মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে গবেষণার পরামর্শ বাস্তবায়ন হয়নি চার বছরেও ।। ঊর্ধ্বতনদের দুর্ব্যবহার, ছুটি না পাওয়ার অভিযোগ মাঠ পুলিশের ।। রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি ও পোস্টিংয়ের অভিযোগ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের
গত শনিবার রাতে গুলশানে পুলিশের এক সদস্যের গুলিতে আরেক সদস্য নিহত হয়েছেন। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য মানসিকভাবে সুস্থ নন বলে দাবি করছে তার পরিবার। শনিবার রাতের ছবি
পুলিশের নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই। উৎসব-পার্বনের ছুটিতে মানুষ যখন পরিবার নিয়ে সময় কাটায়, অধিকাংশ পুলিশকে তখন থাকতে হয় ডিউটিতে। অধিক কর্মঘণ্টার পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে পুলিশের একটি অংশে রয়েছে বঞ্চনার অভিযোগ। এ ছাড়া ঊর্ধ্বতনদের দুর্ব্যবহার, রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি ও পোস্টিংয়ের অভিযোগ পুলিশে দীর্ঘদিনের। ২০২০ সালে ‘রূপকল্প-২০২১ ও ২০৪১’ বাস্তবায়ন ও ‘জনগণের পুলিশ’ গঠনে পুলিশে পদোন্নতি, বদলি, ছুটি, আচরণ, দুর্নীতিসহ সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান বিষয়ে গবেষণা করা হয়। সেই গবেষণার সুপারিশমালার আলোকে অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছিল পুলিশ সদরদপ্তর।
তবে গত চার বছরে সেসব সুপারিশের অধিকাংশই বাস্তবায়ন করা হয়নি। বরং মানসিক চাপে পুলিশের আত্মহত্যা থেকে নিজ সহকর্মীকে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশে সোয়া দুই লাখ সদস্যের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। গত শনিবার রাতে রাজধানীর গুলশানে কনস্টেবল কাওছার আলী খুব কাছ থেকে গুলি করে সহকর্মী মনিরুল হককে হত্যা করেন। কাওছারের পরিবার জানায়, মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। পাবনার মানসিক হাসপাতালে একাধিকবার চিকিৎসাও নিয়েছেন।
২০২০ সালে পুলিশের গবেষণায় উঠে এসেছিল মাঠপর্যায়ে পুলিশের কর্মঘণ্টা নির্ধারণের বিষয়টি। পুলিশের কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করে ডিউটি প্ল্যান ও ডিউটি ক্যালেন্ডার তৈরি করা, প্রতিটি পুলিশ সদস্যের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে ছুটি, বিনোদন ও খেলাধুলার সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া এবং ১২ ঘণ্টা টানা ডিউটির বদলে তিনটি শিফট করে ৮ ঘণ্টা করে ডিউটির ব্যবস্থা করার বিষয়ে বলা হয়েছিল গবেষণায়। এ ছাড়া রোটেশনভিত্তিক সাপ্তাহিক ছুটি নিশ্চিত করা এবং নিয়মিত পিটি-প্যারেডের পাশাপাশি মানসিক ব্যায়ামের বিষয়টিও গবেষণায় উঠে আসে।
জানা গেছে, এসব পরামর্শের অধিকাংশই বাস্তবায়ন করা হয়নি গত চার বছরে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তুলনামূলকভাবে ফোর্সের সংখ্যা কম হওয়ায় এসব গবেষণার ফল বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পুলিশের কালচারও এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ।
দুটি জেলার পুলিশ সুপারসহ ১০ জন বিভিন্ন স্তরের পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, থানাপুলিশকে টানা ১২ ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়। একজন পুলিশ সদস্য রাত ৮টা থেকে ডিউটি শুরু করলে সকাল ৮টায় তার ডিউটি শেষ হয়। এরপর তিনি ঘুমাতে যান। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিকালে তাকে দাপ্তরিক কাজের জন্য থানায় দায়িত্ব দেওয়া হয়। আবার কোনো জরুরি ঘটনা ঘটলে টানা ২৪ ঘণ্টা থেকে ৩৬ ঘণ্টা পর্যন্তও ডিউটি করতে হয়। পুলিশের সদস্য সংখ্যা কম হওয়ায় একটানা ডিউটি দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। ঠিকঠাক ঘুম না হওয়া এবং পরিবারকে সময় দিতে না পারায় মানসিক চাপ বাড়তে থাকে।
জেলার একজন এসপি আমাদের সময়কে বলেন, তার জেলায় পুলিশের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। এখানে প্রায় এক হাজার মানুষের নিরাপত্তার জন্য একজন করে পুলিশ সদস্য কাজ করেন। পাশের দেশগুলোতেও ৩০০/৪০০ জনের নিরাপত্তায় একজন পুলিশ সদস্য রয়েছে। তার জেলায় ৩ থেকে ৪ হাজার পুলিশ সদস্য থাকলে তিনি কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করে দিতে পারতেন, নিয়মিত ছুটিও দিতে পারতেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবার থেকে দূরে থাকা, অতিরিক্ত ডিউটি ও ছুটি না পাওয়ায় হতাশায় ভুগছে পুলিশের একাংশ। পুলিশের কনস্টেবল থেকে পরিদর্শক পর্যন্ত এ ধরনের সমস্যা বেশি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হওয়ায় এসব হতাশা প্রকাশের সুযোগও কম। পদোন্নতি ও পোস্টিংয়ে ক্ষমতা ও রাজনৈতিক বিবেচনা পুলিশের ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য হতাশার অন্যতম কারণ। ব্যাচমেটরা ডিআইজি থেকে অতিরিক্ত আইজিপি পর্যন্ত হয়ে গেলেও এখনো পুলিশ সুপারের পর আর পদোন্নতি হয়নি এমন কর্মকর্তাও রয়েছেন।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক আমাদের সময়কে বলেন, পুলিশ সদস্যরা ছুটি ভোগ করতে পারেন কম। নিচের পদের সদস্যরা পেশাগত দক্ষতা দেখাতে না পারলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অনেক সময় দুর্ব্যবহার করেন। অপমান-অপদস্থ করেন, যা তাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি করে। অতিরিক্ত কাজের কারণে পুলিশের মধ্যে মানসিক অবসাদ দেখা দিচ্ছে।
তিনি বলেন, একজন পুলিশ সদস্য যদি আরেকজন সদস্যের জন্য নিরাপদ না হন, তা হলে সাধারণ মানুষের কাছে কতটা নিরাপদ হবেন- সে প্রশ্নও দেখা দেবে। মাঠপর্যায়ে পুলিশের মোটা দাগে কিছু সংস্কার প্রয়োজন। একটা ফোর্স হিসেবে যারা কাজ করেন, তাদের জন্য চাপ মোকাবিলা করার কৌশলগুলো প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নেওয়া উচিত।
চাকরিতে পুলিশ কনস্টেবলের সমস্যা নিয়ে ২০২০ সালের জুলাইয়ে সদর দপ্তরের এক জরিপে দেখা গেছে, ২৩.৮ শতাংশ পুলিশ কনস্টেবল সময়মতো ছুটি না পাওয়াকে তাদের চাকরিতে বড় সমস্যা মনে করেন। উপপরিদর্শকদের (এসআই) ক্ষেত্রে এই হার ২১.২২ শতাংশ। ১২.৮২ শতাংশ পুলিশ কনস্টেবল বলেন, তারা পরিবারকে সময় দিতে পারছেন না। থানায় রাজনৈতিক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের খারাপ ব্যবহারকে সমস্যা বলেছেন ৫.১৩ শতাংশ। শতভাগ পুলিশ সদস্য মনে করেন, তাদের ডিউটি প্রতি শিফটে আট ঘণ্টা হওয়া উচিত।
পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুরুর দিকে কনস্টেবলরা ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বেতন পান। এই টাকা দিয়ে সৎ জীবনযাপন করে স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে রাখা সম্ভব হয় না। অধিকাংশ কনস্টেবলের স্ত্রী-সন্তানরা বাড়িতে থাকেন।
পুলিশের কর্মকর্তারা বলেন, থানার দরজা কখনো বন্ধ হয় না। তাদের লম্বা সময় ডিউটি করতে হয়। অধিকাংশ পুলিশই বাড়ি থেকে অনেক দূরে চাকরি করেন। কয়েক মাস পরপর হয়তো ৩/৪ দিন ছুটি পান। অতিরিক্ত ডিউটির জন্য তারা কোনো অর্থ পান না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন