|
তাহসিনুল ইসলাম
|
|
অন্ধ (গল্প)
29 December 2014, Monday
ফুলহীন বাগান আর চুলহীন মাথা দুটোই সমান শ্রীহীন। চুলহীন মাথায় যেমন চিরুনি ওঠে না তেমনি ফুলহীন বাগানের দর্শক জুটে না। ফুলেদের একটা বিশেষ শক্তি আছে। আকর্ষণ শক্তি। অতি নিরামিষ মনের মানুষও ফুল দেখলে একটু থমকে দাঁড়ায় কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার এই যে চৌধুরী বাড়ির ফুলভরা বাগানটা নিরামিষ ব্যক্তি তো দূরের কথা কোন আমিষ ব্যক্তিরও পদ রোধ করতে পারে না। বাগানটায় যে ফুলের ঘাটতি আছে এমন কিন্তু নয়। বাগান নানা রঙ বেরঙের ফুলে ভরা। বাগানে মৌমাছি, পাখি আর প্রজাপতিদের উদার উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। বাগানটা আকারেও বেশ বড়। বাগানের পরিচর্যাকারিণী যে বেশ ফুলমনা সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। গ্রামে এই বাগানটার বিশেষ খ্যাতিও আছে। আগে মানুষজন বাগানটায় দাঁড়াতো বেশ। ইদানীং বাগানটার আশপাশে কেউ দাঁড়ায় না। মানুষের এই উদাসীনতা ফুলগুলো ঠিক ধরতে পারে না। তারাও যেনো ভেতরে ভেতরে পুড়ে। তবে একজন মানুষকে তারা সবসময় পাশে পায়। সেই মানুষটি হলেন শরিফা বেগম।
চৌধুরী বাড়ির এই ফুলবাগানটার পরিচর্যাকারিণীর নাম হলো ঋতু। ঋতু জাফর চৌধুরীর দুইমাত্র কন্যা। ঋতু বড়। ঋতুর ছোটবোন রিপা। ঋতুর ফুলের প্রতি দুর্বলতা থাকলেও রিপার দুর্বলতা চুলের প্রতি। সে সবসময় চুলের পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকে। কি করলে চুল আরও ঘনকালো সুন্দর হবে সেটা নিয়েই তার যতো ভাবনা। ইদানীং সে একটা নতুন জটিলতায় ভুগছে। চুলের দৈর্ঘ্য জটিলতা। নাটক সিনেমায় নায়িকাদের ড্রেসের সাথে সাথে চুলের দৈর্ঘ্যও কমে এসেছে। হাফ প্যান্ট পরে তো আর সুচিত্রা সেনের মতো লম্বা চুল রাখা যায় না। রিপার চুল লম্বা। সে ঠিক বুঝতে পারছে না চুল ছোট করবে না-কি এমন লম্বাই রাখবে। দু’ দিন আগে তার স্কুলের এক বান্ধবী চুল কেটে ছোট করেছে চমৎকার নকশায়। তার এই চুল কাটাটাকে সে চুল কাটা না বলে বলেছে হেয়ার কাটিং। কাটা আর কাটিংয়ের মধ্যেও যে বিরাট একটা ফারাক আছে সেটা রিপা সেদিন বুঝেছে। কাটিংয়ের কি একটা নামও বলেছে তার বান্ধবী। রিপার সেটা মনে নেই। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে ঠিক করলো চুলের ব্যাপারে ঋতুর পরামর্শ নেবে। কাটিং-ফাটিং পরামর্শ। ঋতুকে বাড়ির ভেতরে পাওয়া গেলো না। এই সময়টাতে সে বাড়ির উত্তর দিকটায় থাকে। ফুলবাগানে। ফুলের গাছে জল দেয়। রিপা উত্তর দিকটায় সাধারণত যায় না। আটকা পড়ার ভয়ে, কিন্তু আজকে তাকে যেতেই হলো। চুলের ব্যাপার। বেশ সন্তর্পণে পা ফেললো সে। তার এই অতি সতর্কতাতেও কোন লাভ হলো না। আটকা সে ঠিকই পড়লো। শরিফা বেগম তাকে আটকিয়ে দিলেন।
মানুষের জীবন কয়েকটা পর্বে বিভক্ত। মানুষ তার জীবনের দু’ পর্বে অনর্গল কথা বলে, কথা বলতে চায়। এই দু’ পর্বের একটা পর্ব হচ্ছে শৈশব আরেকটা বার্ধক্য। শৈশবে তার কথা শুনার অনেক মানুষ থাকলেও বার্ধক্যে আর তার শ্রোতা জুটে না। হাজার কথা মনের ভেতর ভিড় করে কিন্তু সেটা শোনানোর মানুষ পাওয়া যায় না। বার্ধক্যে মানুষ বড় একা হয়ে যায়। শরিফা বেগম হচ্ছে এমন একা নিসঙ্গ একজন মানুষ। তিনি ঋতু আর রিপার দাদী। উত্তরের ঘরে সারাদিন চিৎকার করেন। চিৎকার করে ছেলে, ছেলের বউ, নাতি নাতনীদের কাছে ডাকেন কথোপকথনের জন্য। কেউ তাঁর ডাক শুনে না। বয়স আশির উপরে চলে গেছে। এখনো তাঁর দৃষ্টি এবং অনুমান শক্তি প্রখর। একটু আওয়াজ পেলেই বুঝে ফেলেন কে কোথা দিয়ে যাচ্ছে। কাছের মানুষকে চিনতে পারেন না, কিন্তু দূর দূরান্তের মানুষ ঠিকই চিনে ফেলেন। দূরে জানালার ফাঁক দিয়ে কাউকে দেখতে পেলেই নাম ধরে ডাকতে থাকেন। যদিও সেই ডাকে কেউ সাড়া দেয় না, কদাচিৎ দু’ একজন ডাক শুনে যদি কাছে আসে শরিফা বেগম তখন আর তাকে চিনতে পারেন না। বলেন, কে বউমা-- ঋতু। ও ফরিদা তুই। আয় বস। তুই ছাড়া আমার ডাক কেউ শোনে না। ফরিদা চৌধুরী বাড়ির কাজের মেয়ে।
কাউকে কাছে পেলেই শরিফা বেগম প্রথমে জাফরের কথা জিজ্ঞেস করেন। রিপাকেও আটকিয়ে প্রথমে তিনি তাই জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে রিপা জাফরকে দেখি না ক্যান? ও তো আমার কাছেই আসে না এখন। রিপা উশখুশ করতে থাকে। দাদীর প্রশ্নের উত্তর সে দেয় না। শরিফা বেগম তার হাত চেপে ধরেছেন। না জানি কখন ছাড়বেন? আজকে কি ভেবেই যে সে শরিফা বেগমের ডাক শুনলো। রিপা আফসোস করে। শরিফা বেগম আবার জাফরের কথা জানতে চান, তোর আব্বু কি আছে বাড়িতে রে? একটু ডেকে দে না? রিপার সংযমের সুতোটা এবার ছিঁড়ে যায়। বিরক্ত কণ্ঠে বলে, না নেই। দাদী ছাড়ো আমি বাগানে যাবো। আপুর সাথে কথা আছে।
শরিফা বেগম রিপাকে ছেড়ে দিয়ে বাগানের পাশের যে জানালাটা সেই জানালায় এগিয়ে গেলেন। জানালাটা বিছানার সাথে লাগানো। বিছানা ছেড়ে তিনি উঠতে পারেন না। এই জানালাটাই এখন শরিফা বেগমের নিত্যসঙ্গী। জানালাটার পাশেই তিনি প্রায় সারাদিন বসে থাকেন। বসে বসে ফুল আর পাখিদের সাথে কথা বলেন একা একা। ঋতু বাগানে এলেই তাকে জ্বালাতন করেন। ঋতু শরিফা বেগমের ঘরে না গেলেও যখন বাগানে আসে তখন অবশ্য বেশ কথা বলে। শরিফা বেগম এজন্য ঋতুকে একটু হলেও পছন্দ করেন। জানালার কাছে এসে দেখলেন বাগান জনশূন্য। বাগানে ঋতু নেই। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো বাগানের পথে চোখ বেঁধে রাখলেন। কেউ যদি এই পথে হাঁটে কিন্তু প্রহরের পর প্রহর কেটে যায় কেউ আর এই পথে হাঁটে না।
বিকেল বেলা। শরিফা বেগম জানালার পাশে বসে আছেন বাগানে। হঠাৎ কানে জাফরের গলা ভেসে আসে। শরিফা বেগম জাফরকে ডাকতে থাকেন, এই জাফর শুনে যা। কই থাকিস সারাদিন বাপ। জাফর--- এই জাফর। জাফর সাড়া দেয় না। আসরের আজান দিয়েছে। সে টুপি পরে মসজিদে যায়। শরিফা বেগম দূর থেকে তাঁর ছেলের সাদা টুপি পাঞ্জাবী পরা মূর্তিটা দেখতে পান আবছায়া। জাফর ইদানীং বেশ ঈশ্বরমুখী হয়েছে। মসজিদে ইমাম সাহেবের অনুপস্থিতিতে এখন সে নামাজও না-কি পড়ায়। শরিফা বেগম আবার চিৎকার করেন, জাফর! নামাজ শেষে একবার শুনে যাস। জাফর--- এই জাফর। জাফর নিরুত্তর। সে মনে মনে তসবিহ পাঠ করছে--- সুবহানাল্লাহ--আল-হামদুলিল্লাহ। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। শরিফা বেগম জাফরের পথ চেয়ে থাকেন। কখন সে নামাজ শেষে ফিরবে। জাফর নামাজ শেষে আবার তসবিহ পাঠ করতে করতে ফিরে। শরিফা বেগম আবার ডাকেন। এবারও জাফরের কোন সাড়া পাওয়া যায় না। জাফর তার ঘরে ঢুকে পবিত্র কুরআন শরিফ বের করে তেলওয়াত শুরু করে। জাফরের সুললিত কণ্ঠের তেলওয়াত শুনে শরিফা বেগমের চোখে জল আসে। তিনি কাঁদতে থাকেন। শরিফা বেগমের কান্না জাফরের কানে ঢুকে না। সে সূরা বনী ইসরাইল পাঠ করে। ২৩ নং আয়াত। আয়াতটা শরিফা বেগমের কান্নাটা আরও বাড়িয়ে দেয়। জাফর এই আয়াতের অর্থ না জানলেও শরিফা বেগম যে ঠিকই জানেন--- ‘আর তোমার রব আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো। যদি তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তুমি তাদেরকে ‘উহ’ পর্যন্ত বল না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; তাদের সাথে বিনম্রভাবে সম্মানসূচক কথা বলো।’
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন