গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে নির্যাতনকে সম্পূর্নভাবে নিষিদ্ধ করা সত্বেও আইনশৃখলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক নির্যাতন এখন নিত্যদিনের ব্যপার হয়ে দাড়িয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধান ছাড়াও সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ধারা ৫ এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির ধারা ৭ সকল প্রকার নির্যাতনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে । এছাড়া নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চুক্তি-১৯৮৪ তে নির্যাতনকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। উল্লিখিত চুক্তিগুলোর সদস্য রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ চুক্তিগুলো মানতে বাধ্য অর্থাৎ নির্যাতন দমনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য।
কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এখনো নির্যাতন বন্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বরং নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চুক্তি-১৯৮৪ এর যে ধারাটি নির্যাতন প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর অর্থাৎ এর ১৪ নং ধারাকে অনুমোদন না করে নির্যাতনের বিরুদ্ধে কনভেনশনকে সম্পূর্নরূপে অকার্যকর করে রেখেছে। সর্বোপরি, বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত নির্যাতনকে প্রচলিত আইনে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে কোন আইন প্রণয়ন করেনি। ফলে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির প্রচলিত আইনে বিচার পাওয়ার পথ রুদ্ধ রয়েছে অর্থাৎ বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত আইনে নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে তেমন কোন প্রতিকার পাওয়া সম্ভবপর নয়।
বাংলাদেশে নির্যাতনের মূল হাতিয়ারগুলো দেশে প্রচলিত আইনগুলোর মধ্যেই বিদ্যমান রয়েছে। বিশেষ করে ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪, ১৬১ ও ১৬৭ নং ধারার অপব্যবহার করে আইন শৃখলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন সময় নির্যাতন করে থাকে।
ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬১ নং ধারায় কোন অভিযোগের তদন্তকালীন সময়ে সাক্ষীরর সাক্ষ্য গ্রহণ ও তা লিপিবদ্ধকরণ সংক্রান্ত বিধি বিধানসূমহ বর্ণিত হযেছে। উক্ত ধারা অনুযায়ী কোন সাক্ষী কর্তৃক সাক্ষ্য প্রদানের পর তা লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে উক্ত সাক্ষর করার প্রযোজন হয় না। ফলে, তদন্ত কর্মকর্তা ইচ্ছামত সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করার সুযোগ পায় এবং তার অপব্যবহার করে।
অনেক সময় সাক্ষীর নিকট উপস্থিত না হয়ে বা তাদের জবানবন্দী গ্রহণ না করে তদন্ত কর্মকর্তা মনমত তথ্য লিপিবদ্ধ করে তদন্ত সম্পন্ন করে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তদন্ত কর্মকর্তার সংগে ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকার কারণে অথবা অবৈধ অর্থ আদায়ের জন্য অথবা অবৈধ অর্থ গ্রহনের মাধ্যমে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বা আত্ত্বীয়তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সাক্ষীর জবানবন্দীতে বিভিন্ন নিরপরাধ ব্যক্তির নাম অপরাধী হিসেবে বা অপরাধের সহযোগী হিসেবে লিপিবদ্ধ করে এবং পরবর্তীকালে সেই নিরপরাধ ব্যক্তিকে পূর্ববর্তী সাক্ষীর প্রদত্ত সাক্ষ্যের সূত্র ধরে গ্রেফতার করে, নির্যাতন করে, অবৈধ অর্থ আদায় করে বা মনের ক্ষোভ মেটায়। এতে অনেকেই মৃত্যুবরণ করে। আবার অনেকে চিরকালের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়।
যদি ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬১ ধারা সংশোধন করে সাক্ষ্য গ্রহনপূর্বক লিপিবদ্ধ করে তা সাক্ষীকে পড়ে শোনানোর পর নিজ হাতে স্বাক্ষর করার বিধান করা হত, তাহলে এভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে নিরপরাধ ব্যক্তিকে মিথ্যা অভিযোগে জড়িয়ে হয়রানি তথা নির্যাতন করার পথ অনেকাংশে রুদ্ধ হত।
তাছাড়া, ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে পুলিশ নিয়মিত নির্যাতন তথা মানবাধিকার লংঘন করে চলেছে। উক্ত বিধি পুলিশকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারের ব্যপক ক্ষমতা প্রদান করেছে । এমনকি উক্ত বিধি বলে শুধুমাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে পুলিশ যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারে।
তবে সন্দেহ অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত হতে হবে। সন্দেহের দৃঢ় ভিত্তি থাকতে হবে। খামখেয়ালীভাবে সন্দেহ করলে চলবে না। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন উক্ত ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিরপরাধ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে নির্মম নির্যাতন করে চলেছে। যদিও উক্ত বিধিতে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে নয়টি সুস্পষ্ট শর্তের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু পুলিশ সে সব শর্তকে থোরায় কেয়ার করে এবং তাদের ইচ্ছামত গ্রেফতার করে অবৈধ অর্থ আদায়সহ নির্যাতন করে থাকে ।
এমনিভাবে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় অপব্যবহার করে পুলিশ নিয়মিত নির্যাতনের মাধ্যমে মানবাধিকার লংঘন করে চলেছে। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় পুলিশকে তদন্তের স্বার্থে অভিযুক্ত আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদ করার ক্ষমতা প্রদান করেছে।
এক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে, কোন আসামী গ্রেফতারের ২৪ ঘন্টার মধ্যে যদি তদন্তকার্য সম্পন্ন করা না যায় এবং তার কাছে থেকে আরো তথ্য পাওয়া যাবে বলে সংশিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার নিকট যদি যুক্তিসংগতভাবে মনে হয়, তবে তিনি বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি সাপেক্ষে রিমান্ডে নিতে পারবে। তবে রিমান্ডের নামে কখনো নির্যাতন করতে পারবে না।
মেধাবী কলেজ ছাত্র রুবেল হত্যা মামলা সংক্রান্ত বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (বাস্ট) কর্তৃক দায়েরকৃত এবং ব্লাস্ট মামলা বলে অধিক পরিচিত রিট পিটিশন নং-৩৮০৬/১৯৯৮ এ গত ০৭ এপ্রিল ২০০৩ ইং তারিখে বিচারপতি মোঃ হামিদুল হক এবং বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ সন্দেহজনকভাবে গ্রেফতার সংক্রান্ত ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারা এবং পুলিশ রিম্যান্ড সংক্রান্ত ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭ ধারা সংশোধন করার জন্য একটি যুগান্তকারী রায় প্রদান করেছেন এবং সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের জন্য সরকারকে নির্দেশ প্রদান করেছেন ।
একই সংগে নতুন আইন প্রণয়ন না করা পর্যন্ত এ দু’টি ক্ষেত্রে সরকারকে কিছু সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা মেনে চলার জন্যও হাইকোর্ট অভিমত দিয়েছেন । আদালতের দেওয়া নির্দেশনায় প্রধানত দু’টি সুপারিশ করা হয়েছে । এতে প্রথমতঃ ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারায় নতুন উপধারা (২) সংযোজন এবং ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭ ধারার (৩), (৪) ও (৫) উপধারাগুলো সংশোধন করার কথা বলা হয়েছে । একই সাথে দন্ড বিধির ২২০ ও ৩৪৮ ধারা দু’টি সংশোধন করে ধারা দু’টির আওতায় প্রদত্ত শাস্তির পরিমান বাড়াতে বলা হয়েছে।
ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারা সম্পর্কে যেসব নির্দেশনা দিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে-এ ধারায় কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে হলে তাৎক্ষণিকভাবে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করে বিষয়টি তার নিকট আত্ত্বীয়কে জানাতে হবে।
আর রাস্তা থেকে গ্রেফতার করা হলে সংগে সংগে টেলিফোনের মাধ্যমে তার নিকট আত্ত্বীয়কে জানাতে হবে । উভয় ক্ষেত্রে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে কী কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে তা তিন ঘন্টার মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে । বিশেষ ক্ষেত্রে গ্রেফতারের পর পরই মেডিকেল চেক-আপ করতে হবে। গ্রেফতারকৃতের গায়ে কোন আঘাতের চিহ্ন থাকলে সংশিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা বিষয়টি যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করবেন এবং যথাযথ কোন কারণ না থাকলে ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতারের পর আটকাদেশ দেওয়া যাবে না বলেও আদালত সুপারিশ করেন।
ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় প্রদত্ত রিমান্ড সম্পর্কে আদালত বলেছেন, পুলিশের কাছে কোন অভিযুক্তকেই রিমান্ড দেওয়া যাবে না । তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে জেলখানার আলাদা কক্ষে শুধু তদন্তকারী কর্মকর্তা তা করতে পারবেন ।
আদালত তার অভিমতে আরো বলেছেন যে, কোন ক্ষেত্রে রিমান্ড দিতে হলে সংশিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে নিশ্চিত হতে হবে যে, সে ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরন করা হয়েছে । এ ক্ষেত্রে সংশিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে গ্রেফতারকৃত ও তার আইনজীবীর বক্তব্য শুনতে হবে ।
সর্বোপরি রিমান্ডের আদেশ নিশ্চিত করবেন মহানগর দায়রা জজ বা দায়রা জজ । সেখানেও গ্রেফতারকৃতের বিরোধিতা বা আপত্তি করার সুযোগ থাকবে । এ ক্ষেত্রে রিমান্ড দিতে হলে সাথে সাথে মেডিকেল চেক আপ করতে হবে এবং রিমান্ড শেষে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি নির্যাতনের অভিযোগ করলে আবারও মেডিকেল চেক-আপ করতে হবে । নির্যাতনের বিষয়ে ডাক্তার নিশ্চিত হলে ম্যাজিস্ট্রেট কোনো নিয়মতান্ত্রিক আবেদন ছাড়াই সংগে সংগে তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিবেন ।
আদালত আরো উলেখ করেন যে, কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে জেলখানায় গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে একটি কাঁচ ঘরে তার নিয়োজিত আইনজীবী বা আত্ত্বীয় স্বজনদের উপস্থিতিতে তা করতে হবে । যাতে তদন্তের স্বার্থে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির আত্ত্বীয় স্বজন বা আইনজীবী কোনো প্রশ্ন-উত্তর শুনতে পারবেন না তবে কোন নির্যাতন করা হচ্ছে কি না সে ব্যাপারে লক্ষ্য রাখতে পারবেন ।
নির্যাতিত ব্যক্তির পক্ষে দেশে বর্তমানে প্রচলিত আইন, আদালত ও বিচার প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে ন্যায় বিচার পাওয়া অনেকাংশে অসম্ভব ব্যপার । নির্যাতনের বিরুদ্ধে ন্যায় বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দেশে বিদ্যমান আইন, নির্যাতনের বিষয়াদি তদন্তের জন্য স্বতন্ত্র তদন্ত বিভাগের অনুপস্থিতি, বিচারক ও আইনজীবীদের জ্ঞানের স্বল্পতা, দীর্ঘ মেয়াদী বিচার প্রক্রিয়া, ভিক্টিম, আইনজীবী ও প্রতিবেশীদের অজ্ঞতা, দারিদ্র ও অসচেতনতা এবং নির্যাতনকারীদের প্রভাব ইত্যাদি কারণসমূহ মূল প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে ।
ন্যায় বিচার প্রাপ্তির লক্ষ্যে অবশ্যই এসমস্ত প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার জন্য সরকারের এখনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত । যেসব আইনসমূহ নির্যাতন করার অজুহাত হিসাবে ব্যবহৃত হয যেমন ফৌজদরী কার্যবিধির ৫৪, ১৬১, ১৬৭, ১৯৭ ধারা সংশোধন করে নতুন আইন প্রনয়ন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনভেনশন যেগুলোর ম্যাধ্যমে নির্যাতনের প্রতিকার পাওয়া সম্ভব সেসবসহ নির্যাতনের বিরুদ্ধে কনভেনশনের ১৪ ধারা অনুমোদনসহ নির্যাতনকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আইন প্রণয়ন করে তা যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজ ও রাস্ট্র থেকে নির্যাতনকে চিরতরে মুছে ফেলার আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন ।
লেখক: মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী; জাস্টিসমেকার্স ফেলো, সুইজারল্যান্ড; ইমেল:
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন