|
ডি মুন
|
|
মেঘপ্রেমে নিষ্ক্রান্ত জীবন
18 September 2014, Thursday
মেঘকে নিয়ে আমার অনেক কিছু লিখবার ছিলো, কিন্তু মৃত্যুর আগে সেসব আর হলো না। মেঘ, আমায় তুমি ক্ষমা করো। অক্ষম দিন শেষে আমার চোখে কেবলি মাকড়শা জমে যায়, জড়ানো জালের বিস্তার এড়িয়ে তোমার কাছে পৌঁছুনো হয় না আমার।
উত্তরের জানালায় রাত্রির কালো এসে গ্রাস করে দিগন্তকে। আমি ভূতের গল্প শোনা আতঙ্ক-বালকের মতো দুহাতে চোখ ঢাকি, আর আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে মিটমিট চোখে তোমার হারিয়ে যাওয়া দেখি। শিস দেয়া বাতাস আমার হাড় জিরজিরে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে থেমে গেলে, আমি তড়িৎ গতিতে জানালা ভিজিয়ে দিয়ে ঘর অন্ধকার করে বসি। অন্ধকারে অন্ধকার এড়িয়ে চোখ বুজি। স্মৃতি হাতড়াই; মেঘের স্মৃতি। প্রবল ঝড়ে যে মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে অদ্ভুত অনিচ্ছায়, তার রক্তে আমি নিজেকে খুঁজে বেড়াই। অতীতের ছোট্ট ফুটো দিয়ে গলে যাই অনিমিখে।
হে মেঘ-মহীয়সী, তোমাকে নিয়ে অনেক কথা বলা যেত। কিন্তু উপযুক্ত শব্দক্ষমতা হারিয়ে এখন আমি শূন্য কলস। আমার ভেতরে জমেছে জন্মান্ধতার কালো অসুখ, প্রবল অন্ধকারের বিস্তার এড়িয়ে তোমার আলোতে আজ গা ভেজানো হবে না আমার। ধুলো জমে মলিন আনকোরা বইয়ের মতো তুমি আজ অপঠিতই থেকে যাবে।
কেবিনের দেয়ালে যুগল টিকটিকি টিক টিক করে জানিয়ে দিচ্ছে, সময় নেই। অভ্যস্ত বেঁচে থাকা এড়িয়ে আমি এখনি পৌঁছে যাব আগন্তক মৃত্যুদ্বারে; সমাপ্ত হবে ‘মনুষ্য যাত্রার কাল’। শুধু আক্ষেপ এই যে তোমাকে জানানো হলো না, গোধূলি-রঙ তোমাকে আমি বড্ডো ভালোবেসেছিলাম। আমার মুগ্ধ নয়ন সমর্পণে কোনদিনও তুমি তা টের পেয়েছ কিনা, সে সমাচার আজো অজানাই রয়ে গেল!
আমাদের শুভদৃষ্টি হয়েছিলো মরিচাপ নদীর পাড়ঘেষা পথের ওপর দাঁড়িয়ে, যেখানে জিউলীর ডালে নবজাতক পাতায় বিকেলের শেষ রোদটুকু লেগে ছিলো; যেখানে কামিনী ঝোপের ফাঁকে টুনটুনি ছিলো অস্থিরচিত্ত অধরা। বালিহাঁস বিলুপ্ত হয়ে ফসিলে পরিণত হবার আগেই আমাদের চোখাচোখি হয়েছিলো, তবে সেদিন কথা হয়েছিলো কিনা - মনে নেই। হয়তো নদীর ঢেউয়ে চোখ রেখে তোমার প্রতিবিম্ব দর্শনে কাটিয়ে দিয়েছিলেম সে গোধূলি-সন্ধ্যার সন্ধিক্ষণ; যেমন করে অচেনা নগর দ্যাখে অভিভূত আগন্তক। মাথার উপরে ডানা ঝাপটানো গো-শালিখ কিংবা বকের সারি আমার মনোযোগ সরিয়ে নিতে পারেনি সেদিন। বাতাসের চিৎকারে বিক্ষিপ্ত হয়নি দু’চোখের নিবিড় একাগ্রতা। তোমার সোনালি মেঘরঙে বিম্বিত প্রথম সে ভালোলাগার মধুক্ষণ আজো অমলিন। সেদিন সরাসরি চক্ষুমিলনে আড়ষ্টতা ছিলো, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। ভয় পেয়েছিলাম, তোমার লাজুক শরীরে চোখ ফেলতেই যদি তুমি বসতি গড়ো ভিন্ন আকাশে!
আজ অন্তিম সমর্পণে তোমাকে ঘিরে কতো কথাই তো মনে আসে। একরাতে পালছেঁড়া নৌকায় পা দুলিয়ে তোমার চাঁদরঙা মুখে আমার জীবনছায়া দেখেছিলাম আমি। চাঁদের আলো পাশ কাটিয়ে তুমি সরে যাচ্ছিলে ভীষণ লজ্জায়। আমি অস্ফুটে বলেছিলাম, ভালোবাসি। তুমি শুধু একফোঁটা জল দিয়েছিলে প্রতিদানে। সেদিন সে পূর্ণিমাতে কতো জলছাপ তরুণীরা বসে ছিলো যৌবনের পসরা সাজিয়ে। আমাকে দিকভ্রান্ত করবার কলাকৌশলের ত্রুটি ছিলো না তাদের। আমি তবু নির্নিমেষে তোমার বিভূষণ রূপে মুগ্ধ ছিলাম। পৃথিবীতে শরীর রেখে তোমার ওপরে বিছিয়েছিলাম মন।
হে নিরাভরনা, তুমি বলেছিলে, মেঘপ্রেমে বর্ষণ আছে। কাকভেজা অস্বস্তি আছে। আছে পাথরে হোঁচট খেয়ে ভুপাতিত হবার মাহেন্দ্রক্ষণ(!)। নিষেধ আছে। উপেক্ষা আছে। আছে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জটিল যন্ত্রণা। কিন্তু আমি তো জানি, এতোসব ছাপিয়ে মানবপ্রেমের চেয়ে তবু মেঘপ্রেমে অনেক বেশি ‘স্থিরতা শান্তি’ আছে। উত্তপ্ত রোদ্দুরে প্রেমময় ছায়া আছে। ঘিনঘিনে ঘামের অস্বস্তিতে আছে শ্রাবণের প্রবাহমান শীতল বারিধারা।
আজ এই জাগতিক বন্ধন সংক্রান্তিতে হে মেঘপ্রেমিকা, তোমার শিমুলতুলো শরীরে নিবেদন করছি আমার একাকীত্বের পাণ্ডুলিপি। দ্বিধাগ্রস্থ নাগরিক জনপদের সবটুকু ক্লান্তি দু’হাতে নিঙড়ে; আমাকে তুলে নাও তোমার ধূপছায়া সরস সঘন প্রেমে। আজ আমি মুক্তি নিচ্ছি। হাসপাতালের এই অন্ধকার অস্থিরতা থেকে ছুটি হচ্ছে আমার। আমি তোমার কাছে ফিরতে চাইছি হে আকাঙ্ক্ষিত জলদ।
গতকাল সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরবার পথেই শিল্পবিপ্লবের ইঞ্জিন পিষে দিয়ে গেল আমাকে। আমার অপরাধ, তোমার চোখে চোখ রেখে ভুলেছিলাম পৃথিবী। আজ আর বাড়ি ফিরবার কোনো দায় নেই। হাসপাতালের এই ‘দার্শনিক বোধ’ জাগানো কক্ষে চিরঘুমে নিদ্রিত হবার আগে তুমিই আমার একমাত্র প্রার্থনা।
গ্রীষ্মের ছুটিতে তালা দেয়া স্কুলঘরের মতো আমার চোখের দরজায় থমকে দাঁড়িয়েছে জীবনঘড়ি। আমার চোখের মাকড়শাজট ক্রমশ কেটে যেতে শুরু করেছে, শেষ নিঃশ্বাস পড়বার সাথে সাথেই তোমার কাছে পৌঁছে যাব ঠিক। তোমাকে নিয়ে কিছু লিখবার নেই আজ, সিদূরে কপাল নিয়ে তুমি জ্বলজ্বল করছো স্মৃতিতে।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন