এক
সাপের গমন পথের মতোই আঁকাবাঁকা মেঠোপথ। দুধারে নয়ন জুড়ানো সারি সারি গাছ। হাজার বছর ধরে যেন প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ ছুঁয়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। শহরের বিক্ষুব্ধ জনজীবনের কর্মকোলাহল থেকে অনেক দূরে, পল্লির নির্জন পথ মাড়িয়ে চাবাগানের একেবারে শেষ মাথায় থাকে ধীরেন। বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই করছে। সাত সন্তানের জনক। গত বছর এক মর্মান্তিক ট্রাজেডির শিকার হয়ে তার চার সন্তানেরই অকালমৃত্যু হয়েছে। ট্রাজেডি বলতে ভয়াবহ ডায়রিয়ার প্রকোপ আর কি! শুধু তার পরিবার নয় এ মড়ক সমস্ত বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিটিভির অনুষ্ঠানগুলো যেমন একযোগে বিটিভি ওয়াল্ডসহ সকল জায়গায় সম্প্রচার হয় তেমনি ডায়রিয়ার প্রকোপও যেন সমস্ত শ্রমিকের গৃহ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল!
আতঙ্কের ঘুরেই তখন তাদের দিন কাটত। কিন্তু করার মতো তেমন কিছুই ছিল না। একে তো বাগানের সাহেব ছিল দেশের বাইরে তার ওপর বাগানে ভালো কোন ডাক্তারও নেই। মড়ক লাগলে যেমন খুব দ্রুতই ফার্মের অনেক গৃহপালিত পশু-পাখির মধ্যে ছড়ায় তেমনি সেবার ডায়রিয়াতেও শ্রমিকদের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ আক্রান্ত হয়েছিল। যারা বেঁচে ছিল তারা যে কেবল পথ্যের জোরেই বেঁচে ছিল তা কিন্তু নয়। নিজের অদম্য বাঁচার আগ্রহের কারণেই হয়ত বিরূপ পরিবেশেও বেঁচে ওঠেছিল।
বাগানের মালিক কিরণ চৌধুরী পুঁজিবাদী মানুষ। তার চিন্তা চেতনা জুড়ে নিউটনের তৃতীয় সূত্র যেমন ভর করে তেমনি সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও শোষণের সূত্রও সর্বদা ঘুরাফেরা করে। তিনি অত্যন্ত কূটকৌশলী মানুষ। লোক দেখানো জনসেবাতে তার জুড়ি মেলা ভার! বাগানের শ্রমিকদের কাছে তিনি হলেন দেবতা তুল্য। তার কারণও আছে - তিনি যে সকল চা শ্রমিকদের শ্রমের সাথে মদ ফ্রি দেন! কোন কোন রেস্টুরেন্টে যেমন ভাতের সাথে ডাল ফ্রি ঠিক তেমনি আরকি! শুধু তা-ই নয়, মাঝে মাঝে ব্যাপক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে দু-এক ভীষণ দারিদ্র শ্রমিকের চিকিৎসার খরচও দেয়; ফলে চতুর্দিকে তার নামে ধন্য ধন্য পড়ে যায়। মদ্য ফ্রি দেওয়ার মাধ্যমে যে তাদের কতবড় ক্ষতি হচ্ছে কিংবা তাদের মস্তিষ্ক যে একেবারে ডেমেজ করে দিচ্ছে সে কথা হয়ত তারা একবারও তলিয়ে দেখে না। হয়ত মদ্য গলাধকরণ করতে করতে এখনও তা তাদের বোধেরই বাইরে!
শ্রমিকদের ছেলেমেয়েরা এমনিতেই পড়াশোনার সুযোগ পায় না। কেননা তাদের নুন আনতেই যে পান্তা ফুরায়! পড়াশোনা করার মতো বাড়তি খরচ কই? আর যারা অতিরিক্ত পরিশ্রম করে বাড়তি উপার্জন করে সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করে, তাদের সন্তানের পড়াশোনার দৌরাত্ম্যও বড় জোর পাঠশালা পর্যন্ত! তার অবশ্য কারণও আছে। বাগানের সাহেব কিরণ চৌধুরী ঐ সব পাঠাশালা পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের বাগানের হিসাবরক্ষণ সংক্রান্ত, কিংবা তদারকি সংক্রান্ত কাজে লাগিয়ে দেন। এতে করে বাগানের কুলি হিশেবে পরিচিত চা শ্রমিকরা যারপর নাই খুশিই হয়।
এ কলির যুগে সাহেব বাবুর এমন মহানুভবতা অবলোকন করে শ্রদ্ধায় তাদের মাথা নুয়ে আসে। অবাধ মাদক কেন্দ্রিক জীবন আবর্তিত হওয়ায় তাদের চিন্তার পরিধি হয়ে ওঠেছে শৃঙ্খলিত। ফলে তাদের ছেলেমেয়েরা যে বিএ, এমএ পাশ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে কিংবা দেশের হাল ধরবে এমন উচ্চশা তাদের স্বপ্নঘুরেও হয় না। যেন চায়ের বাগানই হচ্ছে তাদের পৃথিবী! বাগানের সাহেবই হচ্ছে তাদের ত্রাণকর্তা! মোল্লার দৌঁড় যেমন মসজিদ পর্যন্ত তেমনি এইসব চা শ্রমিকদের চাহিদার দৌরাত্ম্যও বাগানের পরিদর্শক হওয়া পর্যন্ত!
ধীরেনের চার সন্তান ডায়রিয়াতে মারা যাওয়ার পর সে অনেকটা বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল। দরিদ্রদের চিকিৎসা না পেতে পেতে অনেক রোগই ভাল হয়ে যায় আর এ থেকে মোটেও ব্যতিক্রম নয় ধীরেন। কষ্টের সমুদ্রে অবগাহন করতে করতে এখন সে নিজেই কষ্টের কষ্টিপাথর হয়ে গেছে। সহজে মনে কোন কিছু দাগ কাটে না। অর্থাৎ তার কোন কিছু পাওয়ার বিপুল আনন্দ যেমন নাই তেমনি তা হারানোর বেদনাও নাই। চা শ্রমিকদের মধ্যে সকলেই জানে ধীরেনের মতো সৎ ও শান্ত আর দ্বিতীয়টি নেই।
দুই
সেদিন ছিল রবিবার। যথানিয়মেই ধীরেন চাবাগান পরিষ্কার করার জন্য দা-কাঁচি নিয়ে বের হল। আজ 'সতের নম্বর' এলাকা খ্যাত চাবাগান পরিষ্কার করার কথা। তার বাড়ি থেকে সতের নম্বর স্থানটা হাঁটা পায়ে মিনিট চল্লিশের পথ। জায়গাটি নানা কারণে ভয়ংকর। একদিকে এলাকার যত জুয়াখোর রয়েছে প্রায়ই তারা সেখানে আড্ডায় মেতে ওঠে, অন্যদিকে স্থানীয় ডাকাতরা প্রায়ই এখানে এসে মিলিত হয়।
ধীরেনের এসব তথ্য মোটেও অজানা নয়। এবারই প্রথম সে সতের নম্বর চাবাগান পরিষ্কারের জন্য এসেছে। তার আঠার বছরের সুন্দরি মেয়ে পিংকী রানি 'সতের নম্বর' স্থান সংলগ্ন চাবাগানে চাপাতা তুলছে। ধীরেন বিকেল পাঁচটা অবধি বিরতিহীনভাবে কাজ করে ফিরতি পথে রওয়ানা দেয়। তার সাথে রয়েছে নরেন চন্দ্র। গামছায় চোখ-মুখ মুছতে মুছতে সে হাঁটে। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটায় হঠাৎই লোহা জাতীয় কিছুর সাথে পা লেগে হোঁচট খায়। সাথে সাথে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে। ধীরেনের চোখ রক্তের কিন্তু দিকে নয়, লোহার দিকে। লোহাটি তুলতে গিয়ে বড় বিপাকে পড়লো সে। লোহার এক চতুর্থাংশ বের করা আর বাকী অংশটি মাটির মধ্যে। নরেনকে কাছে আসার জন্য ধীরেন ইশরা করে মৃদু স্বরে বলে- বাক্সটা নাই ধরবে?
- ক্যানে ধরবে?
- পয়ছার বাক্স লাগে ওঠা
নরেন বিস্ময়ী দৃষ্টি নিয়ে ধীরেনের দিকে তাকায়। বয়সে দুজনেই প্রায় পিঠাপিঠি। দুকলম হিসাব জানার কারণে বাগানের সাহেব তাকে ইন্সপেক্টরের দায়িত্ব দিয়েছে। ছোট ইন্সপেক্টর! ছোটবেলা থেকেই দুজনে একসাথে বেড়ে ওঠেছিল বলে তাদের মধ্যে মনিব ও শ্রমিক সম্পর্ক বেশ একটা প্রাধান্য পায় নি। বরং অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতোই থেকেছে। নরেন তার দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে রয়েছে বলে ধীরেন একটু ব্যাঙ্গ করে বলে- বাবু, তুই হামার কথার বিশ্বাছ নাই করছিছ?
- ক্যানে রে ধীরেন? হামার কাপড়ে নো মাটি লাগে যাবেক...
- হু, হামদের পয়ছায় তোদের কত ফুটানি রে বাবু...!
তীব্র খোঁচাত্মক কথা শুনে নরেন কেবল মাথা নিচু করল। ধীরেন নিজেই খুঁড়তে লাগলো। যতই সে খুঁড়ছে ততই যেন তার মধ্যে কৌতূহলের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। প্রথমবার ভেবেছিল টাকাভর্তি লোহার কলসি-টলসি হবে হয়ত, কিন্তু পরক্ষণে দেখা গেল কলসি নয় বোমা!
নরেন ভয় পেয়ে একটু দূরে সরে যায়। এ যে তাজা বোমা! এখনো ফোটে নি! তাকেও দ্রুত সরে আসতে বলে। কিন্তু ধীরেন সরে না। তার ভেতর প্রচণ্ড সাহস। এটি যে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি আর রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির মালিকে যে তা যে কোন মূল্যেই ফিরিয়ে দেয়া উচিত; বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ডিগ্রি না থাকলেও চা শ্রমিক ধীরেনের এ জ্ঞানটুকু ছিল। সে দূঢ় প্রত্যয়ের সাথে বলে- বোমা হামি কমান্ডারের গরে লিয়ে যাবে, কমান্ডার বাবু বহুত খুছ হইবেক।
এই বলেই সে বোমাটি মাটি থেকে তুলে ফেলল। অবস্থা দেখে মনে হল জিনিসটি বেশ কয়েকবছর আগের। কেউ হয়ত অগোচরে এখানে লুকিয়ে রেখেছে অথবা এটি নিক্ষিপ্ত হয়েছিল কিন্তু তা ফোটেনি। বোমার মুখ না খুললে সেটি বিস্ফোরিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম এমনটিই ধারণা ছিল ধীরেনের। কেননা, মুক্তিযুদ্ধের সময় সে যখন ট্রেইনিং নিয়েছিল তখন তাকে সব ধরনের অস্ত্র সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিয়েছিল।
সরকার যে এখন মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দিচ্ছে কিংবা সন্তানদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে ধীরেন এখনো তা জানে না। যুদ্ধ শেষে যখন নিজের মাতৃভূমি নন্দীপুরে গিয়েছিল তখন মর্মাহত হয়ে শুনেছিল- একএক করে তার মা-বাবা, বড় ভাইকে পাকিস্তানীদের হাতে নির্মমভাবে শিকার হওয়ার কাহিনি। একটি মাত্র আদরের বোনকে ধর্ষণ করে হত্যা করার মতো লোমহর্ষক কাহিনি। তাদের ঘরবাড়ি পর্যন্ত জ্বালিয়ে দিয়েছিল স্থানীয় রাজাকারের সংঘবদ্ধ চক্র। অনেকটা নিরুপায় হয়েই সেদিন ধীরেন লজ্জায়-ক্ষোভে সে গ্রাম ত্যাগ করে। নিজের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় ভালো কোন চাকরিও হয়নি।
এই চাবাগানে নরেনই তাকে আশ্রয় দিয়েছে। এজন্যই সে নরেনের প্রতি একটু বেশিই দুর্বল। নরেনের বিপদে সে যারপর নাই সাহায্য করার জন্য পাগল থাকে। শুধু সে নয়, তার বড়ে মেয়ে বিজলীও নরেন কাকার প্রতি বাবার মতোই নজর রাখে। আজ বোমা দেখে নরেন ভয় পাওয়ার কারণে ধীরেন সেই কৃতজ্ঞতাবোধ স্মরণ করে মৃদু স্বরে বলে- এ বাবু, তুই ছামনে আগুয়া, হামি হিয়া আছি...। তুই ডরাস না হাম আসছি পেছে।
তিন
বোমাটি ওজনে প্রায় পনের-ষোল কেজির মতো হবে। মরিচা পড়ায় বেশ পুরনো বলে মনে হল। আর সে মরিচাকেই কিছুটা সান্ত্বনা হিশেবে দেখল নরেন। তথাপিও তার গা ছমছম করছে। যদি... ! কথাটি একবার ভাবতেই অজানা শংঙ্কায় এই শীতের মধ্যেও সে ঘামতে থাকে। তার চিন্তার সুশ্রী পৃথিবী শংঙ্কায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। এজন্য ভয়ে ভয়ে সে একটু জোরেই পা চালাচ্ছে। কিছুদূর হাঁটতেই নরেনের চোখ পড়ল রাস্তার অদূরে চা গাছের নিচে আধো আলোতে পড়ে থাকা লাল ওড়নার প্রতি। সে ভাল করে তাকাল। কোন এক তরুণী পা বাঁধা অবস্থায় মাটিতে উপুর হয়ে পড়ে রয়েছে। সন্নিকটেই চায়ের ঝুরি।
নরেনের মন ছ্যাৎ করে ওঠলো। এ তো ধীরেনের মেয়ে বিজলীর মতো লাগছে। চেহারাটা আরেকটু স্পষ্ট হতেই নরেন চিৎকার করে ওঠলো- ধীরেন! তর ব্যাটি গাছের নিচে বান্দা পড়েছেক রে।
কথাটি বলেই সে দৌঁড়ে মেয়েটির কাছে যায়। উপুর করা মুখটি সোজা করে। কী আশ্চর্য! এ যে তার ভাতিজি, ধীরেনের কন্যা বিজলী! মুখ জুড়ে ক্ষতাক্ততা। সাদা জামা জুড়ে অলঙ্কারবিহীন ছুপছুপে রক্ত। অর্ধ উলঙ্গ বুক। যৌনাঙ্গের বলয় জুড়ে রক্তের নহরা এখনো বয়ে চলছে। হয়ত খানিক পূর্বেই কোন নরপশুর দল তার ওপর পাশবিক নির্যাতন করেছে!
নরেন চিৎকার করে ডাকলো - ধীরেন! বিজলী! মাইজি!! হামার মাইজি!!! তার আর্তচিৎকারে হাহাকার করে ওঠে স্নিগ্ধ বিকেল। গগণবিদারী চিৎকারের অণুরনন নিঃশব্দের গভীর অরণ্যে ঢেউ তুলে। ধীরেনের টনক নড়ে। কিন্তু কিছু না বুঝতে পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। নরেন বলে- এরে জলদি আয় তর বেটিটা গিরে আছে।
- কি বলছিছ তুই? হামার বেটি নো আরেক জায়গায় কামে গেছে রে!
- এই দেখ নো তর ব্যাটি লাগে, জলদি আয়।
সূর্য তখন গোধূলির আল্পনায় রং মাখাতে নিমগ্ন। চারদিকে শুনশান নীরবতা। ডানে বামে যতদূর চোখ যায় শুধু বিস্তৃর্ণ চাবাগান। কেউ কোথাও নেই। সমস্ত বাগান জুড়ে যেন অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছে। আকাশে সাদামেঘের ভেলা আঁধারের নীল গালিচায় মুহ্যমান হওয়ার পথে। কোথাও পাখপাখালিরও কোন কিচিরমিচির নেই। হয়ত সারা দিন ক্লান্তির পর নীড়ে ফিরে সন্তান-সন্ততিদের সাথে বিশ্রাম নিচ্ছে। কেবল একটি দুটি ঘাসফড়িংকেই এলোপাথারি ছুটতে দেখা গেল।
এমন নীরব ক্ষণে নরেনের চিৎকারে ধীরেন দৌঁড়ে এল। এখনও নিঃশ্বাস চলছে, বন্ধুর মেয়ের জন্য কিছু একটা করা চাই-ই চাই, তার কর্মী বাহিনীদের আনলেই বেশি উপকার হবে। তাই সে একটু দূরে সরে উচু টিবিতে দাঁড়িয়ে কাকে যেন ফোন করে। দ্রুত আসার জন্য জানায়। এদিকে রাতের অন্ধকার ক্রমেই দিনের আলোকে গ্রাস করার নিরন্তর পায়তারাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেছে।
সারাদিনের কর্মক্লান্ত ধীরেন। তদুপরি মেয়ের ক্ষতবিক্ষত দেহ দেখে তার শরীর আরও নিস্তেজ হয়ে আসে। হাড়-কাঁপানো শীতে দুর্বল ব্যক্তির মতোই সে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে। কাঁপতে কাঁপতে তার হাত থেকে পড়ে যায় পুরনো বোমা। কাকতালীয়ভাবে বোমাটি পড়ে ছোটগর্তের ওপর রাখা কালো একটি পাথরের ওপর। নিমিষেই অপ্রত্যাশিত বিকট শব্দ হয়। প্রচণ্ড ধোঁয়া। কয়েক মিনিট পর ধোঁয়া থামলে নরেন এগিয়ে আসে।
শতাব্দীর নিংড়ানো বেদনা ভারাতুর বিস্ময়ী দৃষ্টি নিয়ে সামনে তাকায়। অবলীলায় সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারের মতোই আরও অন্ধকার হয়ে ওঠে তার চোখ।
-----------------------
০৮.১২.২০১৪
মুনশি আলিম
জাফলং, সিলেট
===========================================
ছোটগল্প 'মুক্তিযোদ্ধা শ্বশুর'
এক
‘‘যেনু বইয়্যা খায়, হেনু বইয়াই অ্যাগে, ... এইডা তো মানুষ না গো, আস্তা একটা জানোয়ার! উপরওয়ালা যে আমার কপালে কী রাকছাল গো! জানুয়াররে টানতে টানতে জীবন আমার একবারে কয়লা অইয়্যা গেছে!' বাজখাই কণ্ঠে কথাগুলো মুক্তিযোদ্ধা শ্বশুর সুদীপ তালুকদারকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো শিখা। সে সুদীপের একমাত্র ছেলে দিলীপের স্ত্রী। বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি। কিন্তু শরীরের গাঠনিক অবয়ব এখনো টিনএজার তরুণীদের মতোই। বড় বোন অনামিকার কল্যাণে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি কোনক্রমে অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছিল। এরপর ষোল পেরুতে না পেরুতেই ধনাঢ্য দিলীপের সাথে তার বিয়ে হয়।
দিলীপের বিদ্যার দৌঁড় প্রাইমারি পর্যন্ত। লেখাপড়ায় তেমন একটা ভালো ছিল না। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় চারবার একই ক্লাসে ছিল কিন্তু পাশ করা তার পক্ষে আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এজন্য 'আদুভাই' গল্পের সাথে পরিচিত গ্রামের অনেকেই তাকে 'আদুভাই' বলে ডাকে। এতে সে মোটেও রাগ করে না, লজ্জাবোধ করে বলেও মনে হয় না। শারীরিক উচ্চতার দিক দিয়ে সে বাংলাদেশের প্রমাণসাইজ মানুষের মতো। পড়াশোনাতে ভাল না হলে কী হবে, ছবি আঁকার ক্ষেত্রে তাঁর জুড়ি নেই। কিন্তু বিয়ের পর সঙ্গদোষে এই একটিমাত্র প্রতিভাও লজ্জিত হয়ে পালিয়ে গেছে অন্ধকারের গহীনে।
এই কিছুদিন আগেও সুদীপ তালুকদারের বেশ জমিজমা ছিল। এলাকার মধ্যে সকলেই তাকে বিত্তশালী বলেই জানতো। কেউ কেউ আবার তাকে নাম ধরে ডাকতো না, ডাকতো তালুকদার মুক্তিযোদ্ধা নামে। গ্রামের আটদশজন ধনী গৃহস্তের মতো তারও কাঁচা-পাকা ঘর-বাড়ি ছিল। গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু ছিল। দিলীপ জুয়া খেলে মোটামুটি তিন চতুর্থাংশ সম্পত্তিই এক বছরের মধ্যে প্রায় শেষ করে দিয়েছে। অবশ্য এ নিয়ে স্ত্রী শিখার সাথে তার বেশ কয়েকবার মনোমালিন্য হয়। একবার তো প্রায় ছাড়াছাড়িও হবার উপক্রম হয়েছিল। নিজের ভুল স্বীকার করার মাধ্যমেই সেবার রক্ষা পেয়েছিল। তাছাড়া জুয়া খেলবে না বলে তিনি যে শপথ করেছিলেন সে শপথের প্রতিও অগাধ বিশ্বাস স্থাপন করেছিল শিখা। কিন্তু সে বিশ্বাস সপ্তাহ না পেরুতেই ভাঙ্গন ধরিয়েছিল দিলীপ। কুকুরের লেজ যেমন সহজে সোজা হবার নয় তেমনি জুয়াখোরদের স্বভাবও সহজে পরিবর্তন হওয়ার নয়!
¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬
এখন সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে শুধু নিজের ভিটে বাড়িটা আর বনেদী আমলের ছোট একটি পুকুর। বছর চারেক ধরে সুদীপ মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পাচ্ছে। প্রথম প্রথম টাকাগুলো নিজের কাছে রাখলেও পরবর্তীতে তা দিলীপের হাতে তুলে দেয়। আর বউভক্ত দিলীপ তুলে দেয় শিখার হাতে। যেদিন টাকা হাতে পায় সেদিন শিখা শ্বশুরের সাথে খুব ভাল ব্যবহার করে। আপ্যায়ন বা সেবা যত্নের দিক থেকেও কোন ঘাটতি রাখে না।
দুই
মাস দুয়েক আগে সুদীপের সুন্দরী স্ত্রী বড় ননদের জামাইয়ের সাথে রাতের আঁধারে পালিয়ে যায়। স্ত্রী মারা গেলে হয়ত তা সময়ে সয়ে যায় কিন্তু অন্যের সাথে পালিয়ে গেলে যে পুরুষত্বেরই অসম্মান হয়! এর চেয়ে আর বড় কষ্ট বোধ করি পুরুষের আর দ্বিতীয়টি নেই - এ সত্য শুধু সুদীপ কেন, যে কোন শিক্ষিত-অশিক্ষিত পুরুষমাত্রই স্বীকার করবে। এই সীমাহীন কষ্ট সইতে না পেরে সেদিনই সে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। এর দুদিনের মধ্যেই তার শরীরের অর্ধাংশ অবশ হয়ে যায়। সুন্দর মুখ বিকৃত হয়ে যায়। পক্ষাঘাতগ্রস্থ হওয়ার সপ্তাহখানেক পর থেকেই তার আদরের পুত্রবধূর আচরণে সহসাই অভূতপূর্ব পরিবর্তন দেখা গেল।
যে শ্বশুর নিজে কাপড় না কিনে স্ত্রী এবং পুত্রবধূর জন্য আনত, নিজে ভাল ফলমূল না খেয়ে স্ত্রী ও পুত্রবধূর জন্য আনত, আজ সেই পুত্রবধূ কিনা পর হয়ে গেল! সাত সকালে শিখার অশ্রাব্য গালি শুনে এমনি নানা রকম স্মৃতি সুদীপের হৃদয়ের ক্যানভাসে ভেসে ওঠতে থাকে। তার মনে পড়তে থাকে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাহিনীকে নিজের পৌরুষত্বের বিনিময়ে বাঁচানোর কথা। পাক হানাদারদের বোমার একটি তেজস্ক্রীয় অংশে আক্রান্ত হয়ে তার যৌনক্রিয়া একেবারে প্রায় দুর্বল হয়ে যায়। কিন্তু তাতেও তার দুঃখ নেই। নিজের অপূরণীয় ক্ষতি স্বীকার করেও যে সেদিন তিনি পঁয়ত্রিশ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচিয়ে ছিলেন সে আনন্দের মধ্যেই তিনি নিজেকে প্রতিনিয়ত নতুন করে খুঁজে বেড়ান। নিজের অক্ষমতাকে ভুলে যাওয়ার নিরমত্মর চেষ্টা করেন।
আজ তার নিজের কাছেই অবাক লাগে, যে হাতে তিনি পাকহানাদারদের ব্যাংকার গুড়িয়ে দিয়েছিলেন, আজ সে হাতে ভাত পর্যন্ত তুলে খেতে পারেন না! সত্যিই সময় যে কাকে কখন কোথায় এনে দাঁড় করায় বলা যায় না। এই প্রথিতযশা মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা হওয়ার টাকাটি পর্যন্ত নেই! কতদিন থেকে সে অসুস্থ! এই খবর কি আর লুকানো থাকার কথা! অথচ জীবিত মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুরা পর্যন্ত তাকে দেখতে এল না। দেশের জন্য সে কি-ই না করলো, নিজের সোনার যৌবন পর্যন্ত উৎসর্গ করলো, নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিলো কিন্তু রাষ্ট্র? কি দিলো? আজ তার এই প্রতিকূল মুহূর্তে কেউ পাশে নেই। না আছে সরকার, না আছে নিজের আত্মীয়-পরিজন! 'সুসময়ের বন্ধু অনেকেই হয়, অসময়ে হায় কেউ কারো নয়'! কথাগুলো মনে করতে করতে সুদীপের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে।
শ্বশুরের সে অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে চোখ পড়তেই শিখা আরও তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। তার গলার স্বর আরও কর্কশ হয়ে ওঠে। সামাজিকতার দায়ে কেবল নিজের হাতে মেরে ফেলতে পারে না, নতুবা যন্ত্রণা লাঘবে হয়ত সেটাও করে ফেলত! না মারলেই বা কী! প্রত্যেহ এইরকম মানসিক নির্যাতনও যে মৃত্যু তুল্য! শিখার গলা চড়াও হলেও সুদীপ কোন প্রতি উত্তর করতে পারে না। একে তো কথা বলতে পারে না, তার ওপর আবার চলতে অক্ষম। ফলে পুত্রবধূর অবহেলা না মেনেও তার কোন উপায় নেই।
সুদীপের ডান হাত পুরোপুরি অবশ। বামহাত দিয়ে কোনরকমে আহারাদির কাজ সম্পন্ন করতে পারে। রাতে বাসি খাবার খাওয়ার কারণে সকাল থেকেই তার বেশ কয়েকবার পাতলা পায়খানা হয়েছে। পাতলা পায়খানা হলে দৈহিক কর্মক্ষম ব্যক্তির অবস্থাও শোচনীয় হয়ে যায় আর সেদিক থেকে সুদীপ তালুকদারের অবস্থা খুব খারাপ হবে সেটাই স্বাভাবিক। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি বলে সে বিছানাতেই পায়খানা করে দিয়েছে। তার নিজের পায়খানা নিজের শরীরের সাথেই লেপ্টে রয়েছে। শত চেষ্টা করেও সে একটু সরতে পারলো না। তার রুমের মধ্যেই রাখা হয়েছিল শুটকি মাছ। শুটকি আর পায়খানার গন্ধ পেয়ে কোথা থেকে যেন কালো মাছিগুলো ছুটে এল। মিষ্টির গন্ধ পেলে যেমন পিঁপড়ার দল আসে তেমনি পায়খানা ও শুটকি মাছের গন্ধ পেলেও কালো মাছিরা ভনভন করে ছুটে আসে। প্রায় মাইল খানেক দূর থেকে নাকি মশারা মানুষের উপস্থিতি টের পায়, কিন্তু মাছি কতটুকু দূর থেকে শুটকি ও পায়খানার উপস্থিতি টের পায় তা নিয়ে বিস্তর এক গবেষণা হতে পারে!
তিন
কিছু কিছু মাছি সুদীপের পায়খানার ওপর বসে গুঞ্জন তোলে, লুটোপুটো খায়। ক্ষণপরে আবার তারই পায়খানায় লুটোপুটো খাওয়া কতক মাছি তার নাকের ওপর বসে। বিড়বিড় করে হেঁটে হেঁটে ঠোঁটে আসে। সুদীপ বিস্ময়ী চোখ মেলে সবই দেখে। কিন্তু তা তাড়ানোর মত শক্তিটিও পর্যন্ত আজ তার নেই। এমনিতেই অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়া তার ওপর বেশ কয়েকবার পাতলা পায়খানা হওয়ায় তার শরীর বেশি নাজেহাল হয়ে পড়েছে। হায়রে মুক্তিযোদ্ধা! যে হাতে পাক হানাদারদের আস্তানা গুড়িয়ে দিয়েছে, আজ সে হাতে একটি মাছি পর্যন্ত তাড়াতে পারে না! সত্যিই ভাগ্যের কারিগরের খেলা বুঝা বড় মুশকিল।
নাক বেঁধে পায়খানা পরিষ্কার করতে করতে শিখা বলতে থাকে- ‘‘বুইড়া ব্যাডা মরেও না, আমারেও
... । ওই শম্পা, কনু গেলি? ছিনালরে কামের সোময় পাওয়া যায় না। তর দাদারে একটু সেমাই
খাওয়া।’’
বিছানা পরিষ্কার হয়ে গেলে সে পাশের বাড়ি চলে যায়। যাওয়ার আগে শম্পারে পুনরায় পূর্বোক্ত কথাটি বলে যায়। শম্পা তাদের একমাত্র মেয়ে। বয়স এ বছরই আট পূর্ণ হল। দেখতে খুব আকর্ষণীয় হলেও শম্পা ছিল একটু হাবাগোবা টাইপের। ঘরে দুই বাটিতে সেমাই রাখা আছে। একটি নিচে রাখা অপরটি বিছানার ওপর। উচ্চতায় একটু খাট হওয়ায় সে নিচের বাটিটি নিয়ে তার দাদা সুদীপ তালুকদারকে দিল।
সুদীপ খেতে পারছে না। কিন্তু নজি হাতে তুলে খাওয়ার জন্য ছঁটফট করছে। বিষয়টি ছোট্ট শম্পাও বুঝে ফেলল। পরক্ষণে বেশ একটু দরদ নিয়ে শম্পাই পরপর কয়েকবার তাকে খাইয়ে দিল। খাওয়ার কিছুক্ষণ পরই সুদীপের গুঙ্গানি শুরু হয়। সে গুঙ্গানি মুহুর্তেই তীব্র থেকে আরও তীব্রতর হতে লাগলো। বুক ফাটা চিৎকার নেই কেবল বোবাদের মতো আউআউ করতে লাগলো। মুহূর্তেই সুদীপের চোখ লাটিমের মতো বড়ো আর রক্তিম হতে থাকে, অক্ষিকোঠর থেকে এই বুঝি বেরিয়ে আসবে! মাথা তুলে বমির ভাব করে কিন্তু হয় না। আকাশে যেমন মেঘ ডাকলেও অনেক সময় বৃষ্টি হয় না, তেমনি আর কি! ক্রমশই তার শরীর নীলবর্ণ হয়ে ওঠছে। অবস্থা বেগতিক দেখে শম্পা দৌঁড়ে তার মায়ের কাছে যায়। গিয়ে বলে- মা, দাদা যেন ক্যামুন করতাছে? জলদি আহ্!
শিখা তেমন একটা গুরুত্ব দিল না। ভাবলো, এ আর নতুন কী! তবু শম্পাকে আশ্বাসের ছলে বলল- তুই যা খেলাগা, আমি ইটটু পরে যামু। আশ্বাস পেয়ে শম্পা চলে যায়। প্রতিবেশি রুমানার সাথে শিখার বেশ ভাব। বহুদিন পর রুমানা বাপের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। বাল্যকালের সই বলে কথা! কত কথা যে জমানো, সে না বলে কি আর যাওয়া যায়!
এর প্রায় ঘণ্টা তিনেক পর শিখা ঘরে ফিরে। রুমে ঢুকেই দেখে মেঝতে রাখা পায়েসের বাটি নেই। তার মনে ছ্যাৎ করে ওঠে। নিচের বাটিতে যে বিড়াল মারার জন্য পায়েসের সাথে বিষ মাখানো ছিল! শিখা দৌঁড়ে শ্বশুরের ঘরে প্রবেশ করে। সুদীপের বুকের বাম পাশেই সে পায়েসের বাটি। একেবারে খালি। সব পায়েসই বোধ করি খেয়েছে। সুদীপের পলকহীন চোখের দিকে তাকিয়ে এক অজ্ঞাত অপরাধবোধে সে জর্জরিত হতে থাকে। তার নিজের ভেতরেই চলে নির্লিপ্ত ক্ষরণ! গভীর রাতের মতোই নিস্তব্দ সুদীপের কক্ষ।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন