বুয়েটের শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি একটি খোলা চিঠি দিয়েছেন। সেই চিঠিতে তারা আবেদন জানিয়েছেন বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ রাখতে। হাইকোর্টের রায়ের পরে তারা কোনো বিক্ষোভ করেননি, অন্য কোনো কর্মসূচি দেননি। এক ধরনের অসহায়ত্ব প্রকাশ পেয়েছে তাদের চিঠিতে। সত্যি তো, তারা তো এখন অসহায়ই। হাইকোর্ট রায় দেয়ার পরে তারা কী করতে পারেন? সে জন্যই প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই আকুল আবেদন। প্রধানমন্ত্রী কি তাদের আবেদন রাখবেন? জানি না। অনেকদিন তার সাথে কাজ করেছি আমি। অনেক সময় তাকে অনেক কিছুতে নরম হতে দেখেছি। কিন্তু, যেমন: যখন কোটা আন্দোলন করলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, মিছিলের সামনে শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনার ছবি রাখলো, জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিল, আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুর প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে তার মায়ের ছবি দেখতে পেল, স্লোগান দিল তখন কিন্তু তিনি নরম হননি।
শিক্ষার্থীরা যে ছাত্রলীগের হাতে বেদম মার খেয়েছে তা এখনো আমরা ভুলিনি।
কিন্তু সে কথা তুলতে চাচ্ছি না এখন। আমি বুয়েটের শিক্ষার্থীদের সাথে আছি। প্রফেসর আইনুন নিশাত আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু বুয়েটকে ছাত্র রাজনীতির বাইরে রাখতে চেয়েছিলেন। আর আমাদের মনে আছে যখন বুয়েট কর্তৃপক্ষ বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন তখন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন সে ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার তাদের আছে। এখন কী হলো যে হঠাৎ করে গভীর রাত্রে ছাত্রলীগকে বুয়েটে গিয়ে সমাবেশ করতে হলো? ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হাইকোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আদেশ বাতিল করে সেখানে ছাত্র রাজনীতি করার পথ অবারিত করে দিল!
ছাত্রলীগ অবশ্য একটা কারণ দেখিয়েছে। তারা বলেছে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার কারণে সেখানে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ভেতরে ভেতরে অন্ধকারের শক্তি জোরদার হচ্ছে। তাই কি? ছাত্রলীগের অন্তর্দৃষ্টি এতখানি বুয়েটের মধ্যে প্রবেশ করতে পেরেছে ? কিন্তু সেখানকার সাধারণ শিক্ষার্থীরা তো তা বলছে না । তারা বরঞ্চ বলছে, একসাথে আমরা জঙ্গিবাদকে রুখে দিতে পারি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও একইরকম কথা বলেছিলেন এবং তিনি এক ধরনের হুমকিও দিয়েছিলেন যে, সরকারকে হয়তো অ্যাকশনে যেতে হবে। এগুলো কি সেইসব অ্যাকশন? মৌলবাদ, জঙ্গিবাদকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে জাতীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এবং তাদের সরকার কিছু করেছে বলে তো আমরা দেখিনি। বরঞ্চ নারীকে যারা ঘরের আসবাবপত্র মনে করে ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখতে চায়, গণতন্ত্র বিশ্বাস করে না তাদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন। কওমি জননী খেতাব পেয়ে খুশি হয়েছেন।
এখন যদি ধরেও নেই সত্যি সত্যি সেই ধরনের শক্তি বুয়েটের ভেতরে ভেতরে কাজ করছে তবে সেগুলো বন্ধ করার ব্যবস্থা নিন। সেটা তো আপনারা পারেন। সোশ্যাল মিডিয়াকে বন্ধ করার জন্য আপনার যে অসাধারণ তৎপরতা দেখাচ্ছেন তার চাইতে এটা কি অনেক বেশি কঠিন কাজ? অথবা আপনারাও সেরকম করে মানে ছাত্রলীগ ভেতরে ভেতরে তাদের সংগঠন গড়ে তুলুক। তার বদলে এরকম করে ক্ষমতার অপব্যবহার করে, শক্তির মদমত্ততায় নিজেদের ইচ্ছা যদি চাপিয়ে দেন তাহলে গণতন্ত্রের শক্তি পরাজিত হবে। তরুণ শিক্ষার্থীদের ঘৃণা তৈরি হবে। অসহায় সেইসব শিক্ষার্থীরা শেষ পর্যন্ত জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের কোলে আশ্রয় নেবে। ব্যাপারটা ভেবে দেখার জন্য আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব।
কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন আমি কি ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দিতে বলছি? না, আমি তা বলছি না। আমি এই শিক্ষার্থীরা কী বলছে, কেন বলছে, তা গভীরভাবে তলিয়ে দেখতে অনুরোধ করছি। পাঠকের মনে থাকার কথা ৯০-এর পর থেকে এদেশে সেই অর্থে কোনো ছাত্র আন্দোলন হয়নি। যা হয়েছে বিশাল বিশাল সমাবেশ ছাত্রদের: যেমন গণজাগরণ মঞ্চ (সেটা অবশ্য শুধু ছাত্রদের আন্দোলন ছিল না, কিন্তু তাদের মুখ্য ভূমিকা ছিল), কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এগুলোর কোনোটাই রাজনৈতিকভাবে জড়িত ছিল না। রাজনৈতিক সংগঠনগুলো যখন এদের সাথে যোগ দিতে গেছে, সহমর্মিতা প্রকাশ করতে গেছে তখন তারা স্পষ্টতই বলেছে, আপনাদের আমাদের দরকার নেই। আপনারা আপনাদের জায়গায় থেকে আমাদের সমর্থন করেন।
আজকে বুয়েটের যে শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলন করছেন তারা ছাত্রদের যে সামাজিক দায়বদ্ধতা সেটা অস্বীকার করছেন না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠিতে তার উল্লেখ আছে। তারা বলছেন, চার বছর তারা নিরাপদে ছিলেন, ক্যাম্পাসে শান্তি বিরাজ করেছে। কিন্তু ভয় হয়, ছাত্ররাজনীতি শুরু হলে আবার সেটাই শুরু হবে। অতীতে যেরকম করে বুয়েটের মেধাবী ছাত্রী সাদেকুন নাহার সনি, আরিফ রায়হান এবং সর্বশেষ আবরার ফাহাদের মৃত্যু দেখেছি তার আর পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না।
এটা কি কেউ অস্বীকার করবেন যে, এই বোধ আজ সারা দেশের ছাত্র সমাজের মধ্যে বিরাজ করে? সনির ঘটনার সময় বিএনপি ক্ষমতায় ছিল আর আবরারের মৃত্যু ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিষ্ঠুর নির্মমতার ফসল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই ভয় কাটার জন্য আমরা কি কিছু করেছি? আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো ব্যাপারটা ভাববেন। ডাকসু নির্বাচনে যেরকম করে শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগ, ছাত্রদল উভয়কেই প্রত্যাখ্যান করেছে আজ বুয়েটেও কি একই চিন্তার প্রতিফলন দেখছেন না? এদেরকে ভরসা দিতে পারবেন আপনারা? তাদের আস্থা অর্জন করতে পারবেন? সেই দায় আপনাদেরই। অন্য কারো নয়।
ছাত্রলীগও গতকাল একটি সংবাদ সম্মেলন করেছে। সেখানে তারা বলেছে, বুয়েটে কোন ধরনের রাজনীতি চলবে সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। র্যাগিং, বুলিং, দখল বাণিজ্য ও হত্যা সন্ত্রাসের রাজনীতি নয়। এই ছাত্ররাজনীতি হতে হবে জ্ঞান, যুক্তি, তথ্য, তত্ত্বনির্ভর। অদ্ভুত লাগে না- যা যা বলেছে এরা এর কোনো কিছুর ধারে কাছে আছে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিরোধী দলের কোনো অস্তিত্ব নেই। হল দখল, ভর্তি বাণিজ্য, চাঁদাবাজি এরাই করে, নিজেদের মধ্যে খুনাখুনিতে এরই মধ্যে দুই একজনের জীবনও গেছে।
প্রধানমন্ত্রী, এই শিক্ষার্থীরা তথা সারা দেশের শিক্ষার্থীরা এবং ব্যাপক জনগণ এই দুঃশাসন থেকেই মুক্তি চায়। তরুণদের কোনো উপায় নেই। তাই তারা আপনার কাছেই আবেদন করেছে। ওদের কথা শুনে আমার মনে হলো, এরকম করে বলি, এরা ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে আপনার কাছে চাইছে। অথচ এটা তাদের প্রাপ্য, এটা দেওয়া আপনার দায়িত্ব।
আপনি কি কষ্ট পেলেন?
(ডাকসুর সাবেক ভিপি, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন