|
অক্টোপাস পল
|
|
রহস্য গল্পঃ মানিক
17 August 2014, Sunday
বুকভরে পুরনো বইয়ের গন্ধ নিতে আমি ভালোবাসি। আঙ্গুলের সযত্ন স্পর্শে যখন এক একটি পৃষ্ঠা উল্টাই তখন নিয়ম করে গন্ধ নেই প্রতিবার। বইয়ের পাতায় না জানি কত স্মৃতি লেপ্টে থাকে। পাতায় পাতায় লেগে থাকে কত অনুভূতি। কখনো কখনো প্রকাশিত হলেও বেশীর ভাগ সময় তা থাকে অব্যক্ত। যেমন মেয়েদের বইয়ের ক্ষেত্রে হয়। উপন্যাসের দুঃখী অংশটায় তাদের শুকিয়ে যাওয়া অশ্রু খুঁজে পেতে জহুরি হতে হয় না। একটু সতর্ক হয়ে ঝাপসা অক্ষরগুলোয় চোখ বোলালেই চলে। কপাল মন্দ না হলে নাক ডুবিয়ে নেয়া যায় তার অশ্রুর গন্ধ। এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা সেটি। অশ্রুর গন্ধ শুঁকে কখনো কখনো অজ্ঞাত কারো প্রেমেও পড়ে গিয়েছি আমি। পুরনো বইয়ে অধিকাংশ সময় নাম লেখা থাকলেও ঠিকানা থাকেনা। এজন্য আমার অশ্রুগন্ধী অনেক প্রেম আকস্মিক পুষ্পের মতো প্রস্ফুটিত হতে পারেনি। এ বোধহয় পুরনো বইয়ে পাওয়া অনেক আনন্দের মাঝে কাঁটা হয়ে ফুটে থাকা একমাত্র আক্ষেপ।
শহীদ জররেজ মার্কেটের যে দোকানটায় আমি আছি তাতে আলো অপ্রতুল। চল্লিশ ওয়াটের টিমটিমে হলদে বাতিতে দোকানের মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য বইয়ের স্তুপ এলোমেলো করতে গিয়ে আমাকে আক্ষরিক অর্থেই গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো যুক্ত হয়েছে গায়ক মশার দল। সিটি কর্পোরেশনের ঠিক উল্টো দিকের মার্কেটে মশককুলের এমন স্বনির্মিত অভয়ারণ্য সত্যিই দেখার মতো বিষয়। মশাদের তাড়াতে গিয়ে একটা পাতলা মতো বই খুঁজে পাই আমি। বইটার সামনের প্রচ্ছদ নেই। সাজসজ্জাতেও মফস্বলের পরিচিত গন্ধ। প্রথম পাতায় সম্ভবত তেলের শিশি উল্টে গিয়েছিল। সে ছাপ অমলিন। বইটা নেড়ে চেড়ে দেখে বুঝলাম মফস্বলের কয়েকজন গল্পকার নিজস্ব উদ্যোগে বইটা প্রকাশ করেছেন। সম্পাদক হবিবর রহমান বিএসসি। প্রকাশনীর নাম ঠিকানা কিচ্ছু নেই। পাতা উল্টোতে উল্টোতে দেখি সম্পাদক সাহেব নিজেকে হাতিবান্ধা ডিগ্রি কলেজের “প্রোফেসর” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর গল্পের নাম “ক্লাসের ফাঁকে প্রেম”।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যথেষ্টই অবাক হয়েছি আমি। মফস্বলের কবিরা সাধারণত একজোট হয়ে কবিতার বই প্রকাশ করেন বলে জানতাম। তাঁরা এসব বই স্থানীয় সাংবাদিক, সরকারি কর্মকর্তা ও কলেজ-স্কুলের হেডস্যারদের বিনামূল্যে বিতরণ করেন। হাটে বাজারে কেউ তাদের কবি বলে ডাকলে আহ্লাদে আটখানা হন। কবি যশপ্রার্থীরা মফস্বলে নিয়মিত মুখ হলেও গল্পকারদের খুব একটা দেখা যায় না। এজন্য স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোর সাহিত্যপাতায় প্লাগারিজমের ছড়াছড়ি দেখা যায়। বিভাগীয় সম্পাদক বুঝেও না বোঝার ভাব করেন। পত্রিকার পাতা ভরাতে হবে তো! কৌতুহল থেকেই নামেমাত্র মূল্যে বইটা বগলদাবা করে বাসায় ফিরি আমি।
বাসায় ফিরে বইটা শুঁকে দেখি। পাতায় পাতায় সেই চেনা পুরনো গন্ধ। কার না কার ছিল বইটা! আটজন গল্পকারের মোটে আটটা গল্প সংকলিত হয়েছে এতে। পৃষ্ঠা সংখ্যা ঊনষাট। মূলত হবিবর রহমান বিএসএসির উদ্যোগে বইটি প্রকাশিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কলেবরের গল্পটাও তাঁর লেখা। একজন বিদগ্ধ পাঠক না হয়েও ঠিক বুঝতে পারছিলাম গল্পগুলো ঠিক গল্প হয়ে ওঠেনি। বড়োজোর গদ্য হয়েছে। খুবই দুর্বল বাক্যগঠন ও বানান ভুলের বাহারে কয়েকটা গদ্যরীতিমত বিরক্তিকর। লেখকদের কয়েকজন সম্ভবত রবীন্দ্র-শরৎ যুগের পরের কোন বই পড়েননি কিংবা ইচ্ছে করে সে যুগে স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে আছেন। কেউ আবার হুমায়ূন আহমেদের ছাঁচে গল্প বানাতে গিয়ে অতি আঁচে পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে ফেলেছেন পুরো ব্যাপারটাকেই। এভাবে বিরক্তি আমাকে যখন প্রায় পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলেছে তখনই একটা অদ্ভুত গল্পে আমার দৃষ্টি আটকে গেল। গল্পটার নাম মানিক। পরিসর অতি স্বল্প। লিখেছেন পুতুল রানী রায়। গল্পের শুরুটা এমন,“সরিষার আদিগন্ত ক্ষেতের দোল খাওয়া বাতাসে শিউরে উঠলো ত্রিসীমানায় থাকা একমাত্র মৌমাছিটি। কালো-কমলার ডোরাকাটা পতঙ্গটা বুঝে গেছে মানিকের উপস্থিতি। নদীর ঘোলাটে জলে ছায়া পড়েছে মানিকের। সাবানের স্বল্প ফেনা তার কালো শরীরের ইতিউতি বিদঘুটে শিল্পকর্মের সৃষ্টি করেছে। মানিক হাসিমুখে একটা গান ধরে। বাতাসের তোড়ে সেটা যেন মৌমাছির গুনগুনের সাথে বিলকুল মিলে যায়”।
মিনিটখানেক অবাক হয়ে বসে থাকার পর আমি লেখক পরিচিতি হাতড়াই। তেমন কিছু লেখা নেই। তিনি কোন একটা প্রাইমারি স্কুলের সহকারী শিক্ষিকা। ব্যাস, এটুকুই। এদিকে বাইরের সুনসান নীরবতা ভেঙে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে। দূরে কোথাও বজ্রপাতের ম্রিয়মান আলো জানালার স্বচ্ছ উপরিভাগে ছড়ায় মোহনীয় বিচ্ছুরণ। বাতাসের দাপটে কুঁজো হওয়া বাঁশঝাড়ে অসুরের তান্ডব শুরু হয়। মেঘের গর্জনে আচমকাই ছ্যাঁত করে ওঠে বুকের ভেতর। যথারীতি বিদ্যুৎ চলে যায়। একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে আমি গল্পটা পড়তে বসি।
“মানিক আমার গ্রামের ছেলে। বয়স দশ বছর। আমার স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। তার সাথে কীসের যেন সম্পর্ক আছে মৌমাছির। মানিক হাসলে মৌমাছির মতোগুন গুন শব্দ হয় বলে ওর সহপাঠিরা প্রায় সময়ই অভিযোগ করে। মানিক তাই হাসতে ভয় পায়। গত বারের ভুট্টার মৌসুম শেষে ওর বাবা যখন বাতিল তিনটা বেয়ারিং দিয়ে তাকে আস্ত একটা গাড়ি বানিয়ে দিয়েছিলো মানিক তখনও হাসেনি। ক্লাসে কানাকানি আছে মানিকের কাছাকাছি নাকি কোন মৌমাছি আসেনা। সালাম চৌকিদারের বাড়ির পেছনের জাম গাছে চাক বেঁধেছিলো সহস্র মৌমাছি। সালাম তক্কে তক্কে ছিলো রাতে ধোঁয়া দিয়ে মধুটুকু পেড়ে নেয়ার। চাচাতো ভাইয়ের ছেলে সবুজকে নিয়ে এক সন্ধ্যায় সে মধু আহরণে গিয়ে দেখে মৌমাছির দল ঝাঁড়বংশে উধাও। গাছের নিচে মুঠো মুঠো মৌমাছি মরে আছে। আহত কিছু মৌমাছি আসন্ন মৃত্যুর অপেক্ষায় ছটফট করছে। হতভম্ব সালামের বিস্ময়ের ঘোর কাটে মানিকের প্রশ্নে। “কী বাহে সালামচা, কী করেন তোমরা?” অর্ধমৃত মৌমাছির দল তার উপস্থিতিতে সর্বশক্তিতে পালাতে চায়। মানিক নির্বিকার। যেন কিছুই হয়নি এমনভাব করে সবুজকে জিজ্ঞেস করে সে তাদের ফুটকিওয়ালা লাল মুরগীটাকে দেখেছে কী না। পলাতক মুরগীটাকে না পেলে তার মা আজ আস্ত রাখবে না। তবে কী শেয়ালে খেলো তাকে?
শান্ত স্বভাবের শিশু ছিলো বলে মানিকের মায়ের চাপা গর্ব আছে। সুস্থ শিশুর অনেক বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে অনুপস্থিত ছিলো। যেমন পাঁচ বছর বয়সে সে প্রথম কথা বলে। মুঠো থেকে তর্জনি বের করে উড়ন্ত এক পতঙ্গের দিকে তাক করে চেঁচিয়ে বলেছিল, “মৌমাছি”! আমার ছাত্র বলে মানিককে খুব ভালো করে চিনি। ছেলেটা মোটের উপর চুপচাপ। স্কুলের মাঠে তাকে খেলতে খুব কম দেখেছি। সে বরং হা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তেমন কিছু দেখতে পাইনি। বরং মানিকের গম্ভীরতা আমার কাছে বেশ লাগতো। স্নেহভরে কথা বলতাম বলে আমাকেও সে বোধহয় পছন্দ করতো। স্কুলে তার সবচেয়ে বড় শত্রু ছিলেন সম্ভবত অংকের শিক্ষক আসমত স্যার। মানিক অংকে ফেল করতো নিয়মিত। ছয়ের ঘর পর্যন্ত নামতাও মুখস্ত করতে পারেনি। আসমত স্যার অংকে দুর্বল ছাত্রদের রীতিমত অপছন্দ করেন। তার দর্শন হলো, অংকে ফেল তো জীবনেও ফেল। কামলার ছেলে গুনতে না শিখলে সারা জীবন ঠকেই যাবে। মানিক একদিন স্কুলে লুঙ্গি পরে এসেছিলো বলে আসমত স্যার তাকে মারতে মারতে প্রায় আধমরা করে ফেলেছিলেন। দপ্তরি রাজ্জাক তাকে না আটকালে হয়তো গুরুতর কিছু হয়ে যেত।
এ গ্রামে সমস্যার কোন শেষ নেই। মানুষের বিশ্বাসে ভর করে বাঁচে বলেভূত-প্রেতের দলও কিছুদিন পরপর জেঁকে বসে মনোজগতে। একদিন খবর বেরুলো মানিক গ্রামের প্রায় লুপ্ত জঙ্গলটিতে একাকী ঘুরে বেড়ায়। বাঁশ কাটতে গিয়ে হরিপদের ছেলে নিজ চোখে দেখেছে তাকে। বানরের মতো একটা জিগার গাছ আঁকড়ে ধরে তাতে কপাল ঘেঁষটে বৃত্তাকারে ঘুরছিলো মানিক! তার চুলে লেপ্টে গিয়ে চটচটে আঠাগড়িয়ে পড়ছিলো কপাল বেয়ে।সবচেয়ে ভয়ের কথা, মানিকের মাথার ওপর তখন জড়ো হয়েছিলো হাজার হাজার মৌমাছি। শীতের সন্ধ্যায় মশার দল যেভাবে মানুষকে নাছোড়বান্দার মতো অনুসরণ করে ঠিক সেভাবে। তাকে অনেকক্ষণ ডাকার পরও মানিক সাড়া দেয়নি। শেষে কাছে গিয়ে ডাকাতে সে ভীষণ বিরক্ত হয়। তার চোখের ঠান্ডা দৃষ্টিতে হরিপদের অত বড় দামড়া ছেলেটাও ভড়কে যায়। কেমন যেন ক্ষেপে ওঠে মৌমাছির দলও। শেষে সে বাঁশ না কেটেই বাড়ি ফিরে আসে। খবরটা বাতাসের বেগে গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে প্রতিবেশীদের কাছে দর্শনীয় হয়ে ওঠে মানিকের মায়ের মরাকান্না। তার ছেলেকে জীন ধরেছে বলে মহিলার বিশ্বাস। এর ওর ফিসফাসে প্রাগৈতিহাসিক ভয় ফিরে আসে ধীর পায়ে। খুব বড় একটা অপরাধ করে ফেলেছে এমন ভঙ্গিতে মানিক মাথা নিচু করে তার মায়ের কান্না দেখে। গ্রামবাসীর সভয় দৃষ্টি তাকে স্পর্শ করতে পারে না। গ্রামের মানুষ দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। অধিকাংশ মত দেয় হুজুর ডেকে এনে ঝাড়ফুঁক করার। বাকিরা সম্ভবত তুকতাকে বিশ্বাসী নয়। তারা শহরের বড় ডাক্তারের কাছে মানিককে নিয়ে যেতে বলে। সবাই কলের পুতুলের মতো মাথা নাড়ে। কে কী বলছে দেখে নিয়ে স্মৃতিতে জমিয়ে রাখে। আলোচনার একটা কিছু তো পাওয়া গেল।
একই গ্রামের মানুষ বলে ব্যাপারটা আসমত স্যারের কানেও যায়। তিনি বিজ্ঞানের ছাত্র বলে এসবকে পাত্তা দিতে চান না। মানিক সম্পর্কে অনেক অস্বাভাবিক কথা শুনে শুনে তার কান পচে গেছে।দশ বছরের একটা বাচ্চার মধ্যে অস্বাভাবিকতা আবার কী! মানুষেরও খেয়েদেয়ে কোন কাজ নেই। একটা তিল পেলে হলো, তাকে টিপেটুপে তাল না বানিয়ে ক্ষান্ত হবে না। এই ছেলেটা এইটুকু বয়সে এমন নাটক শিখে গেছে। বড় হলে নিশ্চয়ই কোন মাজার বানিয়ে খাদেম হয়ে বসবে। উঠন্তি মূলা পত্তনেই চেনা যায়। স্কুলে তাকে পাওয়া মাত্রই শায়েস্তা করার সিদ্ধান্ত নেন আসমত আলী। ছাত্রের ভালোর জন্য মারের দরকার আছে। বিশেষ করে এমন ইঁচড়ে পাকা ছাত্রকে না মার দিলে পাপের কাজ হয়ে যাবে। একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি সেটা করতে চান না।
পরের ঘটনাটা বেদনাদায়ক। মায়ের টিউমার অপারেশন বলে দপ্তরি রাজ্জাক সেদিন স্কুলে আসেনি। ফলে আসমত স্যারকে আটকানোর মত কেউ ছিল না। নির্দয় প্রহারের চোটে বেচারা মানিক হাফপ্যান্টে প্রস্রাব করে দেয়। দোষ তার তেমন কিছু ছিলো না। ঐকিক নিয়মের একটা অংকে ১০০ এর জায়গায় ১০ লিখে ফেলেছিলো। স্বাভাবিকভাবে উত্তরে হেরফের হয়। আসমত স্যার তার ভেল্কিবাজিতে আগে থেকেই তেতে ছিলেন। হাত খানেক লম্বা বেতটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেরি করেননি। মানিকের শরীরের চিমসে চামড়ায় উগড়ে দিয়েছেন সমস্ত ক্রোধ। দশ বছরের শরীর এত ধকল সইতে পারেনি। ব্যাপারটা প্রধান শিক্ষক জানতে পারলে খুব বিরক্ত হন। তার ভয় সাংবাদিকদের। তাদের শিক্ষক সমিতির এক নেতা ফেঁসে গিয়েছিল এক ছাত্রীকে মেরে। পত্রিকায় খবর বেরিয়ে সে কি এক কেলেংকারি। শেষ পর্যন্ত থানা পুলিশের হাঙ্গামা। আসমত আলীকে তিনি এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেন। এই মোবাইল ফোনের যুগে অজ পাড়াগাঁ বলে কিচ্ছু নেই। ইন্টারনেটের জমানায় অভাব নাই সাংবাদিকেরও।
আসমত আলী ভাবতে পারেননি মারটা এত জোরালো হয়ে যাবে। মানিককে ইচ্ছে মতো পেটানোর সময় তার জীবনের সব তিক্ত স্মৃতিগুলো কেন যেন ভেসে উঠছিলো একের পর এক। তিনি পড়তে চেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে। শেষ পর্যন্ত গণিতে অনার্স পাশ করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আজীবন যাকে জীবনসঙ্গী বানানোর কল্পনা করে এসেছেন সে মালা দিয়েছে তার ঘনিষ্টতম বন্ধুর গলায়। নাক ডাকা লোকদের তিনি একদম দেখতে পারেন না। বাসর রাতে তিনি আবিষ্কার করলেন বাঁশির মতো চিকন সুরে নাক ডাকছে তার নবপরিণীতা স্ত্রী। এমন সব বিড়ম্বনা সম্ভবত তার ছাইচাপা সকল ক্রোধকে জাগিয়ে তুলেছে। আসমত আলী অনুতপ্ত হন।
আজ হাটের দিন। ধানের একটা ছোটখাটো স্টক বিজনেস আছে তার। হাটে গিয়ে ভালো দাম পেলে জমানো ধানটুকু বিক্রি করার ইচ্ছে আছে। স্কুল মাস্টারি করে আর কত পাওয়া যায়? একটা সংসার ভালোভাবে চালানোর জন্য তা বড়ো অপ্রতুল।
হাট থেকে ফিরতে আজ দেরি হয়ে যায় আসমত আলীর। রাত দশটার মতো বাজে। চমৎকার চন্দ্রালোকিত একটা রাত। তার মেজাজ বেশ ফুরফুরে। বেশ ভালো দামে ধানটুকু বিক্রি হয়েছে। শ্বশুর বাড়ি থেকে আর কিছু পাওয়া গেলে একটা মোটর সাইকেল কিনে ফেলবেন তিনি। এখনকার মতো আর সাইকেলে চড়তে হবে না। গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। আফানউল্লাহ সুরকারের বাড়িটা পেরিয়ে এগুলে একটা বিল পরে। বর্ষায় সেখানে ভালোই মাছের সমাগম ঘটলেও বাকিটা সময় তেমন কিছু পাওয়া যায় না। চলতে চলতে সামনে তাকিয়ে তিনি হঠাৎ সর্বশক্তিতে সাইকেলের ব্রেক কষেন। চাঁদের আলোয় সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। তবু যেন বিশ্বাস হয়না। আসমত আলীকে গ্রাস করে বিহ্বলতা। তিনি প্রচন্ড ভয় পেয়েছেন। আকস্মিক উত্তেজনায় তার গায়ের সমস্ত লোম শরশর করে দাঁড়িয়ে যায়। নিশিতে পাওয়া লোকের মতো তিনি চলৎশক্তিহীন হয়ে যান। শেষ পর্যন্ত শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে তিনি পানিতে ঝাঁপ দেন। দক্ষ সাঁতারু তিনি। অনায়াসে মিনিট কয়েক ডুবেও থাকতে পারেন। সেই তিনি টুপ করে জলের অতলে হারিয়ে যান। ভেসে ওঠার কথাও যেন ভুলে যান। রাস্তার একপাশে সশব্দে গড়িয়ে পড়ে তার হিরো রয়েল সাইকেল। জলের উপরিভাগে কিছু বুদবুদের আলোড়নে বিশ্ব চরাচরে মিলিয়ে যায় তার শেষ নিঃশ্বাস।
ঘুমের ঘোরে মায়ের কাছে সরে আসে মানিক। আজ তার স্বপ্নে মৌমাছি এসেছিলো। কালো মেঘের মতো সহস্র মৌমাছি বোঁ বোঁ করে উড়েছে তাকে ঘিরে। মানিক অস্ফুটে হেসে ওঠে। বাতাসে রেখাপাত করে তার গুনগুনে ধ্বনি।” আমি বইটা বন্ধ করি।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
The pushraces I make are entirely based on these articles.
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন