|
দ্য ইলিউশনিস্ট
|
|
ছোটগল্পঃ হেটে আসা পথের প্রতিচ্ছবি
10 October 2014, Friday
খালি রাস্তা। কোন কাকের সাদা ইয়ে পড়লে সেই শব্দও কানে আসার মতো শুনশান নীরবতা। নির্ঝরের হাটার শব্দ হচ্ছে শুধু। যেদিকে মন চায় সেদিকে হাটছে সে। খালি পা এবং গায়ে পকেটহীন হলুদ পাঞ্জাবি থাকতে পারতো। কিন্তু তা অসম্ভব। এটা বাস্তবতা, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস নয়।
এতক্ষণ ধরে হেটে একটা মানুষের দেখাও পেল না। তার সিক্সত সেন্স বলছে একটু পরেই নীল শাড়ি পরা একটি মেয়ে হেটে যাবে তার সামনে দিয়ে। মেয়েটির সাথে কিভাবে কথা বলা শুরু করবে, কিভাবে কথাবার্তা চালিয়ে নিয়ে যাবে তা ঠিকঠাক করতে করতে হাটছে।
মেয়েটার সাথে এক রিকশায় চড়ে তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবে- এমন সব কল্পনা করতে গিয়ে একধরণের আনন্দ অনুভব করলো নির্ঝর। সেই আনন্দের সাথে মিশে ছিল কিছুটা শিহরণও।
হাটতে হাটতে বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেল। অথচ কোন মেয়ের দেখা নেই। 'সিক্সথ সেন্সের গুষ্টি কিলাই' বলতে যাবে এমন সময় সে দেখল দূর থেকে একটা রিকশা আসছে। রিকশায় নীল শাড়ি পরা কোন তরুণী থাকবে এই আশা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো, রিকশাটার কাছে আসার অপেক্ষায়।
এক সময় চলেও গেল তার পাশ দিয়ে। খালি রিকশা।
সে আবার হাটা শুরু করল। এভাবে ফজর পর্যন্ত হাটতে থাকলেও কোন সমস্যা নেই। কোথাও কেউ অপেক্ষা করে নেই তার জন্য। কিন্তু এখন ম্যাচে ফেরা দরকার। হাটতে হাটতে সে ক্লান্ত।
চারপাশে গা ছমছম করা জোছনা। নির্ঝর পেছন ফিরে তাকাল চাঁদের দিকে। রুটির মতো চাঁদটাকে পানির মতোই সাধারণ লাগছে। সে বুঝে উঠতে পারল না কবি সাহিত্যিকরা কেন এত কথা লিখে গেছেন এই পানির মত সাধারণ চাঁদ নিয়ে। কেনই বা চাঁদের সাথে তুলনা করে গেলেন তাদের প্রেমিকার।
নির্ঝরের মনে হল এই সাধারণ বৃত্তের সাথে তুলনা করতেই হলে একটা রুটির সাথে করা যেতে পারে। এর বেশি কিছু না।
এই ভাবনা থেকে তার মনে প্রশ্ন জাগল,
আসলেই কি তাই? নাকি সমস্যাটা তার দৃষ্টিভঙ্গিতে? নাকি তার জীবনই এখনো সাদাকালো রয়ে গেল?
নির্ঝর অবশ্য জানে, জীবনকে সে যেভাবে পেতে চেয়েছিল ঠিক তার বিপরীত সব উপকরণ দিয়ে তার জীবন সাজানো হয়ে গিয়েছিল সে বুঝে উঠার আগেই। তার ধারণা এখন আর সময় নেই। সে অবশ্য সময় থাকতেই জানতো, জীবনকে যে যেভাবে পেতে চায় তার থেকে সেভাবে গড়ে নিতে হয়। কেউ কারো অবস্থান গড়ে দিতে আসেনি পৃথিবীতে। কিন্তু নির্ঝর সবকিছু বোঝার পরও, জানার পরও পারেনি। তাকে জীবনের স্রোতে মিলিয়ে যাওয়া এক ব্যর্থ পথিক বলা যেতে পারে।
বাসায় ফিরে যাওয়া উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করলো সে। এমন সময় প্রকৃতি শুরু করলো বৃষ্টি। ভাবসাব এমন যেন প্রকৃতি তার সব রূপ ঢেলে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নির্ঝর হাটার গতি কমিয়ে দিল। থমকে দাঁড়াল হঠাৎ। চোখ উচু করে আকাশ দেখার চেষ্টা। সহস্র তারায় ভরা আলো আধারে মিশ্রিত আকাশ। তার মনে হচ্ছে, এখন মুগ্ধ হওয়া দরকার। কিন্তু নিজের মাঝে মুগ্ধতার রেশমাত্র খুঁজে পেল না।
আবার হাটা শুরু। আফসোস লাগছে। তার মতো এইসব কিছুর স্পর্শের বাইরে বাস করা একজন অঅপদার্থের জায়গাই কোন কবি কিংবা নব্য ছেঁকা খাওয়া পাবলিকের থাকা দরকার ছিল। লেখক হলে এই মুহূর্ত এবং পরিবেশ অনুভব করে তার অনুভূতি থেকে লেখায় দিতে পারতো স্বর্গীয় রূপ। আর ছেঁকা খাওয়া আরেক অপদার্থ হলে উপভোগ করতে পারতো নির্জনতা কিংবা মনের কোণে লুকে থাকা যত বিষণ্ণতা।
বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। তীব্র হচ্ছে জোছনার প্রলেপ। বাতাস হু হু করে বাজিয়ে যাচ্ছে করুণ বাঁশীর সুর, যা কিনা হৃদয়ে কি যেন হারিয়ে ফেলার হাহাকারে ভরিয়ে দেয়।
কি মুশকিল! প্রকৃতি সাহেব কি জোর করে মুগ্ধ করার চেষ্টা করছেন নাকি? এমন বেদনাময় পরিবেশে এক বিন্দু বিষন্নতাও অনুভব করলো না সে। বরং কি জানি ভেবে শুয়ে পড়লো, চোখ বন্ধ করলো কোন সুখের স্মৃতি রোমন্থন করতে। মহা আশ্চর্যের বিষয়, কোন সুখের স্মৃতিও মনে পড়ছে না। এমন সময় খুব অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটে গেল। তার বন্ধ করা চোখের সামনে এমন কিছু ভেসে উঠলো যা ভিজিয়ে দিল তার শত বছর ধরে অনুভূতিহীন কারাগারে বন্দী থাকা চোখ।
কল্পনার দৃশ্যটি অনেকটা এমন- 'ক্লাসের সবাই আড্ডা দিচ্ছে। শুধুমাত্র একটি ছেলে ক্লাসের এক কোণে বসে নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে।'
খুব সাধারণ একটা দৃশ্য। তবে তার চোখ ভিজে গেল কেন?
ছবিটা এতই স্পষ্ট ছিল যে সেই মুহূর্তে ছেলেটির বিষাদময় অনুভূতি তীরের মতো তার হৃদয় ছেদ করে বহুকাল আগের চিরচেনা এক অনুভূতি হয়ে ছড়িয়ে পড়লো অনুভবে।
হঠাৎ নির্ঝরের বুকের মধ্যে মুচড়ে উঠলো। সেই দৃশ্যকে তার অপ্রকাশিত অনুভূতির আর্তনাদ মনে করতেই, কাঁদতে ইচ্ছা করলো চিৎকার করে।
ঝপঝপ করে বৃষ্টি পড়ছে। জোছনা মাখা বৃষ্টির প্রতিটি ফোটা। নির্ঝর উঠার শক্তিটুকুও খুঁজে পেল না। তার চোখের কোণ থেকে টপটপ করে ফোটা ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
আকাশ ফর্শা হতে শুরু করেছে। পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। এভাবেই পৃথিবীতে আরো একবার ভোর হয়। আর সে থেকে যায় সেই চার দেয়ালে বন্দী থাকা সুস্থ মস্তিষ্কের পাগলদের একজন যারা ভাবে, পৃথিবীটা আসলে খুব সুন্দর একটা জায়গা।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন