|
স্বদেশ হাসনাইন
|
|
ছোট গল্প: আগন্তুক, ধূমপান ও গন্তব্য
19 January 2015, Monday
হরিণঘাটা থেকে লোকটা আমার পিছে পিছে আসছে। আমাকে ডাকলো। ঘাড় ঘুরাতেই বলল, সিগেরেটটা দেওয়া যাইবো?
কণ্ঠস্বরটা শুনে না করতে পারলাম না। বললাম, নেন।
ম্যাচ? তুমার ঠোঁটে ওইটা নিবা গেছে মনে হয়। আমি ওইটা পুরা নিভায়া ফিরা আবার জ্বালাই।
তুমি কি মদও খাও নাকি?
না খাইনা। তা, এত কথার কি দরকার। এই সময়ে আমি বিড়ি সিগেরেট কাউরে দেই না। আপনেরে দিলাম কারণ আপনাকে দেইখা মনে হইল আপনের জরুরী দরকার।
হা হা হা। আমার দিকে দয়া হইছে?
জ্বি না। দয়া না। বিড়ি সিগেরেট ছাড়া আমার নিজেরই দম বন্ধ লাগে। এর লাইগা বুঝবার পারি ধুয়ার ইচ্ছা পাইলে দুইনা কেমন লাগে। আমি নিজেই দুইটা শলা আনছি বহুত কষ্ট কইরা। এত রাইতে দোকানপাট সব বন্ধ হয়া যায়।
কথা বলছি আর বড় পায়ে হাঁটতে হাঁটছি। সহিসডাঙা চলে এসেছি। নির্জন জায়গার দু মাইল পরে আলো মিলবে। আমি হরিণঘাটা বাজারে আলকাতরার স্টোরে কাজ করি। দিনের রোদেও আন্ধারি কাজ..স্যাৎসাতে আর কদাকার ড্রামে আলকাতরা ঢালতে হয়! অনেক বার ধুয়ে ফেলার পরও পায়ের নিচে চটচট করে।
লোকটাও দ্রুত হেঁটে আমার পাশে চলে আসে। আকাশে আধখানি চাঁদ চড়ুই পাখির মত মেঘে ঢুকছিল আর বের হয়ে আসছিল।আবছা আলোয় দেখলাম একটা লম্বা আলখেল্লা। কাপড় নয় যেন চটের পোশাকে।
ডরাইতাসো নাকি? ঠাণ্ডা লাইগা গলা ভাঙ্গা। আমি যখন তোমার মতন জোয়ান আছিসলাম, থাকতাম নবীনগরে। দিলের ভিতরে রাইজ্যের সাহস কিন্তু পেটে অভাব! তারপরে এক ডোমের লগে থাইকা গোরের কাম শিখলাম। উস্তাদ ছিল আমার ফেরেস্তা। কইতো এই কামে ভাতের অভাব নাই। মরা শইল কামড়ায় না। মরা শইলের জোরও কম। কিন্তু মাইনষের যত ডর এদের নিয়া।
ঐ যে সহিসডাঙ্গা বেওয়ারিশ গোরস্তান ঐ খানেই কাম করতাম চাইর বছর। হাসপাতালের টেরাক আইসা আমারে খরব দিতো। কোন কোন দিন আরো লোকজনও থাকতো। কোন দিন একলা কোদাল চালাইতাম। আমার ভয়ডর হাসি কান্দা কিছু নাই। গোরচাপা দিয়াই জম্পেস বিড়ি ধরাইতাম। নগদ টেকা নিয়া বাড়িত গিয়া ডাইল দিয়া কচলাইয়া ভাত গিলতাম ।
আমার জানতে ইচ্ছে হল তার সম্পর্কে। লোকটা কি ইচ্ছে করে এসব বলছে ভয় দেখাতে! বললাম,
এখন কই থাকেন?
এখন আর কি করবো? মরার কোন খিদা নাই। কাইজকামের হিসাবও নাই। ইচ্ছা মত ঘুরি ফিরি। ঘুমাই। আসো পাইকুড় গাছের তলায় বসি। আমি তোমারে কিছু কথা কই। নাইলে নিচের ঢাল দিয়ে হাঁটি।
আমি সম্মতি জানাই, আমার বাইত যাওয়া দরকার। কালকে বিহানে কাম আছে বড় চালানের।
লোকটা আমার চেয়ে দ্রুত হেঁটে আমাকে সামনে এগিয়ে নিচ্ছে। তাকে অনুসরণ করে পাকা ইঁট বিছানো সড়ক থেকে নির্জন কাঁচা পথে চলে এলাম। কেন এলাম? কোথাও ভুল হচ্ছে আমার। এ নিশ্চয়ই খারাপ কেউ না। এই পথে বাড়ি ফিরি কম করেও সাড়ে পাঁচ বছর। এই পথে আমাকে ভুল ভাল নেয়ার উপায় নেই।
লোকটার মুখ দেখতে পারছি না।
আমার যে ভয় করছিল না - তা না। চাঁদের কিরণে সতর্ক থাকতে হয় তাই আন্দাজে পা ফেলি। একবার মনে হল এই ঢালে কেন নামাতে যাবে। কাদা থাকলে পা ডুবে যাবে। তখন যদি না উঠতে পারি?
আচ্ছা, তুমি কি মরা মানুষের ফিরা আসা বিশ্বাস করো না?
কি কন এইসব? মরা মানুষ কি ফিরা আসবো কেমনে? এই সবে আমার ডর নাই।
বিশ্বাস না করলেও এইটা হয়, মনু, দুইন্যায় যে কত কিছু ঘটে।
অচেনা মানুষের মুখে মনু নাম শুনে চমকে উঠে বললাম, ভাই, আপনি আমার নাম কোথ থেইকা জানলেন? আপনে কি আমারে আগ থাইকা চিনেন?
দেখলাম লোকটার মুখে সিগারেট নেই। আমি সাথে সাথে প্রশ্ন করি,
আপনেরে যে সিগেরেট দিসিলাম, শেষ কইরা ফেলছেন? ম্যাচ নিলেন ফিরা আগুন ধরানর লাইগা। ম্যাচটা দেন।
হা হা, হা। আবারও হাসি। লোকটা যেন আগুন না ধরানোর কারণে খুশি। দু পাশে গুল্মের কেপে উঠলো। লোকটা বলল,
মরা মানুষের সিগেরেট খাওয়াতে আগুন লাগে না। সিগেরেট ছাড়াই ভাল লাগতেসে।
আমি পাল্টা জবাব দিলাম - তা এত জোরে জোরে হাসেন কেন? বুঝাইতে চান যে আপনে মরা? এইভাবে হাসে পাগলা মানুষ!
মনু, তোমার মনে হয় মরা মানুষ নিয়া ধারণা কম। তুমি যেইদিন মরবা বুঝবা মরণের পরেও মানুষের স্বভাব বদলায় না।
আমার নামে সবাই চিনতো। আমি ডোম আসিলাম। মরা মানুষ চিনছি তখন থেইকা। কোনো দিন সুবে সাদেকের সময় ডাক পড়তো। ্আমি আসতাম। আঁন্ধারে একটা হারিক্যান পাশে রাইখা কাম করতাম। বাক্সের ভিতরে নয়া বউ যেমনে নাইয়র যাওনের সময় জামা পিরান ঢুকায় তেমন কইরা একটা একটা লাশ চাপা দিতাম। দুই দিন তিন দিন যাইতো আর কোন খবর নাই।
তারপরে এক বিষ্যুদবার খুশির খবর শুনলাম। ইস্টিমার ডুইবা গেছে। অনেক লাশ আসতাসে। টেরাক থামলো। মানুষ পঁচার ঘেরান চাইরা পাশে। তেরটা লাশ আমি নামাইছি। একটা লাশ গইলা গেছিল। মনে হয় কোন বাচ্চার। একটা জেনানার। ডোমেরা মানুষের বয়স বুঝে না। চরিত্র বুঝে না। তার কাম সবাইরে মাটি দিয়া সমান করা।
এই কামে যারা থাকে তাদের কিছুই লাগে না। খালি বিড়ি সিগেরেটের নেশা পায়।
শাওন মাসের মেঘলা দিন। আসমান ভাইঙ্গা পানি নামসে। ভিজা চুপ চুপ। একটা বিড়ির নেশায় আমি উচটান। আমি মরা লাশের শইল হাতাইলাম। মনে হইল কোন বড় ঘরের লোক। আহারে ফস্যা হাত। পকেটের মধ্যে টিনের একটা কৌট্টা। কতগুলান তাজা সিগেরেট।
ওস্তাদ কইতো, সিগেরেট জিনিসটা মরা মানুষ দেইখা বানানো। সিগেরেট য্যান সাদা কাগজের কাফন। চিতার মতন সেই জিনিস আগুনে জ্বইলা জ্বইলা ধুঁয়া হইয়া যায়।
যেই দিন আমি কারখানায় মরা কুড়িটা লাশ চাপা দিলাম কেমন যে একলা লাগলো। মনে হইল একটু আগেই বিরাট সংসারের ভিতর ছিলাম। একটা কাটা হাত গাছের মত পুঁইতা দিলাম। একটা সিনা, পা সুন্দর কইরা সাজায়া রাখলাম মাটির ভিতরে । সবাইকে মাটির ভিতর রাইখা আমার যেন কেউ থাকলো না।
আমি সেইদিন খোদার কাছে কইলাম একটা মানুষ আমারে দেও। সে আজ দোস্ত হইয়া আজীবন আমার সাথে থাকবো।
আমি অনুসরণ করে যাচ্ছি গল্প শুনতে।
পাইছিলেন তারে?
হ! তোমার মনে নাই মনু। সেই রাইতে তুমি আসতেসিলা। আরও কেউ ছিল সঙ্গে। তার বাদে পাশের মানুষটা চৌরাস্তার দিকে চইলে যাওয়ার পরে আমি তোমার কাছে গিয়া বললাম সিগেরেট দিতে। কোন কারণে তোমার মন অনেক খুশি ছিল। আমারে আস্ত সিগেরেটে প্যাকেট দিলা। অনেক কথা বললা।
কবে? আমি অস্বীকার করি, আমার মনে নাই ভাই। এই রকম সিগেরেট অনেকেই দেয়।
হু, বিষয় না। জানি । কিন্তু কবরের নিঝুম আন্ধারে আমি থাকি। আমার কথা বলার মানুষ নাই। তুমিও জানি পেটের খিদা মিটাইতে আলকাতরার দোকানে কাম করো। তোমার বাড়িতে কেউ নাই। আমি তোমারে আমার সাথে নিয়া যাবো। যাইবা কিন্তু, না করতে পারবা না।
আমি যেই গোরে থাকি, নিঠাণ্ডা, একটা মানুষ নাই সুখ দু:খের কথা কই।
আমি বলতে চাইলাম আমি যাবো না। কিন্তু বলা আর হলো না।
লোকটা জোর করতে থাকে,
আমার পিছে পিছে আসো আমি কোন কথা শুনবো না।
বললাম, আমার বাইত যাওয়া দরকার। পথ ঠিক করেন।
তুমি কি জানো, আইজকা বহুত ক্ষণ ধইরা শিমুলতলায় অপেক্ষায় আছিলাম তোমার জন্য,
আমার জন্য? কি বলে লোকটা। এ নির্ঘাৎ মাতাল বা পাগল!
আমি ম্যাচটা থাকলে ধরাতাম। মুখটা দেখলেই হতো। তাতে ভয় কমতো। কিন্তু লোকটা হয়তো কৌশলে সেটা নিয়ে নিয়েছে।
হুম, আমারে দেখছো না চক্ষুর কোটরে নাই, দাঁতের উপরে ঠোট নাই, নাক নাই । মরনের সুবিধা অনেক। এইসব কিছুই আর লাগে না।
আমি বললাম, জি না আমি আপনের কিছু দেখতে পাই না।
আবারও খুন খুনে হাসি হাসতে থাকলো। বলল,
মনু, আমার পুরা শইল খালি হাড্ডি আর হাড্ডি। বুকের পিঞ্জিরায় ফেঁফড়া নাই। কলিজা শুকায়ে খইসা গেছে। তারপরেও আমি সিগেরেট খাই। গলার নালিতে খালি হাড্ডি আর হাড্ডি । ওইটা দিয়ে ধৌঁয়া আর ঢোকে না।
আমি কোথাও ছুটে পালানোর উপায় খুঁজতে থাকলাম। একটু আলো পেলে জানতাম সড়কটা কোন দিকে। কিন্তু লোকটা আমাকে নিয়ে চলছে আর বাচালের মত বলেই যাচ্ছে।
ধোঁয়া গলার ভিতরে ঢুকলে কি লাভ, মনু, যেমন ভাত পেটে ঢুকলে কি লাভ? তারচেয়ে আমার মতন শান্তির জাগায় শুইয়া থাকবা। কাম নাই। পেরেশানি নাই। ভাই নাই । বাপ নাই। এইসব কিচ্ছু লাগে না।
আমি বোকার মত প্রশ্ন করি, আপনে ঠিক কন, আমারে কই নিবেন।
আমি সব দেখায়ে দিব। বলতে বলতে হঠাৎ লোকটার একটু উদাসীন কণ্ঠে বলে, আমারে বিশ্বাস করো, জায়গা খারাপ না।
আমি সহিসডাঙ্গা থাইকা দুই বছর আগে এক চা বাগানের ভিতরে কবর দেওনের কাম লইছিলাম। বিলাতি সাদা মানুষ কবরখানা। এদের মরা নাই। কবরখানায় খালি পাথরের বাগিচা। ওখানে যাইবার কয় মাস পরে আমি সাপের কামড় খাই। কালিগোখরা সাঁপ। বাঁচাইতে পারে নাই। একটা বড় ইচ্ছে আসিল সহিসডাঙাতে আমার লাশ যেন থাকে। কওনের সুযোগ পাইলাম আর কই!
সেই জন্য এইখানে আসি মাঝে মাঝে। একটা খোলা কবরে ঢুইকা নিজের হাতে গোর দেয়া মানুষগুলোকে স্বজনের মত ভাবি।
আমার পায়ের নিচের ভেজা মাটি টের পেতে থাকি। আমার পা চপ চপ শব্দ করে কাটা টানে। যেন চোরা বালির ভিতর দিয়ে আমি হাঁটছি। লোকটা চুপ। সে ছায়ার মত চলে। মাটিতে ডেবে যাচ্ছে আমার গোড়ালি। হাঁটু। এটা কি সেই চোরাবালির ঘাট?
আপনি কই?
আমি মানুষটাকে আর দেখতে পাচ্ছি না।
কই?
আমি কই আসলাম।
আছি, মনু, সব ঠিক আছে। তোমার সব ব্যবস্তা আমি কইরা রাখছি। আর একটু সামনে যাও। নাইলে চুপ থাকো। অসুবিধা নাই। আমি তো আছিই
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন