|
সকাল রয়
|
|
::: অ রু ণা র চি ঠি :::
24 December 2014, Wednesday
চন্দন,
তোমাকে যে কি বলিয়া সম্বোধন করিতাম তাহা এই পত্রখানা লিখিবার সময় কিছুতেই মনে করিতে পারিতেছি না। মাথাটা নিয়াই হইয়াছে যতো সমস্যা কিছুতেই আজকাল অনেক কিছু মনে রাখিতে পারেনা। যাই হোক তোমাকে তুমি বলিয়াই বলিতেছি। জানি না কেমন আছো? ভগবান এতটাই কঠিন হইয়াছে আমাদের উপর তাই ভরসা করিতে আর পারি না। পত্র পাইয়া হতবাক হইয়াছো নিশ্চই, তোমাকে পত্র লিখিতাম না; কিন্তু কেন লিখিলাম, তাহা পত্র পাঠে জানিতে পারিবে। আমি ভয় পাইতেছি পত্রখানা তোমার হাতে কি পৌঁছাইবে কিনা। বেহাত হইয়া গেলে আমার হয়তো কিছু হইবে না তবে তোমার অনেক কিছু অজানা রইয়া যাইবে। চন্দন, আমি কেমন আছি তাহা বলিয়া দুঃখের ভার বাড়াইতে চাইনা শুধু জানিও আছি এখনও বাঙলার মাটিতে।
গতকাল আওয়াল স্যারকে এই বিরিশিরি খ্রীষ্ট পল্লী পাড়ার ক্যাম্পে ধরিয়া আনা হইয়াছিল। আড়াল থেকে তাহার মুখ হইতে শুনিলাম তুমি ১১নং সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর সহিত আছো। যুদ্ধে অংশগ্রহন করিয়াছ হালুয়াঘাট আর কিশোরগঞ্জে তোমাদের অপারেশন চলিতেছে জানিয়াই চিঠি লিখিতে বসিয়াছি। পত্র পাঠে তোমাকে বলা দরকার জুন মাসের শেষের দিকে তোমার সহিত আমার দেখা হইয়াছিল সে কথা তোমার মনে নাই। তুমি পরমা (স্কুল মাষ্টার'নি পরমা সেন) কে বলিয়া আসিয়া ছিলে তোমারে মা’র দিকে খেয়াল রাখিতে। তুমি বাড়ি ছাড়িবার পর আমি আর পরমা প্রায়ই তোমাদের বাড়ির দিকে যাইতাম মাসিমার সহিত কথা হইত।
আগষ্ট মাসের এক সন্ধ্যায় শহর হইতে পাক বাহিনী আমাদের গ্রাম ঘিরিয়া ফেলিল, দুর্গাপুর বাজারে তাহার আগুন দিলে পরে যাহারা বাঁধা দিতে গিয়া ছিল তাহাদের মৃতদেহ পরদিন সকালে দেখিয়া আমি অজ্ঞান হইয়া গিয়াছিলাম। আরো ব্যথিত হইয়াছিলাম খ্রিষ্টান পাড়ার আদিবাসীদের সোমেশ্বরীর তীরে নিয়া কোন কারন ছাড়াই গুলিতে বুক ঝাঁজরা করিয়া দিত। দুঃখের কথা আর কি বলিব তোমার মা কিছুতেই বাড়ি ছাড়িবেন না তুমি আসিয়া যদি ফিরিয়া যাও সে ভাবনাতেই বিপদ ডাকিয়াছিলেন।
গত ২৩ শে আগষ্ট শুনিলাম ময়মনসিংহে আলবদর নামে একটা বাহিনী গঠন হইয়াছে তাহার নাকি ধর্মের নাম বলিয়া হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দেয় আর লুট করিয়া নেয় এমনকি মেয়ে মানুষ দেখিলেই উঠাইয়া নিয়া যায়। ২৩ তারিখ বিকালে আমি পরমাকে নিয়া তোমাদের বাড়ির সমুখে গিয়া এতটাই অবাক হইয়াছিলাম যে সেই দৃশ্যের কথা মনে হইলে এখনও আমি সংজ্ঞাহীন হইয়া যাই। তোমাদের বাড়ি লন্ড ভন্ড, তুলসি তলায় তোমার বইপত্র আগুনে অর্ধেক পুড়িয়া রইয়াছে আর তোমার মায়ের রক্তমাখা মরদেহ খানা কলতলায় পড়িয়া রহিয়াছে, সেই দৃশ্যের কথা কি বলিব? পরমা এইসব দেখিয়া মাটিতে পড়িয়া গেলে পড়ে তাহাকে নিয়া আমি বিপাকে পড়িয়াছিলাম। তোমাদের খুড়তুতো কাকিমার দেহের অর্ধাংশ কে বা কাহার পুড়াইয়া দিয়াছে তাহা জানিতে পারিলাম না। তোমার মার মরদেহ দাহ করিবার আয়োজন করিয়া শেষ পর্যন্ত ব্যার্থ হইয়াছিলাম কানিয়াল গ্রামের রাজাকারের দল আসিয়া সোমেশ্বরীর জলে তাহা ভাসাইয়া দিয়া দিল।
এইসব কথা পড়িয়া তুমি নিশ্চই কাঁদিবে, আমি আর কি বলিব সবই ভগবানের লেখা। তবে একটা কথা বলিব তোমায় তাহা হইল তোমার কিন্তু দেশের জন্য প্রাণ দিল। সকলেই জানিত উত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার তোমার মা পৌঁছাইয়া দিত তাই দুঃখ করিবার কিছু নাই। এই পত্রখানা তোমার হাতে পৌঁছাইলে একটি বারের জন্য সোমেশ্বরীর পাশে আসিও তাতে করে তোমার মায়ের আত্মা শান্তি পাইবে। চন্দন চিঠির এই অব্দি লিখিয়া আমার হাত আর চলিতেছে না তবুও লিখিতেছি। আমার চোখ জলে ভিজিয়া আসিতেছে, কি করিয়া যে লিখি? জানি আমি না লিখিলেও তুমি একদিন জানিতে পারিবে। পরমা তুমি যাহাকে প্রাণাধিক ভালবাস সে আর আমি যুদ্ধের ভয়াল দিন গুলিতে এক সাথেই থাকিতাম। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে এক রাত্রিতে আল-বদর বাহিনীর সহযোগীতায় কুলু পাড়ার একদল রাজাকার সহ পাক বাহিনীরা আমার বাবাকে গুলি করিয়া আমাদের দুজনকে ক্যাম্পে তুলিয়া নিয়া আসে। আমাদের কান্না বা অনুনয় কিছুই তাহারা শুনে নাই। পরমা আর আমি দুজন দুই কামরায় বন্দি ছিলাম। তুমি নিশ্চই বুঝিতে পারিয়াছো আমাদের ভাগ্যে কি ঘটিয়াছিল তখন নরকবাসের এক সপ্তাহ পার হইবার পূর্বেই জানিতে পারিলাম পরমা গলায় শাড়ি পেচাইয়া ঝুলিয়া গেছে।
কি দুর্ভাগ্য আমার ওর মরদেহ খানাও দেখিতে পারি নাই। নদীর ধারে নাকি ফেলিয়া রাখিয়াছিল। চন্দন কাঁদিতে কাঁদিতে আমার চোখের জলও শুকাইয়া যাইতেছে আজকাল গলা ছাড়িয়া কাঁদিতেও পারিনা। তুমি হয়তোবা পত্রখানা পাইবে কিন্তু আমি ততদিন থাকিব কিনা তাহা বলিতে পারিনা। নেয়ামত আলীর মতো টুপি পড়া লোক আমাদের সবকটি বাড়ি আগুন দিয়াছে, ফজলু রাজাকার ধানি জমি দখল করিয়াছে আমার যে আর কিছুই রহিল না। পরমা রোজ কাঁদিত আর বলিত চারিপাশে এত যন্ত্রনা! তবুও শান্তি হয় ভাবিয়া, তুমি দেশের জন্য যুদ্ধ করিতেছো। আমাদের কথা ভাবিও না দেশের জন্য যুদ্ধ চালাইয়া যাইও। চন্দন তোমার মনে আছে কলেজের দিন গুলিতে ইউনিয়নের সভায় তুমি বলিয়াছিলে “ অন্যায় দেখিলে প্রত্যেকটা মানুষের গর্জে উঠা উচিৎ, তা না পারলে মরে যাওয়া শ্রেয়”। আমি বা আমরা সেই রেশ ধরিয়া প্রাণ দিয়া চলিয়াছি স্বাধীনতা পাইবার আশায়। জানিনা তাহা মিলিবে কিনা।
চন্দন অনেক কিছু লিখিবার জন্যই বসিয়াছিলাম কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যা, কাগজে আর লিখিবার মতো অধিক জায়গা নাই। বহু কষ্টে এই কাগজখানি সংগ্রহ করিয়াছি। তোমার প্রিয় শিক্ষক আওয়াল স্যারের কোন খোঁজ নাই তুমি পারিলে খোঁজ নিও। এই পত্রখানা আরজ আলী স্যারের কাছে দিয়া দিলাম। চিঠি পড়িয়া কাঁদিও না তাহা হইলে মৃত আত্মারা কষ্ট পাইবে। ভালো থাকিবার চেষ্টা করিও ঈশ্বর তোমার সহায় রইবে।
ইতি
অরুনা।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন