|
তাহসিনুল ইসলাম
|
|
১০৪ নম্বর রুম (গল্প)
01 January 2015, Thursday
ইছমত আলী ফ্যালফ্যাল করে মিমির দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ে এভাবে একা একা গালিগালাজ করছে কেনো? কাকে গালিগালাজ করছে? শান্ত শিষ্ট মেয়ে। সারা দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টায় যে বারোটার বেশি বাক্য বলে না। সেই মেয়ে পাঁচ সেকেন্ডে পাঁচ পঞ্চাশ বাক্য বলে ফেলছে। তাও আবার অশ্রাব্য বাক্য। ব্যাপার নিশ্চয় গুরুতর। ইছমত আলীর মনে হলো এই গুরুতর ব্যাপারটা তার জানা দরকার। গুরুতর ব্যাপার জানার জন্য তাই সে মিমির দিকে পা বাড়ালো। পা বাড়াতেই মিমি চেঁচিয়ে উঠলো, এই বিল্লির বাচ্চা বিল্লি, হারামি আয়, তোর ঠ্যাং আজকে ভাঙবো।
মিমির কথা শুনে ইছমত আলীর পা কেঁপে উঠলো। মিমি কি কথাগুলো তাকেই বলছে? না তাকে বলবে কেনো? ইছমত আলী তবু নির্ভয় হতে পারলো না। বুকের মধ্যে থু থু ছিটিয়ে কম্পিত পায়ে এগিয়ে গেলো। মিমির কাছে এসে বললো, আম্মাজান কি হয়েছে আপনার? কারে গালিগালাজ করেন?
-- বিল্লি চাচা।
-- বিল্লি! বিল্লি মানে বিড়াল?
-- জী চাচা বিড়াল।
ইছমত আলীর ভয় কেটে গেলো। বললো, আলহামদুলিল্লাহ।
ইছমত আলী এই শুকরান আলহামদুলিল্লাহ শব্দটা মনে মনে বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু ভুল করে শব্দটা ঠোঁট দিয়ে বের হয়ে গেছে। মিমি বললো, চাচা হারামি বিল্লিটার কথা শুনে আপনি আলহামদুল্লিলাহ পড়লেন কেনো?
ইছমত আলী আসল প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলো। বললো, বিল্লি কখনো হারামি হয় না আম্মাজান। হারামি হয় মানুষ। মানুষ হচ্ছে সবচেয়ে বড় হারামখোর। মানুষ গুয়ো খায়। মানুষ হচ্ছে সবচেয়ে বড় গুখোর। তো আম্মাজান বিল্লিটা কি এমন করছে যে আপনি তারে হারামি বলে গালি দিচ্ছেন?
-- আমার চশমাটা ভেঙে ফেলেছে চাচা।
-- বিল্লি চশমা ভাঙলো কিভাবে আম্মাজান? বিল্লি কি চশমা পরে?
-- বিল্লি চশমা পরে না চাচা। চশমাটা টেবিলে ছিলো। হারামি বিল্লিটা চশমাটা টেবিল থেকে ফেলে দিয়েছে।
-- ও আচ্ছা এই ব্যাপার। বিল্লিটা আসলে বুঝতে পারে নি আম্মাজান। তারে মাফ করে দেন। অবোধ জীব। অবোধ জীবদের মাফ করলে আল্লাহ তা’য়ালা খুশি হন।
-- ঠিক আছে চাচা মাফ করে দিলাম।
-- আলহামদুলিল্লাহ।
কি ব্যাপার ইছমত এতো খুশি কেনো? বেশ আলহামদুলিল্লাহ্ পাঠ চলছে?
-- আম্মাজানের দিল দেখে খুশি লাগলো ভাইজান। মেয়ে আপনার বড়ই দরদী।
-- কেনো সে আবার কি করলো?
-- একটা অবোধ বিল্লি আম্মাজানের চশমা ভেঙে ফেলছে। আম্মাজান বিল্লিটারে জলজ্যান্ত হাতের কাছে পেয়ে মাফ করে দিলো। কি বিরাট ত্যাগ? আম্মাজানের জায়গায় অন্য কেউ হলে তো বিল্লিটারে লাথি মেরে আসমানে তুলে দিতো।
মিমির চশমা যে ভাঙবে হারুন আহমেদ সেটা আগেই জানতেন। তাঁর দরদী মেয়ের মাথায় নতুন ফ্রেমের চশমা ঢুকেছে। মাথায় নতুন ফ্রেমের চশমা ঢুকলেই তার নাকের পিঠের চশমা কোন না কোনভাবে ভেঙে যায়। তবে চশমা যে এবার বিল্লি ভাঙবে এটা তিনি জানতেন না। নিরীহ বিল্লিটার জন্য তাঁর একটু মায়াই হলো। কিন্তু চশমার ব্যাপারে তিনি কিছু বললেন না। মিমির ব্যাপারে ইছমত আলীর মনের ভেতর বিরাট একটা ধারণা বিরাজ করছে। এখন তার কাছে মিমির চশমা ভাঙার ব্যাপারটা প্রকাশ করা যায় না। তিনি তাই অন্য কথা তুললেন। বললেন, ইছমত তোমার ছেলের চাকরিটা হলো?
-- না ভাইজান। ওই ব্যাটা মোকসেদ ঝামেলা পাকাচ্ছে। ব্যাটা একটা আজাজিল শয়তান।
-- কেনো সে ঝামেলা পাকাচ্ছে কেনো?
-- তারে আপনি গতমাসে লাথি মেরে চাকরি থেকে বের করে দিছেন। তার জায়গায় এখন আমি বসেছি। তার ধরনা আমিই তার চাকরিটা নট করে দিছি। তাই সে প্রতিশোধ নিতে চায়। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই ঝামেলা পাকাচ্ছে। মানুষ বড়ই প্রতিশোধপরায়ণ ভাইজান। মানুষ কারণে অকারণে প্রতিশোধ নিতে চায়। কুরানে পাকে আছে, যে ব্যক্তি প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ শক্তি থাকা সত্ত্বেও সে প্রতিশোধ না নিয়ে মানুষকে ক্ষমা করে দেয় তাকে আল্লাহ তায়ালা সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। ক্ষমা করা বড়ই কঠিন কাজ ভাইজান। সবাই এই কাজ করতে পারে না। বিরাট দিল লাগে। একটা বিল্লিকে ক্ষমা করতেও দিল লাগে। বিরাট দিল। আম্মাজানের দিল বিরাট।
-- বিল্লির কথা রাখো। তোমার ছেলের ব্যাপারটা আমি দেখবো। মোকসেদের সাথে আমি নিজেই কথা বলবো। আমার শরীরটা বেশ খারাপ আজকে। তুমি মিমিকে নিয়ে চশমার দোকানে যাও। ও চশমার ফ্রেম পছন্দ করে দেবে, তুমি দু’ এক ঘণ্টা যা সময় লাগে বসে থেকে চশমাটায় পাওয়ার বেঁধে নিয়ে আসবে। দরকার হলে টাকা একটু বেশি করে দিয়ো। চশমাছাড়া মিমি আবার বেশ সমস্যায় পড়ে যাবে।
ইছমত আলী মিমির সাথে দোকানে দোকানে ঘুরছে। মিমিকে দেখে সে বেশ অবাক হচ্ছে। মেয়েটা ঘরের ভেতর একরকম, বাহিরে অন্যরকম। মিমিকে সে এখন ঠিক বুঝতে পারছে না। তার কর্মকাণ্ড দেখে সে বেশ বিভ্রান্ত। হারুন আহমেদ চশমার জন্য দু’ হাজার টাকা দিয়েছেন। মিমির নিজের হাতেও বেশ কিছু টাকা আছে। টাকাগুলো দিয়ে সে কেক, বিরিয়ানি, সন্দেশ, ক্যান্ডেল থেকে শুরু করে টুকটাক অনেক জিনিস কিনেছে। একটা শাড়িও কিনেছে। ঘিয়া রঙের। ইছমত আলী তাকে এখনো কিছু প্রশ্ন করেনি। সে নিরবে তার কর্মকাণ্ড দেখে যাচ্ছে। মিমিই প্রশ্ন করলো। বললো, চাচা আপনাকে আমি একটা মিথ্যা কথা বলেছি?
-- কি মিথ্যা বলেছেন আম্মাজান?
-- চশমাটা বিল্লি ভাঙ্গেনি।
-- ওহ!
-- চশমাটা আসলে ভাঙ্গেই নি।
-- ওহ!
-- চাচা আপনি কি আমার কথা শুনে খুব কষ্ট পেলেন?
-- না আম্মাজান আমি কষ্ট পাইনি।
-- চাচা আমরা এখন চশমার দোকানে যাচ্ছি না।
-- জী আম্মাজান সেটা তো বুঝতে পারছি। আমরা তাহলে এখন কোথায় যাচ্ছি আম্মজান?
-- চলেন বুঝতে পারবেন।
ইছমত আলীর মনটা হঠাৎ করে বেশ খারাপ হয়ে গেলো। মিমি একটা রিক্সা নিয়েছে। রিক্সা এসে থামলো একটা বৃদ্ধাশ্রমের সামনে। বৃদ্ধাশ্রমের নাম, অপরাহ্ণ। নাম যথার্থই বটে। মিমি অপরাহ্ণের ১০৪ নম্বর রুমে এসে ঢুকলো। ইছমত আলীও পিছু পিছু ঢুকলো। রুমে ঢুকতেই সে একজন শুভ্র শীর্ণ বৃদ্ধাকে দেখতে পেলো। বৃদ্ধা মিমিকে দেখে উচ্ছ্বসিত হাসিতে জড়িয়ে ধরলো। মিমি বললো, হ্যাপি বার্থ ডে দি। ইছমত আলী বৃদ্ধাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে পারলো না। সে ১০৪ নম্বর রুম ছেড়ে পালিয়ে গেলো। তার চোখ দিয়ে জল ঝরছে...
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন