|
সুফিয়া
|
|
গল্প -- প্রিয় বান্ধবী
14 September 2014, Sunday
প্রিয় বান্ধবী
ঘুমভাঙা চোখে বিছানায় উঠে বসার সাথে সাথে নুরানীর মনে পড়ে যায় আজ শুক্রুবার। স্কুল ছুটি। সেই সাথে অনেকগুলো ছুটির সমারোহ। বাবার অফিস ছুটি, মায়ের কলেজ ছুটি। ভাইয়ার অবশ্য গীটারের ক্লাস আছে, সেই বিকেলে। তার মানে সারাদিন বাবা-মা ভাইয়ার সাথে হৈ-হুল্লুড় করে কাটানো যাবে। আনন্দে যেন এখনই নাচতে ইচ্ছে করছে নুরানীর। কিন্তু পর মুহূর্তে দমে যায় সে। কারণ, দশটার সময় আরবীর শিক্ষক আসবে তাকে পড়াতে। সপ্তাহে মোটে একটা দিন আরবী পড়ার সুযোগ পায় নুরানী। কিন্তু আজ কিছুতেই পড়তে ইচ্ছে করছেনা। সমস্ত দিনটা মজা করে কাটানোর প্রবল ইচ্ছায় মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় নুরানী।
মেহেরুন তখন রান্নাঘরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সাধারণত প্রতিদিন নিজের হাতে নাস্তা তৈরী করে সবাইকে নিয়ে একসাথে বসে খাওয়ার সুযোগ হয়না মেহেরুনের। আজ ছুটির দিন, সবাই বাসায়, কারও তেমন কোন ব্যস্ততা নেই। নেহাল গতরাতেই বলে রেখেছে। কয়দিন ধরে ধুম বৃষ্টি হচ্ছে, তাই আজ সকালে গরুর মাংস আর ভুনা খিচুরী খাবে। ছেলের কথায় উৎফুল্ল হয়ে সায় দেয় ওর বাবাও। তাই মেহেরুন সকাল বেলাতেই লেগে যায় জম্পেস একটা নাস্তার আয়োজনে। কাজের বুয়াকে বলে সবকিছু কেটে-বেছে দিতে।
এমন সময় চোখ কচলাতে কচলাতে সেখানে এসে দাঁড়ায় নুরানী। মেহেরুন অবাক হয়ে প্রশ্ন করে
কি রে ? এত সকালে উঠে পড়লি ? তা-ও না ডাকতেই ? আজ তো স্কুল ছুটি। অন্যদিন তো ডেকেও তোলা যায়না ?
কি করব ? ঘুম ভেঙ্গে গেল যে ?
জবাব দেয় নুরানী। মা বলেন
খুব ভাল হয়েছে ঘুম ভেঙ্গে গেছে। এবার যা, তাহ-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়। আজ আমরা মা-মেয়ে মিলে মাংস-খিচুরী রান্না করব।
কিন্তু আমি তো রান্না করতে জানিনা মা ?
জানিস না তো কি হয়েছে ? আমার কাছ থেকে শিখে নিবি।
তা না হয় শিখব। কিন্তু একটা কথা আছে মা।
আবার কি কথা ?
মায়ের প্রশ্নে আবদারের স্বরে নুরানি বলে, মা হুজুরকে আজ আসতে মানা করে দাওনা। আমার না আজ পড়তে একদম ইচ্ছে করছেনা।
ইচ্ছে না করলে চলবে কেন ? সপ্তাহে একটা দিন মাত্র আরবী পড়িস। তা-ও যদি বাদ যায় তাহলে চলবে কি করে ? কুরআন শরীফ ধরবি কবে ? এসএসসি পরীক্ষা দিবে মেয়ে এখনও কুরআন শরীফ পড়তে পারেনা। কেমন শুনায় বলতো ?
তুমি যে কি বলনা মা ? আমার ক্লাসের কত বন্ধুরা তো আরবী পড়ায় এখন পর্যন্ত আমার অবধি পৌঁছুতেই পারেনি। আমি একদিন ছুটি চাইছি তাতেই এমন কি হয়ে গেল ?
মায়ের কথায় নুরানীর অভিমান হয়েছে। বুঝতে পেরে সহাস্যে নুরানীকে কাছে টেনে নিয়ে মেহেরুন বলে
তাতে এমন কিছু হয়নি। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠেই এই বায়না ধরলি কেন ? আজ কি নতুন কিছু পরিকল্পনা করেছিস না-কি ভাই-বোনে মিলে ?
ভাইয়ার কথা আমি জানিনা। তবে আমার একটা পরিকল্পনা আছে মা। আজ তোমাদের সবার সাথে বাসায় অনেক মজা করে কাটাব আমি। সাথে আমার বান্ধবীরাও থাকবে।
তুই কি তোর বন্ধুদের আসতে বলে দিয়েছিস ?
বলিনি। তবে এখন ফোনে ওদেরকে ডাকব ভাবছি। মা, তুমি রাগ করলে না তো ?
রাগ করার কি আছে ? তোর বন্ধু-বান্ধবীরা তো বাসায় আসেতই পারে। তুই বরং এক কাজ কর। ওদেরকে সকালেই আসতে বল। আমাদের সাথে নাস্তা করবে, সারাদিন থাকবে আমাদের এখানে। তারপর বিকেলে যে যার বাসায় ফিরে যাবে। আমি তোর হুজুরকে বলে দিচ্ছি।
মায়ের কথায় খুব খুশী হয় নুরানি। দু’হাতে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে
তুমি কত ভাল একটা মা ! কিন্তু জিজ্ঞেস করলে না তো কেন আমার বান্ধবীদেরকে আজ বাসায় ডাকছি ?
সেকথা পড়ে শুনব। আগে তুই হাত-মুখ ধুয়ে আয়।
বলে কাজে হাত লাগায় মেহেরুন। নুরানী চলে যায় সেখান থেকে। ততক্ষণে নেহাল ও ওর বাবা ঘুম থেকে উঠে গেছে। নুরানি ফ্রেশ হয়ে আবার রান্নাঘরে মায়ের কাছে আসে।
বলো মা, কি করতে হবে ?
কিছু করতে হবেনা তোকে। বরং তুই বলতো তোর কয়জন বন্ধু-বান্ধব আসতে পারে ? আমাকে তো সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা করতে হবে।
এই ধরো পাঁচ/ছয় জন।
এবার বল, আজ হঠাৎ তোর মাথায় এই খেয়াল কেন এলো ? তুই তো সাধারণত এমনটা করিসনা ?
আমি সে কথা তো তোমাকে বলতে চাচ্ছি মা। আমার বান্ধবী আছেনা সাহেলী ? আজ ওর জন্মদিন।
ও বুঝেছি। আমাদের বাসায় ওর জন্মদিন উপলক্ষে তোরা আনন্দ করবি এই তো ? সেটা আগে বললেই হতো। একটা কেকের অর্ডার দিয়ে রাখতাম আমি। তোর বাবাকে বললে অবশ্য এখনও ব্যবস্থা করতে পারবে।
না মা, অতকিছু তোমাদের করতে হবেনা। আজ সাহেলীর জন্মদিন হলেও মূল উপলক্ষটা কিন্তু অন্য। সেখানে তোমার সাহায্য লাগবে আমাদের।
মেয়ের কথায় এবার হাতের কাজ বন্ধ করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায় মেহেরুন। কিন্তু কিছু বলতে হয়না তাকে। নুরানি তার মায়ের এই দৃষ্টির অর্থ বুঝে যায়। বলে
মা, আমার একজন বান্ধবী আছেনা তাসলিমা, যার কথা তোমাকে আগেই বলেছি। ঐ যে আমাদের স্কুলের দফতরী কাকার মেয়ে ?
ও হ্যাঁ। মনে পড়েছে। পড়াশুনায় ভীষণ ভাল মেয়েটি।
নুরানির মুখটা উজ্জল হয়ে উঠে ওর মা তাসলিমাকে মনে রেখেছে দেখে। উৎফুল্ল হয়ে উঠে ওর মন। বলে
হ্যাঁ মা। আমি ওর কথাই বলছি। ও আজ ক’দিন হলো স্কুলে আসছেনা।
কেন ? সামনে পরীক্ষা, সময়টা এখন কত গুরুত্বপূর্ণ ? আর এই সময় মেয়েটা স্কুলে যাচ্ছেনা এটা তো ঠিক নয়।
সেজন্যই তো বলছি মা, তোমার সাহায্য আমাদের খুব দরকার। আমি তাসলিমাকে গতকালই বলে দিয়েছি আজ আমাদের বাসায় আসতে তোমার সাথে দেখা করাব বলে।
ভাল করেছিস। কিন্তু ব্যাপার কি বলতো ? আমি কিভাবে তোদের কাজে লাগতে পারি ?
মা, তাসলিমাকে ওর বাবা স্কুলে আসতে দিচ্ছেনা ওকে বিয়ে দিবে বলে। বিয়েও মোটামুটি ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু তাসলিমার ভীষণ ইচ্ছে ও অনেক পড়াশুনা করবে। আমরাও তাই চাই। আমরা জানি এসএসসি পরীক্ষায়ও খুব ভাল রেজাল্ট করবে। মা. তুমি তো কয়েকটা নারী সংগঠনের সাথে জড়িত। তুমি পারনা তাসলিমার এই বিয়েটা বন্ধ করতে ? ও যাতে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে ?
একটা বেদনাতুর আবেদন ফুটে উঠে নুরানির চোখে-মুখে। সেটা দেখে মেহেরুনের মুখটা খুশীতে উজ্জল হয়ে উঠে। মেয়ের এই মানবিক উদার দিকটা তার বুকের গভীরে কোথায় যেন ভাল লাগার অনুভ’তি জাগিয়ে তোলে। মেয়ের মুখটা দু’হাতে বুকে চেপে ধরে বলে
তাসলিমাকে খুব ভালবাসিস তাই না রে ? ঠিক আছে আমি এব্যাপারে খুব তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নেব। তুই খুব ভাল একটা কাজ করেছিস ব্যাপারটা আমাকে জানিয়ে। তোর আইডিয়াটাও মন্দ নয়। তোর মাথা থেকে বেরিয়েছে বুঝি ?
নুরানি সহসা মায়ের কথার কোন উত্তর দেয়না। কিছুক্ষণ পর বলে,
তাসলিমা আমার খুব ভাল বন্ধু মা। ওকে আমি খুব ভালবাসি। ও অনেক ভাল একটা মেয়ে।
আমি সেটা বেশ বুঝেছি। আমার খুব গর্ব হচ্ছে এটা ভেবে যে, আমার মেয়ের মতই কাজ করেছিস তুই। তুই কোন চিন্তা করিসনা। তোর পরিকল্পনা অবশ্যই সাকসেসফুল হবে।
যথাসময়ে নুরানির সব বান্ধবীরা আসে ওদের বাসায়। তাসলিমাও আসে। কিন্তু ওর মনটা খুব খারাপ। মন খুলে বান্ধবীদের সাথে আনন্দ করবে তা-ও পারছেনা। মেহেরুন বুঝতে পারে তাসলিমার মনের অবস্থা। ওকে কাছে ডেকে নিয়ে কথা বলে, ওদের সংসারের খোঁজ-খবর নেয়। তারপর তাসলিমাকে আশ্বস্ত করে বলে,
তুমি অবশ্যই আগামীকাল থেকে স্কুলে যাবে, পরীক্ষাও দিবে। নুরানির বাবা তোমার বাবার সাথে এব্যাপারে কথা বলবে। এসএসসি এর পর তোমার পড়াশুনার ব্যবস্থা আমি করে দিব। তুমি উচ্চশিক্ষা নিতে চাইলে তা-ও পারবে।
নুরানির মায়ের এমন আশ্বাসে ওর বন্ধুরা সবাই খুব খুশী হয়। সেদিনই নুরানির বাবা-মা তাসলিমাকে ওদের বাসায় পৌঁছে দিতে যায়। কথা বলে তাসলিমার বাবা-মায়ের সাথে। এ-ও বলে যে, এই বয়সে তাসলিমার বিয়ে দিলে সেটা দন্ডনীয় অপরাধ হবে। তাসলিমার পড়াশুনার খরচ নিয়ে তাদেরকে ভাবতে হবেনা। শুধু তারা যেন তাসলিমার বিয়েটা ভেঙ্গে দেয় এবং ওর পড়াশুনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিয়ের কথা যেন না ভাবে।
এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য তাসলিমার বাবা-মা মোটেও প্রস্তুত ছিলনা। তারাও চাইছিল তাদের মেয়ে পড়াশুনা করে অনেক বড় হবে, বড় চাকুরী করবে। কিন্তু অভাব নামক দৈত্য তাদের সেই স্বপ্নটাকে প্রায় ভেঙ্গেচূড়ে দিচ্ছিল। আজ সেখান থেকে উঠে দাঁড়াবার পথ বিধাতা তাদেরকে করে দিয়েছেন।
নুরানির বাবা-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি এসে যায় তাসলিমার বাবা-মায়ের। মেহেরুনের দুটি হাত চেপে ধরে তাসলিমার মা অঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে বলে
আমার মেয়েটার জীবন আপনারা রক্ষা করলেন। আপনাদের এই ঋণ আমি জীবনেও শোধ করতে পারবনা। আমরা বাধ্য হয়ে একটা বখাটের সাথে তাসলিমার বিয়ে ঠিক করেছি। আপনারা আজ না আসলে আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট হয়ে যেত।
মেহেরুন তাসলিমার মায়ের হাত থেকে নিজের হাত দুটি ছাড়িয়ে নিয়ে বলে
আপনারা এভাবে বলবেন না। আমাদেরকে কৃতজ্ঞতা জানানোর কিছু নেই। আসল কাজটা তো করেছে তাসলিমার বন্ধুরা। আমার মেয়ে যদি আমাকে সময়মতো সব খুলে না বলতো তাহলে আমরাও বোধহয় পারতামনা তাসলিমাকে এযাত্রা রক্ষা করতে। আপনারা ওর পড়াশুনার দিকে খেয়াল রাখবেন। আর কোন বখাটে ওকে কোনভাবে উত্যক্ত করলে সাথে সাথে আমাদেরকে জানাবেন।
এই দৃশ্যপট থেকেই পাল্টে যায় তাসলিমার জীবন। সে এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করে অত্যন্ত মেধার স্বাক্ষর রেখে। এরপর নুরানি ও সে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিষয়ে ভর্তি হয়। মেহেরুনের সহযোগীতা ও তত্ত্বাবধানে একটি নারী সংগঠন তাসলিমার পড়াশুনার সমস্ত খরচ বহন করে।
তাসলিমা এখন স্বপ্ন দেখে তার বাবার আর্থিক টানাপোড়েনের সংসানে স্বাচ্ছন্দ ফিরিয়ে আনার। তাসলিমার মধ্যে স্বপ্ন আর প্রত্যয়ের যে অপূর্ব মেলবন্দন ঘটে এরপর মূলত সেটাই তাসলিমাকে টেনে নিয়ে যায় জীবনের এক সফল পটভূমে।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন