আমার মায়ের সাথে কোন প্রকার আত্মীয়তার সম্পর্ক না থেকেও তিনি আমার মামা। কবে, কীভাবে যে তিনি আমার মামা হয়ে গিয়েছিলেন তা আমি নিজেও জানিনা।! আমার দেখাদেখি আমার সমবয়সীরাও তাঁকে মামা বলে ডাকা শুরু করেছিল। সেই থেকে তিনি আমাদের সবার প্রিয় ঘন্টু মামা।
ঘন্টু মামার ভালো নাম ঘনাচরণ সরকার। তবে খুব কমসংখ্যক লোকই তাঁকে এ নামে চেনে। সবার কাছে তিনি ঘন্টু নামেই বেশী পরিচিত। ঘন্টু মামা মানুষটা খুব মজার তবে অসম্ভব রকমের নরম মনের মানুষ। অন্যের দুঃখ-কষ্ট তিনি একদম সইতে পারেননা। পাড়ার গরীব অসহায় মানুষের এক অন্যতম ভরসার নাম ঘন্টু মামা। নিজে না খেয়ে হলেও তিনি অন্যের খাদ্যের ব্যবস্থা করতে মরীয়া হয়ে উঠেন।
ঘন্টু মামার আরেকটা গুণ হচ্ছে তিনি খুব সহজে মানুষের সাথে মিশতে পারেন। একেবারে অপরিচিত মানুষের সাথেও তিনি অল্প সময়ের মধ্যে মিশে যেতে পারেন। ঘন্টু মামার সাথে রাস্তায় বেরোলেই বোঝা যায় তিনি কতোটা পরিচিত! তার পরিচিতির ঠেলায় পাঁচ মিনিটের রাস্তা পেরুতে বিশ মিনিট লেগে যায়। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলি ইলেকশানে তোমাকে দাঁড় করিয়ে দিলে তুমি অনায়াসেই পাশ করে যাবে!
এলাকার মেয়ে মহলে ঘন্টু মামার আলাদা একটা কদর আছে। কতো যুগলের প্রেম-বিরহের গল্প রচিত হয়েছে ঘন্টু মামার হাত দিয়েই। পাড়ার উঠতি ছেলেরা ঘন্টু মামা বলতেই অজ্ঞান। ঘন্টু মামাকে বাদ দিয়ে পাড়ার কোন ধরনের খেলাধুলা বা ফাংশনের কথা চিন্তাই করা যায়না। খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের স্পন্সর যোগাড় করা সহ সব আয়োজনের অগ্রসৈনিক আমাদের প্রিয় ঘন্টু মামা।
জয়াদির সাথে ঘন্টু মামার এক বিশেষ ধরনের সম্পর্ক আছে। আমি আর আমাদের কাছের কয়েকজন ছাড়া এ বিষয়ে কেউ একটা জানেনা। ঘন্টু মামাও ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানাতে আগ্রহী না। ঘনাচরণ সরকার ওরফে ঘন্টু মামাকে আমি যেহেতু মামা বলে ডাকি সেহেতু উনার প্রেমিকাকে আমার মামী বলে সম্বোধন করা উচিত। কিন্তু এখানে ছোট্ট একটা গন্ডগোল আছে। গন্ডগোলটা বাঁধিয়েছেন ঘন্টু মামা স্বয়ং। আমার পাড়াতুতো সুন্দরী দিদির সাথে ঘন্টু মামা প্রেম করলে আমার কী করার আছে! জয়াদিকে ছোটবেলা থেকেই দিদি ডেকে অভ্যস্ত; এখন হঠাত করে মামী বলে ডাকি কেমন করে?
ঘন্টু মামা আর আমি হরিহর আত্মা। ঘন্টু মামা যেখানে আমি আছি সেখানে। আর যেহেতু আমি সবসময় উনার সাথে ছায়ার মতো সেঁটে আছি কাজেই ঘন্টু মামার অনেক অজানা কাহিনীরও প্রত্যক্ষদর্শী আমি।
অনেকদিন থেকেই আঁচ করছিলাম জয়াদি আর ঘন্টু মামার মধ্যে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। রাস্তা বা অন্য কোথাও যখন দুজন একে-অপরের মুখোমুখি হতেন তখন তাদের অঙ্গভঙ্গিই বলে দিতো ডাল ম্যা কুচ কালা হ্যায়! প্রানোচ্ছ্বল, মিশুক আর সদা হাসোজ্জ্বল ঘন্টু মামাকেও দেখতাম কেমন জানি চুপসে যেতেন। জয়াদির সাথে কথা বলতে গেলেই ঘন্টু মামার কথা জড়িয়ে যেতো; জয়াদির মুখোমুখি হলে ঘন্টু মামার কথা শুনে যে কেউ মনে করবে কোনকালে ঘন্টু মামার তোতলানোর অভ্যাস ছিল। জয়াদিকে ঘন্টু মামার মতো এতোটা অপ্রস্তুত না দেখালেও স্পষ্টত বুঝা যেতো উনার মধ্যেও কিছু একটা ঘটছে। তবে জয়াদি তার স্বভাবসুলভ সুন্দর হাসি দিয়ে পুরো পরিস্থিতিটা সামলে নিতেন। এভাবেই অনেকদিন চলছিলো। কেউ আগ বাড়িয়ে মনের কথা খুলে বলতে পারছিলো না।
সে প্রায় বছর দেড়েক আগের কথা। একদিন বিকেলে জয়াদি তার কাকাতো ভাই দেবাকে দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠালেন। জয়াদি আমায় ডেকেছেন শুনে আমি বিষ্মিত হলাম। দেবা নিতান্তই একটা বাচ্চা ছেলে। ওকে কারনটাও জিজ্ঞেস করতে পারছিলাম না। ভাবলাম ঘন্টু মামাকে একটা ফোন দেবো কিনা! পরক্ষণেই মনে হলো গিয়েই দেখি না কি ব্যাপার!
আজকাল জয়াদি খানিক রাগী রাগী হয়ে গেলেও তখন মোটেও রাগী ছিলেন না। তবু আমার কেন জানি ভয় ভয় করছিলো। আসলে অতিরিক্ত সুন্দরী জয়াদির আচরনে এমন একটা গাম্ভীর্য্য ছিল; যে কেউ তাঁকে সমীহ করে চলতে বাধ্য। আমি ভীরু ভীরু পায়ে জয়াদির বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলাম। এর আগেও আমি এ বাড়িতে কত্তো এসেছি। কখনো এতোটা ইতঃস্তত লাগেনি।
দরজায় নক করতেই জয়াদি দরজা খুলে দিলেন। ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করতেই দেখলাম ঝর্না কাকীমা টিভিতে কী একটা অনুষ্ঠান দেখছেন। আমাকে দেখে বললেন, আরে মুন্না! তুই কোত্থেকে! আজকাল তো তোকে দেখাই যায়না! বেশ বড় হয়ে গেছিস দেখছি। তা এবার কোন ক্লাসে উঠলি?
আমি বুক চিতিয়ে জবাব দিলাম, ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছি।
কাকীমা অবাক হয়ে বলল, বলিস কীরে! সেদিনও তো দেখতাম তোর মায়ের হাত ধরে স্কুলে যেতিস। বাব্বা! তোরা সবাই কতো তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেলি! কোন কলেজে এডমিশন নিয়েছিস?
আমি উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম। জয়াদি থামিয়ে দিয়ে বলল, মা কি শুরু করেছো? আসার পর থেকেই ওকে জেরা করে চলেছো! এই মুন্না আমার ঘরে চল।
আমি জয়াদির পিছু পিছু জয়াদির রুমে হাজির হলাম। রুমে ঢুকেই আমার বিষ্ময় আকাশ স্পর্শ করলো। পুরো ঘরের দেয়াল পার্পল রঙের ইমালশন রঙ দিয়ে রাঙ্গানো। দরজার বাঁ-পাশে দুটি আলমিরা ভর্তি বই আর বই। এক পলকে চোখ বুলিয়ে দেখলাম নামী-দামী লেখকের বইয়ে আলমিরা ঠাসা। আলমিরার পাশে দেয়ালে সারি করে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শেকসপীয়ার, ম্যাক্সিম গোর্কী, বঙ্গবন্ধু, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের ছবি ঠাঙ্গানো।
ডানপাশে একটা হোম থিয়েটার সেট করা হয়েছে। হোম থিয়েটারের পাশেই দুটো সেলফভর্তি হরেক রকম ডিভিডি। ঘরের ঠিক মাঝখানে শুভ্র সাদা চাদর বিছানো একটা খাট। বালিশের উপর আধখোলা ল্যাপটপ। খাটের পাশে টেবিলে ছড়ানো কয়েকটি কাগজের টুকরো। মেঝেজুড়ে বিছানো মখমলের কার্পেট। পুরো ঘরের মধ্যে যেন একটা সুভাষ ছড়ানো। আমার কাছে মনে হচ্ছিলো আমি কোন স্বর্গালোকে প্রবেশ করেছি। বিষ্মিত হয়ে জয়াদিকে বললাম, এ কী গো! আমার তো মনে হচ্ছে আমি এক ভিন্নজগতে এসে পড়েছি।
জয়াদি মৃদু হাসলো। আমার ঘোর তখনো কাটছেনা। আমি বললাম, এই বইগুলো কী তুমি পড়? এই ডিভিডিগুলোও কি তোমার?
জয়াদি বলে, তোর কি মনে হয়?
আমি বললাম, ঘরটাকে তো পুরো স্বর্গ বানিয়ে রেখেছো।
জয়াদি মৃদু হাসলো। তারপর বলল, তুই বস। আমি তোর জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসি।
জয়াদি পাশের ঘরে চলে যেতেই আবার বুকে ধুকপুকানি শুরু হলো, জয়াদি কেন আমায় ডেকে পাঠালো!
খানিক পরেই জয়াদি একপ্লেট সন্দেশ আর এক গ্লাস পানি নিয়ে ঘরে ঢুকলো। আমার সামনে প্লেট রেখে বলল, নে খা।
আমি বললাম, পাগল হয়েছো এতো সন্দেশ খাবো কী করে?
“যতোটা পারিস খা। বাকিগুলো তোর গুরুদেব ঘনাচরণের জন্য নিয়ে যাস।”
সন্দেশগুলো খাঁটি গরুর দুধ থুক্কু গরুর খাঁটি দুধের ক্ষীর দিয়ে তৈরি। বেশ মজা করে তিনটে সন্দেশ খেয়ে নিলাম। প্লেটে পড়ে রইলো আরো তিনটে সন্দেশ। সন্দেশগুলো এতোটাই সুস্বাদু যে ইচ্ছে করছিলো আরো দু-একটা খেতে। তবে ইচ্ছেকে দমন করলাম কেননা বেশী খেলে জয়াদি আবার আমাকে রাক্ষস ভেবে বসতে পারে।
ঢক ঢক করে পানির গ্লাস শেষ করতেই জয়াদি বলল, তোকে আজ একটা কাজে ডেকেছি।
আমি জিজ্ঞাসু চোখে জয়াদির দিকে তাঁকালাম। জয়াদি ভাঁজ করা একটা সাদা কাগজ আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এটা তোর ঘন্টু মামাকে দিবি।
আমি মনে মনে এরকম কিছুই আন্দাজ করছিলাম। আমি বাধ্য ছেলের মতো কাগজটা বুক পকেটে ভরে উঠে দাঁড়ালাম। জয়াদিকে খানিকটা লজ্জ্বিত দেখাচ্ছে। আমি পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য বললাম, তুমি কোন চিন্তা করোনা। আমি ঠিকঠাক ঘন্টু মামার কাছে পৌছে দেব।
জয়াদি আমাকে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলো। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় জয়াদি পেছন থেকে বলল, মুন্না আর কাউকে কাগজটি দেখাস নে আমার লক্ষী ভাই। আমি একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে তড়তড় করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম।
জয়াদির বাসা থেকে বেরিয়ে বুঝলাম আমার ছোট্ট পকেটে চিঠিখানা বড্ড ভারী হয়ে গেছে। যার জিনিস তার হাতে পৌছে না দেয়া পর্যন্ত শান্তি পাবোনা। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। এখন মান্নানের চা স্টলে গেলেই ঘন্টু মামাকে পেয়ে যাবো। তাই সোজা মান্নানের চা স্টলের দিকে রওয়ানা দিলাম।
মান্নানের চা স্টলের কাছাকাছি পৌছতেই মান্নানের স্পেশাল আলুচপের গন্ধ নাকে ভেসে এলো। প্রতিদিন সন্ধ্যায় মান্নানের স্পেশাল আলুচপ খাওয়ার জন্য দূর-দূরান্তের মানুষ ভীড় জমায় এ পাড়াতে। এ পাড়ার অনেক রহস্যের মধ্যে মান্নানের স্পেশাল আলুচপ আরো একটা গুরুতর রহস্য। আর দশটা দোকানের প্রচলিত আলুচপ থেকে এর স্বাদ ও আকৃতি সম্পূর্ন ভিন্ন ধরনের। ঘন্টু মামা মান্নানকে পটিয়ে এই স্পেশাল আলু চপ তৈরির কলাকৌশল জানার অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রতিবারই তাঁকে আশাহত হতে হয়েছে। মান্নান কোনভাবেই তার ব্যবসায়িক রহস্য ফাঁস করতে রাজী নয়। ঘন্টু মামা একবার ভয় দেখিয়ে বলেছিলেন, “আমি তোর আলুচপের সেম্পল বিএসটিআই এ পাঠাবো। না জানি কি সব বিষ-টিষ সবাইকে খাওয়াচ্ছিস! পরীক্ষা করে যদি পাওয়া যায় উল্টোপাল্টা কিছু মিশিয়ে আলুচপ তৈরি করিস তাহলে কিন্তু সোজা চৌদ্দ শিকের ভেতরে পাঠাবে। বিয়ে না করেও শ্বশুরবাড়ি দেখে আসবি।” তবে কোন প্রকার ভয় দেখিয়েও লাভ হয়নি, মান্নান তার আটাশখানা দাঁত কেলিয়ে সব হুমকি বাতাসে ঊড়িয়ে দিয়েছে।
এখন মান্নানের ব্যবসার পিক আওয়ার। দোকানে মানুষ গিজগিজ করছে। চারটে বেঞ্চের সবগুলোই বহিরাগত মানুষের দখলে। চা স্টলের বাইরের দিকে একটা বেঞ্চে ঘন্টু মামা আর রাজু বসে আছে। ঘন্টু মামার এক হাতে আলু চপ, আরেক হাতে আরেকহাতে চায়ের কাপ। তিনি আলুচপে একটা কামড় বসিয়ে মান্নানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বিষ-টিষ যাই মেশাশ না কেনো রে ভাই, তোর এই আলুচপ না খেয়ে একটা দিনও কাটাতে পারবোনা। ধন্যি তোর মায়ের পেটের।
মান্নান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, চপ তৈরি করছি আমি আর ধন্যি আমার মায়ের পেটের কেন?
ঘন্টু মামা চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে বললেন, আরে গাড়ল এটাও বুঝলি না। যে মায়ের ছেলে এমন অমৃত বানাতে পারে তার পেটকে ধন্যি না দিয়ে উপায় আছে!
ঘন্টু মামা আলুচপে আরেকটা কামড় দিতে যাচ্ছিলেন তখন আমি উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, তোমার সাথে জরুরী কথা আছে। একটু উঠে এসো।
ঘন্টু মামা চপে মজে আছে, আমার কথা শোনার সময় কোথায়! আমাকে বসার ইঙ্গিত দিয়ে বললেন, ওসব কথাটথা পরে হবে, আগে একটা আলুচপ খেয়ে নে।
আমি রাগ দেখিয়ে বললাম, তোমার শুধু খাওয়া আর খাওয়া! তুমি এতো পেটুক কেন?
ঘন্টু মামা হো হো করে হেসে উঠলেন। “জগতে খাওয়া ছাড়া আর কি আছে বল! তার ওপর মান্নানের স্পেশাল আলুচপ হলে তো আর কথাই নেই।”
উত্তেজনায় আমার হার্টবিট এমনিতেই অনেক বেড়ে গেছে; আর চাপ সামলাতে পারছিলাম না। জয়াদি বলে দিয়েছে আর কেউ যেন না দেখে তাই সবার সামনে চিঠিখানা দিতেও পারছিনা। আমি আকুতির স্বরে বললাম, প্লীজ একটু আসবে। খুব জরুরী দরকার।
মুখ কাঁচুমাচু করে বলায় কাজ হলো। ঘন্টু মামা উঠলেন। মান্নানকে বললেন, ওই আরো দুইটা চপ ভালো করে ভেজে রাখ। আমি আসছি।
ঘন্টু মামা আর আমি দোকানের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আবছা অন্ধকারে ঘন্টু মামার হাতে কাগজটি তুলে দিলাম। কাগজ হাতে নিয়ে ঘন্টু মামা জিজ্ঞেস করলেন, কী এটা?
আমি উৎফুল্ল হয়ে বললাম, খুলেই দেখোনা।
ঘন্টু মামা তার বিখ্যাত নোকিয়া ১১০০ মডেলের সেটখানা বের করে টর্চ লাইটের আলো জ্বেলে কাগজে চোখ রাখলেন। অন্ধকারে ঘন্টু মামার মুখের মানচিত্র ঠিক বুঝা যাচ্ছিলোনা। বেশ খানিকক্ষণ মৌন থাকার পর ঘন্টু মামা নীরবতা ভাঙ্গলেন, অ্যাইরে! যা আন্দাজ করেছিলাম শেষ পর্যন্ত তা সত্যি হয়ে গেলো দেখছি!
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি খুশী হওনি?
ঘন্টু মামা বললেন, এতে খুশী হওয়ার কি আছে? বুঝলি এসব প্রেম-ট্রেম আমার জন্য না। জয়াকে তো বুদ্ধিমতী মেয়ে বলেই জানতাম। ও এমন কান্ড করে বসবে বুঝতে পারিনি!
আমার খুব রাগ হতে লাগলো। “ভাব নিচ্ছো, তাইনা? এখন সব দোষ জয়াদির! জয়াদি সামনে এলে তোমার অবস্থা কি হয় সে আমার দেখা আছে। নিজে আগ বাড়িয়ে প্রপোজ করার মুরোদ তো নেই ই। উলটো আরেকজনকে দোষারোপ করছে!”
ঘন্টু মামা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই এতো রাগ করছিস কেন?
“আমি রাগ করবো কেন! আমি তোমার ভাব নেওয়া দেখে বিষ্মিত হচ্ছি মাত্র। তোমার সাত জন্মের ভাগ্য জয়াদির মতো ধনীর দুলালী তোমাকে আগ বাড়িয়ে প্রপোজ করেছে।”
ঘন্টু মামা হো হো করে হেসে উঠলেন, জয়া তোকে কতো ঘুষ দিয়েছে বলতো? সেই কখন থেকে ওর হয়ে ওকালতি করেই যাচ্ছিস!
“ধুর বাবা আমার কী! আমি তো শুধু চেয়েছি তোমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক হোক। আচ্ছা সত্যি করে বলো তো তুমি জয়াদিকে ভালোবাসোনা? তোমার উত্তর ‘না’ হলে আমি এখনই জয়াদিকে জানিয়ে আসবো।”
“ক্ষেপেছিস! ঘরের লক্ষী পায়ে টেলতে আছে! আমি জীবনেও ওকে আগ বাড়িয়ে ভালোলাগার কথা বলতে পারতাম না। এখনই তো ওর চোখের দিকে ভালো করে তাঁকাতে পারিনা; এরপর তো আর তাঁকাতেই পারবোনা”
“কেন জয়াদির চোখে বিজলী আছে নাকি যে তাঁকালে তোমার চোখ ঝলসে যাবে!”
“বিজলী বলিস কীরে! বল এটম বোমা! ওই চোখে তাঁকালেই বুকে বিস্ফোরন শুরু হয়ে যায়।”
“ভালোই তো। হ্যাঁ বলে দাও চট করে।”
“অনেক সমস্যা আছে”
“সমস্যার দোহাই দেয়া তোমার মানায় না।”
“দেখ এ জীবনে এ পাড়ার কতো জনেরই প্রেম-বিরহের গল্প আমার হাত দিয়ে লেখা হয়েছে। তাতে করে বুঝেছি প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে একটা দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার জায়গা তৈরি হয়ে যায়। নিজের মধ্যে রেসপনসিবিলিটি না থাকলে একটা সম্পর্কের ভার বহন করে চলা খুব কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। জবাবদিহিতা নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই। আসল সমস্যা হলো রেসপনসিবিলিটি। আমি আমার নিজেকে তো চিনি তাই যতো দুশ্চিন্তা।”
ঘন্টু মামার কথা শুনে আমি চূড়ান্ত বিষ্মিত। আমি বললাম, “এ কী গো মামা! তুমি এতো জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলছো যে!”
“জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বললাম কোথায়? এটা হচ্ছে প্র্যাক্টিক্যাল জ্ঞান। চোখের সামনে অনেককেই তো দেখছি তাই বললাম।”
“আমি এতোকিছু বুঝতে চাইনা। তোমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক হচ্ছে এটাই ফাইনাল কথা। আমি কালকেই জয়াদিকে বলে দেবো তুমি উনার প্রস্তাব গ্রহন করেছো। এবার চলো মান্নানের স্পেশাল আলুচপ খাওয়াবে।”
যাই হোক এভাবেই ঘন্টু মামা আর জয়াদির মধ্যে একটা সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। গত দেড় বছর থেকে দেখছি ওরা দুজন ভালো-মন্দের মাঝামাঝি একটা অবস্থানে বেশ কাটিয়ে দিচ্ছে। জয়াদি প্রতিনিয়ত ঘন্টুমামাকে ঘরমুখো রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু কোন প্রচেষ্ঠাই কাজ দিচ্ছেনা। ঘন্টু মামা আছেন ঘন্টু মামার মতো। যদিও অনেকের কাছেই ঘন্টুমামার কাজকর্ম নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো। তবে আমাদের কাছে ঘন্টু মামা ইজ দ্য বস। ঘন্টু মামাকে বাদ দিয়ে আমরা কোন কাজের কথা চিন্তাই করতে পারিনা।
ছবিঃ নেট থেকে সংগৃহিত।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন