|
অপু তানভীর
|
|
মেয়েটির গায়ের রং কালো
15 August 2014, Friday
এক
-কাকে চাই ?
-এটা নুশরাতদের বাসা না ?
ভদ্রমহিলা কিছুটা সময় আমার চেহারার দিকে তাকিয়ের রইলো । আমার মনে ক্ষীণ একটা সন্দেহ জাগলো যে হয় তো এখনই উনি বলবে এখানে নুশরাত নামে কেউ থাকে না । কিন্তু উনি বলল
-তুমি কে ?
-আ..... মানে আমি নুশরাতের সাথে পড়ি । ওর বন্ধু !
-নুশরাতের বন্ধু ?
-জি ?
ভদ্রমহিলার চোখের দৃষ্টি যেন আরও একটু তীক্ষ হল । আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকিয়ে ভদ্রমহিলা বলল
-কি নাম তোমার ?
-আবীর !
-আবীর ? তোমার নাম তো নুশরাতের মুখে শুনি নাই কোন দিন !
যাক এটাই তাহলে নুশরাতের বাসা । নিশ্চিন্ত হয়ে ভাল লাগছে । না হলে আবার ওর ঠিকানা খুজে বের করা !
আমি একটু অপ্রস্তুত হওয়ার হাসি দিলাম । এমন একটা ভাব যে নুশরাত আমার কথা বাসায় বলে নি এটাতে আমি নিজে খুব অপ্রস্তুত হয়েছি ।
ভদ্রমহিলা বলল
-আমি নুশরাতের মা !
-ও স্লামুয়ালাইকুম আন্টি !
-ওয়ালাইকুমাস্লালাম ।
আমার আবারও মন হল ইনি মনে হয় আমাকে এখানে দাড় করিয়েই নুশরাত কে ডাক দিবে । অথবা বলবে এখন দেখা হবে না । তুমি চলে যাও ! ঘরের ভিতর ঢুকতেই দিবে না । কিন্তু যদি ঘরে না ঢুকতে না দেয় তাহলে তো যে কাজে সেটা হবেই না ।
এবারও আমার ধারনা ভুল প্রমানিত করে দিয়ে আন্টি বলল
-আচ্ছা ভিতর আসো । নুশরাত এখনও শুয়ে আছে । কদিন থেকে কি জানি হয়েছে । কোথায় যায় না, সারা দিন শুয়ে থাকে ঘরের ।
আমি কোন কথা না বলে ঘরের ভিতর ঘুকলাম । নুশরাত কেন যে সারা দিন মন খারাপ করে ঘরের ভিতর শুয়ে থাকে সেইটা আমি ভাল করেই জানি । আজকে ওর বাসায় আসার কারনও মূলত এটাই !
-তুমি শোফায় বস ! আমি ওকে ডাকছি !
আসলে কিছু কিছু বিষয়ে কখনও ইয়ার্কি কিংবা রশিকতা করতে নেই । কিন্তু আমি ঠিক এমন কিছুই করেছি নুশরাতের সাথে ।
নুশরাতের গায়ের রং একটু ময়লা । সুন্দরী বলতে যা বোঝায় সে সেইটা মোটেই না । স্বাধারন একটা মেয়ে সে । খুব বেশি সাধারন । যে মেয়েকে কোন ছেলে কোন দিন প্রেমের জন্য প্রপোপজ করে না, তাকে নিয়ে কোন কবি কবিতা লিখে না কোন গল্পের নায়িকাও সে হবে না কোন দিন ।
একটা ব্যাপার লক্ষ্য করতাম যে ক্লাসের কাপলরা যখন এক সাথে গল্প করতো নুশরাত তখন সে তখন অদ্ভুদ বিষন্ন চোখে সেদিকে তাকাতো । মাঝে মাঝে আমার সাথে চোখা চোখি হলে অদ্ভুদ চোখে তাকাতো !
একদিন এটা নিয়েই একটা মজা করার চিন্তা করলাম । আমরা নুশরাতের নাম্বারে ফোন করে ওর সাথে কথা বলা শুরু করলাম । প্রথমে রাজি না পরে একটা সময় ও ঠিকই কথা বলতে শুরু করলাম । বিভিন্ন সময়ে ওর সাথে ও আজকে কি পরে এসেছে ওকে কেমন লাগছে এসব বলতাম ।
ও নিশ্চিত বুঝতে পেরেছিল যে ক্লাসেরই কেউ ওর সাথে কথা বলতে এবং মনে মনে হয় তো সে খুশিও হত কিছুটা ।
আমি প্রথমে এটা টাইম পাশ হিসাবেই নিয়েছিলাম । বন্ধুদের সাথে আড্ডার টপিকও ছিল এটা । এভাবে চলল কিছু দিন । এদিকে নুশরাতের সাথে সম্পর্ক খুব ভাল হয়ে গেল আস্তে আস্তে । নুশরাত তখনও জানে না আমি কে । ক্লাস চলে আমি ওকে অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ পাঠাই । ও পড়ে হাসে । মাঝে মাঝে লজ্জা পায় !
এটা নিয়ে আমরা হাসা হাসি করি !
এভাবেই চলছিল ভালই । কিন্তু একদিন নুশরাত আমাদের ফান নিয়ে জেনে গেল । আমার সামনে এসে হাজির । ঐদিন ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি সেখানে একরাশ অভিমান জল আকারে জমে আছে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আমার গায়ের রং কালো বলে কি আমি খুব সস্তা হয়ে গেছি ? আমার ইমোশনের কোন দাম নেই ?
বলতে বলতেই ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো ! আমি কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর কাজল দেওয়া চোখের দিকে । আমার দিকে কি তীব্র অভিমান নিয়ে মেয়ে টা তাকিয়ে ছিল ! নিজেকে এটোটা নিচ আমার আর কোন দিন মনে হয় নি । মনে হচ্ছিল মাটির সাথে মিশে যাই । বারবার মনে হচ্ছিল
এরকম একটা কাজ আমি কিভাবে করলাম ?
কিভাবে করলাম ?
ভেবেছিলাম ওখানেই সব শেষ হবে । কিন্তু শেষ হল ন । বাসায় আসার পর কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না । বারবার নুশরাতের ঐ চোখটা আমার সামনে ভাসছিল । এই অভিমান ভরা চোখ ! ঐ দিন সারা রাত আমাকে ঐ ঘুমাতে দিল না ।
নুশরাত আসলো আরও মিনিট পনেরো পরে । আমার দিকে তাকিয়ে রইলো । নুশরাতের আম্মা আমাদের বসিয়ে রেখে চলে গেল রান্না ঘরের দিকে চা আনতে ।
নুশরাত আমার দিকে না তাকিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো মুখ অন্ধকার করে ।
দুই
-কে এসেছে ?
-তোর একটা বন্ধু ? দেখতে শুনতে তো ভালই । তোর সাথে পড়ে বলল !
আমি একটু অবাক না হয়ে পারলাম না । কে আসতে পারে ? আমার বাসায় তো কারো আসার কথা না । ক্লাসে কোন ছেলের সাথে তো আমার এমন কোন সম্পর্ক নেই যে একেবারে বাসায় চলে আসবে !
ঠিক তখনই আমার বুকের ভেতর একটা অন্য রকম অনুভুতি হল । আবীর কি এসছে ?
নাহ !
ও আসবে কেন ? আর আসলেই আমি ওর সাথে কেন কথা বল ! যে ছেলে টা আমার অনুভূতি নিয়ে খেলা করতে পারে তার সাথে কোন কথা নেই । কোন কথা থাকতে পারে না ।
আরও কয়েক মিনিট সিদ্ধান্ত নিলাম দেখা করতে যাবো কি না, নামি মাকে না করে দিতে বলবো ! শেষে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিলাম । তবে বারবারই মনে হচ্ছে যেন আবীরই এসেছে ।
কেন আসবে ?
কেন ?
মা বলল
-নাম তো বলল আবীর না কি যেন ?
-কি ?
আমার বুকের ভেতর আবার সেই অনুভুতি শুরু হয়ে গেল ! আমি অসহায়ের মত এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম ! গত কয়েকটা দিনে ছেলেটা আমার মনের ভিতর এমন ভাবে ঢুকে গেছে যে কিছুতেই ওকে বের করতে পারছি না । এমন কেন হচ্ছে ।
রুমে ঢুকেই দেখি আবীর বসে আছে । এদিক ওদিক দেখছে । আমাকে দেখে একটু হাসলো । আমার আবারও বুকটার ভিতর ধক করে উঠলো ! এই ছেলেটা এমন করে কেন হাসে ?
কেন এভাবে হাসে ?
মা পাশেই ছিল । আমাকে বলল
-তোরা কিছু খাবি ?
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই আবীর বলে উঠলো
-আন্টি চা হলেই চলবে ! যদি সমস্যা না হয় ।
-না, সমস্যা কেন হবে !
আমার মুখ থেকে আপনা আপনিই বের হয়ে গেল
-চায়ে চিনি বেশি করে দিও । ও চিনি বেশি খায় !
বলেই মনে হল কেন বললাম কথাটা ! আবীরের দিকে তাকিয়ে দেখি ও অদ্ভুদ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । চোখ দিয়ে হাসছে !
মা রান্না ঘরের দিকে চলে গেল । আমি ওর সামনে একা একা দাড়িয়ে রইলাম ।
-কই বসবা না ?
-কেন এসেছো তুমি ?
একটু কঠিন কন্ঠেই বললাম
আবীর সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ না করেই বলল
-তোমাদের বাসাটা তো অনেক সুন্দর !
-কেন এসেছো ?
-আসতে পারি না ?
-না । পারো না !
-চলে যেতে বলছো ?
-হুম ! এখনই চলে যাও !
-চা টা খেয়ে যাও ? আন্টি কষ্ট পাবে । তুমিও কষ্ট পাবে আমি যদি চলে যাই !
এই কথা বলে আবীর আবার হাসলো !
ছেলেটা এবাকে কেন কথা বলে ! একেবারে চোখের দিকে তাকিয়ে । বুকের ভেতর টা কেমন করে ওঠে !
হুম ! ছেলেটা কে সেই প্রথম দিন থেকেই আমি পছন্দ করি অথচ কোন দিন বলতে সাহস করি নি । কত মেয়ে সাথে ওকে কথা বলতে দেখতাম । খুব বেশি খারাপ লাগতো কিন্তু কোন দিন কিছু বলতে পারি নি । কিভাবে বলবো ? আমি তো আর দেখতে সুন্দর না ! দেখতে কালো ! আমার মাঝে কোন সৌন্দর্য নাই । আমার মত অসুন্দর মানুষের কাউকে ভালবাসতে নেই । তবুও আবীরকে মনে মনে কি পছন্দই না করতাম ! ভালবাসতাম !
কিন্তু সেদিন ওর ফোন আসলো আমার মোবাইলে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম । যদিও প্রথমে ও নিজের পরিচয় দিতো না তবুও আমি টের পেয়েছিলাম ও কে !
কি যে ভাল লাগতো ওর সাথে কথা বলতে । মন হত সারা টা দিন সারাটা রাত ওর সাথে কথা বলি !
কিন্তূ একদিন যেন সব কিছু অন্য রকম হয়ে গেল । পুরো পৃথিবীটা একেবারে ভেঙ্গে গেলো নিমিষেই । আসলে আমি নিজেই ছিলাম বোকা । আবীরের মত একটা সুদর্শন ছেলে আমার সাথে এমনি এমনি তো আর কথা বলতে পারে না । এর ভিতর তো অন্য কিছু থাকতে বাধ্য । আমাকে সবার সামনে ছোট করারই ছিল ওর আর ওদের উদ্দেশ্য ! আমাকে হাসির পাত্রে পরিনত করা ছিল ওদের প্লান ।
খুব ইচ্ছে ছিল আবীর কে খুব কঠিন কিছু করা বলি সেদিন কিন্তু প্রথম বারের মত ওর সামনে গিয়ে নিজেকে কিছুতেই নিজেকে ধরে রাখতে পারি নি । কিভাবে যে চোখের পানি বেরিয়ে এল জানি না !
সুন্দর মেয়েদের কান্নাতে অনেকে বিচলিত হয় কালো মেয়েদের কান্নাতে মানুষ কৌতুক বোধ করে ! জানি না অবীর কৌতুক বোধ করেছিল কি না !
আমি আবার বললাম
-তুমি কেন এসেছো বল ?
-আরে বাবা এমন শক্ত করে কেন কথা কেন বলছো ?
-আবীর আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই না । তুমি চলে যাও !
আবীর অন্য দিকে কিছুটা সময় তাকিয়ে থেকে আমার দিকে তাকালো । সেই গভীর চোখে ! তারপর বলল
-মানুষ ভুল করলে একটা সুযোগ দেওয়া উচিৎ । তাই না ? আমি কি একটা সুযোগও পাবো না ?
আমি কি বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না ! খুব ইচ্ছে হল আবীরের কথা বিশ্বাস করতে ! কিন্তু ....
আবীর বল
-আমি গত কয়েক দিন একটুও ঘুমাতে পারি নি । তোমাকে ফোন দেব সেই উপায়ও তুমি রাখো নি । বারবার মনে হচ্ছিল যে কিছু একটা আমার কাছে থেকে হারিয়ে গেছে । প্রতিদিন সকালেই সেই ঘুম ভাঙ্গানী কন্ঠটা আমি আর শুনতে পাবো না !
আমি লক্ষ্য করলাম আমা রচোখে পানি জমতে শুরু করেছে । কেন জমতে শুরু করেছে ? কেন সেই কথা গুলো মনে পড়ছে ? আমি মনে করতে চাই না ! আবার কষ্ট পেতে চাই না !
আবীর বলল
-আমি......
-তুমি ?
তারপর আবীর নিজের মোবাইল থেকে কি যেন করলো ।
এর ভিতর মা চা নিয়ে এল । চা খেতে আবীর খুব স্বভাবিক ভাবেই মায়ের সাথে কথা বলতে লাগলো । আমি নিজের ঘরের চলে এলাম । আমার বারবার কান্না আসছিল । মায়ের সামনে চোখে পানি এলে বিব্রত হতে হত তাই নিজের রুমে এসে কয়েকবার চোখ মেললাম !
অবাক হয়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম যে আমার কেন জানি খুব আনন্দ লাগছে । কেন লাগছে । এতোটা নির্লজ্জ কেমন করে হয়ে গেলাম আমি ?
কিভাবে ? আয়নার দিকে তাকাতেই পারছিলাম না ! কেমন একটা লজ্জা লজ্জা লাগছিল !
বাধ রুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এলাম । আবীর চোখে কাজল খুব পছন্দ করে ! কে জানে কাজল টা শেষ হয়ে গিয়েছে কি না !
..........
পৃথিবীর সব গল্প কেবল সুন্দর মেয়ে গুলোকে নিয়ে । কালো মেয়ে গুলো কে নিয়ে কোন গল্প লেখা হয় না ! সুন্দরীরা কাঁদলেই মানুষ খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তাদের ভালবাসার অনেক মূল্য, তাদের হাসি, তাদের কথা পুরুষয়ের জীবনের এক অমূল্য সম্পদ হিসাবে বিবেচিত হয় ! কিন্তু কালো মেয়ে গুলোর কান্না নিয়ে কেউ ব্যস্ত হয় না । তাদের অভিমান ভরা চোখের মূল্য কারো কাছে নেই, কেউ সে অভিমান ভাঙ্গাতে তাদের সামনে হাজির হয় না !
গল্প বানানো ! বিশ্বাস করার কোন মানে নেই !
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন