বাসায় ঢুকতেই শান্তার থমথমে মুখখানি দেখে ভাবনায় পড়ে গেলাম। সদা চঞ্চল আমার মায়াবতী ফড়িংটা কেমন মনমরা হয়ে দক্ষিণের বারান্দার ইজি চেয়ারে শুয়ে আছে, দেখে মনে হয় দেহ থেকে কোন ফাঁকে যেন প্রাণ পাখিটা উড়াল দিয়েছে সুদূর আকাশপাণে। সন্ধ্যা প্রায় শেষ, আলো আঁধারির বিষণ্ণ মায়াজালে নিথর হয়ে শুয়ে থাকা শান্তার মুখখানিতে কয়েকটা অবাধ্য বালকের ন্যায় রেশমি চুল হেলেদুলে খেলা করছে। আমি নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম আমার মায়াবতী ফড়িং এর মুখপানে চেয়ে।
শান্তা’র সাথে আমার বিয়ে হয়েছে আজ তের মাস। এই তের মাসে একটু একটু করে যতই তাকে দেখছি, চিনছি, জানছি... ততই মায়ার জাল বিস্তৃত হচ্ছে। শান্তা একটা ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে, ছোটবেলা থেকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বড় হয়েছে। শত ঝড় তার জীবনে বয়ে গেলেও সে ভেঙ্গে পড়েনি। এতটুকু বয়সে এতোটা মানসিক শক্তি কীভাবে ধারণ করে এই মেয়েটা তা ভেবে ভেবে মাঝে মাঝেই যেমন অবাক হই, তেমনি গর্বিতও হই।
আমি নিজের অবচেতনে শান্তার কোমল গালে মায়ার ছোঁয়া দিতেই ও চোখ খুলল। এই আলো আঁধারের মাঝেই তার গালে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুধারার রেখে যাওয়া চিহ্ন দৃষ্টিগোচর হল। আমি তার পাশে হাটু গেড়ে বসে তার মুখখানি দুহাতের তালুতে বন্দী করে গভীর মমতায় তাকালাম তার চোখের পানে। বাদামী চোখের তারার চারপাশ রক্ত জমা লাল হয়ে আছে। সারাটা বেলা বোধহয় বেচারা কেঁদে ভাসিয়েছে।
‘কখন আসছো?’ খসখসে গলায় শান্তা আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল।
‘এই তো... মিনিট পাঁচেক। কি হয়েছে আমার মায়াবতীর? কান্না করা হল কেন?” আমি একটু আমুদে স্বরে বললাম।
‘প্লিজ শাহেদ, ডোন্ট ট্রাই টু মেক আ ফান...” থমথমে গলায় শান্তা কথাগুলো বলে বাইরের দিকে চোখ মেলে দিল, রাতের আঁধার নামা ঘোলাটে কালচে ঐ শুন্য আকাশে কোন কিছু অবহেলে খোঁজার দৃষ্টি হেনে। আমি আর কথা না বাড়িয়ে ভেতরে চলে এলাম। জামাকাপর ছেড়ে রোজকার মত শাওয়ার নিয়ে দুজনের জন্য দুকাপ কফি আর একটা প্লেটে কিছু কাজুবাদাম নিয়ে দক্ষিনের বারান্দায় চলে এলাম। শান্তা সেই আগের মত বাইরে দৃষ্টি হেনে কোথায় যেন হারিয়ে আছে।
আমার ট্রে রাখার শব্দে মাথা ঘুড়িয়ে আমায় দেখল, তারপর এক দৃষ্টিতে পায়ের নখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে গম্ভীর মুখে চেয়ে রইল। আমি বুঝার চেষ্টা করছি ঘটনা কি? তেমন কিছু মনে করতে পারছি না, যার কারণে শান্তা এতোটা ভেঙ্গে পড়ে বিষণ্ণতায় ছেয়ে যাবে। শৈশব আর কৈশোরে অনেক খারাপ সময় পার করে বড় হওয়া শান্তা গত তের মাসে একটু একটু করে নিজের সব দুঃস্বপ্নকে পেছনে ফেলে আমার সাথে আমাদের এই ছোট্ট সুখের নীড়টি সাজিয়েছে। এই তের মাসে আমি তাকে কখনো এমনটি দেখিনি। তাই আমি ভেতরে ভেতরে খুব অসহায় বোধ করতে লাগলাম। মাথায় ভাবনার ডালি নিয়ে কফির মগটা শান্তার দিকে এগিয়ে দিলাম।
দুজনে মুখোমুখি নিঃশব্দে কফি শেষ করলাম। হালকা দক্ষিণা বাতাস কেমন একটা শীতল আমেজ ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা শরীর জুড়ে। প্রতিদিন এই কফি খাওয়ার সময়টুকু আমরা অনেক গল্প করি। সারাদিনের জমানো হাজারো টুকরো গল্প নিয়ে সাজাই আমাদের আরব্য রজনীর রোজকার ইতিহাস। আমি শান্তাকে লক্ষ্য করতে লাগলাম। ড্রইং রুম থেকে আসা ক্ষীণ আলোটুকু শান্তার মায়াময় চেহারাটায় প্রতিফলিত হচ্ছে। সেই আলোয় দেখলাম তার গলার নীলচে শিরাগুলো থেকে থেকে মৃদু কাঁপছে। বুঝতে পারলাম সে কিছু বলার চেষ্টা করছে। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম তাকে সময় দিয়ে।
‘শাহেদ, রুবি আর নেই...’ বলে উচ্চস্বরে শান্তা কেঁদে উঠলো। আমি উঠে গিয়ে শান্তার কাঁধে হাত রাখলাম। কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে তার পুরো শরীর। অনেকটা সময় পার করে ও আবার ধাতস্থ হলে আমি তাকে হাত ধরে উঠিয়ে বেডরুমে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলাম। আমি উঠে যেতে নিতেই ও আমার হাত ধরে বসালো তার পাশে। এখনো তার চোখে জল ছলছল করছে।
রুবি শান্তার স্কুল ফ্রেন্ড, দুজন একসাথে স্কুল এবং কলেজের গণ্ডি পার করেছে। দুজনে একেবারে হরিহর আত্মা। আমি শান্তাকে ঠাট্টা করে বলতাম, 'রুবিতো আমার সতীন'। ও বলত, 'এই সতীন হয় মেয়েতে মেয়েতে; তোমার আবার সতীন হয় কীভাবে?'। আসলে সত্যিই আমার মনে হয় আমি শান্তার লাইফে সেকেন্ড পারসন, ফার্স্ট ওয়ান হল রুবি। হেন কোন কথা নাই যা সে রুবির সাথে শেয়ার করতো না, ইভেন এমন অনেক কিছু ছিল যা আমি জানতাম না কিন্তু রুবি জানতো।
‘কখন?’ আমি ওকে আমার কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
‘গত বুধবার... রাত বারোটার দিকে...’ অনেকটা জোর করে নিজেকে সামলে নিয়ে শান্তা উত্তর দিল। আজ সোমবার, মানে পাঁচদিন হল রুবি মারা গেছে।
‘তুমি কখন জানলে?’
‘আজ দুপুরে। রুবির মামা ফোন করে আমায় জানালেন। উনারা নাকি আমার মোবাইলে অনেকবার ট্রাই করেছে, কিন্তু পায় নাই। পাবে কীভাবে... মরার মোবাইলতো এই সময়েই নষ্ট হয়ে পড়ে ছিল...’ বলে চিৎকার দিয়ে শান্তা কাঁদতে লাগলো। আমি কি বলে সান্তনা দিবো ওকে ভেবে পাচ্ছি না, এরকম সিচুয়েশনে নিজেকে খুব অসহায় লাগে।
‘জানো শাহেদ... রুবি মারা যাওয়ার আগে আমায় খুব দেখতে চাচ্ছিলো... বারবার নাকি ওর মাকে জিজ্ঞাসা করেছে আমার কথা... আর আমি ওর লাশটা পর্যন্ত দেখতে পারলাম না...’ কাঁদতে কাঁদতে শান্তা আমায় জড়িয়ে ধরে কথাগুলো বলতে লাগলো। আমি তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিলাম পরম মমতায় আমার বুকে টেনে নিলাম।
‘জানো শাহেদ, ছোট্টবেলা থেকে রুবি আমার সব দুঃখকষ্ট’র সময় পাশে ছিল, আর তার শেষ সময়ে আমি তার পাশে থাকতে পারলাম না। বাসায় যখন আব্বু আমাকে মারধর করতো, রুবি বলতো তুই আমার বাসায় চলে আয়। আমার খাটে একসাথে ঘুমুবি, আমার খাবার ভাগ করে দুজনে খাবো...’ গাল বেয়ে উষ্ণ অশ্রুর ফোঁটা আমার হাতে পড়ল।
‘আমার বিয়ের আগ দিয়ে, খুব খারাপ সময় ছিল আমার জীবনের, তুমি জানো ও প্রায় একমাস আমার সাথে ছিল তখন। আমি ঐ সময়টায় খুব ভেঙ্গে পড়েছিলাম। দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করি, রুবি আমায় দুবার’ই ধরে ফেলে। ও সবসময় বলতো, আমি আছি তোর জন্য। পৃথিবীতে যখন কোথাও যাওয়ার জায়গা পাবি না, তুই আমার কাছে চলে আসবি। পরক্ষনেই বলতো, ‘না...না... শুধু একটা ফোন দিবি, আমি গিয়ে তোকে নিয়ে আসবো।'......’
শান্তার যেন কথা বলার ভূত চেপেছে, ও অনবরত বলে যাচ্ছে, আমি মনোযোগ দিয়ে শুনছি।
‘জানো ভালো মানুষগুলোর সাথেই কেন জানি সবসময় খারাপ হয়। নাহলে কেন, এঙ্গেজমেণ্টের তিন মাসের মাথায় ওর ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়বে? আর আগামী মাসের শেষ সপ্তাহে ডেট ছিল ওদের বিয়ের। কিন্তু হল কি? রুবি হারিয়ে গেল চিরতরে...’ আমায় জড়িয়ে ধরে আবার কাঁদতে লাগলো শান্তা।
‘শেষ যখন ওকে দেখতে গেলাম, তুমিওতো গিয়েছিলে, মনে নেই? সেবার ও খুব মন খারাপ করে বলেছিল, ‘যত তাড়াতাড়ি মরে যাবো, ততই ভালো হবে রে’। কেমো যখন দিতো, ওর খুব কষ্ট হত, অসহ্য কষ্ট। আরও খারাপ লেগেছিল একটা কথা শুনে... তোমাকে বলা হয় নাই। ওর হবু হাসবেন্ড নাকি ফোন করে ওকে অনেক খারাপ খারাপ কথা বলেছে। বলেছে, ওর ফ্যামিলি নাকি জেনেশুনে একটা ক্যান্সারের রোগী মেয়ের সাথে তার এঙ্গেজমেণ্ট করে তড়িঘড়ি করে বিয়ে দিতে চেয়েছিল... বল শাহেদ, মানুষ এতো নিষ্ঠুর হয় কীভাবে? তাও রুবির মত কোমল মনের মানুষের সাথে...’ আমি নির্বাক, নিশ্চুপ হয়ে শান্তার পাশে বসে থাকি। কান্নার দমকে ওর শরীরের প্রতিটি কম্পন আমায় ছুঁয়ে যায়। কখন আমার চোখ বেয়ে অশ্রু ধারা নেমে এসেছে আমি টের পাইনি। হঠাৎ শান্তার কথায় নড়ে বসলাম।
‘বুঝলে শাহেদ, আমি একা হয়ে গেলাম, খুব একা। রুবি সবসময় বলতো, ‘আমি আছি না তোর জন্য...’। আর আজ ও আমায় একা ফেলে চলে গেল। রুবি... রুবিরে... এভাবে চলে যেতে নেই...’।
আমার ঘরের চার দেয়াল ভেদ করে অনন্ত মহাশূন্যে যেন একটি কথাই প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো, হৃদয়ের গহীন কোন হতে আকাশের ঐ অসীম শূন্যতায় একটাই কথা ভেসে বেড়াতে লাগলো... ‘এভাবে চলে যেতে নেই’।
(একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত। রুবি (ছদ্ম নাম) মেয়েটি গত রমজানের প্রথম সপ্তাহে মারা যায়। সে যেদিন মারা যায়, সেদিন সে রোযা রেখেছিল, ইফতার করা অবস্থায় সে মারা যায়। আল্লাহ্ তাকে বেহেশত নসীব করুন। )
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন