|
ডি মুন
|
|
আগস্ট মাসের ৫টি মনোমুগ্ধকর গল্প
06 September 2014, Saturday
গল্প নম্বরঃ ১
ধূপকাঠি বেচতে বেচতে কতোদূর যেতে পারে একাকী মানুষ?
তাকে তো পেরোতে হবে বহু বন, বহু অগ্নি খাণ্ডব দাহন।
কিছু বন চিনি আমি, পেঁচারা যেখানে বসে কেবলি ধ্বংসের কথা বলে
মগডালে পা ঝুলিয়ে মড়কের হাসি হাসে উলঙ্গ বাদুড়।
দ্বাদশী চাঁদের চেয়ে কয়েকটা চিতাবাঘ পেলে তারা বড়ো খুশী হয়।
কিছু গাছ চিনি আমি, যাদের মজ্জায় রক্তে বয়ে গেছে আদিম সকাল।
বাইসনের মুণ্ডু ছাড়া আর কোনো উৎসবের নাচ যারা দেখেনি কখনো
কিছু গাছ চিনি, যারা এখনো শোনেনি কিংবা শুনে ভুলে গেছে
পৃথিবীতে প্রেম নামে একটা শব্দের চাবি কত দরজা খোলে
অহংকার শব্দটিকে ঘিরে কত বাউণ্ডুলে নক্ষত্রেরা আগুন পোয়ায়
বিষাদ শব্দের মধ্যে বয়ে যায় কি রকম আত্মঘাতী সাদা ঝর্নাজল।
(ধূপকাঠি বেচতে বেচতে / পূর্ণেন্দু পত্রী)
প্রথম গল্পটি এমনই আত্মঘাতী সাদা ঝর্নাজলের গল্প। মনে রেশ রয়ে যায়। ভালোলাগা বিষাদে ভারী হয়ে ওঠে অন্তকরণ। বিয়োগান্তিক সমাপ্তিতে বছর বছর ধরে কেবলি ফুসফুসে জমে যায় অহেতুক প্রশ্নমালা। এবং উত্তর যথারীতি অধরা।
বলছিলাম, ব্লগার মামুন রশিদের ‘বিয়োগান্তিক’ গল্পটির কথা। মুখরিত আড্ডার সমাপ্তি লগ্নে একটি বিয়োগান্তিক বিষাদের গল্পে পাঠকের হৃদয় হয়ে উঠবে আর্দ্র্য । তবে তাঁর আগে পাঠক ঢাকা পড়ে যাবেন ‘পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই চারজন মানুষের প্রাণখোলা উচ্ছাসে'। চলতে থাকবে অদ্ভুত সব গল্প। এবং শেষমেষ পাঠক পরিচিত হবেন ধূপকাঠি বেচতে বেচতে বহুদূর চলে যাওয়া একজন অন্তরে-একাকী মানুষের সাথে।
গল্প নম্বরঃ ২
অঘোর ঘুমের মধ্যে ছুঁয়ে গেছে মনসার কাল
লোহার বাসরে সতী কোন ফাঁকে ঢুকেছে নাগিনী,
আর কোনদিন বলো, দেখব কি নতুন সকাল?
উষ্ণতার অধীশ্বর যে গোলক ওঠে প্রতিদিনই।
বিষের আতপে নীল প্রাণাধার করে থরো থরো
আমারে উঠিয়ে নাও হে বেহুলা, শরীরে তোমার,
প্রবল বাহুতে বেঁধে এ-গতর ধরো, সতী ধরো,
তোমার ভাসানে শোবে দেবদ্রোহী ভাটির কুমার।
কুটিল কালের বিষে প্রাণ যদি শেষ হয়ে আসে,
মৃত্যুর পিঞ্জর ভেঙ্গে প্রাণপাখি ফিরুক তরাসে
জীবনের স্পর্ধা দেখে নত হোক প্রাণাহারী যম,
বসন বিদার করে নেচে ওঠো মরণের পাশে
নিটোল তোমার মুদ্রা পাল্টে দিক বাঁচার নিয়ম।
(সোনালি কাবিন -৮ / আল মাহমুদ)
দ্বিতীয় গল্পটিতে আছে একজন মানুষের পাল্টে যাওয়ার কথা। আছে হাসি- আনন্দ-খুনসুটি। আছে মুগ্ধতা। চমৎকার প্রকাশভঙ্গি, অনবদ্য শব্দচয়ন ও হাস্যরসে ভীষণ উপভোগ্য গল্প হয়ে উঠেছে এটি। পাঠ সমাপ্তিতে একটি আনন্দময় সুখ-সমাপ্তির ইঙ্গিত পাঠকের অন্তরকে তৃপ্ত করবে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
লিখেছেন ব্লগার আফনান আব্দুল্লাহ্। গল্পের নাম – বদলে যাওয়ার গল্প। গল্পটি শুরু হয়েছে এভাবে,
আমার বাবা প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় দেখেন আমি ঘুমাচ্ছি, ফিরে এসেও দেখেন একই ভাবে ঘুমাচ্ছি। তাই উনার ধারনা আমি সারা দিনই ঘুমাই। মাঝখানে যে আমি ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস, টিউশানি, আড্ডা সব দিয়ে এসে সান্ধ্য ঘুম দিচ্ছি এটা উনাকে দেখানো যায় না। আামার উদ্দেশ্যে তাই উনার একটাই বাক্য ব্যায় হয়- ‘হু! নবাব আলীবর্দি খাঁ, ঘুমায়।’ অথচ আমি জানি নবাব বাদশাহরা রাজ্য দখলের ভয়ে ঘুমাতো কম, প্রাসাদের মধ্যে কিলাকিলি করতো বেশি। আর আমি স্বান্ধ ঘুম সেরে রাতে আবার যখন উঠি বাবা ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েন। তাই সাপ্তাহীক ছুটির দিন ছাড়া পিতৃদেবের সাথে আমার খুব একটা দেখা হয়না।
গল্প নম্বরঃ ৩
অমলকান্তি আমার বন্ধু,
ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো,
পড়া পারত না,
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে
এমন অবাক হয়ে জানলার
দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,
দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।
আমরা কেউ মাষ্টার
হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার,
কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে-সব কিছু
হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল! ক্ষান্তবর্ষণ কাক-
ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামরুলের পাতায়
যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন
লেগে থাকে।
(অমলকান্তি / নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী)
আনিসের সাথে যোগাযোগ হয় না অনেকদিন। সে কম করে হলেও বছর পঁচিশেক তো হবেই। সেই যে কলেজ লাইফে গ্রামে বেড়াতে গিয়ে একবার দেখা হয়েছিল তারপর আর দেখা হয় নি। দারিদ্রতার কারনে আনিসের লেখাপড়া স্কুল লাইফেই শেষ হয়ে যায়। সেদিন যখন দেখা হল দেখলাম কাদা মাখা শরীর নিয়ে ক্ষেতবাড়ি থেকে ফিরছে। আমাকে দেখেই হাসি হাসি মুখ করে ইশারায় কিছু একটা জানতে চাইলো। কিছুক্ষন পরে বুঝলাম,সে আমার কাছে কাগজ আছে কিনা তা জিজ্ঞেস করছে। আমি আমার ব্যাগ থেকে একটা সাদা কাগজ আর কলম বের করে দিতেই সে তাঁর কাদা মাখা কাপড়ের মধ্যেই শুকনো জায়গাতে হাত মুছে নিয়ে সেগুলো নিল। তারপর কলম দিয়ে খসখস করে কাগজে কিছু লিখলো। তারপর সেটা আমার দিকে ছুড়ে দিল। আমি সেটা কুড়িয়ে নিয়ে দেখলাম তাতে লেখা,আশফাক কেমন আছিস?অনেক শুকিয়ে গেছিস রে।
বলছিলাম ব্লগার রাঙ্গা রিয়েল... এর গল্প কাগজালাপ এর কিছু অংশ। বলছিলাম, স্কুলঘরে চোখ রেখে শৈশব-দুষ্টুমির সাতসতের। আর বলতে চাইছিলাম, রুঢ় বাস্তবের আঘাতে বাকশক্তি তিরোহিত এক বন্ধুর বর্তমানের কথা। পড়ুন একটি চমৎকার গল্প কাগজালাপ।
গল্প নম্বরঃ ৪
তাকানোর মতো করে তাকালেই চিনবে আমাকে।
আমি মানুষের ব্যাকরণ
জীবনের পুষ্পিত বিজ্ঞান
আমি সভ্যতার শুভ্রতার মৌল উপাদান,
আমাকে চিনতেই হবে
তাকালেই চিনবে আমাকে।
(নাম ভূমিকায় / হেলাল হাফিজ)
চতুর্থ গল্পটি একটি দূর্দান্ত রসাত্মক কল্প-গল্প। পড়তে পড়তে আপনি গল্পের চরিত্রের সাথে একাত্ম হয়ে যাবেন। ঘুরে আসবেন অন্য ঘোরলাগা এক জগত থেকে। অভিনব এক্সপেরিমেন্টে অংশ নেবেন। আর পুলকিত হবেন নতুন অভিজ্ঞতায়। গল্পের কিছু অংশ এমন -
শ্রোতার দিকে মোটেও ভ্রুক্ষেপ নেই ক্যাপ্টেন সাহেবের, সে তার যৌবনের বীরত্বের গল্প বলে যেতে পারলেই খুশি।
বাগের সামনে পড়লে বেশি ভাগ মানুষই হাইগা মুইতা প্যান্ট ভাসায় ফালায়, তারপর মারে খিঁচ্ছা দৌড়। এখানেই হইলো সবচেয়ে বড় ভুল। আরে বেক্কল! তুই কি মোহাম্মদ আলী না কী যে বাগের লগে দৌড় লাগাবি? আগেই তো কইছি বিপদের সময় আমার মাতা ডীপফ্রীজ হয়া যায়; আমি করলাম কি, চোখ পাক দিয়া বাগের চোখের দিকে তাকায়া থাকলাম। দেখি বাগও আমার দিকে বড়বড় কইরা চায়া আছে, এক নজরে তাকায়া আছি তো আছিই; কতক্ষণ তাকায়া আছি মনে নাই হঠাৎ দেখি বাগ অজ্ঞান হয়া পইড়া গেল। শালার বাগ আমারে চিনে নাই, তুই যদি চিতা হস আমি হলাম মিতা, তুই যদি বাগ হস আমি হলাম মাগ।
একবার পড়া শুরু করলে শেষ না করে উঠতে পারবেন না এমনই গল্প এটি। তবে শুধু গল্প মাত্র নয়। গল্পের আদলে একটি বার্তা পৌছে দেয়া হয়েছে পাঠকের মনে, যা সচেতন পাঠ দাবী করে। যাহোক পড়ুন এই চমৎকার গল্পটি। গল্পের নাম - খাস্তগীরের টি-টকার ও টি-টকশো । লিখেছেন ব্লগার শান্তির দেবদূত।
গল্প নম্বরঃ ৫
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল।
তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন
অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন
পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা,
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
(আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি / আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ)
এটি কোনো গল্প নয়। একটি স্মৃতিচারণ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমাদের একজন সহব্লগারের লেখা তারই একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন-
( সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা ভিত্তিক এই স্মৃতিচারণামূলক লেখাটি ১৯৭১ সালের সেই ভয়াবহ দিন গুলোর কথা স্মরণ করার এক ক্ষুদ্র প্রয়াস। নতুন প্রজন্ম জানুক, কেমন ছিল সেই দিনগুলি। ১৯৭১ সালে আমি ছিলাম ১৬ বছরের কিশোর। পরম করুণাময় আল্লাহর ইচ্ছায় ঐ দিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত আরও ৪৩ বছর আমি বেঁচে আছি। কিন্তু সেই ভয়াবহ ঘটনায় আমার বেঁচে থাকার কথা ছিল না। )
সত্যিই তো আমরা কি কোনোদিনও উপলব্ধি করতে পারব সে সময়কার মানসিক উদ্বেগ, ভীতি, ও অচলাবস্থার আদ্যোপান্ত? পারব না। তাই তো কিছু কথা জেনে রাখা ভালো।
আসুন আমরা জেনে নেই আমাদের শ্রদ্ধেয় সহব্লগার আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা।
(আমার নিজস্ব পছন্দের পাঁচটি গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে পোস্টটি। অনেকেই অনেক চমৎকার গল্প লিখছেন। তাদেরকে অভিনন্দন। আরো ভালো লিখে চলুন নিরন্তর। সেই সাথে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি প্রিয় মাহমুদ ভাই ও প্রবাসী পাঠক ভাইকে যারা বিভিন্ন সময় নানারকম তথ্য দিয়ে আমাকে সমৃদ্ধ করেছেন।)
'আগস্ট মাসে' আপনার ভালোলাগা গল্পগুলো সম্পর্কে মন্তব্য / আলোচনা করার জন্য সবাইকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আলাপে, সংলাপে, আলোচনা, সমালোচনায় মুখরিত হয়ে উঠুক পোস্টটি।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন