৩
ভাবছেন, খুনের গল্প বলতে গিয়ে এত কথা কেন বলছি ? দরকার আছে বলেই বলছি । চাইলে তো দু-চার লাইনেও খুনের কথাটা বলা যায় । সেভাবে বলতে চাইছি না । অথবা এক ধাক্কায় দুম করে সেই দু-চার লাইনে চলে যেতে পারছি না । এখনও তো কি অগাধ সময় ! কোথাও আলো নেই ! কার কি কাজ ? শুনুন না বসে বসে একটা বৃহৎ খুনের গল্প !
রবিবার সন্ধ্যার দিকে রামপুরা ডিআইটি রোড থেকে আমরা তিনটা রিকশা নিলাম । দুপায়ের ফাঁকের চটের বস্তায় আমাদের এক্সপ্লোসিভ, অস্ত্রগুলি । আমি আর তমাল বসেছি এক রিকশায় । তমালের দিকে তাকিয়ে দেখি খুব ঘামছে । রাস্তা বেশ ফাঁকা ফাঁকা । মাঝে মাঝে কয়েকটা কুকুরের গা হিম করা ডাক শোনা যাচ্ছে । রামপুরা বাজারের ওখান থেকে উলানের দিকে বামে মোড় নিয়ে দেখি সামনের রিকশা দুটি নেই । গেল কোথায় ?
‘তমাল ! বাবু ভাইরা কোন দিকে গেল ? এটা উলান রোডের রাস্তা না ?’
রিকশাওয়ালা মামা ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘জ্বে । ঠিক রাস্তা দিয়াই যাইতাছি । চিনি আমি ।’
তমাল বলল, ‘ওরা সম্ভবতঃ টিভি সেন্টারের ওদিকে চলে গেছে ।’
‘টিভি সেন্টারের ওদিকে যাবে কেন ?’
‘রাস্তা ভুল করেছে হয়তো । একদম সামনের রিকশায় কারা ছিল ?’
‘দুই মবিনই সামনের রিকশায় ছিল । এক নম্বর মবিন তো রাস্তা চেনে । সমস্যাটা কি ?’
তমাল বলল, ‘মবিন শালা সবসময় একটা বাগড়া বাঁধায় । শালা ফাউল ।’
আমি বললাম, ‘মামা রিকশাটা থামান তো ।’
আমি রিকশা থেকে নেমে এগিয়ে মোড়ের কাছে গিয়ে এদিক ওদিক উঁকি দিতে লাগলাম । ঠিক এই সময় একটা ফিয়াট ৬০০ ঘ্যাঁস করে আমার পাশে এসে থামল । গাড়ি চালাচ্ছে দুই নম্বর মবিন । বাবু ভাই সামনের জানালা থেকে মাথা বের করে বলল, ‘তাড়াতাড়ি ওঠো তো । কুইক ।’
‘সামনে তমালও আছে ।’
‘তুমি ওঠো তো আগে ।’
আমি ফিয়াটটার পেছনের দরজা খুলে উঠে বসলাম । পেছনে হীরু ভাই আর এক নম্বর মবিন । মবিন পায়ের ওপর পা তুলে জিম রিভসের একটা গানের সুরে শিস্ বাজানোর চেষ্টা করছিল । তার চোখ বন্ধ । শিসের তালে তালে সে মাথাও দোলাচ্ছে । আমি বললাম, ‘এই শালা, চেপে বস্ !’ সে চাপল কিন্তু শিস্ বাজানো থামালো না । বাবু ভাইকে বললাম, ‘গাড়িটা পেলেন কোথায় ?’
বাবু ভাই উত্তর না দিয়ে হাতের পাতা নাচিয়ে ডাক দিলেন, ‘এই যে তমাল, এইদিকে ।’
তমাল আমার পাশে উঠে আসলো । আমরা চারজন পেছন দিকে চাপাচাপি করে বসলাম । তমাল হতাশ গলায় বলল, ‘রিকশাভাড়া দিয়ে এসেছি । গাড়ি টানেন ।’
‘স্যরি । হুট করে ছন্নছাড়া হয়ে যাওয়ার জন্য ।’
‘হয়েছেটা কি ? গাড়ি কই পেলেন ?’
বাবু ভাই বোমা ফাটালেন, ‘হাইজ্যাক করেছি ।’
আমি চেঁচিয়ে উঠে বললাম, ‘মানে কি ? আমরা হাইজ্যাকার নাকি ?’
‘রিকশা নিয়ে টুকটুক করে যাওয়ার চাইতে ভাল হয়েছে কি না তাই বলো ?’
আমি কিছু বললাম না । গাড়ির মধ্যে একটা নীরবতা নেমে এল । উলান পাওয়ারস্টেশনে পৌঁছুতে বেশী সময় লাগল না । স্টেশনের গেটের অপর দিকের টং দোকানে তিন-চারটা ছেলে বসে আড্ডা মারছে । তাদের হাসাহাসির শব্দ আসছে থেমে থেমে । বাবু ভাই খুব দ্রুত বললেন, ‘তমাল, গাড়ির উইন্ডো থেকে লুকিয়ে স্টেনগান ধরে থাকো । আমি স্টেশনের গেট দিয়ে ঢুকলে তুমি আর এক নম্বর মবিন গেটের কাছে চলে আসবে । রেড সিগন্যাল পেলে গেটে দাঁড়িয়েই আমাকে সাপোর্ট দেবে । অবস্থা খারাপ দেখলে পালিয়ে যাবে । সবাই ধরা পড়ার চেয়ে একজন ধরা পড়া ভাল । আমি এই স্টেনটা নিয়ে যাচ্ছি ।’
কাউকে আর কোন ধরনের কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি একটা কাপড়ের ব্যাগে স্টেনগান ভরে চায়ের দোকানের দিকে এগিয়ে গেলেন । তিনি সম্ভবতঃ একটা ৫৫৫ সিগারেট চাইলেন । দোকানী সিগারেট ধরিয়ে দিল । তিনি সিগারেট টানতে টানতেই ব্যাগ থেকে স্টেন বের করলেন । দাঁতের ফাঁকে সিগারেট রেখে দুহাতে স্টেনগান ঝাঁকালেন । দোকানীসহ ছেলেদের দলটা গেট দিয়ে ঢুকছে । গেটের সামনে আর কেউ রইলো না । তমাল আর মবিন প্রায় ঝাঁপিয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে গেটের দিকে দৌঁড় দিল । স্টেশনের পাশেই একটি শাদা রঙের বাড়ি । চাপা প্যাসেজটা চোখে পড়ছে । এখানে গাড়িতে বসে থাকার চেয়ে ওখানে থাকাই ভাল । আমি জিনিসপত্রভরা বস্তাটা নিয়ে হীরু ভাই আর মবিনের সাথে দেয়াল ঘেঁসে অন্ধকারে লুকিয়ে পড়লাম । অনেকটা সময় পর কোকিলের শব্দ শুনলাম । নিশ্চিত এক নম্বর মবিনের কাজ । এত বিশ্রী করে কোকিলের ডাক দেয়া সে কোত্থেকে শিখেছে কে জানে !
আমরা গেট দিয়ে ঢুকলাম । ঘর্মাক্ত বাবু ভাই এক হাতে স্টেনগান, আর এক হাতে সিগারেটের গোড়া নিয়ে একটা দরোজার সামনে মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছেন । আমাকে বললেন, ‘গার্ডসহ সবগুলাকে এই রুমের মধ্যে পড়েছি । ভোদাই শালারা । শোনো । আমি এখানে আছি । তমাল আর হীরুকে নিয়ে তুমি ওপরে চলে যাও । কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি ব্যাক করো । ঠেকায় না পড়লে গুলি চালানোর দরকার নেই ।’ সিগারেটের গোড়ায় শেষ টান দিয়ে সে দু আঙুলে ফিল্টারটা ছুঁড়ে ফেললেন । ওটা কত দূরে যায় দেখার জন্য নিশ্চিত, ছেলেমানুষী খেলা । যত দূরে যাবে ভাগ্য তত ভাল হবে । ফিল্টারটা অনেক দূরে পড়ল ।
আমরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে এলাম । অপারেটর রুমের বারান্দার ইজিচেয়ারে কে যেন নাক ডাকাচ্ছে । হলুদ বাল্বের কড়া আলোয় পুলিশটাকে হাস্যকর দেখাচ্ছিল । ইজিচেয়ারের ওপর কাঁত হয়ে ঝিমাচ্ছে । তমাল স্টেন ধরে খেঁকিয়ে উঠল, ‘হ্যান্ডস আপ’ । পুলিশটা নড়ল না । তমাল আরো জোরে চেঁচিয়ে উঠল, হ্যান্ডস- আপ- ! তাতেও কোনরকম বিকার দেখা গেল না । পুলিশটা চোখ খোলার কষ্টও করল না । মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে এক হাত নাচিয়ে ঘুমজড়িত কন্ঠে বলল, ‘আবে- যা-যা- । শারারাত মাৎ কার ।’
তমাল এবার স্টেনগানের শব্দ করল । মুহূর্তে পুলিশটা লাফিয়ে উঠে দুহাত ওপরে তুলে চোখ খুলল । দুচোখ বড় বড় করে সে আমাদের দেখছে । এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না আসলেই মুক্তিবাহিনী তাদের এটাক করেছে । সে কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে বলল, ‘হামকো ছোড় দি জিয়ে সাহেব । গুলি মাৎ কি জিয়ে । হাম মার জায়েঙ্গে ।’
তমাল বলল, ‘খবর্দার । কোন শব্দ না । শব্দ হলে গুলি হবে । ভেতরে আর কোন লোক আছে হ্যাভিং গান’স ?’
‘হাম আকেলা হ্যায় সাব । কোয়ি নেহি হ্যায় । ইধার তো কারফিউ হ্যায় ।’
আমি হেসে উঠে বললাম, ‘কারফিউ তোমার পকেটে ঢুকায়ে রাখো । অপারেটর রুম কোনটা ?’
পুলিশটা অঙ্গুলিনির্দেশ করলো । আমরা অপারেটর রুমে ঢুকলাম । রুমটা জঘন্য, যেদিকে তাকাও কেবল সুইচ আর সুইচ । এক কোণে জায়নামাজে এক লোক নামাজ পড়ছিল । নামাজে থাকা অবস্থায়ই সে ঘাড় ঘুরিয়ে তমালকে দেখল । তারপর দুহাত তুলল । আমি বললাম, ‘ট্রান্সফর্মারের কাছে যাওয়ার রাস্তা কোন দিকে ?’
‘এইদিকে স্যার । স্যার আমার সাথে আসেন ।’
১৩২/৩৩ কেভিএ’র ট্রান্সফর্মারটাকে অবশেষে পেলাম । আমি আর হীরু ভাই দ্রুত কাজ শুরু করে দিলাম । ৪০ পাউন্ডের মত পিকে একত্রে টাল করলাম । ২০ পাউন্ড করে পিকের দুটি চার্জ পনেরো ফুটের প্রাইমা কর্ড দিয়ে লাগিয়ে ট্রান্সফর্মারের দুপাশে ফিট করতে হবে । আমি মনে মনে কর্ডের মাপের একটা আন্দাজ করে হীরু ভাইকে বললাম, ‘ডিটোনেটারটা এখানে লাগান’ । হীরু ভাই ক্ষিপ্রতার সাথে কর্ডের দৈর্ঘ্যের ঠিক মাঝ বরাবর ডিটোনেটার- ২৭’টা বসানো শুরু করে দিলেন । আমি দেখলাম তার হাত কাঁপছে । আমার দিকে না তাকিয়েই তিনি কাজ করতে করতে বললেন, ‘টগন, সিগারেট আছে নাকি তোমার কাছে ?’
আমার শার্টের পকেটে দুটা সিগারেট ছিল । চাপ লেগে ন্যাতা-ন্যাতা হয়ে গেছে । ওর একটাই বাড়িয়ে দিলাম । হীরু ভাই সেফটি ফিউজওয়ারটা লাগাতে লাগাতে বললেন, ‘তুমি টানো । টেনে আমাকে দাও ।’
আমি হীরু ভাইয়ের কাজ দেখতে দেখতে সিগারেট টানছি । আমরা তাহলে পেরেছি ! কি ভয়ংকর ব্যাপার । ফিউজওয়ারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে দিলেই লাভা উত্তপ্ত হতে শুরু করবে । খুব দ্রুত । ব্লাস্ট হতে লাগবে মাত্র তিন মিনিট । উড়ে যাবে ট্রান্সফর্মারটা । আমার খুশীতে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে । হীরু ভাই হাত বাড়ালেন । তার কাজ শেষ হয়েছে । তিনি দুটো টান দিয়েই সিগারেটটা ফিউজওয়ারের মুখে ধরলেন । মুহূর্তে আগুন লেগে গেল । আমার মাথায় সেকেন্ডের কাটার টকটক শব্দ হচ্ছে । হীরু ভাই বললেন, ‘দৌঁড়াও !’
তিন মিনিট পার হওয়ার আগেই আমরা দুজন দৌঁড়ে নীচে নেমে এলাম । হীরু ভাই বৃদ্ধাঙ্গুলি জাগালেন । বাবু ভাইয়ের মুখে বিস্তৃত হাসি দেখা দিল । তিনি দরোজা খুলে বন্দীদের মুক্ত করতে করতে বললেন, ‘দুহাতে কান চেপে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েন । মাথা জাগালে গুলি করবো ।’ কথা শেষ হতে না হতেই বোমা বিস্ফোরনের মত একটা শব্দ হল । ট্রান্সফর্মারের একটা অংশ গিয়ে ছিটকে পড়েছে পাশের বাড়ির টালি ছাদে । ওখান থেকে একটা আর্তচিৎকার শোনা গেল । মুহূর্তে অন্ধকার ছেয়ে গেল শান্তিবাগ থেকে মগবাজার, শান্তিনগর থেকে খিলগাঁওয়ের পুরো এলাকায় । পাওয়ার স্টেশনে আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে । কুন্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে ওপরের দিকে । কোন দৈত্যাকার জ্বিন বের হয়ে আসতে যেন বিদ্যুৎ স্টেশনের চেরাগ থেকে ! বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে ট্রান্সফর্মার অয়েলের পোড়া গন্ধ ।
আমরা ফিয়াটে উঠলাম । গাড়ি স্টার্ট দিল । এবার গাড়ি চালাচ্ছে বাবু ভাই, তার পাশের সিটে মবিন । বাকী সবাই নিজের নিজের জায়গায় । তমালের কোলে এখনো স্টেনগানটা রাখা । বাবু ভাই বললেন, ‘অপারেশনটা জিরো ডিগ্রীর মত সহজ হয়েছে, কি বলো ? শান্তশিষ্ট-লেজবিশিষ্ট, নো উত্তেজনা । হাহাহা ।’ বাবু ভাই এক্সিলারেটর চেপে ধরলেন । গাড়ি শোঁ-শোঁ করে চলছে । উড়ে চলছে যেন । উলান রোডের মাথায় এসে গাড়ি আচমকা থমকে দাঁড়ালো । মবিন বলল, ‘কি হলো বাবু ভাই ?’
‘বুঝতে পারছি না । মেকানিকাল প্রবলেম ।’
ঠিক তখন আমি খেয়াল করলাম রাস্তার ওপারে একটা মিলিটারী জিপ থামানো । আমি তমালের উরূতে চাপ দিলাম । তার মুখও মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে । সে গলা নামিয়ে বলল, ‘জায়গাটা তো ফাঁকাই ছিল । আসার পথে তো ওদের দেখি নি !’
‘রামপুরা টিভি স্টেশন এরিয়ায় একটা প্লাটুন থাকে । ওদের দলটাই বোধহয় বোধহয় টের পেয়ে এইদিকে চলে এসে ব্যারিকেড দিয়েছে । এত তাড়াতাড়ি পজিশন নিলো কিভাবে ওরা ?’
‘এমনও তো হতে পারে ওরা কিছুই জানে না । ব্যাপারটা জাস্ট কো-ইনসিডেন্স !’
মবিন ভয়ার্ত স্বরে বলল, ‘বাবু ভাই ! তাড়াতাড়ি করেন । দুটো মিলিটারী এদিকে আসছে ।’
দুজন সৈন্যের দুজনের মাথায়ই আর্মি ক্যাপ, হাতে রিকয়েল্লেস রাইফেল । একজন সৈন্য পকেট থেকে একটা টর্চ বের করলো । টর্চের আলো ফেলল গাড়ির নম্বরপ্লেটে । আমি প্রমাদ গুনলাম । একটুখানি সুবিধা নেয়ার জন্য আমরা বড্ড বেশী ভুল করে ফেলেছি । হাইজ্যাক করা গাড়িটা আমাদের চিনিয়ে দেবে নিশ্চিত । বাবু ভাই কিছুতেই গাড়ি স্টার্ট দিতে পারছে না । আমার মাথা পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে । অন্ধকারেও কেন যেন স্পষ্ট বুঝতে পারলাম নম্বরপ্লেটটা পড়ে সৈন্যটির মুখে রক্ত সরে গেছে । আমি স্থির চোখে তাকিয়ে আছি সৈন্যটির দিকে । সে যেন কিছু বলল পাশের সৈন্যটিকে । দুজনই হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল । আমি ঝট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম । চকিতে তমালের কোলের ওপর রাখা স্টেনগানটা টেনে নিয়ে গাড়ির পেছনের কাঁচ ভেঙে সৈন্যটিকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করলাম । ঝনঝন করে কাঁচ গুড়িগুড়ি হয়ে রাস্তার ওপর ছড়িয়ে পড়ল । আয়তাকার ফাঁকা খুপরিটা থেকে স্পষ্ট দেখলাম দুজন জায়গার ওপর মাটিতে পড়ে গেছে । আমার বুক ঢিপঢিপ করছে তখনো । আমি অনুভব করতে পারি একটু আগে হুট করে আমার বয়স যেন দশ বছর বেড়ে গেছে । আমি বুঝতে পারি আমি এই একটু আগে নিজের হাতে দুটো মানুষকে খুন করেছি ।
গুলির শব্দে জিপ থেকে আরও কিছু সৈন্য বেড়িয়ে আসছে । আমি কোন ভুল করেছি কিনা এটা জানতেই হয়তো একবারের জন্য পেছনে ঘুরলাম । সবাইকে মনে হল সন্তুষ্টই । আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম । বাবু ভাই তার স্টেনগানটা তমালের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আমাকে বললেন, ‘সাবাশ ছেলে !’
ঠিক এই সময় প্রকট শব্দে পুরো জায়গাটা কেঁপে উঠল । শব্দটা খুব সম্ভবতঃ এলএমজির । আমরা শিউরে উঠলাম । আমরা এও জানি না ওদের আসল সংখ্যাটা আসলে কত । আমরা মাত্র ছ’জন । তাছাড়া হাতে যা অস্ত্রশস্ত্র আছে সবই হালকা । ওরা পজিশন নিয়ে নিতে পারলে আমাদের জন্য কি ভয়াবহ নরক হয়ে যেতে পারে এই জায়গাটা তা ভাবতেও ইচ্ছে করে না । ওদিক থেকে ক্রমাগত গুলি ধেঁয়ে আসছে । চোখে রাস্তার ওপাশে যেটুকু দেখছি সবটাই আলোর ঝলকানি । আমি আর তমাল দুটো স্টেনগান পাশাপাশি রেখে গুলি করা শুরু করলাম । বাবু ভাই গাড়ির দুপাশের জানালা খুলে দিল । হীরু ভাই আর মবিন দুদিক থেকে গ্রেনেড ছুঁড়তে শুরু করল । শব্দে শব্দে জায়গাটা বারবার কেঁপে উঠছে । একনাগাড়ে অনেকক্ষণ গ্রেনেড হামলা চলল । যতক্ষণ গ্রেনেডের পিন খোলার শব্দ হয়েছে আমরা থেমে ছিলাম । গ্রেনেড ফুরিয়েছে বোধহয় । আর্মির দলটা কতটা কি কাঁবু হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না । আমরা আবার গুলি চালানো শুরু করলাম । বাবু ভাই এই সময় আমাদের রেখেই বাকীদের নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলেন । বের হওয়ার আগে বলল, ‘ত্রিশ পর্যন্ত গুনে গাড়ি থেকে নেমে সরে পড়বে । কাল যাত্রাবাড়ির ক্যাম্পে দেখা হচ্ছে আমাদের । জয় বাংলা !’
আমরা নিরবিচ্ছিন্ন গুলি চালাতে চালাতে বিড়বিড় করলাম শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম বাক্য, জয় বাংলা !
এক-দুই-তিন করে আমরা কাউন্ট করছিলাম । ত্রিশ আসছিল না । স্টেনগান থেকে আগুনের ফুলকি ঘাড়ে গলায় কাঁধে ছিটে ছিটে পড়ছে । শরীরটা পুড়ে যাচ্ছে যেন ! তেরো-চৌদ্দ-পনেরো- । ত্রিশ শব্দটি কোথায় হারিয়ে গেল ? স্টেনের জোরালো শব্দে কানে তালা লেগে গেছে । তাও আমি তমালের চীৎকার শুনলাম । তমালের বাঁ হাতে গুলি লেগেছে বোধহয় । সে কঁকিয়ে উঠেছে তবু গুলি করা থামাচ্ছে না । পঁচিশ-ছাব্বিশ-সাতাশ- । ত্রিশ পার হবার আগেই আমি আর তমাল দুজন গাড়ির দুপাশ থেকে লাফিয়ে রাস্তায় পড়ে শরীরে অবশিষ্ট সবটুকু শক্তি দিয়ে দৌঁড় দিলাম । মনেপ্রানে আশা করলাম অন্ধকারে ওরা যেন আমাদের মুভমেন্ট টের না পায় । আমাদের গুলি থেমে যাওয়ায় মিলিটারী জিপের ওপাশ থেকেও গুলি থেমে গেল । ওরা কয়েকজন কি রেকী করতে ছুটে আসছে ?
আমরা দুজন তখন দৌঁড়ে কতখানি গিয়েছিলাম জানি না, পেছন থেকে গাড়ি বিস্ফোরনের অসাধারন আওয়াজটি আমাদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় । খানসেনাগুলির কয়জন পুড়ে কাবাব হল দেখবার সাধ ছিল । আমি হাসতে হাসতে দৌঁড়োচ্ছিলাম । বাবু ভাইয়ের অদ্ভুত প্ল্যানটা আমাদের পালাতে সাহায্য করেছিল । তার পকেটে দু-তিনটে এন্টি পার্সোনাল মাইন হয়তো রয়ে গিয়েছিল । গাড়ি থেকে পালাবার আগে খুব ছোট ছোট সাইজের বিস্ফোরকগুলিকে তিনি গাড়ির চাকায় সফলভাবে বসিয়ে রেখে যেতে পেরেছিলেন ।
৪
যে সময়ের গল্প বলছি আপনাকে সেটা না বাস্তব, না স্বপ্ন । অনেকটা ম্যাজিক রিয়েলিজমের মতন । ১৯৭১ সাল । এমন জাদুবাস্তব সময় কি আর এসেছে কখনো ? বড় অস্থির একটা বছর । যে রেভোল্যুশনকে এত ভালবাসতাম তাকে খুব কাছ থেকে দেখতে পেয়ে সন্ত্রস্ত হওয়ার বছর । খুব প্রিয় মানুষগুলিকে হারিয়ে ফেলার বছর । সব হারাবার বছর ।
জুলাইয়ের শেষ দিন । আগের সপ্তাহের উলানের অপারেশনের পরপর আমি ঢাকা ছাড়ি । চলে আসি আগড়তলার কাছাকাছি একটা জায়গার ট্রেনিং ক্যাম্পে । জায়গাটার নাম মেলাঘর । পাহাড়ী জঙ্গুলেমত জায়গা । আশেপাশে যতদূর চোখ যায় সব সবুজ । এর আগেও এখানে আসা হয়েছে । প্রথম যখন বাবু ভাইয়ের কথায় এখানে ট্রেনিং নিতে আসি, মে মাসের প্রথম দিককার কথা, তখন এখানে আসা হয়েছিল । সেক্টর টু –এর এই বেসক্যাম্প থেকেই ঢাকায় গেরিলা পাঠানো হয় । ট্রেনিং এর সময় অবশ্যি ঠিক এই জায়গাটাতে ছিলাম না । আরো দশ কি বারো মাইল দূরে মতিনগর বলে একটা জায়গা ছিল, সেখানে থাকতাম । গভীর আগ্রহ নিয়ে গেরিলা ট্রেনিং নিতাম । প্রথম দিকে খাওয়াদাওয়ার প্লেট পর্যন্ত ছিল না । গ্রেনেডের খালি বাক্সগুলিকে আড়াআড়ি করে কেটে তার ওপর ভাত রেখে খেয়েছে । ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার পান্ডে একবার পরিদর্শনে এসে অধঃস্তন অফিসারকে বললেন, ‘আরে কি আশ্চর্য ! কচি কচি ছেলেগুলি এত কষ্ট করে যুদ্ধ করবে কিভাবে ? দু-এক দিনের মধ্যে এদের জন্য প্লেট আর গ্লাসের ব্যবস্থা করে দিয়ে আমাকে ইনফর্ম করবে ।’
কে একজন যেন গলা উঁচিয়ে বলল, ‘স্যার আমরা প্লেট-গ্লাস চাই না । এর বদলে আমাদেরকে বুলেট দেন !’
আমাদের এখানে যারা ট্রেনিং নিতে এসেছিল তারা বেশীরভাগই ঢাকার ছেলে । বেশ বড় ঘরের কিছু ছেলেও ছিল । ওভেনে হ্যামবার্গার ঘুরিয়ে গরম গরম খেতে যাদের অভ্যেস, সেই ছেলেগুলিই আহ্লাদ করে ঠান্ডা ভাত-ডাল-লাবড়া মেখে চাষাভুষার মত করে খেলাম । সকালে পোকায় ধরা রুটি দিয়ে ঘোড়ার ডাল খেয়ে সন্ধ্যা অব্দি বারুদ নিয়ে খেলেছি । সন্ধ্যা রাত্রির মত তাড়াতাড়ি সময়েই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি বাঁশের মাচায় খড়ের গদিতে । নিজেকে ধূর্ত-শক্তিশালী কমান্ডো ভাবতে বড়ো ভাল লাগতো । কত কী যে ভাবতাম ! দিন যতই গিয়েছে আর কিছুই ভাবতে ভাল লাগে নি । ভাবতে ভাল লেগেছে শুধু স্বাধীনতা । স্বাধীন একটা দেশ । স্বাধীন বাংলা ।
আমি তাঁবু অন্ধকার করে শুয়ে ছিলাম । সারাদিন অনেক ধকল গেছে । আমার তাঁবুতে দু নম্বর মবিন আর তমাল শুয়ে আছে । এক নম্বর মবিন, হীরু ভাই, বাবু ভাই এদের সবাইকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে । সিদ্ধিরগঞ্জের অপারেশনের জন্য । এবার সিদ্ধিরগঞ্জই উড়িয়ে দেয়া হবে । গেরিলারা যে কত সক্রিয় আর ভয়াবহ হতে পারে এই পরিকল্পনা তারই প্রমান । উলান-ধানমন্ডির অপারেশনের পর থেকে ওখানে নাকি সিকিউরিটি এতই বাড়িয়ে দিয়েছে যে বাইরে থেকে রকেটশেল মেরে কিছু করা যাবে না । ভেতর থেকে স্যাবোটাজ করতে হবে । পিকে লাগবে ৮০ থেকে ৯০ পাউন্ডেরও বেশী !
এখান থেকে বাবু ভাইরা একটা ৩ পয়েন্ট ৫ ইঞ্চি রকেট লাঞ্চার নিয়ে গেছে । চালানোর জন্য আর্টিলারি থেকে একজন গানারও দিয়ে দেয়া হয়েছে ওদেরকে । ৮টা রকেট শেল কিভাবে বয়ে নিয়ে গেছে কে জানে । তার সাথে দুটো এস এল আর উইথ অ্যানার্গালঞ্চার তো আছেই, প্রত্যেকটার জন্য একটা করে স্টেনগান, ম্যাগাজিন, অসংখ্য বুলেট, হ্যান্ড গ্রেনেড । এ এক মহাযুদ্ধযাত্রা !
তাঁবুর বাইরে হঠাৎ কিসের যেন শব্দ হল । আমি ডাক দিলাম, ‘কে ?’
‘আমি !’
আমি ধরতে পারি ক্যাপ্টেন হায়দার ভাইয়ের গলা । এত রাতে তিনি এখানে ? হায়দার ভাইকে বিমর্ষ দেখাচ্ছে । তিনি একটা হারিকেন হাতে দোলাতে দোলাতে এসেছেন । এতটুকু আলোতেও আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল । আমি হাত উলটো করে চোখের ওপর চাপা দিলাম । হায়দার ভাই ক্ষীনস্বরে ডাকলেন, ‘টগন, ঘুমিয়ে গেছো নাকি ?’
‘না, হায়দার ভাই । মাথা ধরেছিল । শুয়ে ছিলাম ।’
‘তোমাদের জন্যে একটা অর্ডার নিয়ে এসেছি । যেতে চাও কিনা তার ওপর ডিপেন্ড করবে । এই মুহূর্তে ক্র্যাক প্লাটুনের কাউকে ঢাকায় পাঠাতে চাচ্ছিলাম না । তবুও ভাবলাম তোমাদের সাথে কথা বলেই সিদ্ধান্তটা নেই ।’
আমি আর তমাল দেখতে দেখতে উঠে বসলাম । আমার আগেই তমাল বলল, ‘অবশ্যই যেতে চাই । কি অপারেশন সেটা পরে জানলেও চলবে !’
‘এই না হলে ক্র্যাক প্লাটুন !’, হায়দার ভাই হেসে উঠলেন, ‘তোমরা একটু বেশীই মারাত্মক ।’
আমরা হাসলাম । হায়দার ভাই বললেন, ‘তোমার সুকান্তের বইটা দিও তো টগন আমাকে । প্রায়ই তোমাকে তাঁবুর মধ্যে বসে পড়তে শুনি ।’
‘ঠিক আছে হায়দার ভাই ।’
হায়দার ভাই উঠে দাঁড়ালেন । কিছু বলতে গিয়ে আবার থেমে গেলেন । ইতস্ততঃ করতে করতে বললেন, ‘কবিতা শুনবে নাকি একটা ?’
আমরা চমকালাম । হায়দার ভাইকে কখনো কবিতাপ্রেমী বলে শুনি নি । বেশ আগ্রহ নিয়েই বললাম, ‘বলুন, শুনি !’ হায়দার ভাই তার শার্টের বুকপকেট থেকে একটা কাগজ বের করে হারিকেনের আলোয় মোটা গলায় পড়তে শুরু করলেনঃ
দেখতে কেমন তুমি ? কী রকম পোশাক-আশাক
পরে করো চলাফেরা ? মাথায় আছে কি জটাজাল ?
পেছনে দেখাতে পারো জ্যোতিশ্চক্র সন্তের মতন ?
টুপিতে পালক গুঁজে অথবা জবরজং, ঢোলা
পাজামা কামিজ গায়ে মগডালে এক শিস দাও
পাখির মতোই কিংবা চা-খানায় বসো ছায়াচ্ছন্ন ?
দেখতে কেমন তুমি ? অনেকেই প্রশ্ন করে, খোঁজে
কুলুজি তোমার আঁজিপাঁতি । তোমার সন্ধানে ঘোরে
ঝানু গুপ্তচর, সৈন্য পাড়ায় পাড়ায় । তন্ন তন্ন
করে খোঁজে প্রতিঘর । পারলে নীলিমা চিড়ে বের
করতো তোমাকে ওরা, দিতো ডুব গহন পাতালে ।
তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছো হাত ধরে পরস্পর ।
সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ তাড়ানিয়াঃ
তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন, সন্তান আমার ।
আমি মুগ্ধ কন্ঠে বললাম, ‘কার কবিতা এটা ? নেতাজী সুভাষ বসুকে নিয়ে লেখা নাতো ?’
‘এটা তোমাকে নিয়ে লেখা !’
‘ধুর ! কি যে বলেন !’
‘তোমাকে মানে তোমাদের নিয়ে । শামসুর রহমান নামের এক নতুন কবির লেখা । আমাদের এখানে মাঝে মাঝেই ঢাকা থেকে কিছু কবির কবিতা আসে । আমরা সীমান্ত পার করিয়ে দেই । আকাশবানী ওগুলিকে প্রচার করে ।’
‘কি নাম কবিতাটার ?’
‘গেরিলা ।’
ক্যাপ্টেন হায়দার কবিতার পাতাটা আমার হাতে ধরিয়ে দেয় । আমি আরও একবার মুগ্ধ হয়ে কবিতাটা পড়ি । ক্যাপ্টেন নখ নিয়ে আঙুল খুঁটতে খুঁটতে বললেন, ‘তোমাদেরকে আসলে একটা খবর দেয়ার ছিল । খারাপ খবর ।’
আমরা দুজন উন্মুখ হয়ে তাকালাম । আসন্ন খবরের শংকায় মুখচোখে তীব্র অস্থিরতা খেলা করতে শুরু করলো । হায়দার ভাই বললেন, ‘বাবু ধরা পড়েছে । সিদ্ধিরগঞ্জ অপারেশনের রেকী করতে গিয়ে নৌকায় বসে গোলাগুলি হয় । বাবু সেখান থেকে কিভাবে পালিয়ে ঢাকায় ওর মামার বাসায় গিয়ে ওঠে আমি জানি না । সেখান থেকেই ওকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় । ওদের কাছে তথ্য আছে বাবু ক্রাক প্লাটুনের একজন ।’
আমার হাত থেকে কবিতাটা পড়ে গেল । হতভম্ব কন্ঠে বললাম, ‘খবর পেল কিভাবে ?’
‘জানি না ।’, তিনি হতাশ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালেন ।
হায়দার ভাই আর কথা বাড়ালেন না । কবিতাটি তুলে নিয়ে তাঁবু থেকে বেড়িয়ে গেলেন । আমরা তাঁবুর দরোজার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলাম । গলার ভেতর কান্না চেপে রাখতে পারছি না । তমাল এই সময় বলল, ‘দমবন্ধ লাগছে রে, বাইরে বের হবি নাকি ?’
‘চল ।’, বললাম আমি ।
বাইরে বেরিয়ে দেখি কি প্রগাঢ় জ্যোৎস্না চারপাশে । আমি ওপরের দিকে তাকাই । বুকটাকে খালি খালি মনে হয় । আমরা কিছুদূর হেঁটে গিয়ে একটা হিজল গাছের নীচে পা ছড়িয়ে বসি । কি একটা সুর মনের মধ্যে অস্পষ্টভাবে বাজতে থাকে, বাজতেই থাকে । কিছু একটা বলা দরকার । গলার ওপর যেন অদৃশ্য কিছু একটা চেপে বসেছে । আমি ছটফট করতে করতে বলি, ‘চাঁদটাকে আজ অন্যদিনের চেয়ে বেশী উজ্জ্বল লাগছে না কি রে তমাল ?’
‘হুম । আজকে একটা বিশেষ দিন, এটা জানিস ?’
‘তোর জন্মদিন নাকি ?’
তমাল খুব একটা মজার কথা শুনেছে যেন এই ভঙ্গীতে হো-হো করে হেসে উঠলো । অনেকক্ষণ সে অপ্রকৃতস্থের মতন হাসল । তারপর হাসি থামিয়ে বলল, ‘আরে না । আজ চাঁদে মানুষ নামবার কথা । রেডিওতে শুনেছিলাম আগস্টের পয়লা তারিখ অ্যাপোলো ১১ চাঁদে নামবে । কিছু মানুষ চাঁদে হাঁটবে । দ্যাখ তো, কাউকে দেখা যায় কিনা ?’ বলে আবার হো-হো করে হাসতে লাগলো । আমি বললাম, ‘বাবু ভাইকে কোন ভাবে ফিরিয়ে আনা যায় না তমাল ? আমরা তো ক্র্যাক । আমরা তো এটা করতেই পারি তাই না ?’
তমাল কোন কথা বলল না । আমি বলি, ‘তোর ঐ রাত্রির কথা মনে আছে তমাল । ঐ যে আমরা মাগনা বিয়ে খেয়ে সারা রাত চাঁদ দেখতে দেখতে হাঁটলাম ?’
তমাল ঘাড় নাড়ল, ‘হ্যাঁ, খুব মনে আছে !’
‘ঐদিন কি আজকের চেয়েও চমৎকার জ্যোৎস্না ফুটেছিল ?’
তমাল আনমনে মাথা নাড়ে । পাহাড়ি কি একটা ফুলের গন্ধে জ্যোৎস্নার আলো মাতাল হয়ে আসে । আমি নস্টালজিক হয়ে যাই । ঢাকা নামের সুবর্ণনগরের খুব ছোট ছোট গল্প আমার চোখের ওপর ভাসতে থাকে । নগরীটা হুট করে কেমন বদলে গেল ! আমি জানি তমালের মনেও একই কথা চলছিল । কিন্তু আমরা কেউ কোন কথা বলি না । হিজল গাছটির নীচে বসে বসে পাতায় পাতায় আলোর কারসাজি দেখতে থাকি । এখানে একটা যুদ্ধ চলছে মনে করতে চাই না । ঘোর ঘোর চোখ নিয়ে আমরা কেবল দেখতেই থাকি, দেখতেই থাকি । আমাদের ঘুম আসে না । চাঁদের অলৌকিক আলো বেয়ে বেয়ে নেমে আসা লৌকিক দুঃখগুলি ক্রমশঃ আমাদের ঘুম গিলে খায় ।
আমরা তারও অনেকদিন পরে জানতে পারি, যেদিন আমরা মেলাঘরের সেই নিস্তরঙ্গ বাতাসে বসে বসে জ্যোৎস্না দেখছিলাম, আমাদের সম্বন্ধে তথ্য জানার জন্য বাবু ভাইকে সেদিন একটানা কি ভীষণ নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়েছিল । বাবু ভাইকে ঐ রাতে রাখা হয়েছিল রমনা থানার একটা সেলে । এক মুসল্লীর মাধ্যমে সেখানকার এক সেপাইকে ঘুষ দিয়ে তার মা লুকিয়ে লুকিয়ে একবারের জন্য তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান । জানালার বাইরে থেকে তিনি যে মুখটা দেখেন সেটি আমাদের চিরচেনা বাবু ভাইয়ের মুখ না । মারের চোটে একটা চোখ গলে এসে তার গালের ওপর লেপ্টে পড়েছিল, ভিজে থকথকে হয়ে ছিল সেখানটা । বাঁ চোখ থেকে অনবড়ত পানি পড়ছিল । হাতুড়ি দিয়ে দুহাতের পাতা পেটানো হয়েছে নির্মম ভাবে । কোন নখ ছিল না দুহাতে । হয়তো তুলে ফেলা হয়েছিল ।
বাবু ভাইয়ের মা নীচু স্বরে বলেছিলেন, ‘বাবা, কারো নাম বলে দাও নি তো ?’
বাবু ভাই বলেছেন, ‘ভয় করে মা । যদি সহ্য করতে না পারি ? যদি বলে ফেলি ?’
‘বাবা, যখন মারবে তুমি আমার কথা মনে করবা । শক্ত হয়ে সব সহ্য করবা । টুঁ শব্দও করবা না ।’, বলতে গিয়ে তিনি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিলেন ।
৫
আমি এখন আছি উত্তর চীনের গানসু প্রদেশে । গাঢ় অন্ধকারে ঝানজাই এর সর্বোচ্চ প্লাটফর্মে এসে দাঁড়িয়েছি । এখনও আকাশে অজস্র নক্ষত্র । পায়ের নীচে ৬০ লক্ষ বছর ধরে টিকে থাকা প্রস্তরভূমি । সাইট সিইং কারের বেঁটেখাটো বৃদ্ধ ড্রাইভার সম্ভবতঃ আমাকে পাগল ভেবে নিয়েছে । বাংলা ভাষায় এতক্ষণ তার সাথে কি যে সমস্ত বকবক করলাম । এতদিন যেসব কথা কাউকে বলতে পারছিলাম না, আজ বলে ফেললাম । মন অনেক হালকা লাগছে । বৃদ্ধ কি কিছু বুঝতে পেরেছে ? এখানকার কেউ ইংরেজী ভাষাই বোঝে না, বাংলা তো অনেক দূরের কথা । আবার বুঝতেও পারে । মানুষকে ঠিকভাবে বুঝতে আসলে ভাষার প্রয়োজন হয় না । প্রয়োজন হয় মন ।
আমার এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, নয় মাসের গাঢ় অমাবস্যার শেষে একদিন আমাদের দেশটা সত্যি সত্যি স্বাধীন হয়েছিল । স্বাধীন দেশে আমার হাসার কথা ছিল । অনেকগুলি পতাকাবাঁধা গ্যাসবেলুন আকাশে ওড়ানোর কথা ছিল । আমি পারি নি । আমি হাসতেও পারি নি । বাবু ভাইয়ের কথা আমার কেবলই মনে হয়েছে । আমার চোখের জলটুকু ঝরানোর জন্য আমি তার কবরের সামনেও যেতে পারি নি । বলতে পারি নি আমরা তার আকাংখিত সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার হাউজ উড়িয়ে দিয়েছিলাম । পাওয়ার হাউজে পরপর তিনটি বোমা বিস্ফোরন হয়েছিল । বিকল হয়ে পড়েছিল চারটা জেনারেটর- ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, টঙ্গী আর তার আশেপাশের এলাকায় বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । বলতে পারি নি তার দেশটা এখন স্বাধীন । আমি তাকে কিছুই বলতে পারি নি । কারন কোথায় তার কবর হয়েছে আমরা কেউ তা জানি না । মজার মজার অদ্ভুত সব তথ্য দিয়ে সাজানো তার স্মৃতিকোষটা নিয়ে তিনি যেন কোথায় হারিয়ে গেছেন ।
হিম ঠান্ডা বাতাস আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে । আমি দুহাতে গায়ের কোট চেপে ধরলাম । এখনই আলো ফুটবে । এখানে সেখানে রঙ বদলাতে থাকবে মুহূর্তে মুহূর্তে । হাজারটা পৃথিবী একই সঙ্গে দুলতে থাকবে চোখের সামনে । আমার চোখে জল এলো । আমি অন্য একজনের স্বপ্ন কাঁধে বয়ে পৃথিবীর দ্বিনবতিটি জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি । আজ পুরো স্বপ্নপূরণ হলো । বাবু ভাই এখন কোন্ পৃথিবীতে আছে ? কোন্ অলৌকিক জগত দেখছে সে ? সেই জগত থেকেও কি স্বপ্ন দেখা যায় ? গাঢ় স্বপ্নে তিনি কি আমার সঙ্গে তার দ্বিনবতি ইচ্ছা পূরণের সমস্ত অংশ জুড়ে ছিলেন ? আমি জানি না ।
আলো ফুটতে শুরু করেছে । ঝানজাই এর এই সুবিশাল প্রস্তরভূমিতে আমি আমার চোখের সামনে যা দেখছি তার সবটাই কি বাস্তব ? পরাবাস্তব সৌন্দর্যের প্রাবল্যে আমি নড়তে পারছি না । আমার মুখ থেকে অস্ফুট একটা স্বর বের হল, পৃথিবীটা এত সুন্দর কেন ? এত সৌন্দর্যও কি ধারণ করা সম্ভব ? আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম । কোথাও যেন আমার প্রিয় টম জোনসের বিখ্যাত রেকর্ডটা ঘুরছেঃ
“Again I touch the green, green grass of home.
Yes, They’ll all come to see me in the shade of that old oak tree
as they lay me neath the green, green grass of home..”
=============================================
উৎসর্গঃ
‘এই সুবর্ণনগরে’ গল্পটি লেখার চিন্তা যখন মাথায় আসে তখন আমি সিলেটে এক বন্ধুর বাড়িতে । চার পাঁচজন বন্ধু মিলে সেখানে বেড়ানোর জন্যে যাওয়া । জায়গাটার নাম সুরমা । সুরমা পর্যন্ত যেতে যেতে যেসব পাগলামি হয়েছে সেসব লেখা যাবে না । চরিত্রে দাগ পড়ে যাবে । সব প্রজন্মই মনে করে আমরা যুবক বয়েসে যে সব উন্মাদ কর্মকান্ড করেছি, উল্লাস করেছি তা অন্য কেউ কল্পনাও করতে পারবে না । আমরাও এর ব্যতিক্রম নই । সেই কর্মকান্ড যাতে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে সেইজন্য ট্রেনে বিনা টিকেটে চার-পাঁচজন মিলে ঢাকা থেকে সিলেট-চট্টগ্রামের ঐদিকে চলে যাওয়া হতো । চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ার অভিজ্ঞতা যেমন নেয়া হয়েছে, ছেড়ে যাওয়া ট্র্বেনে দৌড়ে লাফিয়ে ওঠার ঘটনাও ঘটেছে । ভয়াবহ ধরনের অনেক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও সেন্সরশীপ এবং পারিবারিক প্রতিবন্ধকতার কারনেই লিখতে পারছি না । তবে বুদ্ধিমান পাঠকদের কল্পনা নিতে সমস্যা হবার কথা না । কারন লিস্টটা অনেক লম্বা । কিছু না কিছু কমন পড়েই যাবে ।
তো, সুরমার এক বাড়িতে আমরা কয়েকজন ঘর অন্ধকার করে বসে আছি । ঘরটা ছোট । ঘরের বারান্দা থেকে মেঘালয়ের নীল পর্বত দেখা যায় । আমরা সেই সৌন্দর্য ধারন করার মত অবস্থায় নেই । আমরা আছি ঘোরের জগতে । অন্ধকার ঘর মাঝে মাঝে পিনিকবাতির লাল-নীল-হলুদ আলোয় মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে । একেকজনের হাতে হাতে গিটার ঘুরছে পালাক্রমে । চমৎকার সব গান শুনছি । হঠাৎ শাফি নামের অল্পপরিচিত এক ছেলে তার মায়াময় ভরাট কণ্ঠ ছেড়ে গাইতে শুরু করলঃ
তুমি গাইতেই পারো গান
এই সুবর্ণনগরে
ভুলে যেতে পারো ইতিহাস
অর্থহীন অদরকারে...
গানটা মেঘদল ব্যান্ডের । আমি ঐ প্রথম মেঘদলের কোন গান শুনলাম । তখন কে কি ভাবছিল জানি না । আমি ভাবছিলাম আমার মাটির ইতিহাসের কথা । আমার স্বাধীনতার কথা । আমার মুক্তিযুদ্ধের কথা । গান শেষ হওয়ার পর আমি মুগ্ধ গলায় বললাম, ‘আমি গানটা শুনে এতটাই মুগ্ধ হয়েছি যে আমি ‘এই সুবর্ণনগরে’ নামে একটা গল্প লিখবো । গল্পটা না লেখা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না ।’
আগেই বলেছি সব প্রজন্মেরই নিজেদের যুবক বয়স নিয়ে এক ধরনের অহংকার থাকে । আমদের আছে । আমাদের পূর্বপুরুষদেরও ছিল । একই ধরনের অহংবোধ থাকবে আমাদের পরবর্তী পুরুষদেরও । কিন্তু এর ফাঁকে একদল প্রজন্ম সত্যিকার অর্থেই এমন কিছু করে বসল যা আমরা বা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আসলেই কখনো কল্পনা করতে পারবো না । ঢাল তলোয়ার ছাড়াই প্রচন্ড এক যুদ্ধের খেলায় মেতে উঠলো । যেখানে একবার মারা গেলে দ্বিতীয়বার আর কোনও লাইফ চান্স পাওয়া যায় না । ‘গেম ওভার’ হয়ে যায় । এরা সব জেনেশুনেও ভয়াবহ এই কাজটা কেন করল কে জানে ! হয়তো এটাই যৌবনের সবচে কঠিন নেশা । যুদ্ধ ! ভালবেসে আমরা সেই যুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধ ডাকি ।
গল্পে বর্ণিত ক্র্যাক প্লাটুন নামের এই গেরিলা দলটিকে ইতিহাস মনে করে রেখেছে । দলের ইঞ্জিনিয়ার ছেলেটি আমাদেরকে শহীদ রূমীর কথা মনে করিয়ে দেয় । বাবু ভাইয়ের পরিণতি আর শহীদ আজাদের পরিণতি তো একই গল্প ! তারপরও সঙ্গত কিছু কারনেই গল্পটিকে ফিকশন বলা হল ।
মাঝে মাঝেই মনে হয়, এমনও তো হতে পারত, রূমী আমেরিকা থেকে ফোন করে তার মাকে বলছেন, ‘আম্মা, আমি এখানে একটা বাড়ি কিনেছি । বিশাল দুর্গের মত বাড়ি । এমাসে আপনাকে একবার আসতেই হবে । আমি প্লেনের টিকেট পাঠালাম ।’ রূমী বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই বড় ইঞ্জিনিয়ার হতেন ! তিনি কি বেঁচে থাকতে পারতেন না ? এরকম কতো মানুষই তো আছে যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পালিয়ে বেড়িয়েছে, এখনও বেঁচে আছে বিদেশের মাটিতে । সুখে আছে । অথচ এত চমৎকার ধনী একটি গোছালো পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি কেন যুদ্ধে গেলেন ? শহীদ হলেন ? তিনি তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলা দেখে যেতে পারেন নি ভেবেই আমার বুকে চিনচিনে একটা ব্যথা হয় । আমি আমার গল্পের ইঞ্জিনিয়ার ছেলেটির প্রতি চেষ্টা করেও নিষ্ঠুর হতে পারি না । তাকে জীবিত রাখি । তাকে দিয়েই পুরো গল্পটা বলাই । সেও হয়তো শহীদ রূমীর প্রতি আমার তীব্র আবেগের কারনেই ।
আমি কল্পনা করি রূমী আজ যেখানেই আছেন সুখেই আছেন । কল্পনা করি, কারন প্রতিদিন সূর্যাস্তের সময় টকটকে লাল সূর্যটার দিকে চোখ পড়লেই কেন জানি আমার মনে পড়ে রূমী নামের কেউ একজনের কথা, যাকে আমি দেখি নি । চিনিও না । অথচ কি প্রচন্ডভাবেই না তাঁকে অনুভব করি ! সে আজ ধনী বৃদ্ধ হয়ে বিদেশে বেঁচে নেই । কিন্তু মরে গিয়েও আমাদের প্রজন্মের কাছে নায়ক হয়ে আছেন । তরুন হয়ে আছেন । তিনি কখনোই আমাদের চোখে বুড়ো হবেন না । আমাদের ছেলেমেয়েরাও তাঁকে মনে করবে একই ভাবে, এই একইরকম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা নিয়ে । এজন্যেই কল্পনা করতে পারি রূমী যেখানে আছেন সুখে আছেন, ভাল আছেন ।
বিশাল উপন্যাস সাইজের উৎসর্গপত্র লিখলাম । যাঁর জন্যে লিখলাম তিনিও বিশাল বড় একজন মানুষ । মানুষটি আজ মৃত । বিভূতিভুষণের ‘দেবযান’ উপন্যাসের মত পারলৌকিক যাত্রা হলে তিনি হয়তো এ লেখা পড়তে পারবেন । তার পৃথিবীটা কেমন তা জানি না । উইলিয়াম শেকসপীয়ার কিংবা এডগার এলেন পো’র মৃতদের জগতের মত কি ? তবুও গল্প লেখার সময় সত্যিই খুব ইচ্ছে করছিল যদি আমি তাঁকে আমার লেখা গল্পটি পড়ে শোনাতে পারতাম !
শহীদ শফি ইমাম রূমী –কে,
এ পৃথিবী একবার পায় তারে পায় নাকো আর !
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন