|
নাসরিন চৌধুরী
|
|
গল্পঃ মেঘে ঢাকা তারা
22 January 2015, Thursday
“শোন বউ হল পায়ের জুতা, জুতা যেমন খুব সহজে বদল করা যায় তেমনি বউও বদল করা যায়। বউ মরলে বউ পাওয়া কিন্তু মা মরলে কি মা পাওয়া যায়? বিয়ে করে বউ নিয়ে ভাবলেই হবেনা তার মা-বাবা, ভাই-বোন সবাইকে নিয়েই ভাবতে হবে।” এভাবেই ছেলের বউকে শুনিয়ে শুনিয়ে কথাগুলো বলছেন শর্মিলি বেগম। দু'মাস হল ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন কিন্তু এর মধ্যেই বউকে নিয়ে বেশ কতবার সালিশ ডাকা হয়েছে। ছেলেকে বোঝানো হচ্ছে বা ছেলেকে দেখানো হচ্ছে যে এই সংসারে ছেলের জীবনে প্রথমত তার মা, ভাই, বোন গুরুত্ববহন করে তারপর বউ। শ্বাশুড়ি'র কথাগুলো শুনে বেশ মন খারাপ করে বারান্দায় আনমনে বসে থাকে মিথি। সে জানেনা কেন জানি এবাড়ির মানুষগুলো প্রথম থেকেই এমন করছে! সামান্য ভুলগুলো নিয়ে সবাই অসামান্য কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলছে। এই পরিবারের নতুন একজন সদস্য সে। এই পরিবারের মানুষগুলো'র ইচ্ছা, পছন্দ, রুচি, মানসিকতা কিছুই সে জানেনা কিন্তু জেনে নিতে বা মানিয়ে নিতে যতটুকু সময় একটা মানুষকে দেয়া দরকার সেটা দেয়ার ধৈর্য্য কারো নাই।
ভালবেসে বিয়ে করেনি মিথি। বাবা-মা'র পছন্দমত পাত্রকেই সে বিয়ে করেছে। আমেরিকা প্রবাসী ছেলে ডিভিতে ওখানে গিয়েছে। প্রায় পাঁচ বছর পর দেশে ফিরে এসে অসংখ্য পাত্রী খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত মিথিকেই পছন্দ করেছে। বরাবরই প্রবাসী পাত্র তার অপছন্দের তালিকায় ছিল। অনেক পাত্র সে যোগ্যতা থাকা স্বত্তেও নাকচ করে দিয়েছে শুধু প্রবাসী বলে। সেজন্য মায়ের অনেক বকাও খেয়েছে। কিন্তু বাবা সবসময়ই মিথিকে ও তার মতামতকে গুরুত্ব দিয়েছে। বাবাকে প্রচণ্ড ভালবাসে সে কারন এই বাবা তাকে শিখিয়েছে মেয়ে সন্তান আর ছেলে সন্তানের মাঝে কোন ফারাক নেই।
চারিদিকে বখাটে ছেলেদের উৎপাত, হুমকি এসব সহ্য করেই যেদিন সে মাষ্টার্স পরীক্ষা দিল তার সতের দিনের মাথায় মিথি'র বিয়ে হল। সে বিয়েতে আপত্তি করেনি কারন পাত্রকে দেখার পর কেন জানি তার নিজেরও বেশ ভাল লাগল। এভাবেই মিথি এক অচেনা জগতে এসে খেই হারিয়ে ফেলল। স্বামী নিশান মানুষ হিসেবে বেশ চমৎকার আর যেখানেই যায় প্রতিটা মানুষের মুখেই শুনে যে ছেলেটা বেশ ভাল। মিথি'র খুব ভাল লাগে স্বামী'র প্রশংসা অন্যসবার মুখে শুনে। তিন মাসের ছুটিতে আসে নিশান হাতে আরও দু'মাস বাকি। প্রথম কিছুদিন বেশ ভালই কাটল।
শ্বাশুড়ি শর্মিলি বেগম মিথিকে বললেন হানিমুনে যাওয়ার আগেই যেন বোখরা কিনে নেয়। ছেলেকেও বারবার বললেন। মিথি বুঝতে পারছেনা এভাবে গায়ের জোরে কেন অন্যের কথামত তাকে বোখরা নিতে হবে! পর্দা সে করবেনা এমনত কখনও সে বলেনি কিন্তু সেটা সে নিজে থেকেই নিবে এবং মন থেকেই নিবে কিন্তু ওরা এভাবে বাধ্য করবে কেন? এনিয়ে নিশানে'র সাথে কথা বললে নিশান বলে, “আমি যদি আমেরিকায় চলে যাই তাহলে তোমাকে কিছুদিন দেশে থাকতে হবে, আর বোখরা না পড়লে নানাজনে নানা কথা বলবে এজন্যই তোমাকে এভাবে বলছে।” মিথি বলল, “তাহলে কি পর্দাটা লোক দেখানোর জন্য?”
নিশান বলে, “দেখ মিথি যে'কদিন দেশে আছ একটু মানিয়ে নাও যখন তুমি আমার কাছে চলে যাবে এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা। তুমি তোমার মত করে তোমার সংসার বুঝে নিও। তুমি তোমার পুরো স্বাধীনতা নিয়েই তুমি আমার সহধর্মিনী হবে--বন্ধু হবে। আমি আমার ভাত রান্না করার জন্য তোমাকে বিয়ে করিনি আমি বিয়ে করেছি এমন একজনকে যে হবে আমার বন্ধু, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সে আমার সহযাত্রী হবে।”
নিশানের কথা শুনে চোখে জল এসে গিয়েছিল মিথি'র। সেদিন সে বুঝেছিল বাবা আসলেই তার জন্য যোগ্য পাত্রটিকেই নির্বাচন করেছে। কিন্তু নিশানের সমস্যা ছিল সে কখনও পরিবারের বিরুদ্ধে কথা বলতনা যদিও সে দেখছে ও শুনছে কারন যে মেয়েটা মাত্র এসংসারে এল তাকে খারাপ হতে হলেও বছর খানেক সময় দিতে হবে। এক মাসেই মানুষ নতুন সংসারে এসে খারাপ রূপ দেখাতে পারেনা কিন্তু নিশান ঝামেলায় জড়াতে চায়না কিছু হলে নিজের বউকেই বলে বা বুঝায়। মিথিকেই মানিয়ে নিতে হবে বা মেনে নিতে হবে। এভাবেই একদিন নিশানের যাবার সময় হয়ে যায়। নিশান চলে গেলে বেশ একা হয়ে যায় মিথি। চেষ্টা করে শ্বশুর বাড়ির সবার সাথেই সম্পর্কটুকুকে সহজ ও স্বাভাবিক করে নিতে। ওদের কথা মত বোখরা পড়ে, বাহিরে যাবার জন্য প্রতিদিন রিক্সাভাড়াটুকুও শ্বাশুড়ির কাছে হাত পেতে নেয়, তিন বেলা রান্না করে।
একদিন শখ করে এক জোড়া জুতা কিনেছিল, সেদিন শ্বাশুড়ি শুনিয়েছিল ইদানিং খেয়াল করছি তোমার হাত বেশি লম্বা হয়ে যাচ্ছে টাকা পয়সা হিসেব করে খরচ করো। নিজের বাবা মাও কোনদিন এভাবে বলেনি কিন্তু সেদিন মিথি সহ্য করতে পারেনি। সাথে সাথে নিশানকে জানিয়েছিল এবং বলেছিল যে আমার হাত খরচের টাকা যদি দিতে না পার আমি আজই তোমার ঘর ছেড়ে চলে যাব। আর কত? প্রতিদিন রিক্সাভাড়াটাও তোমার মা'র কাছ থেকে চেয়ে নিতে হয় তারপরও আমার হাত লম্বা হয় কিভাবে? নিশান চেষ্টা করে উভয় পক্ষকেই বোঝাতে। কিন্তু মা'র হাত দিয়ে বউকে প্রয়োজনের বেশি টাকা দেয়া সম্ভব নয় তবুও মাকে বলে মাসে হাত খরচের টাকা মিথিকে একসাথেই দিয়ে দেয়ার জন্য জন্য। সেদিন থেকে শ্বাশুড়ি প্রতিমাসে প্রথম সপ্তাহেই একহাজার টাকা ধরিয়ে দেয়। মিথি সেদিন নিজেই যেন নিজের কাছে মিইয়ে যেতে লাগল কারন এ বাড়ির কাজের বুয়ার বেতনও একহাজার টাকার চেয়ে বেশি। তাহলে কি এবাড়ির সদস্যদের কাছে কাজের বুয়ার দামও তার নেই?
তারপর থেকেই মিথি নিজের জন্য ভাবতে লাগল। কিছুদিনের মাথায় তার বেশ ভাল একটা জব জোগাড় হয়ে গেল। রেজাল্ট ভাল ছিল এবং যেখানে জবটা পেয়েছে সেটা তার এক কাজিনের ফার্মে। মোটা অঙ্কের বেতন সাথে আনুসঙ্গিক সুযোগ সুবিধাও আছে। নিশানের আপত্তি ছিলনা কিন্তু শ্বাশুড়ির আপত্তি। সেটা নিয়ে মিথি মাথা ঘামায়না কারন হাত পেতে নিতে আর কত ভাল লাগে! সকালে বেরিয়ে যায় অফিসের জন্য কিন্তু যাবার আগে সবার জন্য সকালের নাস্তা বানিয়ে যেতে হয়, আবার অফিস থেকে এসে আবার সবার জন্য রাতের রান্না করতে হয়। চাকুরীতে ঢোকার পর থেকে বাড়ির কাজের বুয়া বিদায় করে দেয়া হয়েছে যদিও অজুহাত দেখানো হচ্ছে বুয়া নিজেই চলে গেছে। সাত আটজন লোকের রান্না বান্না নিজেরই করতে হয়। কিন্তু কেউ মিথিকে কোন সহযোগিতাই করেনা এনিয়েও মিথি'র কোন ক্ষোভ নাই কারন তার নিজের পক্ষে যতটুকু সম্ভব ততটুকুই সে করবে এবং আন্তরিকভাবেই সে করবে।
মিথি বাবা'র বাসায় বেড়াতে গেলে কিছুদিন বেশি থাকলেই শ্বশুর বাড়ি থেকে অভিযোগে নিশানের কান ভারী করে তোলে। আর কিছু হলেই মিথি'র বাবা মাকে দোষারোপ করে যে ওনারা মেয়েকে ফুসলে নষ্ট করে দিচ্ছে। অথচ নিজের বিবাহিত মেয়েরা বাবা'র ঘরে মাসের পর মাস বেড়াচ্ছে। মা'র বাসার পাশেই বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছে। অন্যায় অভিযোগগুলো মিথি কখনোই আমলে নিতে চায়না কিন্তু কখনও কখনও সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
এরমধ্যেই মিথি বেশ অসুস্থ হয়ে যায়। ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বললেন শারিরীক কোন সমস্যা নাই কিন্তু মানসিকভাবে অসুস্থ। ডাক্তার বেশ পাওয়ারফুল ঔষধ দিলেন যা খেলে মিথি সারাদিনই ঘুমাতো কিন্তু এনিয়েও নিস্তার নেই। শ্বাশুড়ি বলে, “এগুলো সব অভিনয়। ডাক্তারের রিপোর্টে কিছুই ধরা পড়েনি কিন্তু ওনাদের কাছে মানসিক অসুখ হয়ত অসুখের আওতায় পড়েনা। এভাবেই নিজের সাথে নিজে লড়ে যাচ্ছে সে। নিশানকে মা ও বোনেরা মিলে বলতে লাগল, “ তোমার বউ তোমাকে যা বোঝায় তুমি তাই বোঝ। কদিন পর বউ তোমাকে ঘর থেকেই বের করে দিবে। বউ যা বলে তাই বিশ্বাস করা উচিত নয়।” নিশান তাদের কাউকেই বোঝাতে পারলনা যে মিথি'র অসুস্থতা সত্যিই মানসিক এবং সে মিথি'র ডাক্তারের সাথে কথা বলেছে এব্যপারে।
মিথি বাধ্য হয়েই বাবা'র বাসায় চলে এল। যেদিন সে শ্বশুর বাড়িতে পা রেখেছিল সেদিন শর্মিলি বেগম বলেছিল, “দেখো মেয়েদের আসল বাড়ি হচ্ছে শ্বশুর বাড়ি। মেয়েরা হল বাবা'র বাড়ির মেহমান।” আজ মিথি'র মনে হচ্ছে বাবা'র বাড়িই মেয়েদের আসল বাড়ি। কাল যদি নিশানের সাথে তার সম্পর্ক ভেঙ্গে যায় তাহলে তাকে বাবা'র বাড়িতেই চলে আসতে হবে। শ্বশুর বাড়ি নিজের বাড়ি হলে তাহলে ওখানে কেন ভিতটা এত নড়বড়ে? চাইলেই কেন একটা বউকে বের করে দিতে পারে? না সে মানতেই পারেনা-- শ্বশুর বাড়ি বা স্বামী'র বাড়ি কখনও একটা নারী'র আসল বাড়ি হতে পারেনা। সত্যিকার অর্থে নারী'র কোন ঠিকানাই নাই। এসব ভাবতে ভাবতেই নিশান ফোন দিল তাকে।
মিথিকে বলল সে বেশ লজ্জিত এবং দুঃখিত তার পরিবারের এমন ব্যবহারের জন্য। মিথি'র অনেক কান্না এল। স্বামী ছাড়া একটা মেয়ে পুরো ছ'টা মাস কতভাবেইনা চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি সে এবং পারবেও না। নিশান বলল সে দেশে আসতে চাচ্ছে এক মাসের জন্য কিন্তু মিথি না করল বলল, কি লাভ বল? শুধু শুধু ঝামেলা আর ভাল লাগেনা। আমি আমার জব ছাড়বোনা, আমার যতটুকু দায়িত্ব তোমার পরিবারের প্রতি সেটা আমি আমার সাধ্যমত করে যাব কিন্তু এরপরও যদি ওনাদের আপত্তি থাকে আমার কিছু করার নাই নিশান। আমি আমার অস্তিত্বকে বিকিয়ে দিতে পারবনা , আমি সেসব নারীদের দলে পড়িনা যে হাজারো নির্যাতন সয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে! জীবনটা কদিনের বল! তাহলে একটা জীবন কেন আমি তিলে তিলে মাথা নুয়ে নিজেকে শেষ করে দেব! নিশান কোন জবাব খুঁজে পেলনা। সে জানে মিথি'র জায়গায় মিথি ঠিক আছে।
এভাবে তিনমাস কেটে গেল। নিশান বেশ যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছে, বলছে ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। এদিকে মিথি'রও ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। নিজে একটি এনজিও খুলেছে অসহায় ও নির্যাতিত নারীদের জন্য। বেশ সাড়াও পাচ্ছে। এর মধ্যে বাসায় একটা কুরিয়ার এল মিথি ভাবল নিশান হয়ত কোন উপহার পাঠিয়েছে! খুব আগ্রহ নিয়ে খুলল এবং যেটা দেখল সেটা কোনভাবেই প্রত্যাশিত ছিলনা। একটা ডিভোর্স লেটার সাথে একটা চিঠি, তাতে লেখা
“মিথি”,
ক্ষমা করো। আমি পারলামনা তোমার হাত ধরে সারাটা পথ হাঁটতে। মা খুব অসুস্থ তার একটাই চাওয়া তোমাকে যেন আমি আমার জীবন থেকে সরিয়ে দেই। আমি বোঝাতে চেষ্টা করেও পারিনি। তার শরীরের অবস্থা দেখে আমি তোমার ব্যপারে অনড় থাকতে পারলামনা। মায়ের ভালবাসা'র কাছে প্রেমিকের ভালবাসা হেরে গেল। ক্ষমা করো আমায় –
“নিশান”
মিথি'র বুক থেকে চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। চিঠিটিকে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল, সাথে অতীতের গল্পটাকেও----।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন