাড়ি ফেরে না? দশটা বাজে। হেঁটে গেলে এতক্ষণে নারায়ণগঞ্জ পৌঁছে যেত সে। কি হল আজ? বাস বন্ধ হয়ে গেল না কি?
অগত্যা গুটি গুটি পায়ে পূব দিকে রওয়ানা দিল মামুন। রাগ স্তিমিত হয়ে এসেছে। ছিনতাই, ডাকাতির ভয় আর নেই, জ্বিন, ভুত ও সে মানেনা, শুধু অজানা এক গা ছম ছম করা ভীতি, কেন কে জানে। ফুটপাথ নেই, রাস্তার পাশে এক চিলতে পায়ে চলা পথ। কখনো খোঁয়া কখনো ইট, কখনো মাটির ছোট ছোট ঢিবির সাথে হোঁচট খেতে হচ্ছে। কি সুন্দর দিনটা শুরু হয়েছিল আর কি বিশ্রী ভাবে শেষ হচ্ছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই রুমানার মুখ দেখেছিল মামুন, রবীন্দ্রনাথের গান মনে এসেছিল, “এ দিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার, আজই প্রাতে .. ..” ইত্যাদি ইত্যাদি। গানের সাথে কবিতাও এসেছিল। আহা! মনে মনে রাগ তোলার চেষ্টা করল মামুন। রাগ হলে ভয় কমে, চলার গতিও বাড়ে। হঠাৎ হুশ করে কোত্থেকে এক গাড়ি এসে দাঁড়াল তার পিছনে । এ যে মেঘ না চাইতেই পানি! সোহেল! তার স্কুলের বন্ধু। এখন দারুণ বড় লোক। সোহেল তার লাল অথবা কালচে লাল গাড়ি থেকে নেমে মামুনের পাশে দাঁড়াল।
- এত রাইতে পাগলের মত হাঁইটা রওয়ানা দিছস কই?
সোহেল তার আদি অকৃত্রিম ভাষায় জানতে চাইল। সোহেল কে দেখে বুকে বল এল মামুনের। তবু নির্বিকার ভাব দেখাল।
- বাসায়।
এক কথায় জবাব দিল।
- এই খানে বাসা নিছস?
অবাক হয়ে জানতে চাইল সোহেল। গাড়ির ভিতর সামনের সিটে আরো একজন অন্ধকারে তার দিকে জ্বল জ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে।
- এখানে বাসা হবে কেন? নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছি।
হো হো করে হেসে উঠল সোহেল।
- মাঝ রাইতে হাঁইটা নারায়ণগঞ্জ যাস্, তোর মাথা খারাপ হইছে?
- বাস না পেলে কি করব বল?
- বুঝছি। ওঠ গাড়িতে।
ড্রাইভারের সিটে বসল সোহেল, পাশে বসল মামুন। জ্বল জ্বলে চোখের গাট্টা গোট্টা শ্যামলা লোকটা পিছনে গেল। মামুন গাড়িতে বসার সাথে সাথে তাদের পাশ কাটিয়ে একটা ইপিআরটিসি’র ষ্টেটবাস চলে গেল। প্রায় খালি বাস। শেষ বাস হয়তো। আরো কিছুক্ষণ স্টপেজে অপেক্ষা করলে এই বাসই সে ধরতে পারত। যাক্ এখন আর দরকার নেই। জ্বল জ্বলে চোখের লোকের সংগে পরিচয় করিয়ে দিল সোহেল, ‘আমার পার্টনার, শহীদ’। আধা লোফার টাইপের লোকটা মামুনের দিকে তাকিয়ে দাঁতের ঝিলিক দেখাল। মামুন ক্লিশ্ট হাসি হাসল। হ্যান্ডশেকের সময় এখন নয়। গাড়িতে উঠে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলল মামুন। যা গিয়েছে তা’তো ফিরে পাওয়া যাবে না, ভালোয় ভালোয় এখন বাসায় ফিরতে পারলে হয়। গাড়িতে উঠে ঘটনা জানতে চাইল সোহেল। অপরিচিত লোক গাড়িতে, কাজেই বিস্তারিত বললো না মামুন।
- আর বলিস না, ট্যাক্সিতে উঠেছিলাম জুরাইনের কাছে দুই ছিনতাইকারী টাকা কেড়ে নিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দিল।
- কত টাকা ছিল?
- পাঁচ হাজার।
- ইস্।
সোহেল মুখে বলল বটে ‘ইস্’, তবে তার মনে খুব একটা লেগেছে বলে মনে হল না। এটা তার কাছে কোন টাকা নয়। টাকা হারানো মামুনের কাছে ও শোকের নয়। তবে টাকা দিয়ে তাদের কিছু করার কথা ছিল। ফাঁকা ফাঁকা লাগে মামুনের।
দুই ধারে বিশাল বিশাল গাছ, করই, শিরিষ, বট। ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের আলো। সোহেলের গায়ে শাদা শার্টের উপর নেভী ব্লু ব্লেজার। এখন কালো মনে হয়। খুবই ফ্যাশনেবল, ট্রাউজারটা কালো কর্ডের। পিছনে বসা সংগীর জামা কাপড়ে যেমন তেমন।
ফতুল্লা ছাড়িয়ে পঞ্চবটির কাছাকাছি পৌঁছাতে দেখা গেল লাঠি সোটা হাতে কয়েক জন লোক দাঁড়িয়ে। গাড়ি স্লো করল সোহেল,
- শহীদ, ব্যাকে, ব্যাকে।
‘ব্যাকে’ বলতে সে কি বোঝাল কে জানে, হয়তো একটু ক্ষণের জন্যে গাড়ি থমকালো, গাড়ির ব্যকডোরের শব্দ হল, আর কয়েক মিনিটের মধ্যে তাদের গাড়ি ঘেরাও হল।
- বেরিয়ে আয় ব্যাটা, শহীদ।
চেঁচালো তারা কয়েক জন। গাড়ির গ্লাস নামিয়ে সোহেল বলল,
- শহীদ এই গাড়িতে নাই।
- চুপ কর ব্যাটা, হারামী, ...।
অশ্লীল গাল দিল একজন। অন্য আরো কয়েক জন অন্য পাশের দরজা খুলে টেনে বার করল মামুনকে। কিল ঘুষি বৃষ্টির মত পড়ল মামুনের সর্বাঙ্গে। মাটিতে বসে পড়ল মামুন।
- কী করতাছ তোমরা? এইটা শহীদ না, এ মামুন। জগন্নাথ কলেজের ইংলিশের প্রফেসর।
মার থামাল তারা। সর্দার গোছের লোকটা এগিয়ে এসে বলল,
- এইটাতো মামুন না! এই, মাইর থামা। সোহেলরে ধর। হালায় হেরে পার কইরা দিছে।
সমবেত ভাবে তারা সোহেলকে ঘেরাও করল।
- ট্যাকা তুই দিবি। তুই হালারে পলাইতে দিছস।
সোহেলকে ধাক্কা দি্য়ে সর্দার বলল। মামুনের নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। চোখের উপর ভিজে গেছে, সম্ভবত: কপাল কেটে রক্ত পড়ছে, সম্ভবত: দাঁত ও নড়ে গেছে, কিন্তু সব ছাড়িয়ে মামুনের মনে ছড়িয়ে পড়েছে বিস্ময়! এ কি হচ্ছে? এটা কি সিনেমার কোন দৃশ্য? ‘এ কি সত্য, সকলই সত্য!’ সারা গায়ে ব্যাথা জানান দিচ্ছে, সবকিছুই সত্য।
- সোহেল, তোর ট্যাকার ভাগ তুই নিছসÚ, এখন শহীদের লগে মিলা আমগো ট্যাকায় ভাগ বসাইবি, সেইটা হইব না। তুই ট্যাকা দিবি।
- আমি? আমি ক্যান? শহীদের লগে ভাগ বন্দোবস্ত তোরা বুঝগা যা।
ঠাস করে সোহেলের গালে চড় মারল দলনেতা।
- মাজাকি বাদ দে, হয় শহীদরে বাইর কইরা দিবি, না’ইলে তুই পাঁচ লাখ ট্যাকা দিবি।
পাঁচ লাখ টাকা! মামুন কখনো পাঁচ লাখ টাকা চোখে দেখেনি। শুনেছে রুমানাদের সম্পত্তির দাম দশ লাখ, কিন্তু সে ঐ শোনা পর্যন্তই। কিন্তু এদের সাথে সোহেলের তুই তোকারি সম্পর্ক কেন? স্পষ্টত:ই এরা বে-আইনী কাজে লিপ্ত সমাজবিরোধী আর সোহেল একজন সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী। দু’পক্ষ এক সাথে মিলল কি করে? গাড়ি থেকে শহীদই বা হাওয়া হয়ে গেল কি করে? দূরে এদের সমাবেশ দেখে ক্ষণিকের জন্যে থমকে ছিল বটে গাড়িটা, ক্ষণিকের জন্যে গতিও কমেছিল, কিন্তু দুই ধারে খাল থাকার দরুন সেখানে পালানোর কোন রাস্তা ছিল না।
- সাবু ভাই, হালায় এর কাছে টাকা দেয় নাই তো?
- সার্চ কর। বলল সর্দার।
দু’জনে মিলে রাস্তা থেকে মামুন কে তুলল। পাতলা সোয়েটার খুলে রাস্তায় ছুড়ে ফেলল। এতক্ষণ ঠান্ডা লাগছিল না, এখন পৌষের ঠান্ডা বাতাস মামুনের হাড়-মজ্জা স্পর্শ করল। সাবুর দু’জন সাঙাৎ মামুনের প্যান্টের দু’পকেটে হাত ঢুকাতে যাচ্ছিল, বুদ্ধিমান গ্যাং লিডার বলল,
- পকেটে হাত দিছ না, গাধা! পাঁচ লাখ ট্যাকা পকেটে রাখা যায় না। গাড়ির ভিতর সার্চ কর।
গাড়ির ভিতর বক্স, সিটের উপরে নীচে করতে লাগল চার সাঙাৎ।
- কিছু নাই, সাবু ভাই।
- জানতাম।
বলল সাবু ভাই,
- গাড়ির বুট খোল, সোহেল্।
- খুলুম না, কি করবি?
তেড়িয়া হয়ে বলল সোহেল।
- তবে রে!
সোহেলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল পাঁচ জন। মামুন গাড়ির পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎ দেখে বুটের ডালা আলগা করে বেরিয়ে আসছে শহীদ নামের লোকটি, হাতে গাড়ির জ্যাক। বুটের মধ্যে লুকিয়ে ছিল ব্যাটা? বুটে এত বড় শরীরটা ধরল? এত কিছু ভাবার সময় পেল না মামুন, ফটাস করে একটা শব্দ শুনল আর দেখল, ‘বাবারে’ বলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে সাবু। মূহুর্তের মধ্যে সাঙাৎ চার জন হাওয়া হয়ে গেল অকুস্থল থেকে।
- দোস্ত, এক্সট্রিমলি স্যরি! আমরা এখন নারায়ণগঞ্জ যাইবার পারুম না। তোরে অসুবিধার মধ্যে ফালাইলাম। এইখান থাইকা বেশী দূর না, হাইটা যাইবার পারবি।
সোহেলরা ঢাকার দিকে ফিরে গেল। রাস্তায় পড়ে খাকল সাবুর ‘মৃত’ অথবা ‘জ্ঞানহীন’ দেহ্। গা ছম ছম করল সোহেলের। এখানে থাকলেতো পুলিশ তাকে খুনের দায়ে ধরবে। রাস্তায় একটাও গাড়ি নেই, জন মানুষের চিহ্ন মাত্র নেই, আলো নেই। এখন যদি সাবু হুঁশ ফিরে পায়? যদি জেগে উঠে তাকেই আক্রমণ করে?কবিদের গায়ে জোর থাকে না, মামুনেরও নেই। সাবুর সাথে মামুন পারবে না। সুতরাং, সাবুর ‘জ্ঞানহীন’ বা ‘মৃত’দেহের দিকে না তাকিয়ে দ্রুত সামনে পা বাড়াল মামুন। পঞ্চবটির মোড় পেরিয়ে এল, জামতলা, শ্মশান ঘাট, গোরস্খন পেরিয়ে এল। এইতো মাজদাইড়ের মোড়, তারপর তোলারাম কলেজ এবং সামনে রেল লাইন। একটু একটু করে সাহস ফিরে এসেছে মামুনের, রাত একটার মধ্যে বাসায় পৌঁছে যাবে। হঠাৎ পিছন থেকে পুলিশের এক পিক আপ ভ্যান এসে হাজির হল। ষোল কলা পূর্ণ হল এতক্ষনে! ভয় চলে গেল মামুনের। টাকা হারানোর আফসোসও আর নেই। আকাশে হালকা শাদা মেঘের আড়ালে চাঁদ এখনো উঁকিঝুকি দিচেছ। মাথা এখনো ভারী, কিন্তু মনটা হালকা হয়ে গেছে।
রাত এখন তিনটা বাজে। থানা হাজতে আরো তিন ‘সমাজবিরোধী’র সাথে ঠান্ডা সিমেন্টের মেঝেতে বসে আছে কবি মামুন। সামনে সিপাইকে দশটাকা ঘুষ দিয়ে আনানো খাটো একটা টুল। দু’টাকা দিয়ে সে কলা এনে খেয়েছে, দশটাকা দিয়ে আনিয়েছে থানার ভান্ডারে জমা পড়া এক বিবর্ণ শাদা খাতা আর একটা বল পয়েন্ট কলম। মামুনের পকেট এখন শূণ্য কিন্তু মনে অনির্বচনীয আনন্দ। কবিতা ফিরে এসেছে তার কাছে!
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন