|
কলমের কালি শেষ
|
|
বিবর্ণ শেষকীর্তির সফল সমাপ্তি । (গল্প)
29 December 2014, Monday
যাধব সাহেব এশার নামাজে রুকুতে যেতেই বুক ধব ধব করে উঠল দুই পায়ের ফাঁকা অংশটাকে কবরের মত দেখতে পেয়ে । সেজদায় যেতেও শরীরটা এমনভাবে নিস্তব্ধ হয়ে গেল যেন তিনি কবরে ঢুকে যাচ্ছেন । এমন অনুভূতি এর আগে কখনো হয়নি ।যাধব সাহেবের মনে কেমন যেন অদৃশ্য এক আতংক ভর করেছে এই বুঝি কেউ তাকে মেরে ফেলল ! অথচ তিনি আছেন সিকিউরিটি বেষ্টিত ডুপ্লেক্স বাড়িতে ।তাহলে এ কেমন ভয় যেখানে সার্বিক নিরাপত্তা মূখ্য নয় ? ঘরের ভেতর এদিক ওদিক শুধু ছোটাছুটি করছেন । যেই রুমে লোক আছে সেই রুমে গিয়ে বসে থাকছেন ।কর্মচারীদের ডেকে তাদের সাথে কথা জুড়ে দিচ্ছেন অথচ কর্মচারীগুলো বহু বছর হয় এই ঘরেই কাজ করে আসছে কিন্তু যাধব সাহেব তাদের চেহারাও ঠিকভাবে কখনো দেখেননি । সবার বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না যাধব সাহেবের কিছু একটা হয়েছে ।তিনি আজ খুব আতংকিত ।তার মনে আনাগোনা করছে শত্রুবিহীন কোন এক অচেনা মৃত্যুর আশঙ্কা ।তার মনে হচ্ছে এই মুহূর্তের জন্য পৃথিবীতে কোন নিরাপদ জায়গা নেই ।
নামাজ পড়াটা যাধব সাহেবের কাছে নিছকই অভ্যাস মাত্র । কথায় আছে না মানুষ অভ্যাসের দাস ! তাই ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে পড়তে পড়তে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল সে জন্যই তিনি নামাজ না পড়ে থাকতে পারেন না । তিনি কটা রুকু আর সিজদাকেই নামাজ বলে মনে করে থাকেন । নামাজের যে গভীর মর্মার্থ আছে তিনি সেটা অনেক আগেই ভুলে গেছেন । যাধব সাহেব একজন উচ্চ পদস্থ সরকারী চাকুরে ।অবসরে যাওয়ার আর অল্প কয়দিন বাকী আছে । এই চাকরি সময়কালে অত্যন্ত সফলতার সাথে অনেক ধনসম্পদ গড়েছেন ।তাই বলা যায় অবসরটাও সফলভাবেই হবে । ছেলে মেয়েরা বিভিন্ন উন্নত রাষ্ট্রে স্যাটেল হয়ে গেছে । তিনি এখন তার বউ আর হাফ ডজন কর্মচারী নিয়ে এই বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়িতে থাকেন ।
রাত যত বাড়ছে যাধব সাহেব শঙ্কা ততই বাড়ছে । তার কোনকিছু করতেও ভালো লাগছেনা খুবই অস্থিরতায় ভুগছেন ।তিনি এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে আছেন যা কাউকে বলতেও পারছেন না । ওয়াশ রুমে পর্যন্ত দরজা খোলা রেখে ঢুকছেন ।কোন মতে রাতের খাবার খেয়ে বউকে সাথে নিয়ে শুয়ে পড়েছেন । রুমের লাইটাও জ্বালিয়ে রেখেছেন ।আবার বউকে বলে দিয়েছেন সে যেন তাকে রুমে একা রেখে কোথাও না যায় এমনকি ওয়াশরুমেও না । যাধব সাহেবের এইসব কান্ড দেখে বউ পড়েছেন বিশাল সমস্যায় ।ডাক্তার ডাকবেন কিনা ভাবছেন ।যাধব সাহেব মাথার নিচে হাতদুটো গুঁজে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন ।লাইটের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে গভীরভাবে কি যেন ভাবছেন । তার মনে চাকরি জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাই পায়চারি করছে যে সব ঘটনাগুলো অন্যায় ছিল ।যেসব ঘটনাগুলো অন্যের জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে । আর এইসব ঘটনাগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন যাধব সাহেব ।
তার মনে পড়ে শফিক নামের ছেলেটির কথা ।একটা পিয়নের চাকরির জন্য জমিজমা বিক্রি করে ধারদেনা করে তাকে টাকা দিয়েছিল কিন্তু শফিকের চাকরি তিনি কখনো দিতে পারেননি । পরিশেষে ঋনের বোঝা মাথায় নিয়ে দারিদ্র্যের কশাঘাতে শফিকের মা আত্মহনন করেন ।অথচ শফিকেরা এইজন্য তার একটি বালও ছিড়তে পারেনি বলে তিনি বুকফোলা গর্ব করেছিলেন । তার আরও মনে পড়ে হায়দারের কথা । টেন্ডার পাইয়ে দেওয়ার অজুহাতে তার সুন্দরী বউয়ের সাথে একান্তে ঘন্টখানেক কাটিয়েছিল ।পরে হায়দারকে পাগল হয়ে যেতে দেখেছে সে ।কিন্তু সে কলার উঁচিয়েই ঘুরেছিল ।তার অধীনস্থ আসাদের ঘটনাও তার চোখের সামনে ভাসছে । আসাদকে দিয়ে তিনি অনেক অন্যায় স্বার্থ উদ্ধার করেছিলেন । কিন্তু যখন অবৈধ এক কাজে আসাদ ধরা পড়ে তখন তাকে ফাঁসিয়ে দেন অথচ তিনিই কাজের মদদদাতা ছিলেন ।এইসব ঘটনা নিয়ে অবশ্য যাধব সাহেব কখনো মাথা ঘামাতো না । কারন তিনি মনে করতেন এইগুলোতো চাকরিরই একটা পার্ট ।তার জীবন তো রাজার মতই চলছে । এইরকম আরও অনেক ঘটনাই এই আলো মিশ্রিত রাতে যাধবকে অনেক ভাবিয়ে তুলছে ।চারদিক থেকে যেন এই ঘটনাগুলো বেদনাদায়ক সুঁই হয়ে তাকে অনবরত খোঁচা মারছে আর সারা শরীরে আঁকাআঁকি করছে ।তিব্র যন্ত্রণায় ভেতর ভেতর জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে ।
ভোর হতে আর কয়েক ঘন্টা বাকি ।অটো স্প্রে চালু থাকার পরও হঠাৎ বিশ্রী গন্ধ নাকে আসায় যাধব সাহেবের স্ত্রীর ঘুম ভেঙ্গে যায় ।তিনি আধ ভাঙ্গা ঘুমে পাশ ফিরতে দেখেন যাধব সাহেব বিছানায় নেই ।মাথা উঁচু করে ওয়াশ রুমের দিকে তাকালেন দরজা খোলা । সেখানেও লাইট জ্বলছে কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নেই ।চোখটা খাটের পাশে ফ্লোরে যেতেই তিনি ভয়ে আঁতকে উঠেন । ফ্লোরে উপড় হয়ে যাধব সাহেব পড়ে আছেন । তার একপাশের রাগান্বিতভাব করা চোখ স্ত্রীর দিকে তাক হয়ে আছে ।জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকেন তার স্ত্রী ।যাধব সাহেবের হাত পায়ের হাটুগুলো কিঞ্চিৎ বাঁকা হয়ে আছে । জিবটা হালকা বের করা । মুখের একপাশ দিয়ে লালা ঝরে পড়ছে ফ্লোরে ।গায়ে পড়ে থাকা ট্রাউজার থেকে তীব্র দুর্গন্ধ বের হচ্ছে । কে যেন যাধব সাহেবকে খুব বর্বরভাবে মেরে ফেলে রেখে গেছে ? কার এত বড় সাহস হলো যাধব সাহেবকে এভাবে মারলো ? কিন্তু এত নিরাপত্তার ভেতরে খুনি কিভাবে আসলো এই বদ্ধ এসি রুমটিতে ? কেউ আসার কোন আলামতও দেখা যাচ্ছে না । কে তাকে এত নীরবে নিভৃতে নির্মমভাবে হত্যা করে গেল পাশে শুয়ে থাকা তার স্ত্রীও বিন্দুমাত্র টের পেল না ? এই প্রশ্নগুলো পৃথিবীতে কেবলই রহস্যের জন্ম দেয় । যেগুলোর কোন আদালত নেই, ইনভেষ্টিগেশন নেই, বিচার নেই । উত্তর কেবল যাধব সাহেবই জানেন ।
যাধব সাহেবের স্ত্রী দূরত্ব বজায় রেখে বিলাপ করেই যাচ্ছেন । কিন্তু যাধব সাহেবের কাছে গিয়ে তাকে একটু ছোঁয়ে দেখারও চেষ্টা করছেন না । অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না তিনি কি স্বামী শোকে কাঁদছেন নাকি হরর সিন দেখে ভয়ে কাঁদছেন । কর্মচারীরা যাধব সাহেবের শরীর সোজা করার কাজে ব্যস্ত । অথচ তিনি জীবিত থাকাকালীনই এক কর্মচারী ভুলবসত তার গায়ের সাথে লেগে যাওয়ায় তাকে এমন প্রহার করেছিলেন যে তিনদিন জ্বরে আক্রান্ত ছিল বেচারা । তবে তাদের আজ ভয় নেই সুনিশ্চিত যাধব সাহেব আজ তাদের কাউকেই প্রহার করবেন না !
কর্মচারীরা মন দিয়ে কাজ করছে, স্ত্রী বুক ভাসিয়ে কাঁদছে, দূর থেকে অত্যন্ত শান্তভাবে এই বদ্ধ ঘরে ভেসে আসছে আল্লাহু আকবার আল্লাহ--হু আকবার……
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন