|
ডি মুন
|
|
পঞ্চাশ-বছর-বয়স্ক মুখ (অনুবাদ গল্প)
11 September 2014, Thursday
আমি বছরের পর বছর ধরে এটাকে লুকিয়ে রেখেছি। কখনো গোল করে গুটিয়ে রেখেছি আমার জিমের ব্যাগটাতে। কখনোবা বিছানার নিচে। আর সবচেয়ে বেশি সময় ধরে লুকিয়ে রেখেছিলাম, প্লাস্টিকে মুড়ে তিন ভাঁজ করে আমার ওয়ারড্রবের ড্রয়ারে। এভাবেই দিনের পর দিন আমার পঞ্চাশ-বছর-বয়স্ক মুখটাকে আমি লুকিয়ে এসেছি।
তবে মাঝে মাঝে ভাঁজ খুলে এটা মুখে লাগিয়ে নিয়ে আমি অতীতাশ্রয়ী হই। এবং পুরোনো যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতির দহন অনুভব করি। এটা নিরন্তর আমাকে আমার ভেতরকার বৃদ্ধ সত্ত্বাটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তখন নিজেকে সত্যিই ভীষণ বৃদ্ধ মনে হয়। অথচ এটা আমি কখনো চাইনি। আমি চেয়েছি এখনকার মতোই সবসময় যৌবনদীপ্ত আর শুভ্র ভাবে বেঁচে থাকতে।
অথচ এই একটি যায়গা ছাড়া আর সবখানেই আমি সফল হয়েছি, আপাতদৃষ্টিতে যেগুলো ছিলো প্রায় অসম্ভব। আমি দীর্ঘদিন পর পুনরায় স্কুলে ফিরি এবং ভালোভাবেই মানিয়ে নেই। প্রায় দশ বছর আগে আমার এক জুনিয়রের হাতে চলে যাওয়া চাকরিটা আমি পুনরুদ্ধার করি। খুব সুন্দরী এক মেয়ের সাথে পরিচিত হই। তার আয়তলোচনা মদির আঁখিতে সে আমাকে মুগ্ধ করে। পরবর্তীতে সে মেয়েটিই আমার স্ত্রী হয়। আমাদের এখন সুখের সংসার। একজন ভালো বাবা হতেও আমার চেষ্টা ছিলো আপ্রাণ। এবং এখানেও আমি সফল হয়েছি। আমার সন্তানেরা আমাকেই তাদের সবচেয়ে আপনজন মনে করে। ভালোবাসে। শ্রদ্ধা করে।
কিন্তু তারপরো অদৃশ্য ভূতের মত আমার এই পঞ্চাশ-বছর-বয়স্ক মুখটি পিছু ছাড়েনি কখনো। এটা আমাকে দিনে দিনে ভীত ও সন্দিহান করে তুলছে। সারাক্ষণ মৃত্যুর দূতের মতো যেন আমার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে আমার বাইরের চেহারাটা আসল নয়। আসলে আমি একজন পঞ্চাশ-বছর-বয়স্ক বৃদ্ধ মানুষ।
আমার স্ত্রী অনেকটাই ভুলো মনের কিংবা বলা যায়, বেখেয়ালি। তাই সে কোনদিন ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারে নি। সে ভেবেছে, আমার এই যৌবনদীপ্ত উজ্জ্বল চেহারা যেটাতে এখনো বয়সের ছাপ পড়েনি, এটাই বুঝি আমার একমাত্র চেহারা। এবং সে এটা ভীষণ ভালোও বাসে। কিন্তু সে জানে না আমি আমার পঞ্চাশ-বছর-বয়স্ক চেহারাটাকে এতোদিন ধরে তার কাছ থেকে আড়াল করে চলেছি। দোমড়ানো মুচড়ানো একটা লজ্জাজনক অপরাধী মুখ লুকিয়ে রেখেছি গোপনে।
গতকাল পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই ছিলো। গতদিন আমার স্ত্রী আমাকে সারপ্রাইজ দিতে নতুন একটা বিছানার চাদর কিনে নিয়ে আসে। সেটা বিছাতে গিয়েই সে পুরোনো চাদরের নিচে আবিষ্কার করে আমার পঞ্চাশ-বছর-বয়স্ক মুখটাকে। আমিই বোধহয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। কিংবা আমি চাইছিলাম যে এটা প্রকাশ পাক। অফিস থেকে ফিরে এসেই দেখি আমার দোমড়ানো কুচকানো পঞ্চাশ-বছর-বয়স্ক মুখটিকে নিয়ে সে সোফায় বসে আছে।
‘শোন, আমি সব খুলে বলছি’ - তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বললাম।
তার চোখ ঘৃণা আর সন্দেহে ভরে উঠলো। আমি এতোদিন ধরে তার কাছ থেকে কেন লুকিয়ে এসেছি – এই জিজ্ঞসায় সে আমার দিকে একবার তাকালো। আর বলল- ‘বলো’
আমাদের মাঝখানে আমার সেই মুখটি পড়ে আছে। দুজনের মাঝখানে যেন একটা দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে আছে ওটা। আমি এক দৃষ্টিতে সে দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার মানসপটে অতীত-স্মৃতি ভেসে উঠলো। বলতে শুরু করলাম,
দিনটি ছিলো ১৯৭১ সালের ২১ জুলাই। আমার বাবার পঞ্চাশতম জন্মদিন। তিনি তখনও শৈশবের সেই বাড়িটাতেই থাকতেন যেটা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমাকে আর আমার ভাইকে নিয়ে মা সে বাড়ি থেকে অনেক দূরে একটা শহরে বাড়ি ভাড়া করে থাকতে শুরু করেছিলেন বেশ আগেই। যেখানে আমার বাবার চিৎকার-চেঁচামেচি কিংবা আমাদের দুঃখ-যন্ত্রণা এসব কিছুই ছিলো না। মোটামুটি শান্তি ছিলো।
কিন্তু আমার মা ছিলেন অত্যন্ত সহৃদয় মহিলা। তাই বাবার পঞ্চাশতম জন্মদিনে আমরা ঠিক করি বাবার সাথে দেখা করতে যাব। আমার ভাই যেতে রাজি না হলে আমি আর মা দুজনে যাবো ঠিক করলাম। একটা কার্ডের দোকানে ঢুকে আমি বেছে বেছে বাবার জন্য কিছু কার্ড নিলাম। যেগুলোতে লেখা ছিলো ‘সবচেয়ে ভালো বাবা’, ‘তোমাকে পেয়ে আমি ধন্য’ কিংবা ‘বাবা, আমি তোমাকে ভালোবাসি’- এরকম কথামালা।
আমরা যখন গাড়িতে করে যখন বাড়ির আঙিনায় পৌছুলাম তখন শুনতে পেলাম বাড়ির ভেতর থেকে গানের সুর ভেসে আসছে। পড়ন্ত বিকেল। আমি আর মা হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলাম। দেখলাম সামনের ঘরে শুয়ে আছে একজন অদ্ভুত মহিলা। সে অবশ্য ঘুমাচ্ছিল না। বরং গানের সাথে তাল মিলিয়ে গান গাইবার চেষ্টা করছিলো। আর আমারই মতো একটা ছেলে পাশে মেঝেতে বসে একটা খেলনা ট্রাক নিয়ে খেলছিলো।
মা আমার বাবার ডাকনাম ধরে কাঁপা কাঁপা স্বরে ডাক দিলেন, ‘পাগ?’
ঘরের কোণ থেকে বেরিয়ে এলেন বাবা। আর আমি তাকে দেখেই চিনে ফেললাম। তবে এটা আমার বাবার মুখ ছিলো না বরং এটা ছিলো একজন মদ্যপ উগ্র মানুষের মুখ। আমাদের অপ্রত্যাশিত আগমনে তিনি ক্রোধে লাল হয়ে গেলেন। চিৎকার করে বললেন, ‘দূর হও আমার সামনে থেকে।’
মা নিশ্চুপ দাঁড়িয়েই থাকলেন। বোধহয় তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে আমিও সেখানে আছি। তিনি শুয়ে থাকা মহিলাটির দিকে একবার তাকালেন। তারপর ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। মহিলাটি মাথাটা একটু উঠিয়ে কটাক্ষ করে বলল, ‘এটা আবার কে?’ আর সেই ছেলেটা আরো একটু দূরে গিয়ে সেই খেলনা ট্রাকটা নিয়ে তখনও খেলায় মশগুল।
বাবা তখন রাগে অগ্নিমূর্তি। মুখে যা এলো তাই বললেন। মাগি, বেশ্যা, ইত্যাদি কটুবাক্যে মাকে অসম্মান করে তারপর আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমি তখন বাবার জন্মদিনের কার্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তিনি আমার হাত থেকে কার্ডগুলো নিলেন আর কার্ডের লেখাগুলো উচ্চস্বরে ব্যঙ্গ করে পড়তে শুরু করলেন। হা হা হা করে হাসলেন। তারপর সেগুলো টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলে বললেন, ‘আমি আর তোকে ভালোবাসি না। যা দূর হ এখান থেকে।’
আমি কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে গাড়িতে এলাম। চোখে তখন অবিরাম জলের ধারা। সেগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে আমার চামড়ার ভেতরে কোথায় যেন ঢুকে যাচ্ছে। আমার মুখের চামড়া ঢিলা হতে শুরু করলো। এবং একসময় তা আমার হাতে উঠে আসলো।
এ পর্যন্ত শুনেই আমার স্ত্রী আমার দিকে হতবিহ্ববল চোখে তাকালো। আমি দেখলাম তার চোখে জলের শ্রাবণ। সে পঞ্চাশ-বছর-বয়স্ক মুখটি তুলে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে ধরলো এবং বললো, ‘পরো। তুমি তো তোমার বাবার মতো নও।’
আমি সেই বয়স্ক মুখটির দিকে তাকালাম। ভাবলাম আহা, যদি এটার মুখে একটু হাসি এঁকে দিতে পারতাম! চোখ বন্ধ করে মুখের চামড়ার উপর সেটাকে চেপে ধরলাম। হাতদিয়ে একদম মিলিয়ে দিলাম মুখের সাথে। তারপর আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘খুশি হয়েছ?’
হ্যাঁ, বলেই সে আমার মুখে চুমু দিলো। এবং আমি সেই আগের মতো একইরকম ভালোবাসা অনুভব করলাম। আমার মুখের বয়সী-রেখার উপর সে তার হাত বুলিয়ে দিল। যেন এটা একটা ম্যাজিক। সে বলল, এটা সত্যিই অন্যরকম। তার আচরণে আমি মুক্তি পেলাম। সে যে আমাকে ঘৃণা করছে না – এ ভাবনাটাই আমাকে তৃপ্ত করলো। সে মুচকি হাসল। কিন্তু তার ভেতরের দুঃখবোধকে সে আড়াল করতে পারলো না।
আমার হাত ধরে সে বেডরুমে নিয়ে গেল। নতুন বিছানার উপর আমরা পরস্পরকে আগের মতোই সারারাত ভালোবাসলাম। তারপর আজ সকালে যখন ঘুম থেকে উঠলাম। দেখলাম পুরনো জিনিসপত্রের ভেতর আঁতিপাঁতি করে অবিরাম কী যেন খুঁজে চলেছে সে।
সকালে খাবার টেবিলে আমরা একসাথে বসলাম। ডিম আর পাউরুটি দিয়ে নাস্তা করলাম। তারপর দুজনে দু কাপ কফি নিয়ে নানারকম আলোচনায় মত্ত হলাম। গল্প করলাম রাজনীতি আর দুর্দশাময় এই পৃথিবী নিয়ে। এবং শেষমেশ সৃষ্টিকর্তাকে আমাদের এই সুখী সংসারের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানালাম। আর তখন আমার স্ত্রী ভান করছিলো যেন কিছুই হয় নি। সবকিছু ঠিকঠাক আছে আর এমনটাই সবসময় থাকবে। আর আমিও এমন ভান করছিলাম যেন আমি লক্ষই করি নি এই একরাতে সে কতোটা বুড়িয়ে গেছে।
--
পঞ্চাশ-বছর-বয়স্ক মুখ
মূলঃ কার্ট নিউটন
অনুবাদঃ ডি মুন (এস এম মামুনুর রহমান)
লেখক পরিচতিঃ কার্ট নিউটন(Kurt Newton) বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাটে বসবাস করেন। তার প্রথম গল্প ‘দ্য প্রমিজ অব দ্য সি’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো, দ্য বারিনপান কনসার্টো, দ্য উইশনিক, পাওয়ার লাইনস, দ্য আলটিমেট পারভারসিটিস ইত্যাদি। এছাড়া এ পর্যন্ত তার প্রায় ৩০০টি কবিতা ও ২০০টি ছোটগল্প ইউরোপ ও অ্যামেরিকার বিভিন্ন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। ‘পঞ্চাশ-বছর-বয়স্ক’ মুখ গল্পটি ‘ফ্লাশফিকশন ডট কম’ ওয়েবসাইট থেকে নেয়া হয়েছে। এবং মূল ইংরেজী থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।
আমার এই ক্ষুদ্র অনুবাদ প্রচেষ্টাটি শ্রদ্ধেয় ব্লগার জুলিয়ান সিদ্দিকী কে উৎসর্গ করা হলো, যার অকৃত্রিম উৎসাহে ও অনুপ্রেরণায় আমি অকৃতি অধম গল্পটি অনুবাদের দুঃসাহস করেছি।
অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা প্রিয় জুলিয়ান সিদ্দিকী ভাইয়ের প্রতি।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন