সমাজে সুশাসন নিশ্চিত করে যে আইন, তার দরোজায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিল এক দ্বাররক্ষী। একদিন, গ্রাম্য এক লোক, সেই দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় এবং আইনের রাজ্যে প্রবেশের অনুমতি চায়। কিন্তু দ্বাররক্ষী তাকে এককথায় জানিয়ে দেয়, এই মুহূর্তে তাকে প্রবেশাধিকার দেয়া যাবে না। গ্রাম থেকে আসা লোকটি খানিকক্ষণ চিন্তাভাবনা করে এবং পুনরায় জানতে চায়, সে যদি এই দরজার সম্মুখে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, তবে তাকে পড়ে ঢুকতে দেয়া হতে পারে কিনা। “হয়তো সম্ভব” দ্বাররক্ষক জবাব দেয়, “কিন্তু এখন নয়”।
যেহেতু আইনের দরোজা সবসময় খোলাই থাকে, এবং দ্বাররক্ষকও গেটের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে পাহারার কাজটা করে, গ্রাম্য লোকটি অন্যপ্রান্ত দিয়ে উঁকিঝুকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে যে আইনের রাজ্যের ভেতরটা ঠিক কেমন। এই কাণ্ড দেখে দ্বাররক্ষক অট্টহাসি দিয়ে ওঠে। বলে- “ এতই যদি তোমার স্পৃহা, আইনের শাসন কেমন হয় তা দেখবার, জানাবার, তবে আমার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নাহয় জোর খাটিয়েই একবার ঢুকে দেখার চেষ্টা করো এই দরোজা দিয়ে। কিন্তু মনে রেখো, আমি প্রচণ্ড শক্তিশালী। শুধু তাই নয়, আইনের রাজ্য প্রবেশের পথে দরোজা সর্বমোট তিনটি। তাতে রয়েছে আমিসহ মোট তিনজন রক্ষী। আর তাদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে কম শক্তিসম্পন্ন। চূড়ান্ত, অর্থাৎ তিননম্বর গেইটে যে দ্বাররক্ষী, সে এতটাই ভয়াবহ যে আমিও তাকে একনজর দেখলে পুরো শিউরে উঠি!”
গ্রাম্য লোকটি সব শুনেটুনে একদম হতাশ হয়ে পড়ে। জনসাধারণের জন্যে সুশাসন বয়ে নিয়ে আসার যে অঙ্গীকার করেছিল সে। তার ধারণা ছিল মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার জন্যে যে আইন, তাতে সকলের সহজ অধিগম্যতা থাকবে, এই আশায় বুক বেঁধে সে গ্রাম থেকে এত দুরের পথ পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছিল। এখন তো এখানকার কাণ্ডকারখানা দেখে সে একদম থ হয়ে গেছে! তার মনে বিদ্রোহের বীজ দানা বাঁধলেও সে বিশালবপু প্রহরী, তার ভীষনাকায় ফারকোট, লম্বা-বিদঘুটে নাক আর তাতারদের মত দাঁড়ি দেখে সে আর কিছু করে ওঠার সাহস পায় না। বরং আইনের দরোজায় প্রবেশাধিকার প্রাপ্তির আশায় অপেক্ষা করাটাকেই ভালো একটা সমাধান মনে করে গ্যাঁট হয়ে বোচকা বুচকি নিয়ে বসে পড়ে দরোজার সামনে।
দ্বাররক্ষী অত্যন্ত সহানুভূতিশীলের মত তাকে বসার জন্যে একখানা টুল এনে দেয়। সেখানে লোকটি বসে অপেক্ষা করতে থাকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। এখানে বসেই সে বার বার অনুনয় করে দ্বাররক্ষীর কাছে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চায়। সে নিষ্ঠুর দ্বাররক্ষীকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে সে কত দূর থেকে এসেছে এবং আইনের শাসনের পরিচয় পাওয়াটা তার জন্যে কত জরুরী।
অপরপক্ষে দ্বাররক্ষক কখনো সখনো তার সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলে, গ্রামে তার ফেলে আসা পরিবারের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়, কিন্তু দরোজা পার করে ভেতরে কিভাবে যাওয়া যাবে , এই ব্যাপারে কিছু বলতে রাজি হয় না সে। এও বলে না যে কখন লোকটির সময় আসবে আইনের রাজ্যে প্রবেশের।
গ্রাম্য লোকটি দূরপথের যাত্রার জন্যে সঙ্গে করে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যা এনেছিল, তার সবই একে একে উপঢৌকন হিসেবে দেয়া শুরু করে দ্বাররক্ষীকে। দ্বাররক্ষীও হাসিমুখে সব উপঢৌকন গ্রহণ করে আর বলে- “আমি তোমার উপহারগুলো এজন্যে নিচ্ছি, যাতে তোমার মনে এই দুঃখ না থাকে যে হয়তো তুমি ঠিকমত চেষ্টা করো নি ভেতরে যাবার জন্যে”।
যাই হোক, গ্রাম্য লোকটি সুদীর্ঘকাল ধরে দ্বাররক্ষীর এই সব পিঠ চাপড়ানো কথাবার্তা শোনে আর তাকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। এই দরজা পেরুলে যে আরও দুটো দরজা আছে, তার প্রতিটিতে যমদূতের মত আরও দুজন দ্বাররক্ষী আছে, সে এসব কথা ভুলেই যায় একদম। সে খালি সুশাসন আর তার মধ্যে দেয়াল তৈরি করে রাখা এই প্রথম দ্বাররক্ষীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
প্রথম কিছু দিন সে চিৎকার চেঁচামেচি করে নিজের ভাগ্যকে দোষ দিত। পরবর্তীতে সে চুপচাপ হয়ে যায় এবং আপন মনেই গজগজ করতো কেবল। দিনকে দিন তার আচরণ আরও শিশুসুলভ হয়ে যায়। দ্বাররক্ষীকে ঘিরে যে মাছিগুলো মাঝে মাঝে ভনভন করে ওড়ে, সে সেই মাছিগুলোর কাছেও করজোড়ে মিনতি করে তাকে প্রবেশাধিকার দেয়ার জন্যে। এভাবে ধীরে ধীরে সে তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলতে থাকে। সে বুঝে উঠতে পারে না, পুরো পৃথিবীই কি আস্তে আস্তে আঁধারে ছেয়ে যাচ্ছে না সবই আসলে তার চোখের ধোঁকা! তবুও, এই ক্ষীণদৃষ্টিতে আঁধারঘেরা পৃথিবীর যতটুকু সে দেখতে পায়, তা দিয়েই সে উপলব্ধি করে, সুশাসনের দরোজা দিয়ে অদ্ভুত এক সোনারঙা আলোর বিচ্ছুরণ হচ্ছে। তার যন্ত্রণা আরও বৃদ্ধি পায়।
লোকটি অনুভব করে , পৃথিবীতে তার দিন ফুরিয়ে এসেছে। মৃত্যুর আগে, সে তার অপেক্ষার দিনগুলোর সকল সঞ্চিত অভিজ্ঞতা একত্র করে একটা নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর খোঁজে, কিন্তু পায় না। সে দ্বাররক্ষীকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকে এবং কম্পিত কণ্ঠে প্রশ্নটা করে- “একটা জিনিসের উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না- পৃথিবীতে সুশাসনের প্রয়োজন সবার, আইনের অপর অধিকারও সকলের। আইনের শাসন চাই, সুশাসন চাই – স্লোগানে স্লোগানে তো সবাই রাস্তা গরম করে রাখে, কিন্তু যে দীর্ঘদিন ধরে আমি এখানে অপেক্ষা করলাম, এর মধ্যে আইনের অধিকারের দাবী নিয়ে কেউ আর তোমার দরোজায় এলো না কেন বলতো?”
দ্বাররক্ষী, যে এতক্ষন মৃত্যুপথযাত্রী গ্রাম্য লোকটির অস্পষ্ট কথাগুলো শোনার জন্যে তার খুব কাছাকাছি ঝুঁকে ছিল, সে বুঝতে পারে লোকটির সময় শেষ হয়ে এসেছে। দ্বাররক্ষী, শ্বাপদের মত হিসহিসিয়ে তার কানের কাছে মুখ এনে বলে-“ বেকুব, কেউ কখনো এই দরোজায় আসেনি, কারন এই দরোজা দিয়ে প্রবেশ করে পৃথিবীর বুকে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব তোমার কাঁধেই ছিল। তুমি সে সাহসটুকু দেখাও নি, তুমি তোমার কর্তব্য পালন না করেই মারা যাচ্ছ। তোমার মৃত্যুর পর এই দরোজা চিরদিনের জন্যে বন্ধ হয়ে যাবে।”
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন