ফরিদাবাদ লেনের নোনাধরা পুরাতন দালানটার নীচতলায়, স্যাঁতস্যাঁতে ঘরটাতে মাঘ মাসের অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির ছাঁট যখন হুড়মুড়িয়ে ঢুকছিল, আয়াজ আলী তখন টেবিলের সামনে পেতে রাখা চেয়ারে বসা। তার হাতে প্লাস্টিকের একটি ছবির ফ্রেম, চোখ ছবিতে নিবদ্ধ। আগে রূপালী কাজ করা ছিল ফ্রেমের চতুর্দিক জুড়ে, বয়সের ভারে ও ব্যবহারাধিক্যে তা উঠে গেছে আগেই। ছবির ওপরের আবরনটাও এত অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে ছবি ভালোমত দেখা যায় না। আয়াজের অভ্যস্ত চোখেও খানিকটা সমস্যা হয়। মোমবাতির কম্পিত মৃদু আলোয় সে ছবিখানা আরও ভালো মতন দেখার চেষ্টা করে। পাঁচ বছর বয়সী মায়াকাড়া এক মেয়ের ছবি, আয়াজের শিশুকন্যা। খানিকক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে তার কন্যার মুখের পানে। তারপর তেল চিটচিটে অয়েলক্লথে ঢাকা টেবিলের ওপর সে ছবিটা রেখে দেয়।
মাত্রই গোসল করেছে সে। পরনের ভেজা লুঙ্গি বদলে শার্ট-প্যান্ট পরেছে। চুল আঁচড়েছে ডানদিকে সিথি করে, বরাবরের মত। দেয়ালে টাঙ্গানো বিবাহসূত্রে প্রাপ্ত আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে সে ভালোমতন নিজের মুখের দিকে তাকায়। মোমের আলোয় তার চকচকে ভেজা চুল আয়নায় প্রতিফলিত হয়।
রাত বারোটা বাজতে আর মিনিট দু’এক বাকি। বারোটা বাজলেই তার চল্লিশতম জন্মদিন। আয়াজ দ্রুততার সাথে টেবিলের ওপর থেকে তার অপ্রকাশিত কবিতার পাণ্ডুলিপি তুলে নেয় হাতে। পায়ে ছেঁড়া চপ্পলজোড়া গলাতে না গলাতেই হাতের ক্যাসিও ঘড়িখানা ক্যাঁ ক্যাঁ শব্দ তুলে বারোটা বাজবার সংকেত দেয়।
আয়াজ ধীরপায়ে হেঁটে তার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ায়, পেছনে ফিরে অপলক দৃষ্টিতে চোখ বুলায় তার দীর্ঘদিনের এই ডেরায়। টেবিলে, টেবিলের পাশে মেঝেতে গাদা করে রাখা প্রচুর বই, আলনায় গোটা দু’তিনটে শার্টপ্যান্ট আর পাশে ছোট একটা চৌকি যাতে ক্লান্ত লাগলে গড়িয়ে বিশ্রাম নিত সে। চেয়ারের ওপর থেকে চাদরটা তুলে নিয়ে ভালোমতন গা মাথা জড়িয়ে নেয়, যাতে বৃষ্টির ছাঁটে পুরো ভিজে না যায় সে। ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দিতেই পুরো ঘর গাঢ় অন্ধকারের দখলে চলে যায়। মেইন গেটে তালা লাগিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে সে।
ঘুপচি কানাগলির আনাচে কানাচে জমে থাকা বৃষ্টির পানি, বাসাবাড়ি থেকে ফেলা আবর্জনার স্তূপ মাড়িয়ে আয়াজ সামনে এগোয়। দুর্যোগপূর্ণ শীতের রাত, তার ওপর গোটা এলাকা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন ঘণ্টাখানেক ধরে।
ঘনবসতির জায়গাটিতে সবাই যেন পাল্লা দিয়ে নীরবতা পালন করছে। কাজেই রাস্তায় কুকুর-বিড়ালের পাল্টাপাল্টি ডাকাডাকি আর কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে মেঘের গম্ভীর গর্জন ছাড়া চারপাশ যখন একদম নিথর হয়ে পড়ে আছে, আয়াজের মনে তখন ভিঁড় জমাতে থাকে অনেক অনেক স্মৃতি।
সুন্দর গোছানো একটা সংসার ছিল তার। আয়াজের স্ত্রী - রিমি ছিল ইউনিভার্সিটির সহপাঠী। বড় ঘরের মেয়ে ছিল সে। আয়াজকে বিয়ে করেছিল আয়াজের লেখার প্রেমে পড়ে। ছাত্রজীবনেই আয়াজের লেখার প্রশংসা করতো সবাই। রুদ্রনীল ছদ্মনামে লিখত সে, বন্ধুমহলে বেশ পরিচিতও হয়ে গিয়েছিল ঐ নামে। কিন্তু নিজের লেখা নিয়ে খুব বেশী খুঁতখুঁতে হওয়ার কারনে পত্রপত্রিকায় তেমন একটা লেখা ছাপাতে চাইত না সে। লিখে বন্ধুবান্ধব, শিক্ষকদের দেখাতো। তারা ভূয়সী প্রশংসা করতো আয়াজের লেখার। ওতেই চলে যেত তার বেশ। আয়াজের জীবনের অভিজ্ঞতা বলে, মেয়েরা বীরপূজারিনী হয়। ছাত্রমহলে উঠতি বীর কলমসৈনিক আয়াজের প্রেমে পড়তে খুব একটা সময় নেয় নি রিমি।
কাঁদার মধ্যে ছপছপ আওয়াজ তুলে হেঁটে যেতে যেতে পুরনো সেই দিনগুলির কথা আয়াজের মাথায় ভিড় জমাতে থাকে, সন্ধ্যাবেলা নীড়ে ফিরে আসা পাখিদের মত। “আমার নীড় কোথায়?” – আয়াজের হতাশামিশ্রিত কণ্ঠ বাতাসে ভেসে ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে।
হাঁটতে হাঁটতে গলির মাথায় এসে পড়ে আয়াজ। একদফা বরফগলা বাতাস গলির খোলামুখ দিয়ে সোঁ সোঁ শব্দ তুলে ছুটে গেল। বিদ্যুৎ চমকে গোটা আকাশ আবার নীলচে বর্ণ ধারন করলো মুহূর্তের জন্যে। মহাসড়কটির যদ্দুর দেখা যায়- কোন জনমানব চোখে পড়ে না আয়াজের। এরমধ্যেই মাটি ফুঁড়ে ওঠা একটা -প্রায় লোমহীন কালো কুকুর আয়াজের চোখ এড়ায় না। আয়াজকে দেখে ওটা আধবসা অবস্থা থেকে লাফিয়ে চারপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ায়। একবার সামনে, একবার পেছনে ঝুঁকে অদ্ভুত কায়দায় আড়মোড়া ভাঙ্গে। তারপর আয়াজের পিছু নেয় লেজ নাড়তে নাড়তে।
আয়াজ রিমির মোহাচ্ছন্ন ভালোবাসা বিয়েতে গড়ায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই, মূলত রিমির চাপে। প্রায় কপর্দকশুন্য মেধাবী ছেলেটির প্রতি তার ভালোবাসা ছিল না করুণামিশ্রিত বিচিত্র একধরণের মোহ ছিল – তা নির্ণয় করা মুশকিল। স্বল্পতর সময়ের ভালবাসায় বেশ কয়েকবার বিছানা ভাগ করে নেবার পরই রিমি চাপ দেয় বিয়ে করার। আয়াজের বলার খুব বেশী কিছু ছিল না। ছন্নছাড়া জীবনটা তারও হয়ত একঘেয়ে লাগছিল কিছুটা। হয়ত সেও খুঁজছিল থিতু হওয়ার একটা উপলক্ষ্য। আসলে ফেলে আসা জীবনে এইসব দিনগুলি এমনই দুর্ভেদ্য কিছু সমীকরণ নিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায় যে আয়াজ তার চিন্তার খেই হারিয়ে ফেলে। তাই রিমির সাথে তার সম্পর্কের অসঙ্গায়িত দিকগুলি নিয়ে বরাবরই চিন্তা করেছে কম, এড়িয়ে গিয়েছে বরাবর ইচ্ছা করেই। লেখালিখি থেকে ছুটি নিয়ে ধোপদুরুস্ত কাপড়চোপড় পরে ব্যাংকার হয়ে গিয়েছিল সে রিমির বাবার বদৌলতে।
মাতঙ্গিনীর মত তীব্র শীতল বাতাস যখন ছুটে এসে জাপটে ধরে সারা শরীরে হুল ফোঁটাতে থাকে, আয়াজের চিন্তাভাবনাগুলি আবারও বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। ঝোড়ো হাওয়া মাথায় করে, সূঁচ ফোটানো মিহি বৃষ্টির ছাঁট উপেক্ষা করে কে দাঁড়িয়ে ভুতুড়ে ল্যাম্পপোস্টটার নীচে? আঙ্গিকে আয়াজ বুঝতে পারে সে এক নারী। পরনে মলিন একটি শাড়ি, কিন্তু চাদর দিয়ে মুখ আড়াল করে রাখা। আয়াজ সামনাসামনি এসে দাঁড়ানোর পর সে তার মুখোবয়ব থেকে খুব ধীরে চাদর সরিয়ে আনা মাত্রই আয়াজ তাকে চিনতে পারে। একবার চোখাচোখি হওয়া মাত্রই সে নারী তার চোখ নামিয়ে মাথা নেড়ে আয়াজকে মৃদু সম্ভাষণ জানায়। আয়াজ পুনরায় হাঁটা শুরু করলে সেও আয়াজের পিছে হাঁটা শুরু করে।
একটু এগোলেই সামনে আজিজিয়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। এদের জিলিপির নামডাক দূরদূরান্ত থেকে শোনা যায়। আয়াজের মনে পড়ে, রিমির খুব পছন্দ ছিল এই জিলিপি। প্রায়ই অফিস থেকে ফেরার পথে এই জিলিপি কিনে নিয়ে আসতো সে। কিন্তু একসাথে বেশী মিষ্টি খেয়ে ফেললে মোটা হয়ে যাবার ভয়। তাই রিমি কখনই পুরো একটা জিলিপি খেত না। অর্ধেক ভেঙ্গে খেয়ে বাকি অর্ধেক আয়াজের মুখে তুলে দিত। কিছুক্ষণ পরেই হয়ত আবার একটা জিলিপি নিয়ে আগের মতই অর্ধেক ভেঙ্গে খেয়ে বাকি অর্ধেক নিয়ে চলে আসতো আয়াজের কাছে। আয়াজ মজা করে বলতো অর্ধেক অর্ধেক করে পুরো একটা জিলিপি তো হয়েই গেল! কিন্তু রিমি উত্তর দিত, সে অঙ্ক ভালো পারে না। অর্ধেক জিলিপি তার কাছে অর্ধেক জিলিপি। কয়টা অর্ধেক জিলিপি মিলিয়ে পুরো একটা জিলিপি হয় তা সে বোঝে না। বলেই হাসিতে ভেঙ্গে পড়তো একদম। ঐযে কবিতায় বলে না – জীবনের সোনাঝরা দিন, আক্ষরিক অর্থেই সে দিনগুলি আয়াজের জীবনের সোনাঝরা সুখের দিন ছিল।
এভাবে বছরখানেক কাটার পর হঠাৎ আয়াজের মনে হয়, একহাজারটা দিন এবং রাত্রি কেটে গেছে, সে একটা নূতন কবিতা লেখে নি, নূতন বা পুরাতন কোন কবিতা পড়েনি, লেখালিখির সাথে তার সমস্ত সংশ্রব একদম ঝাড়েবংশে উধাও হয়ে গেছে! সকাল ন’টা থেকে রাত্রি নয়টার চাকরী তার সমস্ত সৃজনশীলতাকে একদম শুষে নিয়ে গেছে। ওভারটাইমের খাটনি, দু’হাতে কেবল টাকা দেয়া নেয়া ছাড়া তার আর কোন কাজ নেই। মানুষ বলতে সে এখন ছিবড়ে কেবল।
আজিজিয়া মিষ্টান্নভাণ্ডার পার হতেই আয়াজের চোখ পড়ে রাস্তার পাশে পেট চেপে ধরে বসে থাকা এক অশীতপর বৃদ্ধের ওপর। শ্বাস নিতে সাংঘাতিক কষ্ট হচ্ছে তার, চোখ প্রায় কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে। প্রবল শীতের রাত্রিতেও সে একদম উদোম, শরীরে কেবল একটা ছেঁড়াফাটা লুঙ্গী। চোখের নীচে কালশিটে পড়া লোকটার সাথে একবার চোখাচোখি হওয়া মাত্রই আয়াজ দেখতে পায় , তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে এলো। আয়াজ তাকে পার করে যেতেই সে হামাগুড়ি দিয়ে পিছু নিল আয়াজের ছোট দলটির।
আয়াজ আবার তার অতীতে আছন্ন হয়ে যায়। আয়াজ আর রিমির সংসার জুড়ে যখন তাদের প্রথম সন্তানটি আসে আয়াজ বোধ করে তার জীবন এবার কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে। তার আর কোনকিছুর অভাব নেই। ছোট্ট কন্যা সন্তানটি তার যখন টুকটুক করে কেবল মাত্র হাঁটা শিখেছে আয়াজ তার বেতন বোনাসের টাকায় মিষ্টি কিনে নিজের শ্বশুরবাড়ি, আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী – সবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। সে সময়টায় তার মনে হত – তার মত মধ্যবিত্ত এক মানুষের জন্যে এ জীবনই কি পরম আকাঙ্খিত নয়? এরপরে আর কি ই বা চাওয়াপাওয়া থাকতে পারে তার জীবনে? মাস শেষে পকেটভর্তি টাকা, ঘর আলো করে রূপসী বউ আর চাঁদের মত ফুটফুটে শিশুকন্যা, তাদের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া, বেড়াতে যাওয়া – এই তো ব্যাস, আর কি চাই?
“ বাবা তই তই! বাবা তই তই!”
মেয়েটি তার লুকোচুরি খেলতে খুব পছন্দ করতো। বাবা কই- সে বলতে পারতো না। বলতো - বাবা তই তই! এই বলতো আর সারা ঘর আঁতিপাঁতি করে খুঁজত আয়াজকে। অল্পক্ষণেই ক্লান্ত হয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে বসতো সে। আয়াজ আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ছোঁ মেরে কোলে তুলে নিত তার মেয়েকে। চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিত তার মুখ। মেয়ে তার উছলে উঠত আকাশ ভাঙ্গা হাসিতে।
ডায়রিটা আয়াজ খুঁজে পেল তার ত্রিশতম জন্মদিনে। তার বাবার ডায়রি। প্রথম পাতায় বড় বড় করে লেখা – “বাবা আয়াজ, তুই কথা রেখেছিস তো? উড়ছিস তুই, ইকারুসের মত?”
ডায়রিটা আঁতিপাঁতি করে পড়ার পর আয়াজের রাতের ঘুম পুনরায় উধাও হয়ে যায়। তার বাবা একটা সরকারি কলেজের লাইব্রেরীয়ান ছিলেন। সারাদিন বই ইস্যু করতেন আর প্রায় সারারাত্রি জেগে জেগে পড়তেন। আয়াজকে সামনে বসিয়ে কত বই পড়ে শুনিয়েছেন তিনি। গল্প বলেছেন ডেডেলাস আর তার পুত্র ইকারুসের যারা পাখির পালকের ডানা তৈরি করে আকাশে ভেসে পড়েছিলেন।
আয়াজকে তিনি প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন যে আয়াজ তার জীবনের কোন অবস্থাতেই লেখালেখি ছেড়ে দেবে না।
হঠাৎ বিকট শব্দে বজ্রপাত হয়। আঁধার আকাশ যেন বিক্ষুব্ধ সর্পের মত ফণা তুলে ছোবল মারে, গোটা পৃথিবী নীল হয়ে যায় তার বিষে।
কার ওপর এত ক্রোধ আকাশের? যাদের ওপর ক্রোধের যৌক্তিকতা আছে, তাদের অনেকেই এই শীতের রাত্রে তিন-চার প্রস্থ কাঁথা-কম্বল মুড়ি দিয়ে এয়ারকন্ডিশনড রুমে ঘুমাচ্ছে। ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সে মানুষগুলি, আরাম আয়েশের সাথে যাদের কোন সম্পর্কই নেই।
দূরে বুড়িগঙ্গা সেতু দেখা গেল। আয়াজ সচকিত হয়ে খেয়াল করে, বুড়িগঙ্গার তীর সংলগ্ন গোটা রাস্তার দু’ধারে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে এক একজন মানুষ। সেই ছেলেটি- যার একটি পা নেই, ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়ানো; আয়াজের পাশের বাড়ির গৃহকর্মী বকুল নামের মেয়েটি; ঝলসানো মুখের রেশমা; ফুলহাতা শার্টের ওপর লালরঙের পুরনো একটি সোয়েটার পরা গ্রামের প্রাইমারী স্কুল মাষ্টার ইউসুফ; আয়াজের এলাকার মুদি দোকানী সগির মিয়া, রিটায়ার্ড সরকারী কর্মকর্তা ইকবাল সাহেব সহ চেনা-অর্ধচেনা আরও অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার দু’পাশে। আয়াজ সবার মুখের দিকে তাকায়, একবারের জন্যেই, তাদের চোখে মুখে বিষণ্ণতা আর কৃতজ্ঞতার মিশ্র অনুভূতি অনুভব করে সে এগিয়ে চলে বুড়িগঙ্গা সেতুর দিকে। তারা সবাই নতমস্তকে আয়াজকে পথ করে দেয়। পরে অগ্রসর হয় আয়াজের পিছু পিছু।
ত্রিশতম জন্মদিনের রাতেই আয়াজ ঠিক করে, সে ছেড়ে দেবে ব্যাংকের চাকরী। কোন এক পত্রিকায় চাকরী নেবে, পাশাপাশি লিখবে সর্বক্ষণ।
রিমিকে জানানো মাত্রই তীব্রস্বরে প্রতিবাদ করে রিমি। আয়াজ অবাক হয়। একদিন, তাকে কেবল মাত্র তার লেখার গুণেই মেয়েটা আপন করে নিয়েছিল। অথচ আজ যখন সে তার জীবনের মূলবিন্দুতে ফিরে যেতে চায়, ফিরে যেতে চায় তার সত্ত্বার কাছে – তখন তার জীবন সঙ্গিনীর আপত্তি!
মাসখানেকের মধ্যেই রিমির ডিভোর্সের কাগজপত্র আয়াজের হাতে পৌঁছে। ছয়মাসের মাথায় কানে আসে রিমির দ্বিতীয় বিয়ের খবর।
আয়াজ ততদিনে সামলে নিয়েছে অনেকটাই। জগৎসংসারে ভালোবাসার দাবী মুখে অনেকেই করে, কিন্তু অগ্নিপরীক্ষা দেবার সময় ধোপে সে দাবী টেকে এমন মানুষ পাওয়াই সমস্যা কেবল।
পেট চালাতে হয়। আয়াজ এক কম সার্কুলেশনের পত্রিকার সাব এডিটর পদে চাকরী জুটিয়ে ফেলে কোনক্রমে। সাজানো সংসার তাকে ছেড়ে চলে গেছে, যাক। এত বড় একটা ধাক্কা সামলে দু’চোখে তার কেবল এখন বড় লেখক হবার স্বপ্ন।
“ধুত্তুরিকা মিয়া, কি লিখসেন এগলি আপনে? ছন্দ নাই, মিল নাই, কোন জাতের শব্দ পর্যন্ত নাই” – এক লিটল ম্যাগাজিনের দপ্তরে প্রথমবারের মত নিজের কবিতাগুলো নিয়ে যাবার পর এই ছিল সেই পত্রিকার সম্পাদকের প্রাথমিক অনুভূতি।
“কিন্তু ভাই আধুনিক কবিতা তো মুক্তছন্দেও হয়, গদ্য ছন্দে অনেকেই লিখছে অনেকদিন ধরে এখন...”
আয়াজের প্রত্তুত্যরে সেই পত্রিকার সম্পাদক প্রচণ্ড বিরক্ত হয়, তা বোঝাই যায় তার মুখভঙ্গীতে-
“নিয়ম ভাঙ্গার লাইগা নিয়ম জানন লাগে আগে। কন দেহি, অমিত্রাক্ষর ছন্দে কেডায় কবিতা লিখত?”
প্রায় মাটির মানুষ আয়াজ বুঝতে পারে, উত্তপ্ত ক্রোধের একটা স্রোত তার
মস্তিষ্কের নিউরনে ছড়িয়ে পড়ছে। তবুও সে স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা করে।
“আচ্ছা, ছন্দ না হয় ছাইরা দিলাম, আপনার কবিতার বিষয়বস্তুগুলা এরুম কেন, আমারে একটু বুঝায়া কন। মাইনষে প্রেমের কবিতা ল্যাখে, কাইব্য কইরা কয়- অয়ো আমার দিলের মালকিন, তোমার গালের একটা তিলের লাইগা আমি বোখরা সমরকন্দ লিখা দিতে পারি! আর আপনে লেখেন খালি এসিড ঝলসাইনা, বা রেপ হওয়া মাইয়াগো আখ্যান, অথবা বুড়া দিনমজুর বা মুদি দোকানীর উপর সন্ত্রাসী হামলার কাহিনী। এইগুলি চলবো বাজারে? খাইবো এগুলি মানুষ, আপনেই কন?”
কবিতাগুলো নিয়ে আয়াজ সেদিন বেরিয়ে এসেছিল ষে লিটল ম্যাগের অফিস থেকে। হতাশা গ্রাস করেছিল তাকে, সাময়িকভাবে। কিন্তু সে হার মানেনি। লক্ষ্য যার ডেডেলাসের মত আকাশে ডানা মেলা, সে এত সহজে হার মানলে চলবে কেন?
আজ অনেকগুলো বছর পার করে বুড়িগঙ্গা সেতুর গোড়ায় দাঁড়িয়ে আয়াজ ভাবে- হয়ত হার মেনে নিলেই ভালো হত সে সময়ে। কবিতা বা গল্পের বিষয়বস্তু বাছার ক্ষেত্রে সে সবসময়ই ভিন্ন পথে হেঁটেছে। ইচ্ছাকৃতভাবেই সে আমি-তুমি মার্কা প্রেমের আখ্যান না লিখে ক্রমাগত লিখে গেছে সমাজে কিছুই না পাওয়া মানুষগুলির আখ্যান। নিজের লেখায় নিজের কবিতায় এমন সব মানুষের গল্প তুলে ধরেছে সে- যাদের কথা কেউ কখনো বলে না, যাদের ওপর ক্রমাগত নিষ্পেষণ চলে কিন্তু সে খবর তেমন জনসমক্ষে আসে না। পাঠকপ্রিয়তা না পাওয়া, সে যেন তার ভবিতব্যই ছিল।
লম্বা একটা দম নেয় আয়াজ। তারপর একপা একপা করে সিঁড়ি ভাঙ্গা শুরু করে। তারপরও সে সংগ্রাম চালিয়ে যেত, লিখতে লিখতে মারা যাওয়া সে তার ভবিতব্যই ধরে নিয়েছিল। ভেবেছিল একদিন ক্ষমতাশালী কারো না কারো চোখে তার লেখাগুলি পড়বে। আয়াজ দুর্বল, সে লেখে খালী। সমাজের কেন্দ্রবিন্দুতে যে তারকাখ্যাতি পাওয়া লেখক, সে তাদের থেকেও যোজনযোজন দূরে। তাই তার লেখায় তড়িৎগতিতে সমাজের অসঙ্গতিগুলি বদলাবে- সে এমনটা ভাবে নি। কিন্তু মনের গভীরে টিমটিম করে জ্বলা বাতির মত সে একটা আলোকরশ্মি দেখতে পেত, তার আশা ছিল একদিন কেউ তার লেখায় অনুপ্রাণিত হয়ে অসঙ্গতিগুলি দূর করার চেষ্টায় নিয়জিত হবে।
দিনসাতেক আগে আয়াজ তার জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খায়। তার তের বছর বয়সী কন্যা, রিমি যাকে শিশু অবস্থায় কোলে করে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তার সে মেয়েটি রিমির দ্বিতীয় স্বামীর যৌন নিপীড়নের ভুক্তভোগী হয়ে আত্মহত্যা করেছে। গত কয়েকদিন প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় আর নিউজ চ্যানেলে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে এই খবর।
রিমির দ্বিতীয়পক্ষের স্বামীর পরিবারও বেশ প্রভাবশালী। তাদের পক্ষ থেকে ঘটনার মোড় ঘোরানোর বেশ চেষ্টা করা হলেও খবর মিডিয়াতে ফ্ল্যাশ হয়ে যায়। রিমি শয্যাশায়ী, রিমির স্বামী পুলিশ হেফাজতে। বিরাট ধনী পরিবারের সন্তান লোকটি নাকি আজীবন দেশের বাইরে বড় হয়েছে, পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়েছে তার, কি অসাধারণ পৌরুষদীপ্ত চেহারা!
আয়াজ ব্রিজের ওপর উঠে আসে। উঠে এসে অবাক হয়ে যায়। ব্রিজের ওপর তারা সবাই দাঁড়ানো, তাদের সবার হাতে একটা করে প্রজ্বলিত মোমবাতি। সেই মুখ ঝলসানো মেয়েটি, কুঁজো বুড়ো, ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়ানো কিশোর ছেলেটি, গৃহকর্মী বকুল, স্কুলমাষ্টার ইউসুফ সাহেব, মুদি দোকানী সগির মিয়া, রিটায়ার্ড সরকারী কর্মকর্তা ইকবাল সাহেব, সবাই যে যার কাপড়ে বা চাদরের আড়ালে একটি করে মোমবাতি ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
“স্যার, আমারে চিনসেন?” – কুঁজো বুড়ো লোকটি এগিয়ে আসে কোনক্রমে আয়াজের সামনে, “আমি করম...করম আলী... দিনমজুরী খাটতাম পোস্তগোলা রাইস মিলে”
“আমি চিনি আপনাকে করম চাচা... দুঃখিত, আমি আপনাকে বাঁচাতে পারি নি... সে সামর্থ্য আমার ছিল না” আয়াজের কণ্ঠ ধরে আসে।
“ না না স্যার, ঐ কথা কয়েন না। বাঁচা মরা আপনের হাতে নি? উয়োর মালিক তো আল্লা...তয় স্যার আপনিই একমাত্র মানুষ যে আমার কথা মনে রাখসে, আমাগো কথা মনে রাখসে। রাইসমিলের মদখোর মালিক, ভারী চাইলের বস্তা লইয়া আমি গইরাইয়া পইরা যাওনের লগেলগেই যে লাথিডা আমার প্যাডে দিছিল আমি তো ঐখানেই ইন্নালিল্লা। কিন্তু তারপরেও যে আপনে আমারে লইয়া লিখসেন, তাতেই তো আমি বাইচা রমু, মাইনসে জানবো এই বুড়া দিন মজুর করম আলীর দুঃখের কথা”
করম আলী একটু দম নিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় শাড়িতে মুখ চাপা দিয়ে রাখা মেয়েটার পাশে –
“এই যে মালো পাড়ার মাইয়াডারে শালার কুত্তার বাচ্চারা রেপ করছিল, সরকারবাহাদুরের লোকজনের চাপে মাইয়াডা কোন বিচার পায় নাই- আপনে পত্রিকায় খবরটা দেহা মাত্রই অরে লইয়া লিখসিলেন একটা কবিতা। মাইনসে জানবো না ওর প্রতি এই অবিচারের কথা?
করম আলী সবার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায় –
“অথবা গেরাম থেকে শহরে মাইনসের বাসায় কাজ করতে আসা এই মাইয়াডারে যে বাড়ির মালিক পতিদিন রেপ করতো, বা গার্মেন্টসে কাজ করা রেশমা যার মুহে এসিড মারসিলো এক জানোয়ার, লিমন- যার পায়ে গুল্লি করসিলো কালা পুলিশে, ইউসুফ মাষ্টার – গেরামের প্রাইমারী স্কুলের মাষ্টার তিনমাস বেতন না পাওয়ার কারনে ছুডো পোলাডারে চিকিৎসা করাইতে পারে নাই- পোলাডা মইরা গেছিলো গা, আমগো এলাকার মুদি দোকানী সগির মিয়া, লাল মাস্তানরে চান্দা দিতে পারতো না কইয়া যার দোকানে আগুন দিসিলো বেজন্মাগুলি, বা এই আমাগো ইকবাল সাব, কত সম্মানিত লোক, যার একমাত্র পোলাডা নেশাভাং করতো নিয়মিত, বখাইটা পোলাপাইনের লগে মারামারি কইরা মারা পড়লো, একমাত্র আপনি আমগো প্রত্যেকের দুক্ষু লইয়া আলাদা আলাদা ভাবে লেখসেন। আমাগো কাউরে আপনে ভুলেন নাই স্যার। আপনের লেখায় বারবার বারবার আমাগো দুখ দুর্দশা, আমাগো বঞ্চনা, আমাগো উপর জুলুমের কথা আসছে”
- এই বলে বৃদ্ধ করম আলী এগিয়ে এসে আয়াজের পীঠ চাপড়ে দেয়
“যাইতাসেন যান স্যার, খুশী মনে যান। দুনিয়ায় হকলডি মানুষ বাঁচে না, সবাই মরার মত কইরাই বাঁচে। তয় আপনে বাঁচছেন স্যার, বাঁচার মত কইরাই বাঁচছেন। আপনার জনম সার্থক” – করম আলী নিজের চোখ মোছে।
“আবার আইয়েন আপনে স্যার আমাগো মইদ্দে। সুযোগ হইলেই চইলা আইয়েন”
আয়াজের চোখ, তার কন্যার মৃত্যুর সংবাদ শোনার পরেই যা বিহ্বল পাথরে পরিণত হয়েছিল, তা থেকে একফোঁটা- দুইফোঁটা, পরে বন্যার পানির স্রোতের মত অশ্রু ঝরে পড়তে লাগলো। সারাটা জীবন তার কেটেছে একজন মানুষ হিসেবে, স্বামী হিসেবে, পিতা হিসেবে, সর্বোপরি একজন লেখক হিসেবে নিজেকে ব্যার্থ মানুষ জেনে। আজ এই মৃত বৃদ্ধের কথাগুলি তার জীবনের সার্থকতা নিরূপণ করে গেল। প্রজ্বলিত মোমবাতি হাতে দুখী মানুষদের আত্মারা দু’ভাগে ভাগ হয়ে আয়াজকে জায়গা করে দিল।
কিছুই বদলায় নি। প্রবল শৈত্যের দমক কমে নি, গুড়িগুড়ি বৃষ্টি এখনও পড়ছে। পুলিশ চেকপোস্টে কোন পুলিশ দেখা যাচ্ছে না। কালেভদ্রে দু’একটা বাস হুশহাশ শব্দ তুলে চলে যাচ্ছে।
ব্রিজের ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়ালো আয়াজ। রেলিঙে ভর দিয়ে নীচে তাকালো। শীতকাল হলেও বুড়িগঙ্গা এখানে যথেষ্টই গভীর।
“হাউ” – পেছন থেকে শিশুকণ্ঠের আওয়াজে আয়াজ চমকে ওঠে। ফিরে দেখে তার ছোট মেয়েটি, লাল টুকটুকে একটা ফ্রক পরা। মাথার দুপাশে ছোটছোট দুটো ঝুটি করা, কপালের একপাশে বেশ বড় করে একটা টিপ, চারদিক আলো করে হাসছে সে।
“ভয় পাওনি আব্বু?” – আয়াজের কন্যা প্রশ্ন করে আয়াজকে।
“অনেক ভয় পেয়েছিরে মা, এভাবে ভয় দেখাতে আছে বাবাকে? যদি হার্টফেল করতাম?" – আয়াজ জিভ বের করে চোখ উল্টে হার্টফেল করার অভিনয় করে দেখায়।
“বাবা ভীতু! বাবা ভীতু!” আয়াজের ছোট্ট শিশুকন্যা হেসে লুটিয়ে পড়ে, হাততালি দিয়ে নাচতে থাকে।
“মা দেখ, এটা কি!”
-আয়াজ তার চাদরের নিচ থেকে কবিতার পাণ্ডুলিপিটা বের করে। প্রায় দশ বছর ধরে জমানো আয়াজ আলির সবগুলো কবিতা আছে এখানে। বই আকারে বের করার স্বপ্ন ছিল তার, কিন্তু তার একমাত্র কন্যার মৃত্যুর সংবাদে তার কবিতায় বিদ্রোহ বা পোয়েটিক জাস্টিসের ধারনাটার ব্যাপারেই ঘৃণা চলে আসে।
“কাগজ!” -আয়াজের কন্যা পাণ্ডুলিপি দু’হাতে ধরে বিস্ময়াভিভূত চোখে বলে, “বাবা, কাগজ ছিঁড়ব”
“ছিঁড়ব না মা, পোড়াব” – আয়াজের কথা শুনে তার কন্যা নূতন ধরনের কোন খেলার আভাস পেয়ে খুশীতে উদ্বেল হয়ে ওঠে।
“চলো আব্বু! আগুন ধরাই! আগুন ধরাই!” শিশুটির আকর্ণবিস্তৃত হাসি অন্ধকারেও মুক্তোর মত ঝলমল করে ওঠে।
আয়াজ প্রথমে চাদর খুলে ছাউনির মত ব্যাবস্থা করে, বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচার জন্যে। পরে বাপ মেয়ে দুজনে মিলে পাণ্ডুলিপিতে দেশলাই দিয়ে আগুন ধরায়।
কবিতার পৃষ্ঠায় সে নির্মম আগুন স্পর্শ করে – প্রথমে পাণ্ডুলিপির সাদা মার্জিনে, ধীরে ধীরে কবিতার শিরোনামে, প্রথম ছত্রে, এভাবে পুরো কবিতায়।
প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বিরাম চিহ্ন, প্রতি ছত্র জ্বলন্ত জোনাকের মত উঠে আসে কবিতার বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে। শুন্যে নক্ষত্রের মত জাজ্বল্যমান সে সব জ্বলন্ত পঙক্তি আয়াজ স্পষ্ট পড়তে পারে। শীতের রাতের ভেজা আবহাওয়া আগুন ঠিকমত জ্বলে না, ধিকিধিকি আগুনের তাপ বাপ মেয়ের মুখে এসে লাগে। দু’জনে মিলে নিস্তব্ধ নীরব নিথর সে ব্রিজের মাঝামাঝি বসে উপভোগ করে পুরোটা পাণ্ডুলিপির পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া। আগুনের শেষ স্ফুলিঙ্গটুকু নিভে যাওয়ার পর আয়াজ ভেতর থেকে একটা ভারমুক্তির আনন্দ অনুভব করে।
সময় এসেছে। আয়াজ তার চল্লিশ বছরের বয়োভার কাঁধে নিয়ে ব্রিজের থাম ধরে রেলিঙের ওপর উঠে দাঁড়ায়।
পৃথিবী তার সমস্ত শৈত্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নগণ্য কবি, আমাদের আয়াজ আলীর ওপর। হাড় জমিয়ে দেয়া শৈত্য কোন দয়া দেখায় না তাকে। বৃষ্টির ছাঁট আরও তীব্র হয়। আয়াজ একে একে তার শার্টের বোতাম খোলা আরম্ভ করে। নীচে মাঘের শীতে বরফের মত জমে থাকা বুড়িগঙ্গার পানি আয়াজকে হাতছানি দিয়ে ডাকে।
চাবুকের মত সপাং করে নীল বিদ্যুৎ পুরো আকাশকে দ্বিখণ্ডিত করে দেয়। আয়াজ তার নত হয়ে থাকা শির ধীরেধীরে উঁচু করে। শার্ট খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া মাত্রই আকাশের চোখ ঝলসে দিয়ে বেরিয়ে আসে আয়াজের পীঠে এক জোড়া ডানা। আয়াজ আলীর ডানা। সাদা পালকের সে ডানার কিনারে রূপার কারকার্য।
সমগ্র মানবজাতির ইতিহাস লেখা সে ডানার একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে। পবিত্র সে সব আত্মা, যারা পৃথিবীর বুকে মানুষের দুখ দুর্দশা অন্তর দিয়ে অনুভব করেছে, ঘোষণা করেছে তার বিরুদ্ধে নীরব বিপ্লব তাদের গাঁথা সোনালী অক্ষরে খচিত সে ডানায়। নিজেকে আজীবন ব্যার্থ ভাবা নগণ্য গণমানুষের কবিকে এভাবেই মহাকাল স্নেহভরে কোলে তুলে নেয়।
উড়ে চলে আয়াজ, তার শিশুকন্যার হাত ধরে, এমন এক আকাশে, যে আকাশ জীবিতাবস্থায় তার প্রতি সদয় আচরণ করে নি।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন