|
সৃষ্টিশীল আলিম
|
|
ছোটগল্প 'আত্মহত্যা'
31 August 2014, Sunday
অ
পড়ন্ত বিকেল। সৈকত জিন্দাবাজার মেইন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সিএনজির অপেক্ষা করছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক হয়ে যায় সে কোন সিএনজি কিংবা রিক্সারও সন্ধান করতে পারলো না। অবশ্য সেদিন হরতাল ছিল, এ কারণেই এত বিড়ম্বনা! আশে পাশে যে দু-একটা রিক্সা চোখে পড়ছিল তাও ছিল পেসেন্জারে পূর্ণ। ওর নিজের ওপর নিজের খুব রাগ হতে লাগলো। ভাগ্যকে দোষারোপ করতে লাগলো। অভাবি পরিবারের লোকজন যেমন কেবল কলহে লিপ্ত থাকে অর্থাৎ একে অপরকে কেবল দোষারূপ করে তেমনি মানুষ প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হতে থাকলেও নিজের ভাগ্যকে দোষারূপ করতে থাকে।
বাসায় যাওয়াও খুব জরুরি। বড় ভাইয়ের বিয়ের সওদা করতে হবে। তাছাড়া নিজেকে নিয়েও আজকাল সে অনেকটা হতাশাতে দিন কাটাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা ছাত্র। দেখতেও বেশ সুদর্শন। কত জায়গাতে যে এরই মধ্যে সে চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছে সে হিসাব লিখে রাখলে নিশ্চয়ই তা শ’খানেকের কম হবে না! যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন সে চোখে আলো-ছায়া দেখছে।
সে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার একটু পাশেই এক সুন্দরী মেয়ে দাঁড়ানো ছিল। সেও রিক্সার সন্ধান করছিল। মাঝে মাঝে ওরা দুজনেই আড়চোখে লুকিয়ে লুকিয়ে একে অপরকে দেখতেছিল। কিন্তু উভয়ের মধ্যে কোন কথা হচ্ছিল না। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর সে একটি খালি রিক্সা পেল। রিক্সাওয়ালাকে ডাকতে হল না, সে নিজ থেকেই কাছে এল। সৈকত বলল- বাস টার্মিনাল যাবে?
–জি মামা।
সিলেটে প্রায় সব রিক্সাওয়ালারাই পেসেন্জারদের মামা বলে সম্বোধন করে।
কত দিতে হবে?
- মামা হরতালের দিন। খুব রিস্ক নিয়া ঘর থাইক্যা বাইর অইছি।আফনে ইনসাফ কইরা দিয়েন।
- আচ্ছা।
এরপর সে আর কথা বাড়াল না। রিক্সায় উঠে গেল। রিক্সা যখন চলতে শুরু করলে তখন সেই সুন্দরী মেয়েটি পিছন থেকে ডাক দিল- এই যে শুনুন...
সৈকত একটু পিছন ফিরে বলল- আমাকে বলছেন?
জি, আপনাকেই।
-জি বলেন
আমাকে একটু নেয়া যাবে?
- কোথায় যাবেন?
গার্ডেন টাওয়ার
কি একটু চিন্তা-ভাবনা করে সৈকত বললো -আচ্ছা ওঠুন।
আ
আকাশ পরিষ্কার ছিল। সূর্যের তেজসক্রিয়তা তেমন একটা নাই বললেই চলে। পাখ-পাখালিরও কোন আনাগোনা নেই। শাহজালাল মাজারের যে কবুতরগুলো যত্রতত্র চড়াট করতো আজ সেগুলোকেউ কোথাও দেখা যাচ্ছে না। শহরের কোলাহলকারী সে দাঁড়কাকগুলোরও কোন উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেল না। ঠিক বুঝা গেল না মানব হরতালের সাথে ওরাও ঐক্য ঘোষণা করলো কি না !
রিক্সা ধীর গতিতে চলছে। সৈকত ভাবে নি যে, মেয়েটি তার সাথে একই রিক্সায় যাবে। যাইহোক, ঈষৎ লজ্জারাঙা কণ্ঠে, সৈকতই প্রথম মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো, কী নাম আপনার?
চৈতি
- আপনার?
সৈকত। ... কী করেন আপনি?
-পড়াশোনা।
কোথায়?
-সাস্টে
কোন ইয়ার ?
-টু ওয়ান
সাবজেক্ট ?
-রাষ্ট্রবিজ্ঞান। ... আপনি কী করেন?
আপাদত পরিপূর্ণ বেকার। তবে আপনাদের সাস্টে আপনার ডিপার্টমেন্টে লেকচারার পোস্টে এপ্লাই করেছি। ভাগ্য সহায় হলে হয়ত আপনার শিক্ষকও হয়ে যেতে পারি।
কথাটি বলেই সে বেশ গর্বের সাথে লজ্জা রাঙা হাসি দিল। চৈতিও হাসছে। হঠাৎ উত্তরীয় বাতাসে চৈতির খোলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেল। কিছু চুল বাতাসের ঝাপটায় সৈকতের মুখমণ্ডলে এসে পড়ল। সৈকত অজ্ঞাত শিহরণে সুখবোধ করে চোখ বুজলো। চৈতিও বেশ লাজুক লাজুক ভাবে চুলগুলো সরিয়ে নিল। চুল সরাতে গিয়ে চৈতির হাত পড়লো সৈকতের ঠোঁটে। কোমল স্পর্শে ওর ঠোঁট কাপতে লাগলো। সৈকত চোখ খোলল। এখন দুজনেই লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠছে। এরপর আর কারো মুখে কোন কথা নেই। রিক্সা চলছে। একটু পর আবারো দমকা হাওয়ায় চৈতির ওড়নায় সৈকতের মাথা মুখ জড়িয়ে গেল। সৈকত অজ্ঞাত সুখবোধ করে পুনরায় চোখ বুজলো। সারাজীবন শুধু পড়াশোনাই করেছে। মেয়েলি স্পর্শ যে কি জিনিস তা কখনো প্র্যাকটিক্যাল করা হয়ে ওঠে নি! অনেক স্পর্শই হুদয় দিয়ে উপলব্ধি করা কিন্তু তা সূক্ষাতিসূক্ষভাবে ব্যাখা করা যায় না। প্রকৃতি কেন যেন বারবার ওদের দুজনকে কাছে টানার চেষ্টা করছে। প্রকৃতির কারিগড়ি বুঝা বড়ই মুশকিল!
ই
দেখতে দেখতেই রিক্সা এসে থামল গার্ডেন টাওয়ারের সামনে। রিক্সা থেকে নেমে চৈতি ভাড়া দিতে চাইলো। সৈকত বললো- থাক, লাগবে না। আমি দিয়ে দিব। আপনারটা জমা রইলো অন্য একদিন দিবেন। বলেই সে মৃদু হাসলো।
চৈতিও মুচকি হাসলো। ঐ রূপ হাসি যার আছে তার আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। গোটা বিশ্বই যেন হাসি দিয়ে জয় করা সম্ভব! হ্যান্ডসেক করার জন্য চৈতি হাত বাড়িয়ে দিল। সৈকত কিছুটা বিষ্ময়ের ঘোরেই হাত মিলাল। পৃথিবীতে অনেক ঘটনাই ঘটে অনুমানের বাইরে। হাত মিলাতে গিয়েই চৈতির কোমল হাতের স্পর্শ সৈকতকে যেন নতুন স্পন্দন দিল। ওর ভেতরটা যেন খুশিতে টইটুম্বুর করছে। ওর ভেতরের আমিত্ব নড়েচড়ে বসল। কেবল তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছে না। চৈতি বলল
- ভাল থাকবেন। অনেক ভালো।
-আপনিও ভাল থাকবেন।... ভাগ্য ভাল থাকলে হয়ত আবারও দেখা হতে পারে।
-সেই কামনাই করছি। বাই।
-বাই
ঈ
রিক্সা করে বাসায় ফিরে সৈকতের কেবলি মেয়েটির কথা মনে হতে লাগলো। বারবার কথাও বলতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কেন যে সাহস করে মোবাইল নাম্বারটা চাইলাম না! চাইলে কি আর না করতো! এমন হাজারো ভাবনা তার মাথায় ঢেউ খেলে যাচ্ছে। শুধু চৈতির জন্যই সে ভার্সিটিতে লেকচারার পোস্টের জন্য উঠে পড়ে লেগে গেল। যতপ্রকারের তদবির রয়েছে সর্ব প্রকারেরই প্রয়োগ করলো। একটা সময় তার চাকরিটি হয়েও গেল। তখন তার খুশি আর দেখে কে! সে যেন স্বর্গকেই হাতের মুঠোয় পেল।
উ
প্রায় মাস দেড়েক পর সে ভার্সিটিতে যোগদান করলো। যোগদানের দ্বিতীয় দিন যখন সে টু ওয়ানে প্রথম ক্লাস করতে গেল তখনই সে মনে মনে প্রচণ্ড একটি ধাক্কা খেল। চৈতি নাম ডাকতেই সবাই বলল- স্যার গত সপ্তাহে সে আত্মহত্যা করেছে। সৈকত বিষ্মিত কণ্ঠে বললো- আত্মহত্যা?
জনৈক মেয়ে বলল- জি স্যার।
সৈকতের গলা ধরে আসে। তার হাত-পা মৃদু কাঁপতে থাকে। কম্পিত কণ্ঠেই সে পুনরায় প্রশ্ন করে- আত্মহত্যা করলো কেন?
জনৈক মেয়ে- স্যার, ওর বাসা থেকে ওর বিয়ে ঠিক করেছিল, আর তাতে সে রাজি ছিল না; ফলে পরিবারের সদস্যরা তাকে বিয়ে করার জন্য খুব চাপ সৃষ্টি করে।
-তার কি কোন পছন্দ ছিল?
জনৈক মেয়ে- ওর ডায়রিতে লেখা ছিল সৈকত নামের জনৈক পথিককে সে পছন্দ করে। এটা সে তার পরিবারকে বলেছিলও। কিন্তু ছেলেটির কোন ঠিকানা দিতে না পারায় তার পরিবারের লোকজন এসব একেবারেই ছেলেমানুষী বলে উড়িয়ে দেয় এবং সেই সাথে জানিয়ে দেয় তাদের পছন্দ করা ছেলেকেই বিয়ে করতে হবে। শুনেছি বিয়েতে রাজি না হওয়ার কারণে নাকি পরিবারের সদস্যরা তাকে গায়ে হাত দিয়েও প্রহার করেছিল। ... পরিশেষে দুঃখে, ক্ষোভে সে ...
সৈকত এরপর কী বলবে সে ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না। তার দুচোখে পানি টলোটলো করতে লাগলো। সে নিজেকে নিজে ধিক্কার দিতে শুরু করলো। এই মেয়ের খুনি যে সে নিজে! কোনভাবেই সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না। সে যেন বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। চোখে হঠাৎ ময়লা ঢুকেছে এবং তা পরিষ্কার করার ছলে চোখ মুছতে মুছতে সে বলল- আজ এই পর্যন্তই। সবাই ভাল থেকো।
কথাটি বলেই সে শ্রেণি কক্ষ থেকে বেরিয়ে টিসু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে তার ব্যক্তিগত কক্ষের দিকে গেল।
চারদিকে শুনশান নীরবতা। কেবল দূর আকাশের গায়ে একটি চিলের বিকট শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে পুনরায় মিলিয়ে গেল আকাশের গহীন থেকে গহীনে।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন