|
কলমের কালি শেষ
|
|
নীল রক্ত- শেষ পর্ব ( গল্প )
09 January 2015, Friday
চতুর্থ লগ্ন :
একবছর পর….
নিহানের বাবা শফিক সাহেব অবসরে চলে আসেন ।তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ভাড়া বাসা ছেড়ে একবারে বাড়িতে চলে যাবেন । দীর্ঘদিন হয় বাড়িটা অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে । সেই কবে বিল্ডিংটা মাত্র উঠানো শেষ হয়েছে তখনি চাকরির সুবাদে বাড়িতে তালা লাগিয়ে শহরে চলে আসি । এরপর মাসে ছয়মাস একবার দু’বার যাওয়া হয় । তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাড়িটা সুন্দর করে সাজাবেন ।এইদিকে নিহান এখন অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্র । তাকে হোস্টেলে বা মেসে দিয়ে যাবেন ।অবশ্য নিহান মা এই নিয়ে নারাজ । তিনি ঝগড়া শুরু করে দেয় শফিক সাহেবের সাথে । তিনি বলেন নিহানের পড়াশোনা শেষ হওয়া পর্যন্ত থাকতে । শফিক সাহেব একটা লেকচার জুড়ে দেন নিহানের মাকে ।তিনি বলেন আমার এখন মাসিক ইনকাম নাই । এখানে ভাড়া বাসা নিয়ে থাকলে আমার অবসরে পাওয়া টাকাটায়ও খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাবে । তাছাড়া আমিও তো মেসে থেকে পড়াশোনা করেছি । নিহানের মত অনেক ছেলেই মেসে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছে । হোস্টেলে আর মেসে থাকলে সবাই অমানুষ হয় না । তাছাড়া নিহানের এখন খারাপ হওয়ার সেই বয়সও নেই । বলো যে তুমি যেতে চাও না এই শহর ছেড়ে আমার অজপাড়াগায়ের বাড়িটায় ।
- যাও তোমার যা ইচ্ছা তাই করো ! একথা বলে রাগে গরগর করতে করতে নিহানের মা সেখান থেকে প্রস্থান করে ।
নিহানদের বাড়িতে চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে । তারা বাড়িতে যাওয়ার জন্য ঘরের মালপত্র গোছগাছে ব্যস্ত । নিহান তার আম্মাকে বলে,
- আম্মা, আমার এস এস সি এবং এইচ এস সি এর কাগজপত্র গুলো কোথায় রাখছ ? ওইগুলা আমি রেখে দেই । আমার কাছে দাও ।
- আলমারিতে দেখ । আলমারির ভেতর একদম নিচে কর্ণারে ছোট একটা ড্রয়ার আছে ওটাতে দেখ । রান্নাঘরে সন্ধ্যাকালীন রান্নায় ব্যস্ত থাকা মায়ের উত্তর ।
নিহান আলমারি খুলে দেখতে যায় । আলমারির নিচের ড্রয়ারটা চাবি দিয়ে খুলে দেখে ওখানে কাগজের কয়েকটা প্যাকেট রাখা আছে ।প্যাকেটগুলো খুলে দেখছে কোনটায় তার কাগজপত্রগুলো রাখা আছে । একটা খুলে দেখে ওখানে কতগুলো স্ট্যাম্প রাখা । ওদের জায়গা জমির দলিলপত্র ।কৌতুহলবশত সেটা খুলে নিহান ।সে আরও কৌতুহল নিয়ে দেখে তাদের জমিজমা কিরকম আছে । কাগজগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে হঠাৎ দেখে একটা স্ট্যাম্প পেপারে তার নাম লেখা । সে কাগজটা বের করে ভালো করে পড়তে থাকে ।সে স্ট্যাম্প পেপারে লেখা দেখে, মোসাম্মৎ সাহেরা খাতুন, বয়স: ৩৫, নামক এক মহিলা থেকে নিহানের আজীবন সন্তান মালিকানা বুঝে নেয় তার মা বাবা ।মহিলাটি ক্লীন ক্লিনিকের একজন নার্স ।যেখানে তার আব্বার ডাক্তার বন্ধু মুহিত আঙ্কেলও বসেন ।স্ট্যাম্পের ইস্যু তারিখ আর তার জন্মতারিখও সমান । সাক্ষী হিসেবে নাম আছে তিনজনের একজন তার মুহিত আঙ্কেল আর দুইজন ওই ক্লিনিকেরই নার্স ।
নিহান তার বা্বার দিকে তাকায় । বাবা রুমের অন্যপাশে কি কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটিতে ব্যস্ত । নিহান স্ট্যাম্প পেপারগুলো প্যাকেটে রেখে দিয়ে ড্রয়ার লাগিয়ে তার সার্টিফিকেটগুলো নিয়ে আস্তে করে তার রুমে চলে আসে ।রুমে এসে তার ডায়েরীতে সাহেরা খাতুনের মুখস্থ করে আসা বর্তমান এবং স্থায়ী ঠিকানা টুকে রাখে ।এইগুলো লেখতে লেখতে নিহানের হাত পা কাঁপতে শুরু করে । এতক্ষন সে প্রায় বাকরুদ্ধ ছিল । এখন যেন তার বোধশক্তি ফিরে আসা শুরু করেছে । সে এসব কি দেখেছে ? তার কাছে কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না । সে তার মা বাবার আসল সন্তান নয় এই ভাবতেই সে যেন মস্তিস্কের নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলছে । সে ওই নার্সের সন্তান তার মাথায় শুধু সেটাই বাজছে ।নিহান নিজেকে কিছুতেই বোঝাতে পারছে না । তার মাথার রগগুলোর ভেতরের রক্ত তীব্র গতিতে উঠানামা করছে । সে বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে পড়েছে । সে চোখগুলো দিয়ে অপলক তাকিয়ে কি যেন দেখছে ।আর জপতে থাকে আমি কে ! আমি কে !... নিহানের এই অবস্থা দেখে তার মা বাবা অলরেডি তার পাশে বসে আছে । তারাও অস্থির হয়ে আছেন । সুস্থ ছেলের হঠাৎ কি হল তারা বুঝতে পারছে না ।নিহান জপতে থাকে আমি কে !আর নিহানের মা উত্তর দিতে থাকে তুই আমাদের সন্তান, তুই আমাদের সন্তান…. ।একসময় তার মায়ের উত্তর দেওয়া বন্ধ হয়ে যায় । তার মা তার পাশে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেছে । কিন্তু নিহান এখনো জপে যাচ্ছে আমি কে ! আমি কে !... সারারাত সে দুচোখ খোলা রেখে এইভাবেই কাটিয়ে দেয় ।ভোর হতে নিহান পাশে ফিরে দেখে তার মা শুয়ে আছে ঠিক ছোটবেলায় তার সাথে যেভাবে শুয়ে থাকতো সেইভাবে । মায়ের দিকে নিহান কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে তারপর পাস কাটিয়ে উঠে পড়ে ।মুখে পানি মেরে সে বারান্দায় গিয়ে দাড়ায় । সে বাহিরে দেখছে মা পাখির সাথে তার ছানা দুটো উড়ছে, রাস্তায় দেখছে পিচ্চি মেয়েটাকে তার বাবা হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে । সে আরও দেখছে এলাকার পেটফোলা কুকুরটি সদ্য প্রসব করা বাচ্চাগুলো নিয়ে রাস্তার ধারে মাঠের কর্ণারে বসে আছে । পুরুষ কুকুরটি আসে পাশে ঘুরছে ।
- কিরে বাপ তোর শরীর ভালো লাগছে ? পেঁছন থেকে তার মা ডাক দেয় ।
- ভালো লাগছে । নিহান উত্তর না দেয়ার মত করে বলে । নিহানের আম্মা কাছে এসে তার কপালে ঘাড়ে হাত দিয়ে দেখে ।
- নাহ এখন তো জ্বর আছে বলে মনে হচ্ছে না । শোন আমি তোর জন্য গরম পানি দিচ্ছি । ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নে ।দেখবি আরো ভালো লাগবে ।
নিহান কিছু না বলে বাহিরের দিকে তাকিয়ে থাকে ।নিহানের মা রান্না ঘরে চলে যায় ।
পঞ্চম লগ্ন :
নিহান সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে তার আসল মায়ের সাথে যোগাযোগ করবে । ক্লিন ক্লিনিকের নার্স মোসাম্মৎ সাহেরা খাতুনের সাথে । কিন্তু সে বিষয়টা কাউকে জানতে দেবে না । তাই সে তার ডাক্তার আঙ্কেলের সাথে যোগাযোগ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কারন তার থেকে বিষয়টা মা বাবা জেনে যেতেই পারে ।ক্লিনিকে ডাক্তার আঙ্কেল বসেন সন্ধ্যায় তাই নিহান সকালের দিকে ক্লিনিকে যায় সাহেরা খাতুনের খোঁজে । কিন্তু ক্লিনিকে খোঁজ নিয়ে দেখে তিন বছর আগেই সাহেরা খাতুন চাকরি থেকে চলে যান ।তখন সে যায় স্ট্যাম্পে লেখা বর্তমান ঠিকানা ধরে । সেখানে খোঁজ নিয়ে দেখে এইখান থেকেও তিন বছর আগে বাসা ছেড়ে চলে যান । কিন্তু কোথায় গেছেন কেউ বলতে পারেন না । নিহান হতাশ হয়ে চলে আসে । সে এখন চিন্তা করছে স্থায়ী ঠিকানায় যাবে কিনা । সেখানে গেলে তাকে না পাওয়া গেলেও তার পরিবার থেকে অন্তত জানা যাবে সে কোথায় আছে ।যেই ভাবা সেই কাজ । সকাল সকাল তার আম্মা থেকে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার নাম করে কিছু টাকা নিয়ে বের হয় । সে আসতে সন্ধ্যা হবে এও বলে যায় । নিহানের আম্মা অন্য সময় হলে তাকে যেতে দিত না । কিন্তু এই কয়দিন ছেলের অবস্থা দেখে যেতে দেন ।তিনি ভাবছেন হয়তো তাকে আমরা শহরে একা রেখে চলে যাব বলে তার মন ভালো নেই । বন্ধুদের সাথে ঘুরলে তার হয়তো মন ভাল লাগবে ।
নিহান খোঁজ নিয়ে দেখে সাহেরা খাতুনের স্থায়ী ঠিকানা শহর থেকে অনেক দূরে এক প্রত্যন্ত অজোপাড়া গাঁয়ে ।প্রায় চার ঘন্টা বাস জার্নি এবং এক ঘন্টা কাঁচা রাস্তায় হাঁটা । অনেককে জিজ্ঞেস করতে করতে শেষ পর্যন্ত সাহেরা খাতুনের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় নিহান ।নিহান দেখে বাড়ির মুখে সাদা কাপড় পড়া এক তরুনী দাঁড়িয়ে আছে । তার কোলে চার পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা ।তার নাকে মুখে লালা আর কফ মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে ।নিহান তরুনীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
- এইটা কি সাহেরা খালার বাড়ি ?
- আপনি কিডা ? তরুনী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে ।মনে হচ্ছে যেন সে নিহানের মত পরিপাটী সাজগোজের ছেলে সে আগে কখনো দেখেনি ।
- আমি শহর থেকে এসেছি । সাহেরা খালা যেখানে চাকরি করতেন সেখান থেকে । নিহান একটু কায়দা করে বলে ।
- ও আইচ্ছা । মেয়েটি একটা বেতের আধভাঙ্গা মোড়া এগিয়ে দিয়ে নিহানকে বসতে বলে ।
- আপনে এহানে বসুইন । আম্মা গোসলে গেছেইন ।
- ও আচ্ছা । আপনি কি উনার মেয়ে ?
- না ছাহেব আমি উনার বেটার বউ ।
- হ্যা, ওনার ছেলে কোথায় ? কি করে ? নিহানের প্রশ্নটা শুনে মেয়েটা এদিক ওদিক তাকাতে থাকে ।
- আপনে বসুইন । আম্মা চইলা আসপেনে । এই কথা বলে মেয়েটা ঘরে চলে যায় ।
নিহান তখন বুঝতে পারে মেয়েটাকে সাদা কাপড় পড়া দেখেও তাকে এই প্রশ্ন করা তার একদমই উচিত হয়নি । সে মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দেয় ।
- আপনি কে ? প্রশ্নটি শুনে নিহান পেঁছনে তাকায় । সে দাড়ায় ।
- জ্বি আমি নিহান । শহর থেকে আসছি ।
- তা তো দেখেই বুঝতে পারছি আপনি শহরের লোক ।তো কাকে খুঁজতে আসছেন ?
- জ্বি আমি সাহেরা খালার সাথে দেখা করতে আসছি ।
- আপনি কি উনাকে চেনেন ?
- জ্বি না । এই প্রথম দেখবো ।
- ও আচ্ছা । আমিই সাহেরা । বলেন আমার কাছে কি প্রয়োজন ? নিহানের চোখ উনার দিকে আঁটকে যায় ।সে দম ধরে তাকিয়ে থাকে সাহেরা খাতুনের দিকে । সে ভাবতে থাকে এই বুঝি তার আসল মা ।
- কি হলো কিছু বলছেন না কেন ? প্রশ্ন শুনে নিহানের ঘোর কাটে ।
- ও হ্যা.. আপনার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে ।নিহান তড়িঘড়ি করে বলে ।
- বেশী গুরুত্বপূর্ণ ?
- জ্বি ।
- তাহলে আপনি কষ্ট করে আরেকটু অপেক্ষা করেন ।আমি জোহরের নামাজটা সেরে আসি । সময় চলে যাচ্ছে ।
- জ্বি আচ্ছা ।
সাহেরা খাতুন ঘরের দিকে যেতে যেতে তিনি আবার পেঁছনের দিকে তাকিয়ে ছেলেটিকে দেখেন । তিনি ছেলেটার নাম শুনেই চিনে গেছেন । তিনি ভয় পাচ্ছেন ছেলেটা এখানে কেন আসছে ? ছেলেটাকি তাহলে সব জেনে গেছে ? সাহেরা খাতুন এই সব প্রশ্ন নিয়ে জোহরের নামাজ পড়তে গেছেন ।
নিহান উঠানের কোনে বসে বসে এদিক ওদিক দেখছে । উঠানে এক মা মুরগি তার বাচ্চাদের ডানার নিচে ঢুকিয়ে একসাথে ভাতঘুম দিচ্ছে । নিহানকে এইসব দৃশ্যগুলো খুব পীড়া দিচ্ছে । তার এখনকার মা বাবাও তাকে আসল মা বাবাদের মতই আদর যত্নে বড় করেছেন । কিন্তু স্ট্যাম্পটা দেখার পর থেকে তার এইসব কিছুই অনুভব হচ্ছে না ।তার কাছে উনাদেরকে অনেক পর মনে হচ্ছে । সে অনুভব করছে শুধু তার জন্মধাত্রীর কাছে যাওয়ার আকুলতা ।
- এই যে নেউন যে বেলের শরবত । মেয়েটির কথায় নিহান ঘোর কেটে তাকায় । সেই সাদাকাপড় পড়া মেয়েটি ।শরবতটা দেখে নিহানের খেতে ইচ্ছে করছে । তার অনেক তৃষ্ণা পেয়েছে । সে শরবতটা হাতে নিতে নিতে বলে-
- আমি দুঃখিত আপনাকে ভুলে প্রশ্নটি করে ফেলায় ।
- ইটস ওকে সমেস্যা নেই ।নিহান মেয়েটির মুখে ইংরেজি বাক্যটি শুনে তন্দ্রা খেয়ে যায় ।
- আপনিতো দেখি ইংরেজিও জানেন ।
- একটু আধটু জানি । আম্মার থেকে শিখছি । উনি শহরে চাকরি করার সময় শিখেছিল ।
- ও আচ্ছা ভালো । আচ্ছা উনার ছেলের কি হয়েছিল ?
- কই কিছুই হয় নাই ।
- তাহলে আপনি যে…. নিহান আশ্চার্য্য হয়ে জিজ্ঞেস করে ।
- আমার সোয়ামী আমার লগে অভিমান কইরা গলায় ফাঁস নিচে । তাতে মাইসের কি ? মেয়েটি অন্যদিকে মুখ ভার করে তাকিয়ে এসব বলতে থাকে । নিহান অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে এই মেয়ে কি বলে !!
- রুপালি তুই এইখানে কি করছ ? যা ঘরে যা । সাহেরা খাতুন চেঁচাতে থাকে । মেয়েটা ঘরে দিকে দৌড়ে চলে যায় । নিহান মেয়েটির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে ।
- জ্বি নিহান সাহেব আপনার কি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন ।
- আমি আপনার ছেলের মত আমাকে তুমি করে বললেই খুশি হবো ।
- আচ্ছা ঠিক আছে বলো ।
নিহান সাহেরা খাতুনের কাছে সবকিছু বিস্তারিত জানতে চায় । কিন্তু সাহেরা খাতুন উল্টো রেগে গিয়ে বলে,
- কি সব উল্টাপাল্টা বলছেন ।আপনি আমার ছেলে ? এর মানে কি ? আপনি এসব কি বলছেন ? আপনি আমার বাড়ি থেকে দূর হন, যান !সাহেরা খাতুনের এমন গরম কথা শুনে নিহান উঠে বের হয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় । নিহান যাওয়ার সময় বলে,
- দেখুন খালা আমি আপনার সাইন করা সেই স্ট্যাম্প পেপারটি নিয়ে থানায় যাব ।ওখানে লেখা আপনি আমাকে বিক্রী করেছিলেন । কারন আমার কাছে সত্য জানাটা খুব জরুরী ।
- আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন ?
- মনে করেন তাই দেখাচ্ছি । এই কথা শুনে সাহেরা খাতুন একটু নরম হয়ে বসেন । তিনি বলতে থাকেন,
- দেখ নিহান তোমার জন্মধাত্রী কে সেটা আমি জানি না তবে তোমাকে কোথায় পেয়েছি সেটুকু আমি বলতে পারি । কিন্তু শুনে তুমি হজম করতে পারবে কিনা জানি না ।
- আমি এখন পর্যন্ত অনেক কিছুই হজম করেছি । আপনি যতটুকু জানেন ততটুকুই বলুন ।
- আমি তখন ক্লিনিকে নাইট ডিউটিতে ছিলাম । হঠাৎ শরীরটা একটু অসুস্থবোধ করি । বাসা কাছে থাকায় ছুটি নিয়ে বাড়ির দিকে বের হই । তখন প্রায় রাত দুইটা আড়াইটা হবে ।আমি হাঁটতে হাঁটতে যখন পাইপলাইন পয়েন্টের পাশে রাস্তার কিনারে পড়ে থাকা ডাস্টবিমটার কাছে আসি তখন দেখতে পাই ডাস্টবিমের পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা ময়লার পাশে টাওয়ালে মোড়ানো একটা স্তূপ । আগ্রহ নিয়ে কাছে গিয়ে দেখি একটা অপরিপক্ক বাচ্চা পড়ে আছে । সাথে সাথে হাতে উঠিয়ে নেই । দেখে মনে হয়েছিল ফেলে গেছে যে বেশীক্ষন হয়নি ।তখনো বাচ্চাটির গায়ে মায়ের পেটের ঘন পানীয়গুলো লেগে আছে । তবে যে ফেলে গেছে সে একটু দয়াবানই ছিল বটে বাচ্চাটাকে ছুড়ে না ফেলে আলতো করে রেখে গেছে ! আমি বাচ্চাটি নিয়ে দ্রুত ক্লিনিকে ফিরে যাই । তখন ডিউটি ডাক্তার ছিলেন ডঃ মুহিত স্যার । তিনি তাড়াতাড়ি বাচ্চাটিকে পরীক্ষা করে দেখেন । তিনি দেখেন তখনো অপরিপক্ক বাচ্চাটির হৃদযন্ত্র কাজ করছে । তিনি তাড়াতাড়ি বাচ্চাটিকে নিবিড় পর্যবেক্ষনে পাঠিয়ে দেন । তারপর ডাঃ মুহিত সাহেব তোমার আব্বা আম্মাকে ফোন করে বিষয়টি জানায় । এর তিনমাস পর আমাকে তোমার মা বানিয়ে উনারা তোমার মালিকানা হস্তান্তর করে নিয়ে যান । আমি আর এর থেকে বেশী কিছু জানি না । সাহেরা খাতুন বলেন ।
নিহান কথাগুলো শুনে সাহেরা খাতুনকে কোন রকম ধন্যবাদ দিয়ে উঠে হাঁটা শুরু করে । আজকে দিনের জন্য সে অনেক শুনেছে । সাহেরা খাতুন নিহানের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে তারপর বিড় বিড় করে বলতে থাকে আল্লাহ এই তোমার কেমন লীলাখেলা !
ষষ্ঠ লগ্ন :
নিহান সাহেরা খাতুনের বাড়ি থেকে বের হয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে । সে যে হাঁটছে সেটাও তার মাথায় নেই । সে শুধুই হাঁটছে । কোনরকম মেইন রাস্তায় এসে বাসের টিকেট কেটে বসে পড়ে । পুরো পথ তার মাথা পাগলা ঘোড়ার মত ছুটতে থাকে । সে শুধু ভাবতে থাকে এই কেমন জীবনের মধ্যে সে পড়েছে ! তার চিন্তা চেতনায় এখন শুধু কিছু অভিশপ্ত প্রশ্ন । সে কি গর্ভ পরিতেক্তা ? সে কি কারো পাপের ফল ? সে কি অভিশপ্ত সন্তান ? এইসব ভাবনায় জুড়ে সে যে কখন শহরে চলে আসে তা বেমালুম ভুলে গেছে । বাসের হেল্পম্যানের ডাকে তার তন্দ্রা ভাঙ্গে ।সন্ধ্যা প্রায় হয়ে গেছে । সে বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসার দিকে রাস্তার কিনার ঘেসে হাঁটতে থাকে । হাঁটতে হাঁটতে সে ওই ডাস্টবিমটার নিকট চলে আসে । সে থমকে দাঁড়ায় জায়গাটার সামনে । সে ডাস্টবিমের পাশে তাকিয়ে থাকে । প্রায় দেড়বছর আগে নিহান ঠিক এইখানটায় এক মহিলাকে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পায় । তাহলে কি সব পাপীরা নিস্পাপদের এইখানে ফেলে যায় ? তার মথায় শউধুই অভিশপ্ত প্রশ্নগুলো বারবার জেগে উঠছে । জেগে রিতিমত তীব্র জোয়ার তুলে দিচ্ছে । সে এখনো হাঁতড়ে বেড়াচ্ছে কে সেই অভিশপ্ত মা ? কে সেই মহাপাপী যার পাপের ফল নিস্পাপকে ডাস্টবিমে এমন নির্মমভাবে ফেলে যায় ?
হঠাৎ করে তার মনে পড়ে যায় ডঃ গোপালের প্রশ্নগুলোর কথা । ডাঃ গোপাল তাকে তার চেম্বারে ডেকে কয়টা প্রশ্ন করেছিল । নিহান জোরে জোরে হাঁটতে শুরু করে । কিছুদূর গিয়ে রিকসা নিয়ে ডাঃ গোপালের চেম্বারের দিকে যেতে থাকে ।চেম্বারে গিয়ে দেখে তিনি রুগী দেখছেন । তেমন একটা রুগী নেই । নিহান বাহিরে অপেক্ষা করছে । ডাঃ গোপাল যখন ফ্রি হলেন নিহান ভেতরে ঢুকে ।
- কি সমস্যা বলুন ? ডাঃ গোপাল প্রেসক্রিপসান খাতা আর কলম সামনে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন ।
- জ্বি না আঙ্কেল আমি রুগী না । আমি অন্য একটা কাজে আসছি ।
- কি কাজ ?
- আমাকে আপনি চিনতে পারছেন না ! আমি নিহান !
- কোন নিহান ? ডাঃ গোপাল কিছুক্ষন নিহানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ।
- ওই যে মতিন সাহেবের স্ত্রীর কেস এর নিহান ! নিহান অবাক হয়ে বলে । নিহান জানতো ডাক্তারদের মেমোরী খুব স্ট্রং কিন্তু ডাঃ গোপালের মেমরীর এই অবস্থা কেন !
- কোন কেস ?
- আরে প্রায় দেড় বছর আগে মতিন সাহেবের স্ত্রী….
- হ্যা ! হ্যা ! মনে পড়ছে । ডাঃ গোপাল নিহানের কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে । তিনি জিজ্ঞেস করেন,
- কি দরকার বলো ?
তারপর নিহান সব বিস্তারিত ডাঃ গোপাল সাহেবকে বলে । যদিও ডাঃ গোপাল ডাঃ মুহিত আর মতিন সাহেবের স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করে সকল ধাঁধার উত্তর অনেক আগেই পেয়ে গেছেন ।নিহান যেহেতু প্রায় সব জেনেই গেছে তাই ডাঃ গোপাল আর কিছু লুকাতে চাইলেন না । তিনি নিহানকে সব উত্তর বলে দেন । নিহান সবকিছু শোনার পর কোন প্রতিক্রিয়া ছাড়াই ডাঃ গোপাল থেকে মতিন সাহেবের বাসার ঠিকানা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ।সে সোজা মতিন সাহেবের বাসার দিকে রওয়ানা দেয় । কলিং বেল চাপতেই কাজের মেয়ে এসে দরজা খুলে দেয় । নিহান ঢুকে দেখে মতিন সাহেব ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছেন ।
- আরে নিহান যে ! তুমি কেমন আছো ? নিহান ভাবতে থাকে এই লোক এখনো আমাকে মনে রেখেছে !
- জ্বি আঙ্কেল ভালো আছি । আপনি কেমন আছেন ?
- এইতো মোটামুটি আছি আরকি ।
- আঙ্কেল আসামীরা ধরা পড়ছে ?
- ধরা পড়ছে মানে ! সবগুলো ধরা পড়ছে । এখন সাজা খাটছে । নিহান জানতো ওরা ধরা পড়বে কারন মতিন সাহেব অনেক প্রভাবশালী ব্যাক্তি ।
- তাহলে তো অনেক ভালো ।
- হ্যা । নিহান এই নিয়ে আমি তোমাকে অনেক অপমান অপদস্ত করেছি । আমার ওইসব করা মোটেও ঠিক হয়নি । তুমি আমাকে মাফ করে দাও । মতিন সাহেব খুব অনুতপ্তের সাথে বলে ।
- ইটস ওকে । নো প্রবলেম আঙ্কেল । আঙ্কেল আন্টি কেমন আছেন ?
- এই তো মোটামুটি ।
- ওনি কোথায় ?
- বারান্দায় বসে আছে ।
- একটু দেখা করা যাবে ?
- হ্যা হ্যা যাও ।মতিন সাহেব তড়িঘড়ি করে বলেন ।
নিহান বারান্দার দিকে যায় । সে দেখে বারান্দায় উষ্কখুষ্ক চুলে এক মহিলা বসে আছেন । মুখটা বারান্দার গ্রীলের সাথে লাগিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছেন । একপাশের চেহারায় মলিনতার তীব্র ভাব ফুটে আছে । পাশে টেবিলের উপর গ্লাসে লালপানি ঢালা আছে । পাশে বোতলও আছে । নিহান এই অবস্থা দেখে আর কিছু না বলেই প্রস্থান করছিলো ।
- নিহান ।
হঠাৎ পেছন থেকে ডাক আসে । নিহান ফিরে তাকায় । মহিলাটি হাতের ইশারায় তাকে কাছে ডাকছে ।নিহান কাছে গিয়ে দাঁড়ায় । মহিলাটি তার খুব কাছে এসে দাঁড়ায় । তাকে খুটিয়ে খুটিয়ে কি যেন দেখছে । ময়লা জমানো নখওয়ালা হাত দুটো দিয়ে নিহানের মুখটি স্পর্শ করছে । এমনভাবে করছে যেন তার হাত দিয়ে নিহানের মুখটি মাপছে । এইবার মহিলাটি লালছে হওয়া চোখ দুটো দিয়ে নিহানে চোখে চোখে তাকায় । মহিলার চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে । তিনি বলেন তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও । নিহান মহিলাটির হাত দুটো ছাড়িয়ে চলে আসতে থাকে । সে আর কোন কাহিনী শুনতে চায় না । সে জানে মহিলাটি কি বলবে । সে এখানে এসেছে শুধু তার অভিশপ্ত মাকে একটু দেখতে কোন কাহিনী শুনতে নয় । সে দেখতে এসেছে তার পাপীকে ।নিহান শুধু তাকেই ধিক্কার দেয় না সে যার তরল থেকে নিঃস্বরিত হয়েছিল তাকেও তীব্র ধিক্কার দেয় । এই পৃথিবী তাদের ক্ষমা করবে না ।একজনকে নিজ চোখেই দেখছে সে যার বেঁচে থাকাটাই এখন সবচেয়ে বড় শাস্তি । আর আরেকজন কোথায় আছে নিহান তা জানেনা । তবে তার মন তীব্র ঘৃণায় বলে যাচ্ছে সেও যেন বেঁচে থাকার মাঝেই শাস্তি ভোগ করে । তবুও নিহানের কাছে মনে হচ্ছে এই শাস্তি তাদের পাপের জন্য নেহাতই কম হয় । নিহান দরজা খুলে বেরিয়ে যায় । মতিন সাহেব তার বেরিয়ে যাওয়া দেখলো । তার মনের ভেতর এইরকম একটা ছেলে থাকার আকুতিতে হাহাকার করে উঠে ।
সপ্তম লগ্ন :
নিহান বাসায় চলে আসে । দরজায় কলিং বেল চাপতে গিয়েও চাপে না । তার কাছে এই ঘরকে অনেক অচেনা মনে হয় । সে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চলে যায় । সে এই বিল্ডিংয়ের সর্বোচ্চ চূড়া পানির টাঙ্কিটার উপর উঠে বসেছে ।সে যেন চাইছে আকাশের ওই মেঘ হয়ে বৃষ্টির জলাধারায় মিশে যেতে । তার মা বারবার ফোন করছে । নিহানের সে দিকে কোন খেয়াল নেই । নিহানের চোখের বৃত্তাকার কালো অংশ যেন আরও কালো হয়ে আসছে । আরও অন্ধকার হয়ে আসছে । তার কাছে মনে হচ্ছে তার শরীরে প্রবাহিত রক্ত লাল নয় । নীল । গাঢ় নীল ।
কিছু ঘটনা থাকে যেগুলো জানতে নেই ।অজানা থাকাই তাদেরকে মানায় । কিন্তু নিহান সেইরকমই একটি ঘটনা প্রদক্ষিণ করে ফেলেছে ।সে জানে না কখন সে এই নিগূঢ় অন্ধকার থেকে ভোরের কাছে ফিরে যাবে….
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন