|
পার্থ তালুকদার
|
|
গল্পঃ শাড়ি
29 November 2014, Saturday
আকাশি গাছের খসখসে শুকনো পাতাগুলো মৃদু বাতাসের স্পর্শে এক এক করে বাড়ীর উঠানে বিছানো বালিতে গড়াগড়ি করছে। জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে লোহার রডে দুই হাতের মুষ্টি চেপে গাছের প্রাণহীন শুকনো পাতা আর বালিকণার এমন মাখামাখি অপলক চোখে খেয়াল করছে লোপা। শহরে মাথা উচু করে দাড়িয়ে থাকা বিল্ডিংয়ের মাঝে হাটু ভাঙ্গা বৃদ্ধের মতো কোনভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে লোপাদের বাড়ীটি। লোপার বাবার এ নিয়ে মনে কোন আক্ষেপ নেই। বুক উচিয়ে, চোখ ঘুরিয়ে তাঁর স্ত্রীকে বলেন- বুঝলা লোপার মা, আমার দুইটা মেয়ে যেন আমার দুইটা জলন্ত চোখ, ঐ চোখ দুটির যত্নে তুমি কখনও হেয়ালি করো না।
গত বছরের এমনই এক দিনে লোপা বিয়ে করে সদ্য বিদেশ থেকে পিএইচডি করে আগত পলাশকে। মা-বাবার একমাত্র আদুরে ছেলে পলাশ। পড়াশুনায় মেধাবী এমন ছেলে পেয়ে লোপার বাবা-মা যেন হাতে আকাশের উজ্জ্বলতর তারাটা পেয়েছেন। সর্বগুণে গুনান্নীত না হলেও সুশ্রী, শিক্ষিত ও বুদ্ধিমতি মেয়ে লোপা। ছোট বোন দিপাকে তাঁর মা বলেন- ‘শুন দিপা, ভাল করে পড়াশুনা কর। তোকেও পলাশের মত এমন শিক্ষিত ছেলের কাছে বিয়ে দিব।’ মায়ের মুখে পলাশের এমন গুণগান শুনে গর্বে লোপার মনটা ভরে যায়।
এসব মনে পড়তেই জানালায় লম্বালম্বি ভাবে দাড়িয়ে থাকা রড দুটিতে দুহাতে শক্ত করে চেপে ধরে সে। দুচোখে ঠান্ডা অনুভুতি হয় তাঁর। শাড়ির নরম আচল দিয়ে মুছে নেয় চোখের জমানো জলের ধারা। বাবার বাড়িতে এভাবে হুটহাট করে চলে আসবে তা কখনো কল্পনা করেনি সে।
বিয়ের ছ’মাস পরেই পলাশের আমুল পরিবর্তন চোখে পড়ে তাঁর। স্ত্রীর সামনে একটা অচেনা মোবাইল থেকে ফোন আসলেই পলাশের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কিছু একটা লোকানোর চেষ্টা করে সে। ফেসবুকে যখন ঐ মেয়েটির সাথে চ্যাট করে তখন তাঁর মুচকি হাসি লোপার হৃদয় কাপিয়ে তুলে। শান্ত নদীতে যেন বৈশাখি ঝড় বয়ে যায়। চকচকে ফ্ল্যাটে সে তখন কোন সুখ খুঁজে পায় না। সে সুখ খুঁজে চাকচিক্যময় এই জীবনের পাতায় পাতায়। শোকেসে রাখা প্রতিটা রঙ্গিন শোপিসের মাঝে লোপা সুখ খোঁজে।
একটা সময় পলাশের কাছ থেকে সব জেনে নেয় লোপা। মেয়েটির নাম নিম্মি। পলাশের খুব কাছের বান্ধবী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন নিম্মির সাথে খুবই ঘনিষ্টতা ছিল তাঁর। এ নিয়ে বন্ধু-বান্ধবীরা আড় চোখে অনেক কিছুই বলতো। তাতে কান না দিয়ে অবাধে ঘোরাফেরা করত তারা। পলাশের ভাষায়- ‘কিছু প্রেম নাকি সুপ্তই রয়ে যায়। সময় আর সুযোগের অভাবে বিকশিত হয় না।’ নিম্মির প্রতি তাঁর প্রেমের ধরণ এমনই ছিল।
- তাহলে আমার সাথে না জড়ালেই পারতে।
- তা পারতাম, তবে নিম্মিকে বিয়ে করে সংসার গড়ব তাও মানতে পারছিলাম না। ভেবেছিলাম তোমাকে বিয়ে করলেই পুরানো সব স্মৃতি মন থেকে ঝড়ে যাবে। কিন্তু তা ও হয়নি।
- দেখো পলাশ, তুমি যেভাবে ঐ মেয়েটির সাথে কথা বল, চ্যাট কর, তা চলতে থাকলে আমার দ্বারা তোমার এই সংসারে থাকা সম্ভব নয়। তোমার ভিতরের এই দ্বৈতসত্তা আমাকে চিবিয়ে চিবিয়ে শেষ করে দিচ্ছে।
- আহা, এখানে দ্বৈতসত্তার কী দেখলে। নিম্মির প্রতি আমার একটা মোহ ছিল,টান ছিল, সেটা আমি কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছি। তাছাড়া তোমাকে আমি অনেক পছন্দ করি। এই যে শাড়িটা তুমি পরে আছ, সেটা কত কষ্টের বিনিময়ে ম্যানেজ করেছি আমি, তুমি কি জানো !
এসব বলতে বলতে পেছন থেকে লোপাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে পলাশ। লোপা ঘুরে গিয়ে পলাশের কামুক হাত দুটি ফিরিয়ে দেয়। নিজেকে একটু দুরত্বে সরিয়ে নিয়ে বলে- ‘তোমাকে আমি দু’একদিন সময় দিচ্ছি পলাশ, তুমি নিজেকে শুধরিয়ে নাও। এর পরিনতি ভাল হবে না বলে দিচ্ছি। বেলা শেষে তোমার ব্যাকুল সুর আমাকে ফিরাতে পারবে না।’
না, পলাশ নিজেকে শুধরাতে পারেনি। লোপাও পারেনি নিজেকে সামলাতে। একদিন ঝগড়া যখন তুঙ্গে, লোপা তখন মায়ার এমন ইন্দ্রজাল পেছনে ফেলে তাঁর বাবার বাড়িতে চলে আসে। আজ সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে গত এক বছরের প্রতিটি মুহুর্তকে আকড়ে ধরার চেষ্টা করছে। সেখানে দুঃখের স্মৃতি বেশি হলেও সুখের পরিমানটাও নেহাত কম নয়।
পিঠে নরম হাতের পরশ পেয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে তাঁর মা মুখে কালো মেঘের ছায়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। লোপা বাড়িতে আসার পর থেকে তাঁর মায়ের হাসিমুখ যেভাবে কালো বরন ধারন করেছে তা আর সরূপে ফিরে আসেনি।
- বুঝলি মা, সংসারে এমন একটু-আধটু সমস্যা হবেই। তাই হুট করে এভাবে চলে আসতে হয় না। তাছাড়া আমাদের আশেপাশের মানুষজন কী বলবে শুনি। পলাশ তোকে অনেক ভালবাসে। আচ্ছা দেখ, সে যখনই কোথাও বেড়াতে যায় তোর জন্য কত কিছু নিয়ে আসে। তুই এই এক বছরে যে কয়টা শাড়ি পরেছিস, আমি সারা জীবনেও এতটা শাড়ি পাইনি।
- মা, একটা মেয়ের জীবনে শাড়িই কি সব ? আচ্ছা মা, বাবা তো তোমাকে এতটা শাড়ি কিনে দেয়নি, তার মানে কী তুমি সুখি হও নি ?
মেয়ের মুখ দিয়ে এমন কঠিন সত্যটা বেরুবে তা ভাবেননি লোপার মা। মাথা নিচু করে তিনি রুমের দিকে পা বাড়ান। লোপা বলে, ঠিক আছে মা, আমি কাল পলাশের কাছে চলে যাব। আমাকে নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। আর পাড়াপড়শিকে বলে দিও, ওরা যা বলতে চায় তা যেন আমাকেই বলে।
পুরোটা রাত জেগেই কাটিয়ে দেয় লোপা। পলাশের সাথে কেটে যাওয়া দিনগুলোর মধ্যে ভাললাগার প্রতিটা ক্ষণ খুটিয়ে খুটিয়ে আলাদা করে। একবার গভীর রাতে যখন ঝুম বেগে বৃষ্টি হচ্ছে, তখন পলাশ লোপাকে নিবিড় ঘুম থেকে টেনে তুলে বেলকনিতে বসিয়ে রাখে। তারপর সে নিজ হাতে কফি তৈরি করে নিয়ে এসেছিল। লোপা ঘুমকাতুর চোখে বলেছিল- এসব কী হচ্ছে পলাশ !
আরেকবার কী হলো, লোপা বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় ফিরেছে। পলাশ তাকে গদগদ কন্ঠে বলল, তুমি কিন্তু এখন হলুদ শাড়িটা পরবে এবং শাড়িটা আমিই পরিয়ে দিব। লোপা চোখদুটি কপালে তুলে বলল- তুমি আমাকে শাড়ি পরিয়ে দিবে! ছিঃ পলাশ, অবশেষে তুমি দুষ্টুর তালিকায় নাম উঠালে ! পলাশ বলল, আচ্ছা তাই ! ওকে, যেহেতু তুমি এই খেতাব দিয়েছ, তাহলে এবার আমার দুষ্টুমিটা একটু সহ্যই করো ডার্লিং।
সেদিন কিছু দুষ্টুমিই হয়েছে, শাড়িটা পরা হয়নি।
আজ রাতে লোপার চোখে বর্ষা বইছে। মন কাঁদছে তাঁর। প্রিয়কে কাছে পাওয়া তীব্র বাসনা এই বর্ষাকে দ্বিগুন করে দিয়েছে। তাই, পৃথিবী যখন একান্ত ভাবনায় ব্যস্ত তখন সে সিদ্ধান্ত নেয় রাত পোহালেই পলাশের কাছে হাজির হবে। নতুন সূর্যকে সাক্ষী রেখে ভালবাসার কাছে সে হার মানবে।
কলিং বেলটা চেপে দাঁড়িয়ে আছে লোপা। মনটা অজানা এক ভয় আর উত্তেজনায় চটপট করছে। ভিতর থেকে কানে আসা কলিং বেলের শব্দটা তাঁর খুবই পছন্দের। কিছুদিন আগে সে নিউমার্কেট থেকে অনেক খোজাখুজি করে কিনেছিল। বেলটা চাপলেই একটা শিশুকণ্ঠ বলে উঠে- ‘আমাদের বাসায় সু-স্বাগতম।’
ওপাশের দরজা খোলার শব্দটা কানে বাজতেই সোজা হয়ে দাঁড়ায় লোপা। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে তাঁর অচেনা মনে হলেও শাড়িটি চিনতে ভূল করেনি। এটা তাঁর সেই প্রিয় শাড়ী, যেটা কিছুদিন আগে পলাশই কিনে দিয়েছিল। ভিতর থেকে পলাশের তীর্যক কণ্ঠ- কে এসেছে নিম্মি ?
নিম্মি শব্দটা তাঁর কানে আসতেই সে অবাক চোখে মেয়েটির দিকে তাকায়। তাঁর দু’পা কাঁপছে। নরম হৃদয়টাতে কে যেন ধারালো ছুরি দিয়ে ছপাত ছপাত করে কুপিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি তাঁর সামনে এভাবে হোঁচট খেয়ে পরবে তা ভাবেনি কখনো।
বুদ্ধিমতী লোপা মাথা ঠান্ডা করে বলে- এটা কি ফারুক সাহেবের বাসা ?
- না। আপনি ?
- আমি .. .. স্যরি, আপনি আমাকে চিনবেন না।
আবার পলাশের কণ্ঠ- কে এসেছে নিম্মি ?
- অপরিচিত এক মহিলা। ফারুক সাহেবের বাসা খুঁজছে।
- তুমি বলে দাও, এই নামে কোন মানুষ এই ফ্ল্যাটে নেই, এমনকি বিল্ডিংয়েও। তারপর নিজেকে নিজেই বলে- এত স্লো মেমরি নিয়ে মানুষ কীভাবে চলে!
পলাশের এমন অবহেলার সুর কানে নিয়ে লোপা ক্ষীপ্র গতিতে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। তিন তলার এই কয়েকটি সিড়ি বেয়ে নামতে ঘাম ঝরছে তার। চোখের কোনে যেন বরষা বইছে। সে জানেনা এই সিঁড়ি বেয়ে কখনও তাকে উঠতে হবে কিনা। তাঁর গন্তব্য এখন অজানা, অজ্ঞাত। সে কী আজ শ্বেত-শুভ্র বক পাখির মত মুক্ত ডানা উড়িয়ে আকাশে উড়বে নাকি আশ্রয় নিবে নতুন কোন ঠিকানায়, নতুন কোন নীড়ে। সবই অজানা তাঁর, অথচ নিয়তি দ্বারা সবই নির্ধারিত।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন