|
ডি মুন
|
|
জটিল জলে আবর্তন
24 September 2014, Wednesday
ক
লোকটির বাস্তবে কোনো বৈচিত্র্য নেই। স্যাঁতস্যাঁতে একঘেয়ে তার জীবনযাপন। নাসের আলীর ধানকাটা কাঁচিটার মতো প্রতিদিন একই কাজে ব্যবহার করা হয় লোকটাকে। ন’টা-পাঁচটা। তাতে আনন্দ কিছু নেই বরং জীবনের ধার ক্ষয়ে যাবার ক্লান্তি আছে।
জীবনটা ক্রমশ ভোঁতা এবং অকেজো হয়ে যায়।
শুরুটা তো লিখলাম। কিন্তু তারপর কি লিখব? নাহ, হবে না । আমাকে দিয়ে আর যাই হোক গল্প হবে না। আমি বুঝে গেছি। শব্দক্ষমতা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি। উফ্ যন্ত্রণা হচ্ছে ভীষণ। মনে হচ্ছে সামনের শেলফ থেকে অফিসের ফাইলগুলো পাজা করে ধরে জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলি। রাগে রি রি করে জ্বলছে আমার শরীর। হাতের কাছে এসেও যখন উপযুক্ত শব্দেরা ধরা না দিয়ে শুধু হাতছানি দেয়, তখন এমনই হয় আমার। এই যেমন এখন হচ্ছে। বুকের মধ্যে দাপাদাপি চলছে ভীষণ । মনে হচ্ছে সবকিছু এলোমেলো করে ফেলি। চীৎকার করি; রেগে উঠি; লাথি মেরে গুড়ো করে দেই ডেস্কে জমে থাকা কর্পোরেট ব্যস্ততা। তারপর পরিচিত শব্দজট এড়িয়ে নতুন শব্দঘরের সন্ধানে ঘুরে ফিরি। কিন্তু নাহ, হচ্ছে না কিছুই। অবশেষে সেই পুরোনো ভাগাড়ে যেয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে হয়। উফ, আর পারছি না।
যাই, একটু দম নিয়ে আসি। বিষাক্ত নিকোটিনে বিলিয়ে দিয়ে আসি অশান্ত কিছু সময়।
খ
এবার মাথাটা একটু হালকা লাগছে। সিদ্ধান্তে এসেছি - গল্প না হলে না হবে। আর একটা গল্প লিখতে না পারলে কেউ তো আমার ফাঁসি দিচ্ছে না। তাছাড়া আমি লেখালেখি করে সমাজ উদ্ধার করার মহান ব্রত নিয়ে বসিনি। আমি লেখক নই। আমি নাগরিক ব্যক্তিজীবনে স্বচ্ছন্দ। সুতরাং দায় নেই। অধরা শব্দগুচ্ছ অধরাই থাক। আমি নির্বিকার।
ভাবছি, একদম নির্ভার হয়ে প্রথম থেকে লেখা শুরু করবো আবার। প্রথম লাইনটা একটু বদলাতেও মন চাইছে। কিন্তু একি! আমার কলম যে আর চলতে চাইছে না। নিদারুণ অলসতায় ‘হাই’ উঠছে বার বার। তন্দ্রা নাকি ঘুম?
এমনটা খুব দেখেছি। যখনই কিছু একটা দরকারি কাজ করতে যাব অমনি চোখ জুড়ে নেমে আসবে রাজ্যের ক্লান্তি। ঘুমঘুম নির্ঘুমতায় ঝিমিয়ে যেতে যাইবে আমার স্নায়ুকোষ। অথচ এমনও হয়েছে যে রাতের পর রাত আমি নির্ঘুম কাটিয়েছি এবং এখনো কাটাই। বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই আমার রাতগুলো বেশিরভাগ সময়ই কুমারী থেকে যায়। কিন্তু এমন তন্দ্রাবিলাস আলস্য নিয়ে আগন্তক শব্দজলে অবগাহন করা যায় না। তাই লিখতে মন চাইছে না আজ। এক কাজ করি, চোখে মুখে একটু পানি দিয়ে আসি। দেখি, তন্দ্রাভাব কাটে কিনা।
গ
প্রায় মাসখানেক বিরতি নিয়ে আজ আবার কলম ধরলাম। কিন্তু কি লিখব? কতটুকু লেখা যায়?
যেটুকু লেখা যাবে না; যেটুকু শুধু মনের মধ্যে তোলপাড়; যেটুকু বোঝানোর মতো শব্দ নেই অভিধানে; সেটুকুর কি হবে? অনবরত একঘেয়ে শব্দসম্ভার দিয়ে কতটুকু খোলা যায় মানবশৃংখল? অপরিচিত অনুভূতির ভেতর পরিচিত শব্দখেলা আর কতক্ষণ ভালোলাগে? এ বিকারগ্রস্থতা রোধে আসবেনা কি কোনো অত্যাশ্চর্য শব্দশরীর?
যাদুময় শব্দগুচ্ছ চাইছি কি আমি? হতে পারে। কেননা, ‘স্যাঁতস্যাঁতে একঘেয়ে তার জীবনযাপন।’
স্যাঁতস্যাঁতে? মানে বর্ষাজলে ভিজে অগোচরে বেড়ে ওঠা শৈবালগুলোর শরীর যেমনটা হয়, কিংবা ভাঙ্গা ইটের গায়ে সবুজ মতন জমে থাকা ভেজা মস। পিচ্ছিল। ধরতে যেয়ে গা ঘিনঘিন করা অস্বস্থি। অথবা কল্পনায় আমার মেটে-বাড়িটার উঠোনজুড়ে আকাশের অবিরাম কান্নায় জমে যাওয়া পিছলে আদিখ্যেতা।
স্যাঁতস্যাঁতে- শব্দটার ঠিক কী মানে? আমার অনুভূতি বোঝাতে এই শব্দটা কি পুরোপুরি সক্ষম? আমি কি কোনো নতুন শব্দপথে চলতে চাইছি? ভাসতে চাইছি জটিল শব্দজলে?
ঘ
নদীর কাছে গিয়েছিলাম কিছুদিন আগে। সন্ধ্যা পেরিয়ে যখন রাত নেমেছিলো নদীতটে, আমি আর আমার এক বন্ধু বসেছিলাম রূপালীবসনা চাঁদের আলোয়। মেঘেদের দূরন্তপনায় মাঝে মাঝে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল সে আকাঙ্ক্ষিত শশী।
আমার সহযাত্রীর স্বরতন্ত্রী শব্দ নির্মান শুরু করতেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘চুপ। এখন মৌনতায় মুখরিত হবার সময়। শব্দহীন হও আজ। জটিল শব্দজাল খুজে পাক চিন্তাসমুদ্রের তল।’
অপ্রস্তুত হয়ে থেমে গিয়েছিলো সে। আর আমি তখন নিজেকে ডুবিয়েছিলাম জল-বায়ু-তরঙ্গের মিথস্ক্রিয়ায়।
মেঘেদের ফাঁক গলে চাদের রূপালী কিংবা সোনালি আলোয় জ্বলজ্বল করছিলো নদীতরঙ্গ। দু একটা মাছ ধরা নৌকা। দু’একজন নদীপাড়ে জাল নিয়ে জীবিকায় জড়িয়ে ফেলছিল নিজেকে। আমি উঠে পাড় ঘেঁষে হাঁটতে শুরু করলাম, বাতাসের শরীর কেটে এদিক ওদিক।
আমার মাথায় তখন শেয়ারবাজার কিংবা খবরের কাগজ ছিলো না, আমি তখন সচিবালয়ের পেটমোটা কর্মকর্তার সাথে আসন্ন আলাপের কথা ভাবছিলাম না; কারণ আমার চোখে তখন ঢুকে গিয়েছিল একটা অদ্ভুত তটিনী। আমি নেশাচ্ছন্ন ছিলাম রূপালী ঢেউয়ের উপরে ভাসমান সহজ জীবনজালে।
জেলেদের নৌকাজীবন? হয়তো। কিন্তু নাগরিক আমরা তো কোনদিনও অনগ্রসর প্রকৃতিঘনিষ্ঠ জীবন কামনা করি না। করি কি? কিংবা জেলেরা কি সারাজীবন জলজ থাকতে চায়?
তবুও জানি, ন’টা-পাঁচটা জীবনে কোনো বৈচিত্র্য নেই। স্যাঁতস্যাঁতে একঘেয়ে জীবন যাপন। মেকি। বানানো। ঠিক অকৃত্রিম নয় প্রকৃতির মতো।
এসব কি লিখছি আজ। অসুস্থ চিন্তাজট নাকি একান্ত কিছু সময়ে হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা দার্শনিক বোধ? কী লাভ...? সেই তো প্রচলিত নিয়মে সমর্পিত মানবসত্ত্বা। সাময়িক দার্শনিক বোধ যতই তীব্র হোক, শেষমেশ ক্ষুধা আর যৌনতার কাছে নতি স্বীকার করে পথচলা।
জীবনের ধার ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছে 'সেলফ মার্কেটিং'- এর এই আশ্চর্য পৃথিবীতে। অথচ ‘সেলফ’ তলিয়ে যাচ্ছে অতলে। খবর আছে কি?
ঙ
ও পথিক খবর আছে কি, নাসের আলীর ধানকাটা কাঁচিটার ধার ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছে। বালির বড়ো অভাব এখন। প্রতিদিন একটু একটু করে অকেজো ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে ব্যক্তিজীবন।
ঠিকঠাক নিরাপদ জীবনে আনন্দ কিছু নেই বরং জীবনের ধার ক্ষয়ে যাবার ক্লান্তি আছে। জীবনটা ভোঁতা এবং অকেজো হয়ে যায়। কার জীবন?
বৈচিত্র্যহীন লোকটি কে? ... আপনি? আমি? নাকি অন্য কেউ?
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন