|
কলমের কালি শেষ
|
|
গল্প: আত্মহত্যার পরে ।
29 November 2014, Saturday
বিশপ ময়লার স্তুব থেকে উঠতে উঠতে তার ঘড়ির দিকে তাকায় ।ওহ্ শিট্ আটটা বেজে গেছে । তার অফিস নয়টা শুরু হয় । সে খুব সময় মেপে চলে বলা যায় অত্যন্ত ক্যারিয়ার সিকার একজন মানুষ ।তার দৈনন্দিন সকল কাজ রুটিন মেপে হয় । কোনদিন রুটিনের একটু হেরফের হলেই তার মাথা ঠিক থাকে না ।অবশ্য এর অনেক সুফলও সে পেয়েছে । চাকরির অল্প বয়সেই সে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টের এজিএম পদে উন্নিত হয়েছে ।
বিশপ ময়লার স্তুব থেকে উঠে এসে রাস্তার উপর দাড়ায় । সে তার দিকে তাকায় পুরো শরীর ময়লায় ঘিনঘিন করছে ।সে ভাবে আমি কিভাবে এখানে আসলাম ? আবার চিন্তা করে যাই হোক এই সব নিয়ে ভাবাভাবীর এখন আর টাইম নাই । আমাকে তাড়াতাড়ি অফিসে যেত হবে সেই ভেবেই হাত নাড়িয়ে একটু দৌড়েই রাস্তা পার হতে থাকে । কিন্তু দ্রুত গতিতে আসা বাসটা তার ইশারার তোয়াক্কা না করেই তার উপর দিয়ে চলে গেল । বাসের পর আরও দুটি গাড়ি তাকে চাপা দিয়ে চলে গেল । কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় সে এখনো রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ।গাড়ীগুলো যেন তাকে বাতাসের মত ভেদ করে চলে যাচ্ছে । বিশপ আঁতকে উঠে আবার তার নিজের দিকে তাকায় । হাত দিয়ে শরীরে স্পর্শ করে দেখে সবই তো ঠিক আছে তাহলে গাড়ীগুলো আমার গায়ে লাগছেনা কেন ? হঠাৎ করে রাস্তার পাশের এক আয়নার দোকানের দিকে চোখ যেতেই সে হতবম্ভ হয়ে যায় ।সে নিজেকে আয়নাতে দেখছেনা !
আমার কি হয়েছে ? তাহলে কি আমি মারা গেছি ! তখনি কিছু দূরে অনেক মানুষের জটলা দেখতে পায় বিশপ । সে সেই দিকে এগিয়ে যায় ।সে ভীড়ের মানুষগুলোকে ভেদ করে ভেতরে ডুকতেই দেখতে পায় একজন মানুষ রাস্তায় উপড় হয়ে পড়ে আছে ।এক হাত বুকের ভেতরে ডুকানো আরেক হাত বের হয়ে আছে । চেহারার একপাশ দেখা যাচ্ছে । বিশপ একপেশে চেহারা দেখেই বুঝতে পারে এইলোক সে নিজেই । সে তখন নিজেকে কিছুই বোঝাতে পারে না । বিশপ খুব করুনভাবে কান্না করতে করতেই পড়ে থাকা তার নিজের দেহের পাশে বসে পড়ে ।সে পড়ে থাকা দেহটির দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে কে তার এত বড় সর্বনাশ করলো ।কে তাকে এত নির্মনভাবে গুলি করলো ? বুলেটটা বাম বুক বরাবর পিঠের পাশে অর্ধেক বেরিয়ে আছে । বিশপ অভাগার মত বসে বসে ভাবতে থাকে ।
নিশ্চয় জাওয়াইল্যা এই কাজ করছে । সে দীর্ঘদিন ধরে দিনুকে ডিস্টার্ব করছে এই নিয়ে তার সাথে আমার কয়েকবার হাতাহাতি হয়েছে ।তাহলে কি দিনুকে পাওয়ার জন্যই আমাকে সরিয়ে দিয়েছে জাওয়াল ?বিশপ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে না এটা জাওয়ালের কাজ না সে তো গত মাসে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করছে । তার সাথে তো আমার বিরোধ মিটে গেছে । তবে আর কে হতে পারে? চাচারা নয় তো? উনার সাথে আব্বার অনেকদিনের বিরোধ চলছে দাদার বাড়িটা নিয়ে । মাঝে মাঝে মেরে ফেলারও হুমকি দিত আমাদের । তাহলে কি আমাকে দিয়েই শুরু করেছে ? যাহ্ এইসব আমি কি ভাবছি চাচারা আমাকে মারবে কেন । তাছাড়া উনাদেরকে টাকা দিয়ে আমরা বিবাধ মিটমাট করে ফেলেছি । সেইদিনও তো আমরা চাচারা একসাথে পার্টিতে মেতে ছিলাম । নাহ চাচারা এই কাজ করতে পারে না । তাহলে আমার এই সর্বনাশটা করলো কে ?
বিশফ আবার ভাবতে থাকে । আচ্ছা অফিসের ভোমান ভাই নয়তো ?এমনিতেও লোকটা সুবিধার না । তার সাথে অনেকদিন ধরে জিএম পদ পাওয়ার জন্য আমার লড়াই চলছে । তবে কি ভোমান এই পদ পাওয়ার জন্য আমাকে সরিয়ে দিলো । তাই বলে সামান্য প্রোমোশনের জন্য একজন জনজ্যান্ত মানুষকে মেরে ফেলবে ? তার দ্বারা হতেও পারে সে যেই ক্র্যাক পাবলিক ! আচ্ছা তবে ভোমানকে নিয়ে একটু ভাবা দরকার ।গতকালও তো তার সাথে অফিসে দেখা হয়েছে । সেইরকম কিছু তো মনে হয়নি উল্টো গতকাল সে অনেক হাসিখুশি ছিলো আর হাসিখুশি থাকবেইবা না কেন গতকাল তো ভোমানের.. । না না ভোমান তো আমাকে মারতেই পারে না । জিএম পদে তো তাকেই প্রোমোট করা হয়েছিলেন এবং আমিও খুশি মনে মেনে নিয়েছিলাম । তবে কি আমি ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েছিলাম ? হয়তো রাতে বাসায় ফেরার সময় আমাকে এটাক্ট করেছিল । আমি কিছু না দিতে জোরাজোরি করায় গুলি করে নিয়ে গেছে ।এই সম্ভাবনাটা কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যায় না দেশের যা অবস্থা এখন । হুম তবে ছিনতাইকারীই আমার এই বিশাল ক্ষতিটা করে গেছে ।
সাইরেন বাজার আওয়াজে ঘোর কাটে বাতাসরুপী বিশপের । পুলিশ এসেছে ঘটনাস্থলে ।সেই কবে ঘটনা ঘটলো আর পুলিশ এসেছে এখন ! পুলিশ কর্তা বিশাল ভাব নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে লাশটা চিৎ করার জন্য বলল । একজন নাকে ফুটায় আঙ্গুলের ছোঁয়া দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করলো । বিশপ তাদের কাজের দিকে তাকিয়ে আছে । কিছু পুলিশ হাতে গ্লাভস্ পড়ে আমাকে চিৎ করালো । বুকের নিচে চাপা পড়া হাতটিও বের হয়ে আসলো ।হাতটি দেখে বিশপ নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না । সে স্তব্ধ হয়ে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল । তার পিঠে আঁধেক বের হয়ে থাকা বুলেটের মালিক তার হাতেই আটকানো । তাহলে কি আমিই আমাকে মেরেছি । আমি আত্মহত্যা করেছি ! না এ কখনোই সম্ভব না আমার কত সুন্দর সুখী জীবন ছিলো আমি আত্মহত্যা করবো কেন ? বিশপ আবার গভীর ঘোরে চলে যায় । গতকালকে সে আবার রিক্যাপ করতে থাকে ।
প্রতিদিনের মত সকালে উঠে সময়ের আগে অফিসে পৌঁছাই ।তারপর সারাদিনের কাজ শেষ করে বিকাল হয়ে যায় । বিকালের দিকে বস আমাকে আর ভোমানকে উনার রুমে ডাকেন । আমাদের সাথে কথা বলে ভোমানকে প্রোমোশন দেওয়ার কথাটা বলেন আর আমাকে মন খারাপ না করতে বলেন । কিন্তু এই পোষ্টের জন্য অনেক কষ্ট করেছিলাম আমি । নিজেকে যন্ত্রের মত বানিয়ে ফেলেছি । অফিসে এসেছি টাইমের আগে কিন্তু যাওয়ার সময় ভুলে অফিসের কাজ করেছি । এই পোষ্ট যদি কেউ ডিজার্ভ করে সে হলাম আমি কিন্তু বস দিয়ে দিলেন ভোমানকে । অনেক মন খারাপ হয়েছে তারপরও হাসিমুখে সব মেনে নিয়েছি ভোমানকে কনগ্রেচুলেট করেছি । ভোমানও খুশিতে ইন্সট্যান্ট অফিসে একটা পার্টি থ্রো করে । পার্টি শেষে স্বন্ধ্যায় আমি বাসায় ফেরার জন্য অফিস থেকে বের হই। তারপর তারপর…. । ও হ্যা আমি রাস্তার একপাশ ধরে হাঁটতে থাকি । আমার শরীর একদম নিরব হয়ে গিয়েছিল মনে হয় যেন চেতনা হারিয়ে গেছে । অফিসে এতক্ষন সব হাসিখুশীভাবে দেখলেও এখন আর পারছিলাম না । যেন খালি বিশাল একটা পৃথিবীতে আমি দাঁড়িয়ে আছি যেখানে চন্দ্র, সূর্যও উঠে না । চোখকে আর ধরে রাখতে পারলাম না । বাঁধটা ভেঙ্গে পানি বেরিয়ে আসলো । এই মুহূর্তে বন্ধু সুমিদকে খুব দরকার যদিও তার ঈর্শনীয় সাফল্যে আমি তার প্রতি হিংসা পরায়ন । তবে তাকে এখন আমার খুব দরকার আসলে তাকে নয় তার লাইসেন্স করা বন্দুকটা দরকার ।
আমি সুমিদকে ফোন দিয়ে তার বাসায় যাই । তার ঘরে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দেশী বিদেশী মদ সবসময় থাকে কারন বিদেশী ব্যবসায়িক পার্টনারদের খুশী করাতে হয়। যদিও আমি কখনো মদ খেতাম না কিন্তু সুমিদের সাথে রাতে অনেক মদ খাই । তবে আমার যে বন্দুক দরকার সেটা ভুলি না । কোন একসময় তার ড্রয়ার থেকে বন্দুকটা আমার ইনকরা শার্টের ভেতর গুজে ফেলি ।গভীর রাতে যখন সুমিদের শরীর ছেড়ে দেয় তখন আমি বেরিয়ে পড়ি । আর এই ব্রিজের এইখানটায় এসে দাড়াই এবং নিজের বাম বুকে গুলিটা বসিয়ে দেই ।নিজের দুঃখে নিজে মরলাম ঠিক আছে কিন্তু সুমিদকে বিপদে ফেললাম কেন ? আমিতো অন্য কোনভাবেও নিজেকে মারতে পারতাম । তাহলে কি তার প্রতি হিংসাপরায়নতার প্রতিশোধও নিলাম ? ছি. ছি. আমি এইসব কি করেছি ! কত সুন্দর একটা জীবন ছিল আমার । সামান্য হতাশায় আর হিংসার কারনে আমি নিজেকে এইভাবে মেরে ফেললাম। একি আমি আবার এই ময়লার স্তুবে কি করে আসলাম !
বিশপ আবার বের হতে চায় ময়লার ভেতর থেকে কিন্তু বের হতে পারে না । যেন আয়নায় বন্ধী ময়লার স্তুবের ভেতর সে আটকে গেছে । বিশপ বের হওয়ার জন্য খুব চিৎকার করে তার সাথে আরও অনেক আছে । তারাও সজোরে চিৎকার করতে থাকে বের হওয়ার জন্য ।ময়লাযুক্ত আয়নার বাক্সের ভেতর থেকে অনেকগুলো হাতের অনবরত চিৎকার চলতে থাকে…শুধুই চিৎকার….তীব্র চিৎকার….দুর্গন্ধের চিৎকার….
কোথায় থেকে যেন আওয়াজ ভেসে আসে, তোমাদের জায়গা কোথাও নেই, তোমরা আত্মহত্যাকারী, তোমরা পরাজিত….
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন