চাঁদ, জ্যোৎস্না ও ছায়ার গল্প
মাঝ হেমন্তের চাঁদনী রাত। প্রকৃতির বুক জুড়ে রাতের গভীরতার আবাহন। ঋতুর পালাবদলের আগমনী সংগীত ঠোঁটে নিয়ে নীরব মুখরতায় একে এক ঝরে পড়ছে শিশির কণা। এমনি আয়োজনে নিস্তব্ধ রাতের বুক ছিঁড়ে জেগে উঠা একটি মানুষ আমি, একা রাস্তায়। ধবধবে সাদা মাটির উঁচু রাস্তার দুই পাশ ঘন দুর্বায় ঢাকা। আমি ইচ্ছে করেই মাঝখানের মাটির রাস্তা ছেড়ে পাশের ঘন দুর্বা ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটছি, ঘাসের ডগায় তির তির করে জমে উঠা কুয়াশার আদুরে ষ্পর্শ নিব বলে। শেষ হেমন্তের দিনগুলোতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে না আসতেই কুয়াশা পড়তে শুরু করে। গ্রামাঞ্চলে না গেলে হেমন্তের কুয়াশার দেখা পাওয়া যায় না। কারণ, শহুরে যান্ত্রিকতায় হেমন্ত কেন, শীতকালেও কুয়াশার দেখা পাওয়াটা ক্রমশঃ ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আমি হাঁটছি। ঘন দুর্বা ঘাসের বুকে আমার পায়ের এক একটা ষ্পর্শ পড়ছে আর তা আমার মনের অনুভূতির তারগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে নব কুয়াশার আলিঙ্গন পেয়ে যৌবনবতী হয়ে উঠেছে দুর্বাঘাসগুলো। আমার প্রতিটি পদষ্পর্শে নড়েচড়ে উঠে ঘাসের ডগাগুলো তাই জানান দিচ্ছে। ভিজে যাচ্ছে আমার শাড়ির পাড়। তবু হাঁটছি আমি, মাঝে মাঝে উপুর হয়ে হাতের পাঁচ আঙুলের আলতো ষ্পর্শ বুলাচ্ছি ঘাসের ডগায়। টের পাচ্ছি শিশিরভেজা ঘাসের ষ্পর্শে আন্দোলিত হচ্ছে আমার চেতনার রুদ্ধ বাতায়ন। সেখানে জাগছে নব প্রাণের উন্মাদনা নব কিশলয়ে পত্র-পুষ্পের সুশোভিত আবাহনে।
চাঁদনী রাতে গাঁয়ের পথে শিশিরভেজা ঘাসের সাথে আমার এই সখ্যতা নতুন নয়, তবে বহুদিন পরের। তাই আমার এই মুহূর্তের উপলব্ধিটা অনেক পরিপক্ক, কাংখিত আস্বাদন লাভের আনন্দে আন্দোলিত। শৈশবকালে এই পথ, এই চাঁদনী রাত, এই শিশিরভেজা দুর্বা ঘাস- সবই ছিল আমার বেড়ে উঠার সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে, এখনও জীবন্ত হয়ে আছে আমার জীবনের খেরোখাতায়। তাই আজ এরা আমার সম্মোহনী চেতনাকে আবিষ্ট করে ফেলেছে মুহূর্তেই, আমার চেতনার রুদ্ধ দ্বার খোলে আমাকে বের এনেছে, দাঁড় করিয়ে দিয়েছে উদার প্রকৃতির মুখোমুখি। যেখানে শুধু নিজকেই খোঁজে পাওয়া যায় নিজের মতো করে, নিজকে আবিস্কার করা যায় ফেলে আসা দিনগুলোতে। আমি হাঁটছি তো হাঁটছি যেন এই চলার শেষ নেই, যেন অনাদিকালের কোন সোনালী মুহূর্ত থেকে শুরু এই পথ চলা। দুর্বা ঘাস ছুঁয়ে শিশির বিন্দুর ষ্পর্শ নিচ্ছি আমি, আকাশে চাঁদের দিকে তাকিয়ে দু’হাত বাড়িয়ে প্রকৃতিকে কাছে ডাকছি আমি, আরও কাছে। মনে মনে বলছি, এই আমার পথ চলা প্রাগৈতিহাসিক ক্ষণ থেকে, সৃষ্টির সাথে এই-ই আমার সখ্যতা অনাদি কালের। এরাই আমার প্রকৃত বন্ধু, চলার পথের সাথী, একাকিত্বের সরব আবাহন, ভালবাসার নিষ্কন্টক অনুভূতি। কেবল এরাই পারে আমার একাকিত্বের মুহূর্তগুলোকে মুখর আনন্দে মাতিয়ে তুলতে।
হঠাৎ মনে হলো কে যেন আমায় ডাকছে! কিন্তু নাম ধরে নয়। আমি সামান্য ক্ষণের জন্য সেদিকে মনযোগ দিলাম। কিন্তু ষ্পষ্ট কিছু বুঝতে না পেরে ফিরে গেলাম একটু আগের তৈরী স্বপ্নিল পৃথিবীতে। সেখানে চাঁদ আছে জোছনার বিলোল মোহময়তা ছড়িয়ে, নরম দুর্বা ঘাস আছে বুকে শিশিরের আলপনা এঁকে, নৈশব্দের পতন আছে মায়াজালে জড়িয়ে, ঝি ঝি পোকার সুরেলা ডাক আছে রাতের আয়োজনকে গভীরতার দিকে টেনে নিয়ে যেতে। আর কি চাই আমার হেমন্তের শিশিরঢাকা একটি চাঁদনী রাতকে উপভোগ করার জন্য? তার উপর এসবের সাথে আছে আমার চলার ছন্দ। হেঁটে চলেছি আমি অদৃশ্য শূণ্যতার পাণে, নির্জন সময়ের বুকে পদরেখা এঁকে। আমার শব্দহীন চলার ছন্দ এসব কিছুর সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার করছে মহাকালের বুকে। আমি কি থামতে পারি এক মুহূর্তের জন্য?
এরই মধ্যে আবার সেই ডাক। আমি চলার ছন্দে বিরতি দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কে তুমি? অমন করে ডাকছো আমায়? কাছে এসো। সাথী করতে দাও তোমায়।
উত্তর এলো, আমি তো তোমার সাথী হয়েই আছি। তুমি বুঝতে পারছনা তাই তোমায় ডাকছি। অমন আনমনা হয়ে হাঁটছো কেন তুমি ?
তুমি বুঝি তাই দেখলে ? আনমনা তো নই আমি? আমি তো আরাধনা করছি তোমাদের।
আমার উত্তর শেষ হতে না হতেই সে আবার প্রশ্ন করে।
আমার আরাধনা করছ অথচ আমাকেই চিনতে পারছনা এ কেমন করে হয় ?
তোমাকে চিনতে পারছি না মানে? ভালো করেই চিনি। তুমি হচ্ছ এই চাঁদ, এই দুর্বা ঘাস, পড়ন্ত শিশির অথবা মায়াবী জোছনা। অথবা সবকিছু মিলিয়ে উদার এই প্রকৃতি।
তুমি এভাবে বলছ কারণ আজ তুমি নিজকে হারিয়ে ফেলেছ। তাই চিনতে পারছ না নিজকে। তুমি ফিরে গেছ তোমার শৈশবে। তোমার শৈশবের খেলার সাথীরা তোমার চেতনার অবরুদ্ধ দ্বার খোলে আজ বেরিয়ে এসেছে, মুখর করে তুলেছে তোমার চারপাশকে। তুমি নিজকে হারিয়ে ফেলেছ তোমার সেই মধুর দিনগুলোতে। তাই চিনতে পাচ্ছ না নিজকে।
যদি চিনতে না-ই পারি তাহলে ক্ষতি কি বল ? যদি ফিরে পাই নিজকে শৈশবের স্বর্ণালী দিনগুলোতে?
উত্তর আসে, কিন্তু যেখান থেকে ফিরে গেছ সেখানটার কথা একবার ভাব। সেখানেই তো রয়েছে এই চাঁদ-জ্যোৎস্নার খেলা, শিশিরঢাকা প্রকৃতি, নৈশব্দের ছন্দ-তাল আর আমি।
তুমি ? আচ্ছা বলতো তুমি কে ?
আমি কে যদি তুমি চিনতে না পার তাহলে কি হবে এত কিছুর মাঝে নিজের শৈশবকে খোঁজে ফিরে ?
আমি তো আমার শৈশবকে খোঁজে পেয়েছি। আমার শৈশব মিশে আছে এই চাঁদ-জ্যোৎস্না-কুয়াশার সাথে একাকার হয়ে এই মাটি আর দুর্বা ঘাসে।
উত্তর দিলাম আমি। সাথে সাথে সে উত্তর দিলো।
সেখানেও আছি আমি। এবার চিনে নাও আমাকে।
এবার আমি একটু বিরক্ত হলাম। আমার অনুভবের সুন্দর মুহূর্তগুলোকে এভাবে বাধাগ্রস্ত করায়। প্রকাশও করে ফেললাম। বললাম
তুমি যেই হও। এবার বিদায় হও। আমি এই মুহূর্তে আমার চারপাশকে নিয়ে একা থাকতে চাই।
কিন্তু আমি চলে গেলে যে তোমারও কোন অস্তিত্ব থাকবে না। তখন এই চাঁদ, জ্যোৎস্না, দুর্বাঘাস, শিশির--এরা কেউ তোমাকে আপন করে কাছে ডাকবে না, হারিয়ে যাবে তোমার শৈশবও।
তার মানে ?
প্রশ্ন করি আমি। উত্তর আসে।
তার মানে বুঝলে না? সত্যি তুমি আজ তোমার মধ্যে নেই। আমি হলাম তোমার ছায়া। তুমি থাকলে তোমার ছায়া তো থাকবেই। কায়া থেকে ছায়াকে কি কখনও সরানো যায়? যায় না। যায় না বলেই তুমি যেখানে যাও, যেখানে নিজকে খোঁজে পাও, আমিও সেখানে থাকি।
এবার আমার মোহভগ্ন ঘটে। আমি চলার ছন্দে বিরতি দেই। চারপাশে ভালো করে দৃষ্টি বুলাই। না, কোথাও কেউ নেই। আছে কেবল আমার চেয়েও দীর্ঘ একটি ছায়া, হাঁটছে আমার সাথে সাথে। যাদেরকে ভালবেসে এই নির্জন রাস্তায় বেরিয়ে এসেছি আমি সেও ভালবাসে তাদেরকে। আমার জীবনের যে খেরোখাতায় জড়িয়ে আছে এই মুহূর্তের প্রকৃতি সেই খেরোখাতার এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ সে। আমার একাকিত্ব যেখানে মুখরতার আবডালে ঢেকে যায় সেখানেও সে থাকে, আমার বেদনার মুহূর্তগুলো যেখানে খুশীর জোয়ারে ভাসতে থাকে সেখানেও সে থাকে।
আর এগোই না আমি। বসে পড়ি ভেজা ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে। ঘাসের উপর ডান হাতের আলতো ষ্পর্শ বুলাই। ভিজে যায় আমার হাত। আমি সেই হাত আমার নাকে-মুখে বুলাই। দু’গালে ষ্পর্শ নেই শিশিরের। শূণ্যে দু’হাত বাড়িয়ে জ্যোৎস্নার আলোর পাণে। মুঠো মুঠো আলো নিয়ে মাখতে থাকি আমার সর্বাঙ্গে। তারপর হাত বাড়াই সাদা ধবধবে মাটির দিকে। রাস্তার মাঝখানের সাদা ধবধবে মাটি নিয়ে মাখতে থাকি সারা গায়ে। আমার শরীরে পরতে পরতে জমে উঠে শিশির, আলো আর মাটির গন্ধ। আমি আন্দোলিত হই ভালবাসার নতুন অনুভবে। এই ভালবাসা আমার শৈশবকে ঘিরে আমার মাটির টানে। আমি টের পাই আমার ভিতর ক্রমেই জেগে উঠছে সেই খেলাঘরে ফিরে যাবার প্রবল আকর্ষণ। আমি নিজকে সঁপে দেই সেখানে। হাত বাড়িয়ে কাছে, আরও কাছে টেনে নেই নুপুর পরা দিনগুলোকে। কিন্তু এই চাঁদ-জ্যোৎস্নার খেলাঘরের মোহময়তা আমি কাটিয়ে উঠতে পারিনা। অবশেষে যখন আমার তন্ময়তা কেটে যায় তখন চাঁদ তার নিয়মমাফিক কর্তব্যের সমাপ্তি টানতে ব্যস্ত। জ্যোৎস্নার আলো তার শেষ রেশটুকু নিয়ে তখনও জেগে আছে শুধু আমার অপেক্ষায়। ফিরে তাকাই নিজের দিকে। আমি হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছি দুর্বা ঘাসের উপর। ভেজা শিশিরের আদুরে ছোঁয়ায় ভিজে গেছে আমার সর্বাঙ্গ। উঠে বসে হাঁটতে লাগলাম আমি। আমার সঙ্গে হাঁটছে আমার একমাত্র সঙ্গী ছায়া।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন