|
পার্থ তালুকদার
|
|
গল্পঃ দ্বিতীয় পরাজয় (মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক)
20 December 2014, Saturday
গভীর রাতের হিম শীতল বাতাস বাঁশের বেড়ার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে শাঁ শাঁ করে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। দড়ি দিয়ে বানানো আলনায় রাখা কাপড়গুলো দোল খায় নারকেলের পাতার মতো। রাতের নিরবতা ভেঙ্গে বাতাসের এমন অবাদ চলাচলের শব্দ সুরুজ মিয়া’র খারাপ লাগছে না। এমন হাড়কাপুনে শীতে নিজের শরীরটাকে বাঁচাতে না পারলেও ক’দিন আগে বাজার থেকে কিনে আনা চকচকে দা’টা গরম কাপড় দিয়ে মোড়িয়ে তাঁর শিয়রের কাছে রেখে দেয়। ছোট্ট বেলায় মাটির পুতুলকে যেভাবে রঙ্গিন কাপড়ের টুকরো দিয়ে মোড়িয়ে নিজের বালিশের এক কোনায় রেখে দিত, সেভাবে। সুরুজের মা বলতেন, ‘কিরে সুরুজ, পুতুল নিয়ে তো মেয়েরা খেলবে। তুই তো বাবা ঘুড়ি উড়াবি, ফুটবল খেলবি, কাবাডি খেলবি। তুই কেন পুতুল দিয়ে খেলিস?’ সুরুজের বাবা বলতেন, ‘আহা ! তুমি শিশুদের খেলার মধ্যে এমন ভাগাভাগি করো না তো। আমার ছেলের যা ইচ্ছে তা নিয়েই খেলবে।’ পরের দিন সুরুজের বাবা তাঁর জন্য আরো কয়েক ধরনের পুতুল কিনে আনেন।
বাবা-মা’র কথা মনে পড়তেই সুরুজ মিয়ার দু’চোখে ঝাপসা অনুভুতি হয়। জলের ধারা বয়ে যায় নিরবে। শিয়রের পাশে রাখা মোড়ানো দা’টাকে ডান হাতের মুষ্টি দিয়ে শক্ত করে কিছু সময় চেপে ধরে। দু’চোখে তাঁর ঘুম নেই আজ। এপিট-ওপিট করা রাতটা কিছুতেই কাটছে না।
কী হইছে, এমন চটপট করছো কেন, ঘুম আসছেনা তোমার? -পাশে শোয়া স্ত্রী’র এমন কথা শুনে চমকে উঠে সুরুজ মিয়া।
না, মুক্তার মা। কিছুতেই আমার ঘুম আসছে না। আগামী কালের জন্য আমি উত্তেজিত। এতদিনের অপেক্ষার পালা সমাপ্তির সময় এসেছে আমার।
- কী বলছো তুমি। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
- আমি খুন করবো মুক্তার মা। আমি একজনকে খুন করবো।
- খুন করবা তুমি ! এসব কী বলছো সুরুজ!
- হ্যাঁ মুক্তার মা। আমি খুন করবো। হাজার মানুষের সামনে আমি খুন করবো। আমি এই দা দিয়ে শরফত আলিকে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করবো। ওর শরীরের লাল রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হবে। সবুজ ঘাস লাল রক্তে রঞ্জিত হবে।
শরফত আলি’র নামটা মুখে নিয়ে চোঁয়াল জোড়া শক্ত করে সুরুজ। দাঁতে দাঁত চেপে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকে। শীতের রাতে শরীরের লোমগুলো গর্জে উঠে তাঁর। ক্ষুধার্ত সজারু খাবারের নাগাল পেয়ে শরীরের কাটাগুলোকে যেভাবে খাড়া করে, সেভাবেই। সুরুজ মিয়া’র চোখে স্পষ্ট ভেঁসে উঠে সেই ভয়ার্ত দীর্ঘ রাতের মায়ের আহাজারি, বাবার নিরীহ চোখের চাহনি।
অমাবস্যার কালো রাত। বাইরের ঝিঝি পোকা রাতের শূন্যতাকে আরো এক রত্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই রাতে ঠাস ঠাস করে দরজায় আঘাত করছিল তারা। সেগুন কাঠের আলপনা আঁকা দরজা। বাইরে থেকে সিংহের মতো হুংকার- দরজা খোল্ বদরুল মিয়া, দরজা খোল্ কইলাম। সুরুজ মিয়া’র বাবা বদরুল মিয়া বুঝতে পারেন এবার তাদের রক্ষা নেই। হিংস্র বাঘের থাবা থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়, কিন্তু ওদের শিকার থেকে বাঁচা সম্ভব নয়। ডিসেম্বরের শীতের রাতে কপাল বেয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরে মাটিতে। গায়ে জড়ানো শালটা এলোমেলো ভাবে নিচে পরে থাকে অবহেলায়। দরজা খোলার জন্য উদ্ব্যত হলে সুরুজের মা তাঁর বাবার সামনে এসে বাঁধা দেন। বলেন, ‘ওগো দরজা খোলো না তুমি। ওরা ভিতরে ঢুকলে আমাদের কী হবে, আমার সুরুজের কী হবে।’ পাশে থাকা ছয় বছরের সুরুজ মুখবন্ধ শামুকের মত স্থির হয়ে দাঁড়ায়। কাঠের তৈরী দু’তলা বাড়িটার উপর তলায় সুরুজকে তাঁর বাবা রেখে আসেন এক সুযোগে। নিচে নামতে নামতে দরজা ভাঙ্গার আওয়াজ পান তিনি। চার-পাঁচ জনের একটি দল ঘিরে ফেলে তাদের।
‘মারাত্মক মুক্তিযোদ্ধা হইছ তুমি। তুমি গেরিলা হইছো। ঘরে এত সুন্দরী বউ রাইখা তুমি যুদ্ধে যাও। খারাপ লাগেনা তোমার, দিলে কষ্ট লাগে না।’ একটানে কথাগুলো বলে দলপ্রধান শরফত আলি। নিজের লুঙ্গির এক কোনা ধরে বদরুল মিয়ার দিকে তেড়ে এসে বলে- তুমি দেশ স্বাধীন করবা ! এবার লুঙ্গির নিচের দিকটা উপরের দিকে তুলে বলে- ‘তুমি আমার এইটা স্বাধীন করো আগে।’
উপর থেকে কাঠের ফাঁক দিয়ে সবকিছু দেখে সুরুজ। মা-বাবার ভয়ার্ত, করুন, নিরূপায় মুখ দেখে চোখের জল আটকাতে পারে না সে। তাঁর চোখের জল টস করে তাঁর মায়ের ঘাড়ে এসে পরে। মা টের পান। ছেলের চোখের নোনা জল তাঁর ভীত উত্তপ্ত শরীরে চুপসে যায়। সুরুজের নামটা জিহ্বায় এসেও আটকে যায় তাঁর। না, ঘরে তাঁর ফুঁটফুটে ছেলে রয়েছে শরফত আলিকে তা বুঝানো যাবে না। তারা দু’জন মিলে সকল কুকর্ম পিঠ পেতে সহ্য করবে তবুও ছেলের অস্তিত্ব বুঝানো যাবে না।
তারপর, একটা গুলি। সাথে বিকট আওয়াজ। সেগুন কাঠের তৈরি বাড়িটা ধপধপ করে কাঁপে। সব তছনছ করে দেয়। জীবনের সপ্তসুর বেসুরা হয়ে যায়। বদরুল মিয়ার কপাল ছিদ্র করে সেগুন কাঠের দরজায় আশ্রয় নেয় বুলেট। ফিনকি দিয়ে বের হওয়া লাল রক্ত সুরুজের মায়ের চোখ-মুখ লেপ্টে দেয়। সুপারির কালো কসে খাঁজ কাটা হলুদ দাঁতের শরফত আলি’র মাথা দোলানো অট্টহাসি সুরুজ মিয়ার কানে তালা লাগিয়ে দেয়। এবার শরফত লাল চোখে তাঁকিয়ে থাকে সুরুজের মায়ের দিকে। ইশারা দেয় দাঁড়িয়ে থাকা সঙ্গীদের। চোখের ভাষা বুঝে সময় অপচয় করেনা তারা। সুরুজের মায়ের চুলের গোছা ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায় তাদের আস্তানায়। যেখানে ধ্বনিত হয় শতশত নারীর বুকফাটা আর্তনাদ। তবে কেউ শুনার নেই। কেউ শুনেনা, কেউ বুঝে না।
কাল বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান। সুরুজ মিয়ার এলাকায় সাঁজ সাঁজ রব। মাইকে রাত থেকেই জোরে জোরে দেশের গান বাঁজছে। চেতনার গান। ও আমার দেশের মাটি... ..., সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা ..। আরও অনেক ধরনের গান। পাড়ার কিশোর ছেলেরা আয়োজন করেছে অনুষ্ঠানটি। সুরুজ মিয়া সাধ্যমত চাঁদা দিয়ে সাহায্য করেছে তাদের। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সেই শরফত আলি।
গাছের সবুজ পাতা ধূসর হয় কিন্তুু ধূসর কখনো সবুজ হয় না। মানুষের জীবনের রং সময়ের পরিবর্তনের সাথে বদলায়। জীবনের ধূসর রং মাঝেমাঝে সবুজ হয়ে যায়। শরফত মিয়া’র ও তাই হয়েছে। আজ সে এলাকার জনপ্রতিনিধি। এক সময়ের দেশদ্রোহী আজ দেশদরদী। সবাই যখন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি নির্বাচন নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে তখন সুরুজ মিয়াই এই নামটা প্রস্তাব করে। তাতে অবশ্য কারো দ্বিমত ছিল না। থাকবেই বা কেন। এই এলাকায় একমাত্র শরফত আলি’র শক্তি সামর্থই সবার উপরে। সু-উচ্চে, সীমাহীন।
অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে সূর্য উঠার সাথে পাল্লা দিয়ে। আজকের সূর্যটা অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশীই লাল মনেহচ্ছে। গতকয়েক বছর আগে সুরুজের বাবার কপাল বেয়ে পরা রক্তের মত লাল। টুকটুকে লাল। একটু পরেই শরফত আলি অনুষ্ঠানে আসন গ্রহন করবেন। চেতনার কথা বলবেন। মুক্তির কথা বলবেন। মাইকে বারেবারে তাঁর নাম ঘোষনা হচ্ছে। বাবার সম্পত্তি হারিয়ে জৌলুসহীন এক বাঁশের ঘরের মালিক সুরুজ মিয়া নিজেকে প্রস্তুত করে। বালিশের নিচ থেকে চকচকে দা’টা হাতে নিয়ে ভাল করে দেখে নেয়। প্রতিশোধস্পৃহায় শরীরের শীতল রক্ত রোদে রাখা নারকেল তেলের মতো গরম হয়ে উঠে।
চুপিসারে মঞ্চে উঠে সুরুজ মিয়া। লম্বা সবুজ পাঞ্জাবীর ভিতর থেকে হেচকা টানে বের করে দা’ টা। শরফত আলির কাঁধের উপর দা’টা তুলতেই পিছন থেকে তাকে ঝাঁপটে ধরে একজন। শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে নিজেকে ছাড়াতে পারেনি। সবাই হুড়মোড় খেয়ে চেপে ধরে তাকে। শত মানুষের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে সুরুজ মিয়া ভাবে, এ যে তাঁর দ্বিতীয় পরাজয়।
দিন শেষে রাত পার হয়ে নতুন ভোরে খবরের কাগজের শিরোনাম- দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা শরফত আলিকে হত্যার চেষ্টা, আটক এক।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন