|
শিরিছ কাগজ
|
|
আমি সাগরের স্পর্শ চাইনি… কিন্তু তারপরও সে আমাকে ছুঁয়ে দিয়েছে
01 January 2015, Thursday
মিরপুর ভাষানটেক মেঝো চাচার বাড়ি এসেছি। উদ্দেশ্য- কম্পিউটারের হার্ডড্রাইভারগুলো ডাউনলোড করা আর নিজের সাইট দুইটা আপডেট করা। বেশ অনেক দিন থাকা হলো। এর মধ্যে একদিন মুকুল ভাই –চাচার বড় ছেলে- প্ল্যান করল কক্সবাজার যাবে এবং অবশ্যই একা যাবে না। কয়েকজন নিয়ে যাবে। আমাকে বলল যেতে। আমি না করে দিলাম। কিন্তু পরে এমন একটা সিচুয়েশন তৈরী হলো যে, বাধ্য হয়ে যেতে হলো। কোন সিচুয়েশন বা পরিস্থিতির কারণে খুব সহজে আমি বাধ্য হই না। কারণ আমি প্রচুর পরিমাণের চা প্রচুর পরিমাণে লিকার দিয়ে খাই। যে কারণে তেল দেয়া এবং নেয়ার ব্যাপারটা নাই বললেই চলে। পরিস্থিতিটা আমাকে বাধ্য করেছিল।
শুধু ঘুরার জন্য- যেটাকে বলে সফর বা ট্যুর, শুধু এ উদ্দেশ্যে কখনও আমি ঘর থেকে বের হইনি। আত্মীয়দের বাসায় গিয়েছি বেড়াতে। চিটাগাং বড় খালার বাসায় গিয়েছি। সেখান থেকে সবার সাথে পতেঙ্গা গিয়েছি। কিন্তু পতেঙ্গা যাবার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হইনি। খালার বাসার উদ্দেশ্যে বের হওয়া। তারপর সবার সাথে পতেঙ্গা।
তেমনি স্রেফ কোন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখার জন্য কথনই ঘর থেকে বের হওয়া হয়নি। এ কারণে মুকুল ভাই যখন গাড়ি স্টার্ট দিল, তখন অবাক হয়ে নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম- ওয়াও ম্যান, তুমি কক্সবাজার যাইতেছ শুধু ঘুরার জন্য! পারও তুমি আল্লায় দিলে! এতই যখন ঘুরার শখ, পাঙক্ষার সাথে দড়ি দিয়া ঝুইল্লা আরেকজানরে বল্লেই পার- ভাই, অনুগ্রহ পূর্বক পাঙক্ষাটা ছাইড়া দেন, কারণ আমি ঘুরতাম চাই। এত কষ্ট করে কক্সবাজার যাওয়ার দরকার কি!
কিন্তু পৃথিবীর সবচে’ বড় সমুদ্র সৈকতে এসে যখন দাঁড়ালাম, তখন মনে হলো যে- না, দরকার আছে। এতই দরকার যে, পৃথিবীবাসীর প্রতি স্রষ্টার সর্বশেষ বার্তাগ্রন্থে সফরের আদেশও করা হয়েছে, তা-ও একাধিকবার।
বিশাল সমুদ্রটার সামনে এই ছোট্ট আমি যখন গিয়ে দাঁড়ালাম, বিস্ময়ে মুচকি একটু হেসেই ফেললাম। বিকট গর্জন আর সমুদ্রের বুকে জায়গা না হওয়া উপচে পড়া একেকটা ঢেউ- প্রথম সমুদ্রের সামনে যে কোন হৃদয়ের স্পন্দনে একটু ছন্দ-পতন হতেই পারে। এটা কোন ব্যাপার না।
কিন্তু আমি সমুদ্রে নামিনি। কেড্স পড়ে ছিলাম, এক কাপড়ে গিয়েছি- এ জন্য না। ইচ্ছে করেনি, তাই নামিনি। জীবনের প্রথম এত্ত বিশাল একটা সমুদ্রের এত্ত কাছাকাছি এলাম, অথচ আমার প্রিয় মানুষগুলোর কেউই আমার পাশে নেই। আব্বু আম্মু ভাইয়া ছোট বোনটা, আমার বন্ধুরা- কেউ না। তাই সাগরকে দেখে ভাল লাগার পরিবর্তে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই সাগর আমার আগেও ছিল পরেও থাকবে। কিন্তু জীবন যখন আমার হৃদয়ে যন্ত্রণার সবগুলো নখ বসিয়ে দিচ্ছিল, তখন আমার প্রিয় মানুষগুলো আমাকে জড়িয়ে রেখেছিল পরম ভালবাসা ও বিশ্বাস দিয়ে। বিশাল পৃথিবীর এই ক্ষুদ্র সাগর তখন আমার পাশে ছিল না। তাই তাকে দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি, কিন্তু মুগ্ধ হইনি। অবাক হয়েছি, কিন্তু আভিভূত হইনি। তাই সাগরকে আমি স্পর্শ করিনি, সাগরকেও দিইনি আমাকে স্পর্শ করতে। যখনই সাগরের ঢেউগুলো আমার কাছে আসত, আমি দূরে চলে যেতাম। কারণ আমার হৃদয়ের যে সাগর আর তাতে আনন্দ ও বেদনার যে ঢেউ, এই সাগরের ঢেউ তো সেখানে অল্পতেই হারিয়ে যাবে।
কিন্তু আমার এক কাজিন যখন কয়েকটি শামুক ধুয়ে দিতে বলল, তখন আমি সেগুলো ধোয়ার জন্য সাগরের একটু কাছাকাছি আসতেই সাগরের ঢেউ এসে আমার পা ছুঁয়ে দিল। আমি ছিটকে সরে আসলাম। কিন্তু সাগর আমাকে স্পর্শ করেছে। সান্ত্বনা একটাই- সাগরে সত্যি সত্যি সূর্যের ডুবে যাওয়াটা দেখা হয়নি। সে সময় মেঘেরা দল বেধে এসে সূর্যকে সাগর থেকে আড়াল করে রেখেছিল। পরেরবার যখন সবাইকে নিয়ে আসবো, তখন হয়ত মেঘের আড়াল থাকবে না। দেখবো সূর্যটা কিভাবে সত্যি সত্যি ডুবে যায়।
এই সফরে সবচে' বড় পাওয়া হলো- ফটোগ্রাফি রোগ। কঠিনভাবে আক্রান্ত হয়েছি এই রোগে। তবে আমি খুশি।
এই ছবিটা অসংখ্য আজাইরা শটের মধ্যে অন্যতম।
ফটোগ্রাফির ব্যাপারটা অদ্ভুত। বহু দিনের চেনাজানা একটা জায়গা, শুধু বিশেষ একটি কোণ থেকে ক্যামারার একটা ক্লীকের কারণে কেমন অদ্ভুত সুন্দর হয়ে ধরা দেয়। অনেকটা আমাদের জীবনের মত। এই সব চলে যাওয়া, বয়ে চলা সাদামাটা দিনরাত্রি। অথচ একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যাবে- ধরার বুকে স্বর্গীয় উদ্যান। প্রতিদিন অব্বুর একই সময়ে অফিসে যাওয়া। সকাল থেকে আম্মুর ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে যাওয়া। আযান শুনে মাথায় কাপড়টা টেনে দেয়া। চায়ের কাপটা বেসিনে রাখার কারণে বকা দেয়া...আরও কত কি। নিজের সন্তানদের আরও একটু সুরক্ষিত ভবিষ্যতের চিন্তায় ও আশায় পিতামাতার নিরলস বিরতিহীন পরিশ্রম।
জীবনের ক্ষেত্রে আমরা সবাই এক ধরণের ফটোগ্রাফার। যে দিনমজুর সারাদিন পরিশ্রম করে এসে দেখে, বাচ্চারা খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে, বউ খাবার নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে, তখন সারাদিনের পরিশ্রম ভুলে একটি তৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে। খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমুতে যাবার সময় হয়ত বউকে দু'য়েকটা আহ্লাদের কথা বলে। তারপর তলিয়ে যায় নিবিড় ঘুমে। সকালে উঠে আবার জীবনকে স্বাগত জানায় পূর্ণ জীবনী-শক্তি সাথে নিয়ে।
যে ফটোগ্রাফার ময়লা আবর্জনার মধ্যেও কোন একটা বিশেষ এঙ্গেল থেকে তার চাওয়া ফ্রেমটি বের করে আনতে পারে, সেই তো সফল একজন। তেমনি জীবন যখন যেমন, আমরা যদি তাকে সন্তুষ্টি ও পরিতৃপ্তির বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করতে পারি, তাহলে জীবনের ফটোগ্রাফীতে আমরাও হয়ত সফল হতে পারব। সুখ পাখিটা তখন অট্টালিকার চারদেয়ালে বন্দী থাকবে না, অথবা কুড়েঘরের জানালা দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে অট্টালিকার ছাদ দেখতে চাইবে না। আমার যা আছে, আমি যেখানে আছি যেভাবে আছি- ভালো আছি। আমার যা কিছু অর্জন, তা আমি করব আমার মত করে। আমার এই দুটি হাত দিয়ে।
উৎসঃ ইস্টিশন ব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন