|
কলমের কালি শেষ
|
|
একটি ইঁদুর, এবং যুবকের ভাবনা । (গল্প)
24 December 2014, Wednesday
রাতের গভীরতাটা অতি সহজেই আন্দাজ করা যায় ।চারদিকে সুনসান নীরবতা পালিত হচ্ছে ।বিল্ডিংগুলোর বেশিরভাগ লাইটই অফ হয়ে আছে ।হঠাৎ হঠাৎ কুকুরের কিছু ডাক কিংবা নাইটগার্ডের ফুরুত ফুরুত বাঁশির আওয়াজ ।এই বাসায়ও ঠিক সেইরকমই গভীর রাতের আচ্ছন্নতা চলছে । সকল রুমেরই লাইট বন্ধ । সবাই গভীর ঘুমে স্বপ্ন দেখায় ব্যস্ত ।শুধু মাঝে মাঝে টুকটাক কিছু শব্দ হচ্ছে যেগুলো বিলগেটস এর বাড়িতেও হয় ।মোটামুটি গভীর রাতের সকল বৈশিষ্ট্যই চমৎকার মোহনীয়তায় ফুটে উঠেছে ।কিন্তু সেই বৈশিষ্ট্যকে এক যুবক কুপোকাত করে দিয়েছি । এখনো সকল অন্ধকারের মাঝে একটি রুমে নীরবে লাইট জ্বলছে । একজন পরিপূর্ণ যুবক এখনো চেয়ার এবং কম্পিউটার নিয়ে নিরলস কাজ করে চলেছে ।যদিও গভীর রাত জেগে কি কাজ করা হয় স্বয়ং যুবকও এই রহস্যের ভেতর ঘুরপাক খায় ।
গভীর রাতের নিস্তব্ধতা হঠাৎ করে ভেঙ্গে গেল ।এই নিস্তব্ধতা অবশ্য পারিপার্শ্বিক অবস্থার নীরবতা নয় । এই নিস্তব্ধতা হচ্ছে আমার ভেতরের নীরবতা । রাতের গভীরতার সাথে সাথে আমিও কোন এক গভীর নীরবতার জঙ্গলে ঢুকে গেছি তা ঠিক খেয়ালে ছিল না । কিন্তু যখন নিজের ভেতরের ১ নাম্বার থেকে কল করে বলা হল ‘ওই হারামজাদা তুই আমারে আর কতক্ষণ আটকাইয়া রাখবি তাড়াতাড়ি রিলিজ কর ! এই তোর লাস্ট ওয়ারনিং বলে দিলাম’ ।আমাকে রীতিমতো বাধ্য করে নীরবতাটা ভঙ্গালো ।কি আর করা টয়লেটের দিকে ছোট লাগালাম ।
লাইট জ্বালিয়ে টয়লেটে ঢুকতেই একটা ইঁদুর তড়িঘড়ি করে বেসিনের আড়ালে লুকিয়ে গেল ।এইটা দেখে প্রথমে নিজেকে মনে মনে খুব সাহসী ভাবতে লাগলাম যাক এই প্রথম কোনকিছু এই নিরীহ জীবটিকে দেখে ভয় পেল হোক না সেটা ইঁদুর তাতে কি ভয় তো পেয়েছে ! কিন্তু ইঁদুরটা টয়লেটে ঢুকলো কিভাবে ? ছোট জানালাটার দিকে চোখ যেতেই বুঝলাম জানালার এই ছোট্ট ফাঁকাটা দিয়েই ঢুকেছে ।কিন্তু টয়লেটে কেন ঢুকলো? এখানে তো ইঁদুরের কোন খাওয়ার পাওয়া যায় না !ভাবলাম হয়তো পানি খেতে ঢুকছে ।দুরর আমার এত কিছু ভেবে কাজ নাই আমার কাজে আমি যাই ।
তবে ইঁদুরটাকে প্রথম দর্শনে মনে হলো আমার মতই তাগড়া কোন যুবক ইঁদুর হবে । হয়তো এখনো কোন ললনা ইঁদুরের পিছনে ভালবাসা পাওয়ার জন্য নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছে ।হঠাৎ করে ইঁদুরটা আবার বেরিয়ে এসে আবার বেসিনের আড়ালে চলে গেল ।এখন দেখে আবার মনে হলো ইঁদুরটা বড়ই ক্লান্ত । মনে হলো যেন কোন মধ্যবিত্ত ইঁদুর পরিবারের কর্তা । আমার বাবার মতই পরিবারের হাল টানতে টানতে নুয়ে পড়েছে ।ইঁদুরটা আবার বের হয়ে আবার ঢুকে গেল । বুঝতে পারছি ইঁদুরটা আমার ভয়ে দিশেহারা হয়ে গেছে তাই তার মাথায় কোন কিছুই কাজ করছে না ।সেইজন্যই বারবার ছুটোছুটি করছে । বিপদে পড়লে তো মানুষেরই মাথা ঠিক থাকে না আর সে তো ইঁদুর ।তাছাড়া মানবজাতি সম্পর্কে তো তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনাতীত । আর সে জায়গায় ছোট্ট একটি রুমে আস্ত একটা মানুষের সাথেই সে অবস্থান করছে ।সে তো পাগল হবেই হয়তো ধরেই নিয়েছে মৃত্যু এইখানেই অবধারিত ।
কিন্তু সে তো আর জানে না যে আমি একজন নিরীহ ।আমি তাকে সান্ত্বনা দিলাম, তোর ভয়ের কোন কারন নেই আমি তোর জন্য সম্পূর্ণ সেফ ।আরে বেটা তেলাপোকা পর্যন্ত মাঝে মাঝে উড়ে এসে আমার গায়ে বসে পড়ে ।সুতরাং তোর টেনশানের কোন কারনই নেই । আর ভয় লাগলে ওখানে একটু অপেক্ষা কর আমার কাজ শেষ হলে বের হয়ে যাস বুজলি ?আরে শোন গাধা, তুই কি জানিস ভয় পেলে মানুষও তোদের মত ইঁদুর হয়ে যায় ।আর আমিতো সে জায়গায় পুরুষ ।আমাদের সমাজে একটা কৌতুক প্রচলিত আছে সেটা হলো ‘নারীরা ভয় পায় তেলাপোকাকে আর সেই নারীকে ভয় পায় পুরুষলোকে’ !এইটা একটা কৌতুক হলেও এর সত্যতাও কিন্তু অনেক আছে । আচ্ছা ভালো কথা ভয় পেলে তোরা কি হছ? তেলাপোকা নাকি অন্য কিছু? ধুরর তুই তো আবার কথা কইতে পারিস না ।সে যাক গে আপাতত তুই শুনতেই থাক । তোরা যে ভাবিস মানবজাতি তোদের প্রতি বড়ই নিষ্ঠুর এইটা কিন্তু ঠিক না । তুই কি জানিস মানবজাতি নিজেরা নিজেদের প্রতি আরো বেশি নিষ্ঠুর ? আমরা তো তোদেরকে মারলে লেজটা ধরে বাহিরে ফেলে দেই । কিন্তু আমরা আমাদেরকে তো অনেক কষ্ট দিয়ে মারিই তারপর পিসপিসও করি, আগুনেও পোড়াই, গুমও করে ফেলি । কেন তোরা টিভি দেখিস না ? টিভিতে তো এসব ঘটনা ঘন্টায় ঘন্টায় দেখায় । ও আচ্ছা তোদের তো আবার টিভি নাই ধুরর আমিতো দেখি পাগল হয়ে গেছি ।
আচ্ছা যাই হোক এইসব খুনখারাপির আলাপ বাদ দেই । তোরা কি জানিস মানুষ তোদেরকে ব্যবহার করে কত খ্যাতি অর্জন করেছে ? তোদের নিয়ে যে যুগে যুগে কত গল্প, কবিতা, উপন্যাস, সিনেমা লেখা হয়েছে এবং সেগুলো অনেক বিখ্যাতও হয়েছে, সে ব্যপারে তো তোরা একদমই ওয়াকিবহাল না ! প্রায় জায়গায়ই তোদেরকে হিরোর রোলে দেওয়া হয়েছে । যেমন ধর, বিখ্যাত কার্টুন ‘টম এন্ড জেরি’ তে তুই লিজেন্ড হয়ে আছিস । যেই সব কান্ডকীর্তি তুই দেখিয়েছিস ! কতভাবে যে বিড়ালকে তুই ধোঁকা দিয়েছিস ! আমি তো ধরতে গেলে বেশিরভাগ বুদ্ধি তোর থেকে শিখেছি ।তারপর মনে কর হলিউডের বিখ্যাত এ্যানিমেটেড মুভি ‘Ratatouille’ তে তোকে দেখানো হয়েছে বিখ্যাত শেফ এর চরিত্রে ।আরও ছিলি Harry Potter, Ice Age এ এই রকম আরও অনেক মুভিতে । গল্পের কথাতো বললামই না । বিখ্যাত গল্প ‘হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালা’ তেও ছিলি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে যদিও ওখানে তোদের হেরে যাওয়ার চরিত্রে দেখানো হয়েছে ।তবে একদিক দিয়ে তোরা জিতে গিয়েছিলি তোরা দেখিয়ে দিয়েছিস তোরা কতটা আবেগী এবং রোমান্টিক । বাঁশির সুর শুনে সবাই গিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিস । তোদের মত আমরাও এইরকম আবেগ ভালোবাসায় আটকা পড়ে লবন দেয়া ঝোঁকের মত প্রতিনিয়তই চটপট করি ।তোদের একটা সাহসী গল্পও এখন মনে পড়ছে । ওই যে সিংহকে জালে আটকা পড়া থেকে কিভাবেই না সাহস দেখিয়ে জাল কেটে উদ্ধার করেছিলি মনে পড়লে এখনো শিউরে উঠি !আরও কত সাহসী গল্প কবিতা আছে তোদের নিয়ে উদাহরন টেনে শেষ করা যাবে না । সুতরাং তোদের এত ভয় পেলে চলবে না । মনে সাহস রাখ !
এইসব ভাবতে ভাবতে চোখ ফেরাতেই হঠাৎ চমকে উঠি !কিছু দূরত্বে ইঁদুরটি তার মুখের সামনে চিকচিকে একফোঁটা জল নিয়ে আমার দিকে জ্বলজ্বলে চোখ দুটো দিয়ে তাকিয়ে আছে । এইটা দেখে আমি অবাকতো হলামই ভয়ও পেলাম । ইঁদুরটা কেন আমার দিকে এইভাবে তাকিয়ে আছে ? আমার কি দোষ ?সে কি আমার কথা শোনে অনুপ্রাণিত হওয়ার চেষ্টা করছে ! মুখে আওয়াজ দিয়ে একটু ধমকালাম কিন্তু সে যেন আমার ধমক শুনে আরও ঝিমিয়ে পড়লো । আরও কয়েকবার ধমক দিলাম ।কিন্তু কোন কাজই হলো না । এইবার মগে পানি নিয়ে ফ্লোর দিয়ে তার দিকে ঢলকালাম । কিন্তু কিসের কি পানির ঢলকানিতে তার শরীর একটু কাঁপলো কিন্তু সে একটুও নড়লোনা । এইবার আরও জোরে পানি মারলাম । একি ! ইঁদুরটা পানির ঢলকানিতে উল্টে গেল ! মারা গেল নাকি ! একটু ভালো করে দেখলাম ইঁদুরের উল্টে থাকা নিথর দেহটার দিকে ।পাঁ চারটাও নড়ছে না, লেজটাও অমনিভাবে পড়ে আছে । আহারে ইঁদুরটা বুঝি মারাই গেল । মনে হয় রূহটা চোখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে তাই চোখ দুটো ওভাবে খোলা ছিল ।ইসস মরার আগে মুখের সামনে ওই একফোটা জলও খেতে পারলো না ।মৃত্যুটা বুঝি এমনই ।
কিন্তু ইঁদুরটা মারা গেল কেন ? নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো আমার জন্য না তো এই ভেবে ? আবার চিন্তা করলাম আমার জন্য কেন হবে আমিতো ওকে কিছুই করিনি । নাকি সুইসাইড এটেম্প ছিল !হতেও পারে ! আমাদের মতই হয়তো প্রেমিকার ছেঁকা খেয়ে কিংবা সংসারের যন্ত্রনায় ইঁদুরটা আত্মহত্যা করেছে ।কিন্তু কিভাবে আত্মহত্যা করলো এখানে তো আত্মহত্যার কোন উপকরনই দেখছিনা । নাকি আমরা যেমন বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করি তেমনই ইঁদুররা পানি খেয়ে আত্মহত্যা করে ? এইসব চিন্তা করে মনটাই খারাপ হয়ে গেল । ইঁদুরের নিথর দেহটি টয়লেটে ওভাবে রেখেই বের হয়ে আসলাম ।
সকালে ছোটভাইয়ের আনন্দ চিৎকারে আধো আধো ঘুমে শুনতে পেলাম ‘আম্মা আম্মা! রাতে যে ইঁদুর মারার ঔষধ দিয়েছি সেটা খেয়ে একটা ইঁদুর টয়লেটে চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে’ ।এখন বুঝতে পারলাম ইঁদুরটা ঔষধ খেয়ে যন্ত্রনায় টয়লেটে ঢুকেছিল পানি পানের জন্য ।শুধু শুধু ইঁদুরটাকে আত্মহত্যার অপবাদ দিয়েছি । অনেক দুঃখ পেলাম । আমার জন্য ইঁদুরটা ঠিকমত পানি পান করতে পারিনি তাই অকালে একটা সম্ভাবনাময় ইঁদুর এইভাবেই ঝরে পড়লো । তবুও লেপের ভেতর উষ্ণতার খোঁজে ঘুঁজে থাকা নিজেকে সান্তনা দিলাম, গায়েবী ইঁদুরটাকে বললাম, তোকে হত্যা করে আমরা যে আনন্দ পালন করি তার থেকে আমরা নিজেরা নিজেদেরকে হত্যা করে আরো বেশি আনন্দ পাই তুই তো নিছক একটা ইঁদুর’ । এইসব চিন্তা করে মাথার নিচে লেপটা ঘুঁজে আবার ঘুমিয়ে গেলাম….
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন