স্বল্প বিনিয়োগে দ্বিগুণ লাভের প্রলোভন, সেই প্রলোভনে পড়ে সর্বস্ব হারানোর ঘটনা দীর্ঘ দিনের। বিশেষ করে মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং কোম্পানি (এমএলএম) কিংবা এনজিও’র নামে বহু প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। একেকটি ঘটনায় মানুষ প্রতারিত হওয়ার পর জানাজানি হয়, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীসহ সংশ্লিষ্টরা কিছুদিন তৎপর থাকে। এরপর আবারও নতুন নামে, নতুন পদ্ধতিতে শুরু হয় একই ধরনের প্রতারণা। এনালগ যুগে গ্লোবাল গার্ডিয়ান নেটওয়ার্ক (জিজিএন), যুবক, ডেসটিনি, টংচং, ইউনিপেটুইউ, নিউওয়ে’তে বিনিয়োগ করে নিঃস্ব হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িতরা থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে তাদের প্রতারণাও। এনালগ পরবর্তী ডিজিটাল যুগে প্রতারকচক্র এখন সক্রিয় ডিজিটাল মাধ্যমেও। তথ্য-প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে একের পর এক গড়ে উঠেছে ‘ডিজিটাল হায় হায় কোম্পানি’। আগের মতোই দ্রুততম সময়ে স্বল্প বিনিয়োগে অধিক লাভ, কিংবা নির্ধারিত মূল্যের অর্ধেক বা তারো কমমূল্যে পণ্য বিক্রির প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনোটিকে আবার সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা মন্ত্রী বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়েছেন, অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে প্রশংসা করেছেন। ফলে মানুষও বিনিয়োগ করেছে নির্দ্বিধায়। কিন্তু প্রতারিত হওয়ার পর দায় নিচ্ছে না কেউ।
অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, একের পর এক যেসব প্রতরাণা হচ্ছে তার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) আরো কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সাধারণ মানুষকে মাথায় রাখতে হবে- যারাই অতিরিক্ত লাভের কথা বলছে, তারাই প্রতারণা করতে পারে। যেখানে দেশের বড় বড় ব্যাংক পারছে না ৭-৮ শতাংশের বেশি লাভ দিতে, সেখানে তারা কীভাবে শতভাগ লাভ দেবে?’ অ্যাপের ফাঁদকে অভিনব বলে উল্লেখ করে তিনি তরুণদের আরো সাবধান হওয়ার পরামর্শ দেন। কয়েক মাসে দ্বিগুণ, এমনকি ১০ দিনে দ্বিগুণ করার প্রসঙ্গে ড. মনসুর বলেন, বোঝাই যাচ্ছে এরা পরিষ্কার ধান্ধাবাজ।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, যেসব প্রতিষ্ঠান প্রতারণা করেছে তার প্রত্যেকটি দীর্ঘসময় ধরে বাংলাদেশে প্রকাশ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করেছে, অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা বাংলাদেশ ব্যাংক, তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোনোটিই কি তাদের বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখেনি। এর কোনো কোনোটিকে তো সরকারের মন্ত্রীরা সার্টিফাই করেছেন।
তারা মনে করেন, বাংলাদেশের মতো অত্যন্ত ঘনবসিতপূর্ণ দেশে সরকার বা কর্তৃপক্ষের অজান্তে কোনো মানুষের পক্ষে ব্যবসায়িক ‘নেটওয়ার্ক’ পরিচালনা করা অসম্ভব। যেখানে গোপন বৈঠক, সরকারবিরোধী কর্মকা-সহ নানা ইস্যু আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী মুহূর্তের মধ্যেই জেনে যায়, সেখানে এমন প্রতিষ্ঠান বছরজুড়ে পরিচালিত হচ্ছে কিন্তু কোনো ভূমিকা নেই।
সমাজবিজ্ঞানী, অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ভুক্তভোগীরা বলেন, যেসব প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো বিস্তারের শুরু থেকে দায়িত্বশীলেরা জানতেন। শুধু অবহেলা করে জনস্বার্থের দিকে নজর না দিয়ে ব্যবসা চলতে দেয়া হয়েছে। যখন মানুষ সর্বস্বান্ত হয়, তখন সরকার বলে লিখিতভাবে জানান, ব্যবস্থা নেব। এগুলো দায়সারা কথা। নিজের দায়ভার এড়ানোর কথা। ছলচাতুরী ছাড়া আর কিছু নয়। এটাকে কখনো সুশাসনের পর্যায়ে ফেলতে পারি না। শাসনব্যবস্থার করুণ চিত্র এটা। যেকোনো ডিজিটাল প্রতারণা ও অনিয়ম সবার আগে নজরে আসে পুলিশের। তাদের সঙ্গে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক যারা, তারা এটা নজরদারি করবেন। তাদের দায়িত্ব পালনে ঘাটতি আছে। মানুষের টাকার প্রতি লোভ বাংলাদেশে যেমন আছে, অন্য দেশেও আছে। অতীতেও অর্থের প্রতি মানুষের লোভ ছিল। এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এ লোভে পড়ে মানুষ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেটি দেখার দায়িত্ব সরকারের। আইনের মাধ্যমে জনগণকে সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, একটি সমাজতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে এটি তৈরি হয়। আর তা হলো সমাজের বৈষম্য; ধনী সমাজের ধনী-দরিদ্রের দূরত্বটা বেড়ে যাওয়া। আর এই দূরত্বটা অতিক্রম করতে সমাজের নিচের তলার মানুষগুলো উপরে ওঠার স্বপ্নে বিভোর থাকে। তাই যেখানে অর্থের ছোঁয়া পায় সেখানেই মানুষ ছুটে যায়। সেখানেই স্বপ্ন বুনে। মানুষ দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। এর মধ্যে তাদের স্বপ্ন ছাড়া আর আছে কী? সুতরাং মানুষ স্বপ্ন দেখবে একটু বড় হওয়ার।
তিনি বলেন, আজকে যেখানে রাষ্ট্র তাদের সকল লাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এরকম দুর্বৃত্ত ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেয়, সেখানে এই বিষয়গুলো তো ঘটতেই থাকবে। এখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে, তারা তা জানেও কিন্তু পালন করে না। যারা এগুলো করে তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে জড়িত এবং তাদের ছত্রছায়ায় তারা এগুলো করে। আর এরকমভাবেই তারা স্বপ্নের জাল বিস্তার করে এবং ঘটনাচক্রে আমি (সাধারণ মানুষ) স্বপ্ন দেখতে বাধ্য। কারণ স্বপ্ন ছাড়া আমার আছে কী! আমি দুঃসহ সংগ্রামের মধ্যে। সামান্য ডিমের ডজন যদি ১৮০ টাকা হয় তাহলে এই লোকগুলো খাবে কী? সুতরাং তাকে স্বপ্ন দেখতেই হবে একটু বড় হওয়ার জন্য।
জানা যায়, বাংলাদেশে প্রথম মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি হিসেবে গ্লোবাল গার্ডিয়ান নেটওয়ার্কের (জিজিএন) আবির্ভাব হয় ১৯৯৮ সালে। ২০০৬ সালে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটির (যুবক) অনিয়মের বিষয়টি উঠে আসে। ডেসটিনিতেও টাকা রেখে কেউ ফেরত পাননি। এ ঘটনা জেনেও ইউনিপেটুইউ নামীয় প্রতিষ্ঠানের একই ধরনের জালে আটকা পড়েন অনেকে। ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে ইউনিপেটুইউ ১০ মাসে দ্বিগুণ লাভের লোভ দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়া শুরু করে। কয়েকজন আমানতকারী জানিয়েছেন, ইউনিপেটুইউতে বিনিয়োগকারীরা ছয় হাজার কোটি টাকা জমা রেখেছিলেন। কেউ টাকা ফেরত পাননি। এরপর পর্যায়ক্রমে টংচং, নিউওয়ের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে প্রতারক চক্র। সময়ের পরিক্রমায় দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সর্বত্রই লেগেছে প্রযুক্তির ছোয়া। প্রতারকরাও এখন বেছে নিয়েছে এই প্রযুক্তিকে। ডিজিটাল বাংলাদেশে তারা গড়ে তুলেছেন ডিজিটাল হায় হায় কোম্পানি। ২০১৮ সালে যুবক-ডেসটিনি-ইউনিপেটুইউ’র মডেলেই নতুন রূপে এসেছে ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, আলিশা মার্ট, কিউকমসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। বিপুল ছাড়ে মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রির কথা বলে ই-কমার্স ব্যবসায় নামে ইভ্যালি। এরপর ই-অরেঞ্জ, আলেশা মার্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একই কায়দায় মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়া শুরু করে। ইভ্যালি সরকারি প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক হয়েছিল। সরকারের দায়িত্বশীলেরা এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রশংসা করেছিলেন। যেমন ২০২১ সালের ৮ নভেম্বর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ই-ক্যাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে পদক পায় ইভ্যালি। অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ-প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তখন তিনি বলেছিলেন, ইভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠান একসময় বাংলাদেশের আলিবাবা, আমাজন হবে। কিন্তু পরে দেখা যায়, এসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান মানুষের টাকা আত্মসাৎ করেছে, অর্থ পাচার করেছে। এখন ইভ্যালির কাছে ১ হাজার কোটি টাকা, ই-অরেঞ্জের কাছে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা এবং ধামাকার কাছে ৮০৮ কোটি টাকা পাওনা গ্রাহকের। আরও কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা আটকে আছে মানুষের।
আর সর্বশেষটি মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ (এমটিএফই)। শরীয়াহ-সম্মত প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে এতে বিনিয়োগ করে ক্রিপ্টোকারেন্সি, বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন ও বিভিন্ন পণ্য কিনে লাভবান হওয়ার প্রলোভন দেখানো হয় সাধারণ মানুষদের। প্রতিষ্ঠানটি এক বছর ধরে বাংলাদেশে কার্যক্রম চালিয়েছে, মানুষের মাঝে প্রচারণা চালিয়েছে, অফিস নিয়েছে, অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এর কোনটিই জানতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা-বিটিআরসি। এমটিএফই গ্রুপ ইনকরপোরেটেড বাংলাদেশে রীতিমতো প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। ব্যবহার করেছে বাংলাদেশের ব্যাংক ও আর্থিক লেনদেনব্যবস্থা। গত ১৭ আগস্ট অ্যাপ্লিকেশনটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ আটকে গেছে। এ কেলেঙ্কারির আর্থিক পরিমাণ এখনো সুনির্দিষ্ট করা যায়নি। মোট আর্থিক ক্ষতি ও ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যাও এখনো নির্ধারণ করা যায়নি। ঘটনার পর এখন সরকারি সংস্থাগুলোর কেউই দায় নিতে রাজি নয়। মাল্টি-লেভেল মার্কেটিংয়ের (এমএলএম) জন্য বাংলাদেশে আইন আছে। তবে অনুমোদিত কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। তারপরও এমটিএফই এ ধরনের ব্যবসা করে কীভাবে অর্থ হাতিয়ে নিল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, তারা এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বিষয়টি দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি)।
অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মানুষের সামনে যাতে লোভের ফাঁদ কেউ পাততে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতেই সংস্থা তৈরি করা হয়। এমটিএফইর ‘প্রতারণার’ ধরনটি ভিন্ন, তবে কৌশল ডেসটিনির মতোই। ডেসটিনি যেভাবে গ্রাহকের মাধ্যমে গ্রাহক সংগ্রহ করত, তেমনি এমটিএফইও ‘বিনিয়োগকারী’ সংগ্রহ করেছে। দেশে টাকা খোয়ানো ব্যক্তিরা বলছেন, এমটিএফই অনলাইন বা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় শেয়ার, ডলার, ক্রিপ্টোকারেন্সি (ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা, যেমন বিটকয়েন) কেনাবেচার কানাডা ও দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বলে দাবি করত। তারা বিনিয়োগের বিপরীতে বড় লভ্যাংশের লোভ দেখাত। কেউ আগ্রহী হলে টাকা দিতে হতো ব্যাংক অথবা মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের (এমএফএস) মাধ্যমে। বিপরীতে তারা পেতেন ভার্চুয়াল মুদ্রা। মুঠোফোনের অ্যাপে লভ্যাংশ জমা হতো। কিছুদিন সেই লভ্যাংশ তোলা গেছে। সম্প্রতি অ্যাপটিতে গ্রাহকের হিসাবগুলো বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ বুঝতে পারে, তারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশে এমটিএফইর কোনো কার্যালয় নেই, নেই কোম্পানির কোনো চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) নাম-ঠিকানা। মুঠোফোনেই সব কাজ হতো। বিনিয়োগকারী সংগ্রহ করতে এমটিএফই কান্ট্রি অপারেশন সার্ভিস (সিওও) পদমর্যাদায় প্রতিনিধি নিয়োগ করত। দেশের বিভিন্ন জেলায় এ রকম শত শত সিওও বানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। কত মানুষের টাকা খোয়া গেছে, তার হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন জেলায় হাজার হাজার মানুষ কোটি কোটি টাকা হারানোর দাবি করছেন। দীর্ঘ সময় ধরে এ কার্যক্রম চললেও সরকারের কোনো দপ্তরের কাছে তা ধরা পড়েনি। এমটিএফই নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, তারা এমটিএফইর প্রতারণার বিষয়টি পত্রিকায় দেখেছেন। বৈধ চ্যানেল ব্যবহার করে অবৈধ ব্যবসা হয়েছে। কেউ তার টাকা কোথায় ব্যবহার করবেন, তা তারই অধিকার। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারে না।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও প্রতারিত গ্রাহকের হিসাব অনুযায়ী, এমএলএম প্রতিষ্ঠান ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে মানুষের প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা আটকা। এসব প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় এক কোটি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, এমটিএফই নিয়ে তারা কিছু বলতে পারবে না। তবে ডেসটিনি ও যুবকের গ্রাহকের অর্থ ফেরত দেয়ার একটা চেষ্টা আছে। ইভ্যালি বা আরও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের যেসব গ্রাহক ২০২১ সালের ৩০ জুনের আগে টাকা দিয়ে প্রতারিত হয়েছেন, তাদের ব্যাপারে কিছু করার বাস্তবতা কম। কিছু মানুষের লোভের ফাঁদে পড়া দেখে করুণা হয়। কষ্টার্জিত অর্থ তারা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বিনিয়োগ না করলেই পারেন।
বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, এমটিএফই কেলেঙ্কারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারের বাইরে। কারণ এখানে ই-কমার্সের মতো কেনাবেচা হয় না। এখানে বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থ আয়ের ঘটনা বেশি ঘটেছে। আমরা এ ধরনের বিষয় নজরদারি করি না।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বলেন, এমটিএফইর বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আওতায়। বিষয়টি আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে সম্পর্কিত।
প্রতিষ্ঠানটির উপ-পরিচালক মো. জাকির হোসেন খান বলেন, আমরা প্রযুক্তির বিষয়গুলো দেখি। আর্থিক কোন বিষয় বিটিআরসির আওতাভুক্ত নয়। তবে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী, বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা অন্য কোন সংস্থা যদি আমাদের প্রযুক্তিগত সহায়তা চায় সেটি আমরা করতে পারি। এক্ষেত্রে কোন ওয়েবসাইট বন্ধ করা, ব্যান্ডউইথ ধীরগতি করে দেয়া এগুলো আমরা করে থাকি।
তিনি বলেন, ফিন্যান্সিয়াল ইস্যু বাংলাদেশ ব্যাংক দেখার কথা। তাদের জানা উচিত কিভাবে কার্যক্রম পরিচালিত হতো, টাকা কিভাবে গেল? অনুমোদন ছিল কিনা? এতোদিন ধরে চললো আমরা কিছুই জানিনা, কেউ জানায়নি।
এসব ঘটনার জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণহীনতাকেই দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে ডলার নিয়ে যায়, দেশিয় লোকজনের কাছ থেকে নিয়ে যায়। তার নিয়ন্ত্রণ কোথায়? আমি বিস্মিত হয়েছি গভর্নর জানিয়েছেন তাদের যে অ্যাকাউন্ট আছে সেখান থেকে তারা নিয়ে যেতে পারে!
তিনি বলেন, যদি ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করা হয়, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এমটিএফই কেলেঙ্কারির দায় নিতে হবে। এছাড়া, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের অপরাধ পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার। তারা যদি বিটিআরসিকে জানায়, তবে বিটিআরসি কোনো প্ল্যাটফর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। কেউ জানায়নি। কোনো গ্রাহক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এমনকি, বাংলাদেশ ব্যাংক এ সম্পর্কে কিছু জানায়নি।’
এছাড়া তিনি প্রতারণার জন্য মানুষের সচেতনতার অভাবকেও মনে করেন। মন্ত্রী বলেন, মানুষ প্রতারিত হচ্ছে, এর প্রধানতম দূর্বলতা হচ্ছে- মানুষের মধ্যে সচেতনতা কাজ করেনি। আরেকটি অতিলোভ, বা রাতারাতি অর্থবিত্ত পাওয়ার যে প্রবণতা সেগুলো কাজ করেছে। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। আইন অনুযায়ী অর্থপাচারের বিষয়টি দেখার এখতিয়ার বাংলাদেশ ফাইন্যান্স ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউর)।
ভুক্তভোগী ও বিশ্লেষকরা বলছেন, এমটিএফইর মতো অন্তত এক হাজার প্রতিষ্ঠান সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। অথচ সরকার বিষয়টাকে হালকাভাবে নিয়েছে। প্রথমে যুবক, ডেসটিনির মতো এমএলএম; পরে ইভ্যালির মতো ই-কমার্স এবং এখন এমটিএফইর মতো ক্রিপটোকারেন্সির (ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা) মাধ্যমে কম পরিশ্রমে বেশে অর্থ উপার্জনের মোহে পড়েছেন যুবকেরা। কেন এমন হচ্ছে, এ ব্যাপারে গবেষণা হওয়া দরকার। আপাতত সরকারের পক্ষে এসব বিনিয়োগ রোধে ব্যাপক প্রচারণা চালানার বিকল্প নেই; কিন্তু সরকার তা করছে না। প্রতারণার যে ঘটনাগুলোর ঘটছে, তা কেউ লুকিয়ে করছে না। ঘটা করে প্রচারের মাধ্যমে প্রতারকেরা সংগঠিত হয়, গ্রাহক জোগাড় করে। সেই প্রচারের কথা সবার কানে পৌঁছায়, শুধু কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছায় না।
আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, অনলাইনে এমএলএম ব্যবসার বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহনে সারাদেশেই পুলিশ সক্রিয় রয়েছে। এ ধরনের অবৈধ ব্যবসায় জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করা হচ্ছে। বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অধিকাংশ অপরাধের ক্ষেত্রেই পুলিশ তথ্য পেয়ে দ্রুত আইনগত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করে। আবার কিছু ক্ষেত্রে তথ্য পেতে কিছুটা সময় লেগে যায়, তবে প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রেই পুলিশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন