|
অপু তানভীর
|
|
গল্প নাম্বার তিনঃ বিষন্ন বিকেলের মেয়ে
23 September 2014, Tuesday
খাঁদটা বেশ গভীর । তবে একদম খাড়া না । পৃথিশা এক দৃষ্টিতে খাঁদটার দিকে তাকিয়ে আছে । মাঝে মাঝে ও এমনটা করে । গভীর এই খাঁদগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে । নিচে কি যেন খোজে ! কি খোজে তা ও নিজেই জানে না !
-আপনি কি লাফ দেওয়ার কথা ভাবছেন ?
পৃথিশা বেশ চমকালো । খাদের এই দিকটা সাধারনত কেউ আসে না । পৃথিশা একা একাই ঘুড়ে বেড়ায় । আজও একা একা ঘুরছিল । তারপর এই খাঁদটার কাছে এসে তাকিয়ে ছিল নিচে ।
এমন সময় লোকটা এসে কথাটা বলল ।
পৃথিশা একটু ভয়ও পেল । কে এই লোকটা ? আগে তো কখনও দেখি নি ।
লোকটা না বলে ছেলেটা বলতে ভাল হয় । ২৫/২৬ এর বেশি বয়স হবে বলে মনে হয় না । ছেলেটা আবার বলল
-আপনি কি নিচে লাফিয়ে পড়ার কথা চিন্তা করছেন ?
পৃথিশা সত্যিই নিচে লাফিয়ে পড়ার কথা চিন্তা করছিল । অবশ্য প্রতিদিনই করে । কিন্তু শেষ মুহুর্তে এসে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলে । তবে ওর বিশ্বাস একদিন ও আর সিদ্ধান্তটা বদলাবে না । ঠিকই লাফিয়ে পড়বে নিচে ।
-আপনার কেন মনে হল যে আমি নিচে লাফিয়ে পড়বো ?
ছেলেটা হাসল । ছেলেটার হাসি সুন্দর । কিন্তু চোখ দুটো বড় তীক্ষ । এই চোখের সামনে মিথ্যা বলাটা বেশ কষ্টের ।
-না এমনি বললাম আর কি ! আপনি যেভাবে নিচে তাকিয়ে ছিলেন তাতে যে কারো এই কথাই মনে হবে ।
পৃথিশা এবার একটু বিরক্ত হল । কিন্তু কিছু বলল না । ছেলেটা আবার বলল
-তবে একটা কথা । এখান থেকে লাফ দিলে মরার সম্ভাবনা কিন্তু অনেক কম ।
পৃথিশা এবারও কোন কথা না বলে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকলো । খানিকটা বোঝার চেষ্টা করল যে ছেলেটা কি ওর সাথে ফান করছে কিনা !
-দেখুন যদি আপনি এখান থেকে লাফিয়ে পড়েন তাহলে কিন্তু গড়িয়ে পড়বেন । কারন খাঁদ টা কিন্তু খুব বেশি খাড়া না । ঢালু । বড় জোড় আপনার হাত পা ভাঙ্গতে পারে ।
পৃথিশা নিজেও জানে এটা । ছেলেটা সত্যি কথাই বলছে । খাঁদ টা অতটা খাড়া না ।
-তবে আপনি চাইলে আমি একটা খাড়া আর গভীর খাদের সন্ধান দিতে পারি । যেখান থেকে লাফ দিলে একেবারে সোজাসুজি উপরে যাবেন । দিবো সন্ধান ?
পৃথিশার এবার মনে হল যে ছেলেটা ফান করছে ।
-আপনি কি আমার সাথে ফান করছেন ?
-আশ্চর্য আমি ফান করবো কেন ? আমি তো আপনার উপকার করছি ।
-আমি কি বলেছি উপকার করতে ? আমার চাই না আপনার উপকার ।
ছেলেটা হাসল । বলল
-পৃথিশা, জীবনের সব কিছু কি আপনার চাওয়ার মত হবে ? আপনি যা চান তাই যদি হত তাহলে আপনার জীবনটা এমন হত ? তাহলে কি আপনি এভাবে জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াতেন ?
পৃথিশা ছোটখাটো ধাক্কার মত খেল । এই দুই লাইনই বলে দিচ্ছে ছেলেটা ওকে চেনে । ওর সম্মন্ধে জানে । এমন কি ওর নাম টাও জানে । কিন্তু পৃথিশা তো ছেলেটাকে চিনতে পারছে না ।
-আপনি আমার নাম কিভাবে জানেন ?
ছেলেটা আবার হাসল । বলল
-ঐ সামনে একটা গাছের গুড়ির আছে । আসুন ওখানে বসে কথা বলি । আর ভয় নেই আমি আপনার উপকার করতে এসেছি ক্ষতি করতে না ।
সত্যি সামনে একটা গাছের গুড়ির মত আছে । পৃথিশা ওখানটাতে গিয়ে বসল । ছেলেটা ওর পিছন পিছন গিয়ে বসল ।
-এবার বলুন আমার নাম কিভাবে জানেন ?
ছেলেটা বলল
-অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নের জবাবের চেয়ে কিছু প্রয়োজনীয় কথা শুনুন ।
-যেমন ?
-আচ্ছা আপনি যে প্রায়ই এখানে আসেন, সুইসাইড করার জন্য, কেন আসেন ?
-আপনি যখন প্রশ্নটা জানেন আমার মনে হয় উত্তরটাও আপনার জানা ।
-হুম জানি । তবুও আপনার মুখে শুনতে চাই । একজন মানুষের জন্য কি আপনার আশেপাশের মানুষ গুলোকে কষ্ট দেওয়া কি ঠিক ? আপনি যদি এখান লাফ মারেন তাহলে তাদের কি হবে একবার ভেবেছেন ? আপনার বাবার কি হবে ?
বাবার কথা উঠতেই পৃথিশার মুখটা কেমন যেন বদলে উঠলো । বিষন্নতার ভাব থেকে সেখানে কেমন একটা রাগ ফুটে উঠল ।
-আপনি কি জানেন বা জানেন আমি জানি না কিন্তু আমার এই অবস্থার জন্য আমার বাবাই দায়ী । কেবল উনি দায়ী ।
পৃথিশার খুব রাগ উঠে যায় । ও আবার বলল
-আপনার সাথে যথেষ্ট কথা হয়ে । আমি এখন উঠবো । আপনার সাথে কথা বলতে আর ভাল লাগছে না ।
-আরে আরে রাগছেন কেন ? আপনার রাগ হয় এমন কোন কিছুতো আমি করছি না । আমি কেবল আপনার সাথে কথা বলছি । আপনি আপনার কথা গুলো শেয়ার করুন দেখবেন ভাল লাগবে । সত্যি ভাল লাগবে । এমনও হতে পারে আপনার সব কষ্ট গুলো আজ শেষ হয়ে যেতে পারে । যদি আপনি চান !
পৃথিশা ঠিক বুঝতে পারল না ছেলেটা কি বলতে চাইছে । তবে উঠল না । ছেলেটা বলল
-মৃত্যু খুব সহজ একটা সমাধান । সব কিছু থেকে পালিয়ে যাওয়া । কিন্তু একবারও কি ভেবেছেন যারা আপনাকে ভালবাসে তাদের কি হবে ? আপনার এই চলে যাওয়া তারা কিভাবে নিবে । আপনার বাবা কিভাবে নিবে ?
পৃথিশা বলল
-আপনি আমার বাবাকে কিভাবে চিনেন ?
ছেলেটা আবার হাসল । বলল
-আমি অনেক কিছু জানি ।
-ওয়েল, তাহলে নিশ্চই এটাও জানেন যে আজ আমার এই অবস্থার জন্য আমার বাবা দায়ী ।
-কথাটা ঠিক বললেন না আপনি ।
-ঠিক বলি নি ?
পৃথিশা কেন যেন রেগে ওঠে ।
-আপনি আমার থেকে বেশি জানেন ? বাবা যদি জোর করে ঐ জানোয়ারটার সাথে আমার বিয়ে না দিত তাহলে আজ এমনটা কোন দিন হত না ।
ছেলেটা বলল
-আপনার কি মনে হয় যে প্রিতমের সাথে আপনার বিয়ে হলে আপনি খুব সুখি হতেন ? মিস পৃথিশা সুখ বড় দুর্লভ জিনিস । সবাই তার পিছনে দৌড়ায় কিন্তু নাগাল পায় না ।
পৃথিশা কোন কথা বলল না । আরো একবার অবাক হল । ছেলেটা প্রিতমের কথাও জানে ! কিন্তু কিভাবে ? বাবার পরিচিত কেউ ? এতো কিছু কিভাবে জানে ?
ছেলেটার কথা ভুল বলা যাচ্ছে না । আসলেই ওর কপালে বোধহয় সুখ নামক জিনিসটা নেই । ছেলেটা হঠাৎ বলল
-প্রিতম কিন্তু কিছুই করতো না যখন আপনার বিয়ে হয় । কেবল কবিতা লিখতো । এমন একটা ভ্যাগাবন্ডের সাথে কোন বাবাই তার মেয়ে বিয়ে দেবে না । আপনি আপনার বাবার জায়গায় হলে ঠিক একই কাজটা করতেন ।
-তাইতো একটা জানোয়ারের হাতে আমাকে তুলে দিয়েছিল । কোর্ট টাই পরা জানোয়ার ।
-মানুষের বাইরে থেকে কি ভেতরের দিকটা বোঝা যায় ? মোমেন সব দিক দিয়ে আপনার যোগ্য ছিল । শিক্ষিত । ভাল জব । ভাল স্যালারী । ভাল বাড়ি । এমন ছেলে কে হাত ছাড়া করবে বলুন ?
ছেলেটা কিছুক্ষন চুপ করে থাকল । এবার পৃথিশা আর অবাক হল না । প্রিতমের কথা যখন জানে মোমেনের কথাও জানবে, এমন ধারনা ও করেছিল । ছেলেটা বলল
-কিন্তু মোমেন যে এমন করবে সেটা আপনার বাবা বুঝতে পারেন নি । পারলে কখনই সে এমন কাজ কখনই করতো না । আপনি কি জানা আপনার বাবা কি আপনার এই অবস্থার জন্য সব সময় নিজেকে দোষারোপ করেন ! কি পরিমান কষ্ট তিনি পান নিজে নিজে !
পৃথিশা এবারও কোন কথা বলল না । ভাবতে লাগল এই ছেলেটা এতো কিছু জানে কিভাবে ?
-পৃথিশা বাবা মা ছেলেমেয়েদের সব ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দেন নির্দ্বিধায় । আপনার কি উচিত্ না আপনার বাবার এই সামান্য ভুল টুকা ক্ষমা করে দেওয়া । আপনি তাকে এমন একটা ভুলের জন্য তার উপর রেগে আছেন যেটা সে ইচ্ছা করে নি । যার জন্য তাকে কিছুতেই দোষারোপ করা যাবে না ।
পৃথিশা ছেলেটার দিকে তাকিয়েই থাকল । ছেলেটার প্রতিটা কথাই ঠিক । কি চমৎকার যুক্তি দিয়ে ওকে বুঝিয়ে দিল যে ও যা করছে ঠিক করছে না ।
-চলুন যাওয়া যাক । সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে ।
বাড়ির কাছাকাছি আসতে ছেলেটা বলল
-আমার কথা গুলো আজ একটু ভেবে দেখবেন । যদি মনে হয় আমি ভুল বলেছি তাহলে কালকে আমি ঐ খাড়া খাঁদ টার কাছে আমি আপনাকে নিয়ে যাবো । যদি চান পেছন থেকে ধাক্কাও দিতে পারি ।
ছেলেটা হাসল ।
-আজ যাই ?
এমন ভাবে যাই বলল যেন অনুমুতি না দিলে যাবে না ।
-আপনার নামটা বললেন না !
ছেলেটা আবার হাসল । ছেলেটার হাসি আসলেই সুন্দর ।
-কাল তো দেখা হচ্ছে ! কাল না হয় বলি ।
এই বলে ছেলেটা পেছন ঘুরে হাটা দিল । পৃথিশা চুপচাপ ছেলেটার চলে যাওয়া টা দেখলো ।
প্রতিটি সন্ধ্যার জুবায়ের সাহেব বারান্দায় বসে থাকে মেয়ের অপেক্ষায় । অপেক্ষা করে তার মেয়ে যখন সন্ধ্যা বেলা ফিরে আসবে তার সাথে বসে এক কাপ চা খাবে । কিন্তু এমন টা হয় না । পৃথিশা প্রতিদিন সন্ধ্যার যখন বাসায় আসে বারান্দা দিয়ে সোজা ঘরের ভিতরে চলে যায় ! একটা বারের জন্যও তার দিকে ফিরে তাকায় না । জুবায়ের সাহেব ব্যাথিত চোখ নিয়ে মেয়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে !
মেয়েটা সারা দিন বাসা থেকে বের না হলেও বিকেলের দিকে বের হয় ! একা একা ঘুরে বেড়ায় বন জঙ্গলে । অবশ্য বাইরে থেকে খুব একটা ভয়ের কারন নেই কারন পুরো একল সরকারী । কাটা তার দিয়ে ঘেরা । নির্দিষ্ট দুরুত্বে পাহারাও বসানো আছে যাতে করে সরকারী গাছ কেউ কেটে না নিয়ে যেতে পারে ।
ভয় কেবল জঙ্গলের ভিতরকার বড় বড় খাঁদ গুলো । মেয়ে যদি অন্য কিছু করে বসে । প্রথম প্রথম মেয়ের পেছন একজন গার্ড তিনি পাঠাতেন কিন্তু পৃথিশা এতে খুব বেশি রেগে যেত । পরে বাদ দিয়েছেন ।
জুবায়ের সাহেব প্রতিদিন অপেক্ষা করেন । একটা সময় নিশ্চয় মেয়েটা বুঝতে পারবে । তিনি যে ইচ্ছে করে তার জীবনের সাথে এমন টা করেন নি এই উপলব্ধিটা মেয়ে একদিন নিশ্চই বুঝতে পারবেন ।
আজকেও জুবায়ের সাহেব দেখলেন পৃথিশা তার সামনে দিয়ে হেটে চলে গেল । একটা বারও তার দিকে ফিরে তাকালেন না । তিনি মনে মনে আরেকটা বার দীর্ঘ্যশ্বাস ফেললেন । প্রতিদিন চিন্তা করেন মেয়েকে তিনি বলবেন একটা অনিচ্ছাকৃত ভুল সে করে ফেলেছে । বাবা হিসাবে ক্ষমা কি করে দেওয়া যায় না ? কিন্তু বলতে পারেন না ! আজকেও বলা হল না মনে হয় !
মোমেনের সাথে এক প্রকার জোর করেই তিনি মেয়ের বিয়েটা দিয়েছিলেন । ছেলে হিসাবে মোমেন সব দিক দিয়ে যোগ্য ছিল । যে কোন মেয়ের বাবা এর থেকে আর কি চাওয়া হতে পারে যে তার মেয়েটার একটা সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ হোক । কিন্তু মোমেনের মানষিক অবস্থা যে এমন হবে এটা তিনি ভাবতেই পারেন নি । শেষে বাধ্য হয়ে মেয়েকর নিজের কাছে নিয়ে এসেছেন ।
-বাবা, চা বানাবো তোমার জন্য ?
যুবায়ের সাহবে যেন চমকে উঠলো মেয়ের কথা শুনে ! পৃথিশা তার এখানে এসেছে প্রায় মাস দুয়েক ! এর ভিতরে একবারও সে যুবায়ের সাহবে কে বাবা বলে ডাকে নি । কি এক অভিমানে তার একটা বারও কথা বলে নি । আজকে বলছে !
তিনি কেবল অবাক হয়ে তাকালো মেয়ের দিকে !
পৃথিশা টি-পট থেকে চা ঢেলে সেখানে চিনি মেশাতে লাগলো ! যুবায়ের সাহবে হঠাৎ করেই অনুভব করলেন তার চোখে পানি চলে এসেছে । তিনি তা লুকানোর চেষ্টা করলেন না ।
পৃথিশা চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি আর মন খারাপ কর না কেমন ? জীবন তো এখনও শেষ হয়ে যায় নি !
জুবায়ের সাহবে পৃথিশার হাত ধরে আসলেই কেঁদে উঠলো !
তারপর বলল
-আমি খুবই দুঃখিত মা ! খুব বেশি ! আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস !
এই এতো দিনে পৃথিশা আসলেই উপলব্ধি করতে পারলো সে বাবা উপর অভিমান করে তাকে কতটা কষ্ট দিয়েছে । ছেলেটা আসলে ঠিকই বলেছিল !
-কাকে খুজছেন ?
পৃথিশা তাকিয়ে দেখে গত দিনের সেই ছেলেটা হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে !
-আমি তো ভাবলাম আপনি আর আসবেনই না !
-হুম ! আসতে হল ! আমার কথা কিছুটা হলেও গুরুত্ব দিয়েছেন দেখে ভাল লাগছে !
ছেলেটা কথা বলতে বলতে হাটতে লাগলো । পৃথিশাও ছেলেটার পেছন পেছন হাটতে লাগলো !
-আপনি কি জানে কাল রাতে আপনার বাবা খুব শান্তি করে ঘুমিয়েছে । তার বুকের উপর থেকে একটা বোঝা কাল কমে গেছে !
পৃথিশা একটু অবাক হল ছেলেটার কথা শুনে । ছেলেটা এতো খবর কিভাবে জানে । বলল
-আচ্ছা আপনি কে বলেন তো ? এতো খবর কার কাছ থেকে পেয়েছেন ? আপনার কথা বাবাকে কাল আমি জানতে চেয়েছি ! বাবা আপনাকে চিনে না !
-উনি আমাকে চিনেন না !
-তাহলে ? আপনি কেমন করে জানেন ?
-জানি ! এক ভাবে ! তো এখন কি করবেন ? নিয়ে যাবো আপনাকে খাদের কাছে ?
পৃথিশা হেসে ফেলল !
-কেন ধাক্কা দিবেন বুঝি ?
-চাইলে দিতেও পারি !
-হা হা হা !
-ও হ্যা একটা কথা ! আজকে আপনার বাবা প্রিতমের সাথে দেখা করতে গেছে ! জানেন তো ?
এই খবর টা পৃথিসা কে একটু অবাক করলো !
-আপনি কিভাবে জানেন ?
-বললাম না ! আমি জানি !
ছেলেটার পেছন পেছন হাটতে সত্যি সত্যি একটা বড় খাঁদের কাছে চলে এল দুজন !
এই হল সেই খাঁদ !
পৃথিশা একটু দেখার চেষ্টা করলো । আসলেই বেশ বড় খাঁদ এখান থেকে পড়লে আর রক্ষা নেই !
-আচ্ছা এখানে থেকে লাফ দিয়ে কেউ আত্মহত্যা করেছে ? জানেন কিছু ?
পেছনে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই । একটু আগেও ছিল । বলা চলে এই ৩০ সেকেন্ড আগেও । তাহলে ?
কোথায় গেল ?
ছেলেটার নামও জানে না যে নাম ধরে ডাকবে ! বুকের ভেতর একটু যেন শিরশিরে ভয় ধুকে গেল পৃথিশার !
-আফা !
-কে ?
-আফা আমি !
পৃথিশা তাকিয়ে দেখে ওর ওদের রেঞ্জে কাজ করা একজন পাহারাদার !
-আফা এই জায়গাটা ভালা না ! আপনে এই খানে কি করেন ?
-না কিছু না !
মুখের ভয়ের ভাবটা এখনও পুরোপুরি কাটে নি । পাহারাদারকে বলল
-তুমি কি এখান থেকে কাউকে যেতে দেখেছো ?
-না আফা ! কেউ যায় নাই ! অনেক্ষান ধইরা দেখতাছি আপনে একা একা হাটতাছেন । এই খাঁদ টা ভালা না ! অনেক দিন আগে এই খানে থেইকা একটা সুন্দর মতন পোলা ফাল দিয়া মরছিল ! তারপর থেইকা এইখানে কেউ আসে না ! আপেও থাইকেন না !
পৃথিশার মাথায় কিছু আসছিল না ! এই মাত্র এই খানে ছিল । আর এখন নেই । কোথায় গেল তাহলে । খানিকটা অনিশ্চিয়তা নিয়ে বাসার পথে হাটা দিল ! সারাটা পথ কেবল ছেলেটার কথাই ভাবতে লাগলো ! পাহারাদারের কথাও কানে বাজতে লাগলো একটু পরপর !
অনেক দিন আগে এই খানে থেইকা একটা সুন্দর মতন পোলা ফাল দিয়া মরছিল !
(এই গল্পটা শুরু করেছিলাম অনেক দিন আগে ! আজকে শেষ করলাম)
(সমাপ্ত)
গল্প নাম্বারঃ দুই
বাবা স্বাধারনত দিনের বেলা খুব দরকার না পড়লে আমাকে ফোন করে না । তার ফোন করার সময় হচ্ছে রাতের বেলা । কিন্তু এই ভর দুপুর বেলা আব্বার ফোন পেয়ে খানিটা অবাক না হয়ে পারলাম না । একটু যেন ভয় ভয়ও করতে লাগলো মনের ভিতর ।
-কোথায় তুমি ?
এই সেরেছে ! আব্বা আমাকে তুই করে বলে এমনি সময়ে । আজকে তুমি তে নেমে এসেছে তার মানে সমস্যা কিছু একটা হয়েছে নিশ্চিত ! আমি শান্ত কন্ঠে বললাম
-এই তো আব্বা ক্যাম্পাসে !
-তোমার পাশে নিশি আছে ?
এবার আসলেই আমাকে বেশ খানিকটা চমকাতে হল । আমি মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে কিছু একটা সমস্যা অবশ্যই হয়েছে । কোন রকমে বললাম
-হ্যা আছে !
-নিশিদের বাসায় আসো ওকে নিয়ে ।
-জি !
আব্বা ফোন রেখে দিয়ে দিল আমি নিশির দিকে তাকিয়ে দেখি ও তখনও আপন মনে বাদাম চিবিয়ে যাচ্ছে ! আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল
-কি হয়েছে ? এমন করে তাকিয়ে আছিস কেন ?
-আব্বা ফোন দিয়েছিল !
-হুম বুঝেছি ! তোর আব্বা তোকে বকা দিয়েছে নাকি ? তুই না ?
-বকা নি ?
-তাহলে ? মুখ ওমন করে রেখেছিস কেন ?
-বাসায় যেতে বলেছে !
-যা । সমস্যা কি ?
-আমার আব্বা তোকে সাথে নিয়ে তোদের বাসায় যেতে বলেছে !
এইবার দেখলাম নিশি চমকে উঠলো ! বলল
-সেকি কেন ? তোমার আব্বা তোকে আমাদের বাসায় যেতে বলবে কেন ?
-সেটা তো আমারও মাথায়ও আসছে না ।
তারপর দুজনের মাথায় একসাথে কথা এলো
-ঐ টা না তো.....
দুজনেই একসাথে কথা টা বলে উঠলাম ! আমি তাকিয়ে আছি নিশির দিকে নিশি তাকিয়ে আছে আমার দিকে । আমি ওকে বললাম
-যদি ঐ হয় তাহলে কিন্তু তোর খবর আছে । সত্যি তোর খবর আছে । আমাকে দুই এর ভিতর টেনে এনেছিস !
দেখলাম নিশি খানিকটা চুপছে গেল । বলল
-না ওটা কিভাবে হবে ? কোন চান্সই নেই । তুই চিন্তা করিস না । আগে চল সেখি কি ব্যাপার !
দুজনেই রিক্সা নিলাম । নিশি আমাকে অভয় দিতে লাগলো কিন্তু আমার মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছিলো না । বারবার মনে হচ্ছে কিছু একটা ঝামেলার ভিতরে পড়তে যাচ্ছি । এই নিশিই আমাকে সেই ঝামেলায় ফেলতে যাচ্ছে ।
নিশিদের বাসায় গিয়ে দেখি সেখাবে বাবা আর আমার বড় মামা উপস্থিত ! সাথে নিশির বাবা গম্ভীর মুখে বসে আছে । আমাদের আসতে দেখে বাবা কেবল গম্ভীর মুখে আমাদের দিকে তাকালেন । নিশির বাবা আমাকে দেখে বলল
-অপু এসো ! বস এখানে ?
খাইছে ! আমার কেন জানি মনে গরু জবাই করার আগে যেমন করে আদর যত্ন করা হয় আমাকে ঠিক তেমন ভাবে আদর করে বসানো হচ্ছে । নিশির বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি কি জানো নিশির কদিন থেকেই আমি ছেলে দেখছিলাম !
-জি জানি !
-তুমি যে নিশিকে পছন্দ কর এই কথা টা আমাকে আগে কেন বল নি ? তুমি কিংবা নিশি কেউই আমাকে বলেনি ! কেন ?
আমি কোন কথা বললাম না । কিন্তু মনে মনে বলতে বড় ইচ্ছে হল আসলে আঙ্কেল আমি যে আপনার মেয়ের সাথে প্রেম করছি এটা আমি নিজেই জানতাম না । কেবল তিন দিন আগে জেনেছি ! এই কিন্তু এই কথা তো সরাসরি বলা যায় না !
নিশির বাবা বলল
-আগে জানলে তো আর তোমার বড় মামার ছেলের সাথে নিশির বিয়ের কথা বার্তা চালাই না !
বড় মামার ছেলে কথা টা শুনতে আমার চোখ কপালে উঠলো । নিশির দিকে তাকিয়ে দেখি ও নিজেও খুব অবাক হয়েছে কথা টা শুনে ! আস্তে আস্তে আমার কাছে সব কিছু পরিস্কার হয়ে গেল । নিশির দিকে তাকালাম অগ্নি চোখে । ইচ্ছে হল ওকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলি ! বদ মেয়ে তুই আর ছেলে পাস নাই !!
ঘটনা তেমন কিছু না । তিন দিন আগে নিশির আমার কাছে এসে বলল আমার জন্য ছেলে দেখছে !
আমি বললাম
-ভাল তো ! বিয়ে করে ফেল । মেয়েদের এতো দেরি করে বিয়ে করা ঠিক না !
-থাপ্পড় খাবি ! কিছু একটা কর !
-আমি কি করবো ? কিছু একটা করি আর বিপদে পরি ! তাছাড়া বিয়ের খানা টা মিস করবো কোন হিসেবে বল তো ?
ওর করুন মুখ করে বলল
-প্লিজ কিছু একটা কর ! এবারের গাধাটাকে কিছুতেই কাটাতে পারছি না । শেষে বলেছি যে আমার একটা বয়ফ্রেন্ড আছে !
-ভাল করেছিস ! এখন ?
-সে তার ছবি দেখতে চায় !
-দিয়ে দে কারও ছবি ! সমস্যা কি ?
-তুই বুঝতে পারছিস না কেন ? এই লোকের বুদ্ধি আছে মনে হচ্ছে । ঠিক খোজ খবর বের করে ফেলবে ! আর আমি কার না কার ছবি দেব ব্যাচারা বিপদে পড়বে !
-তো কি চাস ?
-তোর ছবি দেই ?
-মাথা খারাপ ?
-প্লিজ দেখ ! তোর খোজ খবর নিলেও সমস্যা নেই । আমি বেশি ভাগ সময়ে তোর সাথেই থাকি । ক্যাম্পাসে কারো কাউকে জিজ্ঞেস করলে সমস্যা হবে না । আর তোরও কোন গার্লফ্রেন্ড নেই । সো খুব বেশি সমস্যা হবে না !
-নো মানে না !
-প্লিজ ! দেখ !
রাজি হব না, হব না করে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলাম । এক সাথে বেশ করেকটা সেলফি তুললাম । এমন ভাবে তুললাম যে অচেনা যে কেউ দেখলে মনে করতে পারে যে আমরা প্রেমিক প্রেমিকা !
ছবি গুলো নিয়ে যাওয়ার সময় বললাম
-মনে থাকে যেন । যদি আমার কোন সমস্যা হয় তাহলে তোর খবর আছে ! আর কাচ্চির কথা মনে রাখি স !
-তুই বন্ধু নাকি অন্য কিছু !
আমি তো ভেবেছিলাম ঘটনা এখানেই শেষ হবে কিন্তু এতো দুর যাবে সেইটা তো ভাবি নাই ! শাফায়েত মানে আমার বড় মামার ছেলেকে নিশি সেই ছবি দেখিয়েছে । আমাকে চিনতে শাফায়েত ভাইয়ের নিশ্চই দেরি হয় নি । আর সেখান থেকে বাবার কাছে খবর যেতেও দেরি হয় নি ।
কিন্তু শাফায়েত ভাই আমাকে কিছু না বলে একেবারে সরাসরি বাবার কাছে কেন গেল এটা ঠিক বুঝতে পারলাম না । আমার কাছে আগে আসতো ! তাহলে তো আর ঝামেলা হত না !
যাক সেই টা এখন চিন্তা ভাবনা করার সময় নেই । এখন এখানের এই সমস্যা কিভাবে সামাল দেব এই ভাবছি ! বাবা চুপ করে বসে আছে আমি মাথা নিচু করে বসে আছি !
হঠাৎ বড় মামা জানতে চাইলো
-এসব কত দিন ধরে চলছে ?
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগে নিশি বলল
-এই তো বছর তিনেক !
-তিন বছর ?
আমি তাকালাম নিশির দিকে, নিশি আমার দিকে তাকিয়ে মুখ দিয়ে অনুনয়ের দৃষ্টিতে তাকালো !
আমি না কিছু পারছিলাম বলতে না পারছিলাম সইতে । এই ফাজিল মেয়ে আমাকে কোথায় বিপদে ফেলল কে জানে । তার থেকেও বড় সমস্যা আমাদের এর পরে কি হবে কে জানে !
আমাদের কাছে আর বেশি কিছু জানতে চাওয়া হল না । বড়দের কি না কি কথা আছে বলে আমাদের অন্য ঘরে পাঠিয় দেওয়া হল ! ঘরের ঢুকে আমি পারি তো নিশির গলা টিপে ধরে মেরে ফেলি !
বললাম
-তোর জন্য আজকে এতো বড় ঝামেলায় পড়েছি । বাবার সামনে মুখ দেখাবো কি ভাবে বল ?
-আমি কি করবো বল ? আমি জানি নাকি ঐ বেটা তোর মামাতো ভাই । কপালে এমন হলে আমার দোষ কোথায় ?
-না দোষ কোথায় ? দোষ কোথায় তোর ? সব দোষ আমার । কোন দুঃখে তোর প্রস্তাবে রাজী হয়েছিলাম । শোন তুই থাক এখানে আমি পালাবো ভাবছি !
নিশি আমার কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো ।
-পালাবি কোথায় ? আর কেন পালাবি ?
-যদি বিয়ে দিয়ে দেয় ?
-আরে ভয় পাশ না । আমার আব্বা বেকার ছেলের সাথে মেয়ের নিয়ে দিবে না !
-আচ্ছা তুমি তাহলে সব কিছুই ভেবে রেখেছো ? তাই না ?
-নো চিন্তা ! একটু শান্ত হয়ে বয় ।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেষ রক্ষা হল না । বিয়ে যদিও দিলো তবে ঐ রাতেই আমাদের বাগদান করে রাখলো । নিশির বাবার কথা যেহেতু দুজনই দুজনই পছন্দ এবং যেহেতু ছেলের এখনও পড়ালেখা শেষ হয় নাই তাই ওদের বাগ দান করিয়ে রাখা হোক ! পরে সময় মত বিয়ে দেওয়া যাবে ।
অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে নিশিকে দেখলাম বাবার পা ছুয়ে সালাম করতে ! বাবার আমার দিকে বিরক্ত হয়ে তাকালেও নিশিকে দেখলাম ঠিকই হাসি মুখে দোয়া করলেন !
আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না কি করবো ? কোথা থেকে এসে কি হয়ে গেল !
রাতের বেলা যখন নিশিদের বাসা থেকে বের হতে যাবো দেখলাম নিশি আমার সাথেই বের হয়ে এল ! আমার সবার সামনেই আমাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল
-তুই চিন্তা করিস না কেমন ? আমাদের পড়া লেখা শেষ হতে এখনও বছর দেড়েক বাকি ! এই সময় পর্যন্ত তো ঝামেলা দুর হল !
-তাই না ? তোর খুব মজা লাগছে ?
-হুম ! খুব !
এই বলে নিশি হাসলো ! আমারও কেন জানি হাসি আসলো ! বললাম
-তোর কালকে খবর আছে । ক্যাম্পাসে আয় !
-আমার খবর পরে করবি আগে নিজের টা সামলা । আজকে বাসায় গেলা তোর কপালে কি হবে ভেবেদেখেছিস !
খাইছে ! তারপর ! ভয়ভয় চোখে নিশির কাছ থেকে বিদায় নিলাম । বাবা আর মামা ততক্ষনে একটু দুরে চলে গেছে । যখন বাবার কাছে পৌছালাম কি মনে হল পেছন ফিরে তাকালাম । দেখি নিশি এখনও সেখানেই দাড়িয়ে আছে । আমাকে তাকাতে দেখে হাত নাড়লো !
জানি না কেন এই দৃশ্যটা আমার কাছে খুব ভাল লাগলো ! ওর দিকে তাকিয়ে আরেকবা হাত নাড়লাম ! কেনা জানি মনের ভিতর একটা সুক্ষ আনন্দের ধারা বয়ে গেল !
তারপর ? তারপরের টা না হয় অন্য কোন গল্প !
(সমাপ্ত)
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন